কানাডায় এশিয়ানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি ৩০১ শতাংশ

ভেঙ্গেছে আগের সকল রেকর্ড

খুরশিদ আলম ॥ কানাডায় বসবাসকারী পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধ বা হেট ক্রাইমের (hate crime) মাত্রা বৃদ্ধি আগের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। গত ১৭ মার্চ,২০২২ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডা’র নতুন এক রিপোর্টে এ তথ্য প্রকাশিত হয়। স্ট্যাটিসটিকস কানাডা জানায়, কভিড-১৯ মহামারীর প্রথম বছরে (২০২০) পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় কানাডিয়ানাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধের মাত্রা তার আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০১%। এটি পুলিশের খাতায় নিবন্ধিত হিসাব। ২০২০ সালে পুলিশের কাছে মোট ২৬৬৯টি বিদ্বেষমূলক অপরাধের অভিযোগ করা হয়। হিসাবে দেখা যায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে কানাডায় সার্বিকভাবে বিদ্বেষমূলক অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৮%। আর এশিয়ানদের বিরুদ্ধে বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০১%।

স্যাটিসটিসক কানাডা এই হিসাব রাখতে শুরু করে ২০০৯ সাল থেকে। তখন থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত হিসাব তুলনা করে দেখা গেছে ২০২০ সালে বিদ্বেষমূলক অপরাধের মাত্রা সবচেয়ে বেশী ছিল পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়দের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।

স্ট্যাটিসটিকস কানাডা’র গবেষণা রিপোর্টে আরো বলা হয় :

* ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধের মাত্রা গত তিন বছরে ক্রমান্বয়ে কমেছে। ২০১৯ সালে এই ধরণের ঘটনা ঘটেছিল ৬১৩ টি। ২০২০ সালে এই সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৫১৫ টিতে। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধের সংখ্যা বা মাত্রা কমে আসার কারণ, এই সময়ের মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা আক্রান্ত হয়েছেন কম। ২০১৯ সালে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ১৮২ টি বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা ঘটেছিল। ২০২০ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৮২ টিতে। হ্রাসের হার -৫৫%। তবে ইহুদী ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধের সংখ্যা সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩০৬ টি। ২০২০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩২১ টিতে। বৃদ্ধির হার +৫%।

* ২০২০ সালে বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা সবচেয়ে বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে অন্টারিও প্রভিন্সে (+৩১৬ টি)। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ব্রিটিশ কলম্বিয়া (+১৯৮ টি), কুইবেক (+৮৬ টি) এবং আলবার্টা (+৮৪ টি)। মূলত বেশীর ভাগ প্রভিন্স ও টেরিটরিতেই ২০২০ সালে বিদ্বেষমূলক অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর বিদ্বেষমূলক অপরাধের সংখ্যা যে সকল প্রভিন্স ও টেরিটরিতে কমেছে তার মধ্যে আছে নিউ ব্রান্সউইক (-১১ টি), নর্থওয়েস্ট টেরিটরিস (-২ টি), প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড (-১ টি)। মেনিটোভা প্রভিন্সে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। অন্যদিকে জনসংখ্যার বিচারে (প্রতি এক লাখে) যে সকল প্রভিন্সে বিদ্বেষমূলক অপরাধের মাত্রা সবচেয়ে বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে তার মধ্যে প্রথম স্থানে আছে নোভা স্কোশিয়া (+৭০%)। এর পরের অবস্থানে আছে ব্রিটিশ কলম্বিয়া (+৬০%), সাস্কাচুয়ান (+৬০%), আলবার্টা (+৩৯%) এবং অন্টারিও (+৩৫%)।

