মানুষের কথা

সাইদুল হোসেন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

জানা-অজানাকে নিয়েই এই জগৎ, এই মানব-জীবন। মানুষ বহু বিষয়ে জানতে আগ্রহী, চেষ্টারও ত্রুটি নাই, তথাপি তার জীবনে জানার চেয়ে অজানার ভাগই বেশী। জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে-সন্তান, স্ত্রী-ভাগ্য, স্বামী-ভাগ্য, সম্পদ-স্বাস্থ্য, সুখ্যাতি-কুখ্যাতি, সুখশান্তি-দুঃখ-দারিদ্র্য, বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবইতো অজানা। বলতে গেলে গোটা জীবনটাই অজানা ও অনিশ্চয়তায় ভরা। আজ রাতে ঘুমাচ্ছি, আগামীকালের ভোরের সূর্য দেখতে পাব কিনা জানা নেই। অথচ আগামীকালের জন্যে কত প্ল­্যান-প্রোগ্রাম গুছিয়ে রেখেছি! অজানা ভবিষ্যতের জন্যে কতনা কল্পনা করে রেখেছি! এক নিঃশ্বাসের ভরসা নেই অথচ আগামী দীর্ঘ-জীবনের সুখ-স্বপ্নে বিভোর মানুষ। এমনটা না করে কোন উপায়ও নেই, মানুষের বাঁচার জন্যে একটা অবলম্বন তো চাই। হোক সে কল্পনা। এ এক মস্ত গোলকধাঁধাঁ বটে!

এই অজানা অরণ্যে বাস করা সত্ত্বেও মানুষ একে অপরকে জানতে, কাছে পেতে, আপন করে নিতে নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় :

“কত অজানারে জানাইলে তুমি

কত ঘরে দিলে ঠাঁই,

দূরকে করিলে নিকট বন্ধু,

পরকে করিলে ভাই।”

এই যে অপরকে কাছে টানা, তাকে ভাই বা বন্ধু বলে গ্রহণ করা এটা খুব সহজ কাজ নয়। এর জন্যে চাই উদারতা, হৃদয় থেকে আপন-পরের ব্যবধানমূলক চিন্তাটাকে বিসর্জন দেয়ার ক্ষমতা ও সাহস। একদিনে অথবা একবারের চেষ্টায় সেটা সম্ভব নয়। মনকে কলুষমুক্ত করে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলে তবেই সেই মুক্ত মনের প্রসারতা অর্জন করা সম্ভব। সবাই পারেনা মুক্তমনা হতে, নিজেদের দলীয়-ধর্মীয়-সামাজিক-আর্থিক পরিমন্ডলের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে। নিরন্তর চোখে ঠুলি-আঁটা আবদ্ধ দৃষ্টির সীমানা বড়ই কম, তার ফলে looking outside (নিজের সংকীর্ণ গন্ডীর বাইরে তাকানো) সম্ভব হয় না।

মনের চক্ষু খুলতে গেলেও চর্মচক্ষুর চাক্ষুষ দর্শন প্রয়োজন কারণ চোখে দেখতে পেলে তবেই সাদাকালোর পার্থক্যটা বোঝা যায়। চাই সাধনা, অজানাকে জানার আগ্রহ, নিজেকে একজন বিবেকবান, উন্নত মানুষে পরিণত করার অদম্য ইচ্ছা। সেই স্তরে পৌঁছতে হলে জানার গন্ডী পেরিয়ে অজানাকে স্বাগতঃ জানাতে হবে, তাকে বোঝার এবং উপলব্ধি করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। চোখের দেখা ও হৃদয়ের উপলব্ধির সমন্বয় ঘটাতে হবে, নূতন সত্যকে স্বীকার করে নিতে হবে, হিংসা ও ঘৃণার  ঊর্ধ্বে উঠতে হবে।

“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে

আসে নাই কেহ অবনী পরে,

সকলের তরে সকলে আমরা

প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”

[স্মৃতি থেকে বলছি, উদ্ধৃতি হয়তো ভুল থাকতে পারে]

এক বাঙ্গালী কবি একথা শতাব্দী কাল আগেই ঘোষণা করে গেছেন। বলে গেছেন যে আপন-পরের ব্যবধান ভুলে মানুষ যেন ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্ধুদ্ধ হয়, নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সে যেন পরের হিতে নিজেকে নিয়োজিত করে তার মানবজনম সার্থক করে। এই সেবা বড়ই মহান, বড়ই তৃপ্তিদায়ক।