* স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাবে আরো দেখা গেছে ২০১৯-২০২০ সালে বিদ্বেষমূলক অপরাধের সংখ্যা বেশী ছিল কানাডার বিভিন্ন বড় শহরগুলোতে । এর মধ্যে অন্যতম হলো ভেঙ্গুভার, টরন্টো, মন্ট্রিয়ল, অটোয়া এবং ক্যালগারী। আর শতকরা হিসাবে দেখা গেছে সবচেয়ে বেশী বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা ঘটেছে কিচেনার-ক্যামব্রিজ-ওয়াটারলুতে (+২৫৩%), পিটারব্যুরোতে (+১২৬), গুলেল্ফে (+৮০) এবং ক্যালগারীতে (+৭৫%)। তবে কয়েকটি শহরে ঘৃণাজনিত আপরাধের মাত্রা কমেছে যার মধ্যে আছে হ্যামিলটন (-৩৬%), উইনিপেগ (-৩২%) এবং উইন্ডসর (-৮%)।

* ২০২০ সালে অহিংস বিদ্বেষমূলক অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে (+৪০%) এবং সহিংস বিদ্বেষমূলক অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে (+৩২%)।

* সহিংস বিদ্বেষমূলক অপরাধের সংখ্যা ২০১৯ সালে ছিল ৮৬৫ টি এবং ২০২০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১১৪৩ টিতে।

কানাডায় বসবাসকারী পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধ বা হেট ক্রাইমের মাত্রা বৃদ্ধি আগের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।। ছবি: গ্রাহাম হিউজ/দি কানাডিয়ান প্রেস

কানাডায় বিদ্বেষমূলক অপরাধ কি?

কানাডায় পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা কোন ঘটনাকে তখনই বিদ্বেষমূলক অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয় যখন, কেউ কারো জাতি, জাতীয় বা জাতিগত উৎস, ভাষা, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, বয়স, মানসিক বা শারীরিক অক্ষমতা, যৌন অভিমুখীতা বা লিঙ্গ পরিচয় বা অভিব্যক্তি ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে তাঁর প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ করে। এছাড়াও কানাডার ‘ক্রিমিনাল কোড’ এ আরো কিছু বিষয়কে বিদ্বেষমূলক অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয় যার মধ্যে আছে, গণহত্যার প্ররোচনা বা উস্কানী প্রদান করা বা জনসমক্ষে ঘৃণার উস্কানী প্রদান করা যার ফলে শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে। নির্দিষ্ট কোন জনগোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এ জাতীয় প্ররোচনা বা উস্কানিকে বিদ্বেষমূলক অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। ঘৃণার  বশবর্তী হয়ে কোন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা উপাসনালয়ের ক্ষতিসাধন করাও বিদ্বেষমূলক অপরাধের মধ্যে পড়ে।

উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনে প্রথম করোনা অর্থাৎ কভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার পর পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে তা বিশে^র বিভিন্ন দেশে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কানাডায়ও ছড়িয়ে পড়ে এই কভিড-১৯ এর ভাইরাস। শুরুতে কানাডিয়ানদের মধ্যে তেমন সতর্কতা দেখা যায়নি। তবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী সোফি গ্রেগওয়া যেদিন আক্রান্ত হন তার পরের দিনই কানাডা জুড়ে শুরু হয় আতঙ্ক। লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়েন গ্রোসারীতে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই খালি হয়ে যায় অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের শেলফ। এবং ঐ সময় থেকেই কানাডিয়ানদের অনেকের মধ্যেই চীন বিরোধী একটি মনোভাব গড়ে উঠতে থাকে। করোনার জন্য তাঁরা চীনকে দুষতে থাকেন। এমনকি কেউ কেউ চীনা বংশোদ্ভূত কাউকে রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে বা গ্রোসারীতে দেখলে আতঙ্কিত হয়ে দূরে সরে যেতে থাকেন। শুধু তাই নয়, কোন কোন স্থানে চীনা বংশোদ্ভূত লোকদের উপর হামলার ঘটনাও ঘটতে থাকে। ভ্যাঙ্গুভারে এক গ্রোসারীর মালিক একজন বৃদ্ধ চাইনিজ-কানাডিয়ানকে জোর করে গ্রোসারীর বাইরে বের করে দেন এবং ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন।

করনো ভাইরাস ঐ সময় দেখতে দেখতে গোটা ভারতেও ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। সেই সাথে এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে। এরপর ভারতীয়সহ ঐ সব দেশ থেকে আসা লোকদের প্রতিও কানাডিয়ানদের কেউ কেউ বিদ্বেষী হয়ে উঠতে আরম্ভ করেন। ফলে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধ বা হেট ক্রাইমের মাত্রা। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার গবেষণায় সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে।

উল্লেখ্য যে, কানাডায় চীন থেকে আসা লোকদের উপর বিদ্বেষী মনোভাব বা আচরণ নতুন কিছু নয়। কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী জন এ. ম্যাকডোনাল্ড তাঁর আমলে কানাডায় বসবাসরত চাইনিজদের ভাল চোখে দেখতেন না। চাইনিজদের বিরুদ্ধে তিনি বর্ণবাদী আচরণ করেছেন।

কানাডায় বিভিন্ন প্রভিন্সের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা যখন ভাল ছিলনা তখন রেলপথ নির্মানের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে চাইনিজ শ্রমিকরা তাতে যথেষ্ট অবদান রাখেন। কিন্তুু এই শ্রমিকদের সঙ্গে কানাডা সেদিন অনেক অমানবিক আচরণ করেছিল। কানাডিয়ান শ্রমিকদের যা বেতন দেয়া হতো তার চেয়ে অর্ধেক কম বেতন দেয়া হতো চাইনিজ শ্রমিকদেরকে। আর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করানো হতো চাইনিজ শ্রমিকদের দিয়ে। এতে করে সেই সময় ছয় শতাধিক চাইনিজ শ্রমিকের প্রাণহানী ঘটে বিভিন্ন দুর্ঘটনায়।

চাইনিজদের প্রতি বৈষম্য ও বিদ্বেষের আরো ঘটনা আছে। তাঁদেরকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে। কানাডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ে নির্মান কাজ শেষ হলে সেই সময় চাইনিজ ইমিগ্রেশন এ্যাক্ট নামে একটি আইন পাশ করা হয়েছি যার মাধ্যমে তাদের উপর ‘হেড টেক্স’ নামে একটি অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য কানাডা সরকার বহু বছর পর গত ২৬ জুন, ২০০৬ সালে ক্ষমা প্রার্থনা করে। সে সময়ের সরকার প্রধান স্টিফেন হারপার পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে এই ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

কিন্তু তাতে পরিস্থিতি খুব একটা পাল্টেছে এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। করোনার কারণে এশিয়ানদের প্রতি বিদ্বেষ নতুন মাত্রা পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত  স্ট্যাটিসটিকস কানাডার অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে করোনা মহামারীর সময় নিজ নিজ এলাকায় বর্ণবাদী বা জাতিগত পরিচয়ের কারণে হয়রানি অথবা সহিংসতার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল এশীয় অঞ্চল থেকে আসা এশীয়-কানাডিয়ানদের।

ঐ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ানরাও অন্তত এটুকু বিশ্বাস করেন যে, নিজেদের এলাকায় নিয়মিতভাবে বর্ণবাদী হামলা বা হয়রানির ঘটনা ঘটছে কিংবা বর্তমান মহামারী শুরুর পর থেকে তা বেড়েছে বলে মনে হয়। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার বরাত দিয়ে সিটিভি নিউজ এ তথ্য প্রকাশ করে।

স্ট্যাটিসটিকস কানাডার ঐ সমীক্ষায় অংশ নেয়া লোকেদের মধ্যে যারা চীনা তাঁদের ৩০ শতাংশেরও বেশি সংখ্যক তখন বলেছিলেন, মহামারী শুরুর পর তাঁদের এলাকায় জাতি, গোষ্ঠী বা বর্ণের ভিত্তিতে হয়রানি বা হামলার ঘটনা বেড়েছে। এরপর সর্বোচ্চ সংখ্যক যাঁরা একই ধরণের কথা বলেছেন তাঁরা হলেন কোরীয়, ২৭ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে বিভিন্ন অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সদস্য ২২ শতাংশ এবং এরপর দক্ষিণ এশীয় ১৯ শতাংশ।