যাকে চিনি না, কোন পরিচয় নেই, তার সাহায্যে এগিয়ে যেতে আমরা ইতস্ততঃ বোধ করি, অপরিচয়ের দেয়াল আমাদের নিরুৎসাহ করে। বছর কয়েক আগে টরন্টোর কোন এক পত্রিকায় পড়েছিলাম যে কিছু যুবক-যুবতীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল : “তুমি লেইকের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছ। এমন সময় দেখতে পেলে যে তোমার কুকুরটা লেইকের পানিতে ডুবে যাচ্ছে এবং পাশেই তোমার অপরিচিত একটা লোকও সাঁতার জানেনা বলে পানিতে ডুবে যাচ্ছে। তুমি কাকে বাঁচাবে”? কয়েকজন বলল : অবশ্যই সেই মানুষটাকে বাঁচাবো। অন্যেরা বলল : আমার কুকুরটাকে বাঁচাবো।

প্রশ্ন : কিন্তু সেই ডুবন্ত মানুষটিকে নয় কেন?

উত্তর : সেই মানুষটাকে আমি চিনি না, ওর জন্যে আমার কোন দায়িত্ব নেই। কিন্তু কুকুরটা আমার, ওটাকে আমি চিনি, ভালবাসি। স্বভাবতই ওটাকে বাঁচানোই আমার কাছে প্রাধান্য পাবে।

দেখুন, অপরিচিত একটি মানুষের জীবন প্রতিপালিত, নিত্যসংগী একটা কুকুরের জীবনের চেয়েও কম মূল্যবান। কারণটা স্পষ্ট, লোকটির সংগে অজানার, অপরিচয়ের ব্যবধান।

অতীতে একটা সময় ছিল, তবে আজো সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি সেই প্রথা, যখন নারীপুরুষের বিয়ে হতো সম্পূর্ণ অচেনা, অপরিচিত জনের সংগে, এবং সেই সম্পর্কটা স্থির করতেন পাত্র এবং পাত্রীর বাবা-মা অথবা অন্য কোন দায়িত্বশীল গুরুজন। “না” বলার কোন উপায় ছিল না। পিতৃশাসিত পরিবার ও সমাজ-ব্যবস্থা এটাকেই দু’পক্ষের জন্যে শুভ ফলদায়ক প্রথা বলে সাব্যস্থ করেছিল। স্বামী-স্ত্রীর জীবনের প্রথম দেখা হতো বিয়ের পর, বাসর রাতে। বর্তমান যুগের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এটা কল্পনাও করতে পারবে না- দু’জনের মাঝে জানাশোনা এবং মেলামেশা ছাড়া বিয়ে? নো ওয়ে! অথচ এটাই ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সর্বজনগ্রাহ্য বিয়েশাদীর ভারতীয় প্রথা, এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও। সেই অজানা জনকে স্বামী অথবা স্ত্রী হিসেবে জানতে জানতেই বাকি জীবনটা কেটে যেতো দু’জনের, জন্ম হতো পরবর্তী প্রজন্মের এবং তারাও ঐ একই প্রথায় বিবাহিত জীবন শুরু করতো, শেষ করতো।

মৃত্যু জীবনের অবসান, এই দুনিয়া থেকে এক অজানা জগতে প্রস্থান। কিন্তু তারপর কি? কেউ জানে না তারপর কি ঘটে। জানার কোন উপায়ও নেই কারণ মৃত ব্যক্তি কখনো ফিরে এসেছে, তার মৃত্যু পরবর্তী অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে এমন কোন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোন দেশেই, কোন সমাজেই নেই। সেই জগৎ সম্পূর্ণই অজ্ঞাত, অন্ধকারাচ্ছন্ন। কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণাই আজো সে ব্যাপারে কোন অলোকপাত করতে পারেনি।