সবচেয়ে কম যাঁরা এধরণের কথা বলেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন যাঁরা নিজেদেরকে অশ্বেতাঙ্গ বা দৃশ্যমান সংখ্যালঘুর মর্যাদায় দেখেন না এবং যাঁরা দৃশ্যমান সংখ্যালঘু হিসাবে বিবেচিত হন না। এই উভয় গ্রুপের লোকেদের হার হলো আনুমানিক ৬ শতাংশ।

মহামারিকালে কানাডায় এশীয়রা যে ক্রমবর্ধমান হারে বর্ণবাদী বা বিদ্বেষী হামলা এবং গালাগালির শিকার হচ্ছেন, জরিপের এসব ফলাফল হলো তার সর্বশেষ প্রমাণ।

উল্লেখ্য যে, ২০২০ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময়ে যখন মহামারি কেবল ছড়িয়ে পড়ছিলো সেই সময় মন্ট্রিয়লে দক্ষিণ কোরীয় কনস্যুলেট ওই শহরের কোরীয় বংশোদ্ভূতদেরকে সম্ভাব্য বর্ণবাদী হামলার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল। তখন থেকেই মন্ট্রিয়লের এশীয়দের বিরুদ্ধে সংঘটিত বেশ কিছু বর্ণবাদী ঘটনা প্রকাশ পায়।

২০২০ সালের মে মাসে ভ্যাঙ্কুভার পুলিশ জানিয়েছিল, তারা এশীয়দের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য ২৯টি হেট ক্রাইমের তদন্ত করছে। ঐ সময়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় বসবাসরত পূর্ব এশীয় বা দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকদের ২৪ শতাংশই বলেছেন যে, মহামারি শুরুর পর তাঁরা গালমন্দ ও অপমানের মুখোমুখি হয়েছেন।

বিদ্বেষের পাঁচভাগের চারভাগই (৮০ শতাংশ) ছিল মৌখিক অর্থাৎ গালাগালি, দোষারোপ করা ইত্যাদি। বাকি ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে শারীরিক সম্পৃক্ততা ছিল যেমন, থুতু ছিটানো, কাউকে লক্ষ্য করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাশি দেয়া এমনকি সরাসরি সহিংসতা ঘটানো। সবগুলো ঘটনাই ঘটেছে প্রকাশ্যে জনসমক্ষে। অর্ধেকের বেশি ঘটনা ঘটে কোনও সড়কে অথবা ফুটপাতে।

নিরাপত্তাহীনতার বোধ

২০২০ সালের আগস্টে সিটিভি নিউজে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ঐ সময় স্ট্যাটিসটিকস কানাডা তাদের সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের কাছে জানতে চেয়েছিল যে, নিজেদের এলাকায় এবং সাধারণভাবে সবখানে বর্ণবাদী ও জাতিগত কারণে হয়রানি ও হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের ধারণা কি?

নিজেদের এলাকায় প্রায়ই বা কখনও কখনও এধরণের বৈষম্যমূলক ঘটনা ঘটে বলে বিশ্বাস করেন এমন জবাব সবচেয়ে বেশি দিয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ ও কোরীয় অংশগ্রহণকারীরা। উভয় গ্রুপেরই এমন জবাব দিয়েছেন ২৬.৫ শতাংশ মানুষ। ২৫ শতাংশের বেশি লোক একই ধরণের জবাব দিয়ে পরের অবস্থানে ছিলেন চীনারা। ফিলিপিনোদের মধ্যে এমন জবাব দিয়েছেন ২২ শতাংশ লোক।

ঐ সময় সার্বিকভাবে দৃশ্যমান সংখ্যালঘুদের মধ্যে ২১ শতাংশ বলেছিলেন তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, তাঁদের এলাকায় বৈষম্যমূলক হয়রানি বা হামলার ঘটনা মাঝেমধ্যে বা প্রায়শ ঘটে। দৃশ্যমান সংখ্যালঘুদের মধ্যে তাঁদের সংখ্যাও কিছুটা বেশি যাঁরা মনে করেন যে, মহামারীকালে তাঁদের এলাকায় অপরাধ বেড়েছে। জাপানি ও চীনারা এধরনের ধারণা পোষণ করেন বেশি।

উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার প্রিমিয়ার জন হোরগান ইতিপূর্বে বলেছিলেন, ভ্যাঙ্কুভার পুলিশের প্রকাশিত তথ্যে ২০২০ সালে এশীয়দের বিরুদ্ধে ঘৃণাজনিত অপরাধ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় অশ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে হেইট ক্রাইম হিসাবে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা জোরালো হয়েছে।

গত বছর মে মাসে দি কানাডিয়ান প্রেস জানায়, ভ্যাঙ্কুভার পুলিশের প্রকাশিত উপাত্ত অনুযায়ী, ঐ প্রভিন্সে এশীয়দের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ বেড়েছে ৭১৭ শতাংশ। ২০১৯ সালে যে অপরাধের সংখ্যায় ছিল এক ডজনের মত সেটি ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪২টিতে। এদিকে ঘৃণাপ্রসূত সাধারণ ঘটনাও দ্বিগুণ বেড়েছে।

ব্রিটিশ কলম্বিয়ার প্রিমিয়ার জন হোরগান বলেন, হেট ক্রাইমের বিচারের ক্ষেত্রে অসুবিধা আছে। অসুবিধার আংশিক কারণ হলো, সহিংস অপরাধের বিপরীতে হেট ক্রাইম সত্যি জাতিগত বিদ্বেষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিনা তা প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু এটি করা জরুরী। গণমাধ্যমের সামনে ইতিপূর্বে জন হোরগান বলেন, “আমাদের নিশ্চিত করা দরকার যে, অশ্বেতাঙ্গ জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা নিছক সহিংসতা নয়, এটি হেট ক্রাইম। কেউ যদি গাত্রবর্ণের কারণে কাউকে আক্রমণ করে তাহলে তার বিচারে আইন পুরো মাত্রায় প্রয়োগ করা হবে।”

হোরগান বলেন, প্রাদেশিক সরকার বর্ণবাদবিরোধী আইন প্রণয়নে কাজ করছে এবং জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী মাইক ফার্নওয়ার্থ হেট ক্রাইমের বিচারের ওপর জোর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পুলিশ বাহিনীকে অবহিত করেছেন।

এদিকে কানাডায় নবাগতদের পরিষেবা দানকারী একটি সামাজিক গ্রুপ ‘সাকসেস’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কুইনি চু কানাডিয়ান প্রেস-কে বলেন, এখানে হেইট ক্রাইমের সংখ্যা আরও অনেক বেশি যেগুলি পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয় না। তিনি বলেন, “আমি নিশ্চিত, এটি হলো হিমবাহের সামান্য চূড়ামাত্র।”

চু আরো বলেন, প্রাদেশিক সরকার যা করতে পারে তা হলো, কোন ধরণের ঘটনা হেট ক্রাইম বলে বিবেচিত হবে বর্ণবাদবিরোধী আইনের সঙ্গে মিলিয়ে তার একটি স্পষ্ট সংজ্ঞায়নে জরুরী পদক্ষেপ নেওয়া। তিনি বলেন, “কেউ এ ধরণের আচরণ করলে তার পরিণতি কী হবে? মানুষকে কি তার আচরণের জন্য দায়ী করা হচ্ছে?”

হিংসা বা বিদ্বেষমূলক অপরাধ কোনটি তা নিয়ে বিভ্রান্তি

কী করলে সেটা হেট ক্রাইম হবে সে বিষয়ে কানাডার বিভিন্ন প্রভিন্সে পুলিশ বিভাগে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে কোন কোন সম্প্রদায়ের লোকেরা হেট ক্রাইমের শিকার হচ্ছে তা নির্ধারণের মত সঠিক সংখ্যা পাওয়া অসম্ভব। সিবিসি’র এক নতুন অনুসন্ধানে এ তথ্য জানা গেছে।