অথচ পৃথিবীর দেশে দেশে প্রচলিত নানা ধর্ম-পুস্তক মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্য-আনন্দের এবং একই সংগে নানা ধরণের শাস্তির বর্ণনায় ভরপুর। ধর্মীয় পুস্তকগুলোর উদ্দেশ্য মানুষকে ‘গড’ নামে এক মহাশক্তিশালী স্রষ্টা প্রভুর সংগে পরিচয় করে দেয়া এবং মৃত্যুর পরেও একটা জীবন আছে এই বিশ্বাসে দীক্ষিত করা এবং পাপ- মুক্ত জীবন যাপন করে নূতন জীবনে গডের আশীর্বাদ লাভ করে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় স্বর্গীয় জীবন উপভোগের আশ্বাস দেয়া। এবং একই সংগে বিপথগামীদের গডের ক্রোধের ফলে শাস্তি ও যন্ত্রণাময় নরকবাসের ভয় দেখানো। স্বর্গ-নরকের আয়েশ অথবা শাস্তির বাস্তব কোন প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও অগণিত মানুষ সেই অজানা জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাসী হয়ে এই পৃথিবীর বুকে সৎ ও কলুষহীন জীবন যাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ এক রহস্য বটে।

গডকে কেউ কখনো চোখে দেখেনি অথচ গডের অস্তিত্বে ও তাঁর অসীম ক্ষমতার বিশ্বাসী লোকের অভাব নেই কোন সমাজেই। সে সব বিশ্বাসীরা তাদের জীবনের সকল আশা-আকাক্সক্ষা গডের কাছে সমর্পণ করে নিত্যদিন তাঁর আশীর্বাদ ও শান্তিময় জীবনের আশায় প্রার্থনা করে যাচ্ছে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস এই যে NO GOD, NO PEACE. KNOW GOD, KNOW PEACE.

স্ত্রীয়াশ্চরিত্রং পুরুষস্য ভাগ্যং

দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ

সংস্কৃত ভাষার অতি প্রাচীন এবং বহুল আলোচিত শ্লোক, যার অর্থ হচ্ছে : স্ত্রীলোকের চরিত্র এবং পুরুষের ভাগ্য দেবতারাই জানে না, মানুষ কি করে জানবে (মানুষ তো কোন ছার!) তবে সত্য হচ্ছে এই যে শুধুমাত্র নারীর চরিত্র অথবা পুরুষের ভাগ্যই নয় এ জগতে আরো অনেক বিষয় আছে যা মানুষের অজানা, তাদের জ্ঞানের বাইরে। এই অজানার মাঝে বাস করেই জীবনের গতিপথ নির্ণয় করতে হয়, সিদ্ধান্ত নিতে হয়, এগিয়ে যেতে হয়, সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হয়। অজানার অন্ধকার আছে বলেই মানুষ সাহসী হয়, ভালমন্দ বিচার করতে শিখে, বিচক্ষণতা লাভ করে, মুখ থুবড়ে পড়ে যায় না। অজানার অন্ধকার এবং অনিশ্চয়তা মানুষের জন্যে সদাসর্বদাই অনভিপ্রেত নয়, বরং সহায়ক ভূমিকা রাখে।

অজানাকে, পরকে আপন করার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অতিসম্প্রতি আমার নিজের জীবনেই ঘটেছে, মানুষের হৃদয়ের উদারতা ও প্রসারতা আমি দেখেছি, আমি নিজেকে বড় ভাগ্যবান বলে মেনেছি। অভাবনীয় সেই ঘটনা।

২০০৭ সনের মাঝামাঝি একটি বৃদ্ধাকে সংগে নিয়ে চিকিৎসার জন্যে মহিলার ছেলের বৌ (মূলতঃ আরব দেশ ওমান-এর লোক ওরা) তিন মাস ধরে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই টরন্টোর একটা হসপিটালের একটা ক্লিনিকে আসত। আমি ছিলাম ওখানে একজন ভলানটিয়ার। ছেলের বৌয়ের নাম ছিল ফাতিমা, চমৎকার ইংরেজী বলত সে, বড় হাসিখুশী, মিশুক মেজাজের মেয়ে। সে তখন প্রেগন্যান্ট, ওর জীবনের ফার্স্ট প্রেগন্যান্সী। ওরা ক্লিনিকে আসলেই আমার ঠিক পেছনের দু’টি চেয়ারে বসত, আমার সংগে গল্প করত। সেই দিনগুলিতে আমি আমার যথাসাধ্য ওদের সাহায্য-সহায়তা করতে চেষ্টা করেছি।

দু’বছর পর জুলাই, ২০০৯ এর প্রথম সপ্তাহে সেই মেয়েটির সংগে আবার দেখা একটা শপিং মলে, ওর সাথে স্ট্রলারে বসা ফুটফুটে সুন্দর একটি ছেলে। যথারীতি কুশল বিনিময়ের পর বললাম : ২০০৭ সনের অক্টোবরেই তো তোমার ডেলিভারি হওয়ার কথা ছিল। এই বুঝি সেই ছেলে? কি নাম রেখেছ ছেলের?