উল্লেখ্য যে, কানাডার বিভিন্ন পুলিশ বিভাগ হেট ক্রাইমের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা ব্যবহার করে, যার অর্থ হলো, ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়াটি অঞ্চল ভেদে ভিন্ন। এমনকি এ ধরণের অপরাধের তদন্তকারী পুলিশের কর্মকর্তাদের মধ্যেও ভিন্নতা দেখা যায়। কিছু পৌরসভায় হেট ক্রাইমের সমন্বিত সংজ্ঞা আছে যাতে জেন্ডার স্বাতন্ত্র ও তার অভিব্যক্তির বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু অন্যদের আদৌ কোনও আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা নেই।

আলবার্টা মানবাধিকার কমিশনের হেট ক্রাইম বিষয়ক কমিটির প্রেসিডেন্ট স্টিফেন ক্যাম্প সিবিসিকে বলেন, সারাদেশে একটি সংজ্ঞা না থাকার অর্থ হলো হেট ক্রাইমের বিদ্যমানতা নিয়ে কানাডীয়দের কোনও যথাযথ ধারণা নেই। তিনি বলেন, এর অর্থ হলো এই অপরাধ বন্ধের জন্য কোথায় সম্পদ বিনিয়োগ করতে হবে সে সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও ধারণা নেই।

সিবিসি নিউজকে তিনি আরো বলেন, “যেটা হওয়া দরকার সেটা হলো জাতীয় পর্যায়ে এর একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ এবং তা দন্ডবিধিতে অন্তর্ভুক্ত করা। আর কেবল অপরাধের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য নয় বরং বেশ কিছু কারণে এটা হওয়া দরকার।” তিনি বলেন, “একটি মানসম্মত সংজ্ঞা ছাড়া কানাডায় যা ঘটছে তাতে বর্তমান পরিসংখ্যান যথাযথ নয়।”

দণ্ডদানের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়

কিছু পুলিশ সার্ভিস যেমন অটোয়া পুলিশ সার্ভিস হেট ক্রাইমকে সংজ্ঞায়িত করে “জাতিগোষ্ঠী, জাতীয় ও সম্প্রদায়, ভাষা, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, মানসিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, যৌন প্রবণতা বা এরকম অন্য যে কোনও কারণে ঘৃণা বা বিদ্বেষ থেকে সংঘটিত অপরাধ হিসাবে।”

কুইবেক প্রাদেশিক পুলিশের আদৌ কোনও আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা নেই।

ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা

আলবার্টা মানবাধিকার কমিশনের হেট ক্রাইম বিষয়ক কমিটির প্রেসিডেন্ট স্টিফেন ক্যাম্প সিবিসি নিউজকে বলেন, একটি মানসম্মত সংজ্ঞা না থাকায় বিভিন্ন পুলিশ বিভাগ তাদের মাঠ পর্যায়ের অফিসারদেকে হেট ক্রাইম চিহ্ণিত করা ও তার তদন্তের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের নির্দেশনা দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, এটি যদি কানাডার জন্য অগ্রাধিকারের বিষয় হয়ে থাকে তাহলে এর প্রতিফলন ঘটতে হবে একটি অভিন্ন দণ্ডবিধিতে যাতে অফিসাররা দায়িত্ব পালনের সময় সেটি ব্যবহার করতে পারে। তাঁর ভাষায়, “দণ্ডবিধি হলো আমাদের সমাজের নীতিবোধ, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের প্রতিফলন, আর কানাডা সব সময়ই একটি বহুমতের, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং নিরাপদ সমাজ হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে এই অভিপ্রায়ের প্রতিফলন হিসাবে দণ্ডবিধিতে হেট ক্রাইম বিষয়ে কোনও অনুচ্ছেদ নেই কেন?”

মহামারী শেষ হলে এশিয়দের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ কমবে কি?

গত বছর জানুয়ারীতে প্রকাশিত কানাডার এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের (এপিএফ) বার্ষিক মতামত জরিপে অংশ নেয়া বেশিরভাগ কানাডীয় বলেছেন, কানাডায় এশিয়বিরোধী বর্ণবাদ মহামারির আগে থেকেই বিদ্যমান। আর তাঁদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি মনে করেন, কোভিড-১৯ ভাইরাস পরাস্ত হবার পরও এর অবসান হবে না। খবর নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.কম এর।

এপিএফ-এর জরিপে এশিয়া সম্পর্কে কানাডীয়দের দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে রয়েছে:

৭৮ শতাংশ বলেছেন, কোভিড-১৯ এর কারণে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁদের ধারণার অবনতি ঘটেছে। চীন সম্পর্কে এমনটা বলেছেন ৫৫ শতাংশ কানাডীয়।

৫৩ শতাংশ কানাডীয় মনে করেন কোভিড-১৯ সংক্রমণের সময় পূর্ব এশীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয়দের প্রতি নেতিবাচক আচরণ করা হয়েছে। আর ৮৪ শতাংশ মনে করেন, কানাডায় মহামারির আগে থেকেই এশীয়বিরোধী বর্ণবাদ বিদ্যমান।

বিগত প্রায় দুই বছরে বিশ^ব্যাপী করোনা মহামারী মানুষের অনেক ক্ষতি করেছে। মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শারীরিক ও মানসিকভাবে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কত দিন লাগবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। কারণ, মহামারী এখনো শেষ হয়ে যায়নি। কানাডায় এখনো প্রতিদিন বহু সংখ্যক মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর এই অস্থিরতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যত এবং বেগতিক অর্থনৈতিক অবস্থার পাশাপাশি এশিয় বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক ও ইমিগ্রেন্টরা প্রতিনিয়ত বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন বিনা দোষে। করোনার শিকারও তাঁরাই বেশী হচ্ছেন। কারণ, তাঁদের মধ্যে ফ্রন্টলাইনের কর্মী বেশী। তাঁদের মধ্যে দারিদ্রতা বেশী। দারিদ্রতার কারণে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন বিপদের মধ্যেও কাজ করতে। দারিদ্রতার কারণে তাঁরা ঘনবসতী এলাকায় ঘিঞ্জি এপার্টমেন্টে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এ কারণগুলো সহজে সংক্রমিত হওয়ার পথকে সুগম করে দেয়। অর্থাৎ তাঁরা শুধু করোনায় বেশী মাত্রায় সংক্রমিত হচ্ছেন তাই নয়, করোনার কারণে তাঁরা বিদ্বেষেরও শিকার হচ্ছেন। তাঁদের বিপদটা আসছে দুই দিক থেকে। এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে বা কবে শেষ হবে কেউ জানেনা।

প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অবশ্য এশিয়দের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি এর নিন্দাও করেছেন। ইতিপূর্বে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রুডো বলেন, “ঘৃণা, সহিংসতা ও বৈষম্যের কোনও জায়গা কানাডায় নেই। কানাডীয় হিসাবে আমরা যেরকম, এরা (ঘৃণা, সহিংসতা ও বৈষম্যকারীরা) সেরকম নয়।”

২০২০ সালের এপ্রিলে হাফিংটন এর এক রিপোর্টে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেন যে, চলতি বসন্তে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ভবন ও মূর্তি ভাঙচুর করা হয়েছে এবং অনেক মানুষ মৌখিকভাবে গালাগালি ও শারীরিক হামলার শিকার হয়েছেন।  প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সারাদেশের এশীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয়দের বলছি, জেনে রাখুন, আমরা সবাই আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। ঘৃণা আমাদের মাঝে বিভেদ তৈরি করবে, এমনটা আমরা হতে দেবো না।”

কানাডায় যারা নিজেদের কমিউনিটিতে সহিংসতা ও প্রকাশ্য বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন সেইসব কানাডীয়কে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ট্রুডো।

ট্রুডো বলেন, “যেখানেই বর্ণবাদের দেখা পাওয়া যাবে সেখানেই আমাদের সোচ্চার হওয়া দরকার যাতে আমরা এটা বন্ধ করতে পারি।”