ফাতিমাঃ আমার ডেলিভারির মাসটাও আপনার মনে আছে? আশ্চর্য! হ্যাঁ, সেই মাসেই আমার ছেলের জন্ম হয়েছিল। ওর নাম রেখেছি সাইদ, আপনারই নাম।

আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলামঃ আমার নাম? আমার নাম কেন?

ফাতিমা বললঃ তিনটি মাস ধরে আপনি আমার শাশুড়ির এবং আমার যে কেয়ার নিয়েছেন, হেল্প করেছেন, আমাদের কম্পেনি দিয়ে কষ্ট দূর করার চেষ্টা করেছেন এই বিদেশে সেটা ছিল আশাতীত, আমাদের কল্পনারও বাইরে। আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, সেই কৃতজ্ঞতার স্মৃতিটুকু বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই আমরা আমার ছেলের নাম রেখেছি সাইদ, আপনাকে আমরা ভুলতে চাই না।

ওর কথাগুলো শুনে আমি হতবাক, অভিভূত, চোখে পানি এসে গেল আমার। এত গভীর কৃতজ্ঞতাও মানুষের হৃদয়ে স্থান পেতে পারে! অবিশ্বাস্য! গলাটা ধরে এল, শুধু বলতে পারলাম : শোকরান (ধন্যবাদ)। হাসিমুখে ফাতিমা বললঃ আফ্ওয়ান (ইউ আর ওয়েলকাম)। তারপর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আরবীতে বললঃ সাইদ, চাচাকে সালাম কর।

সাইদ তার ছোট্ট ডানহাতটি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল, হাসিতে ভরা মুখ। আমিও হাত বাড়িয়ে ওর তুলতুলে হাতটি আমার হাতে তুলে নিলাম।

ক্যানাডাতে লোকজনকে হাসানোর জন্য JUST FOR LAUGHS নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। ছবি : ইউটিউব

হাসি নিয়ে কিছু কথা

“”Laughter is the best medicine”- Reader’s Digest Magazine একটা regular feature, বহু মজাদার সব কথার দেখা পাওয়া যায় সেখানে প্রতিমাসেই। Quite enjoyable। আজ ৪০ বছর ধরে আমরা স্বামী -স্ত্রী দুজনেই এই ম্যাগাজিনের একান্ত অনুরক্ত পাঠক। হাসি সত্যি সত্যি দুঃখবিনাশিনী এক মহৌষধ বটে।

হাসির আবার রকমফের অর্থাৎ শ্রেণীবিভাগও রয়েছে- আনন্দের হাসি, দুঃখের হাসি, করুণার হাসি, অবজ্ঞার হাসি, নিষ্ঠুর হাসি, সমবেদনার হাসি ইত্যাদি। অন্য ধরনের শ্রেণী বিভাগও আছে- মিষ্টি হাসি, মৃদু হাসি, অট্টহাসি, নীরব হাসি, তিক্ত হাসি, দেঁতো হাসি, হা-হা হাসি, হো- হো হাসি, খিলখিল হাসি, খুকখুক হাসি। আরো আছে চোখের হাসি যা একজন নারীকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। এতো গেল বাংলা ভাষার কথা।

এমনি শ্রেণীবিভাগ পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাতেও দেখা যায়। ধরুন ইংরেজী ভাষা। তাদের vocabulary ঘাঁটলে সেখানে আছে laughter (উচ্চস্বরে/জোরে হাসি), smile (মৃদু হাসি), giggle/titter (ফিকফিক করে হাসি/বোকার মত হাসি), guffaw (অট্টহাসি)।

ফ্রেঞ্চ ভাষায় sourire (সুরির) মানে হলো মৃদুহাসি। স্প্যানীশ ভাষায় sonrisa হলো হাসি এবং una carita feliz হলো হাসিমুখ। আরবী ভাষায় ইব্তিসাম হচ্ছে হাসি, আর তাবাস্সুম হলো মৃদু হাসি। আফ্রিকার বিখ্যাত সোয়াহিলি ভাষায় হাসি হলো “চেকা”। এক সোমালী মহিলার নামের শেষ অংশটা ছিল Hashi. জিজ্ঞাসা করলাম, এর অর্থ কি? হাসিমুখে বললঃ এর অর্থ হলো white (সাদা), আমার দাদার নাম। আমরা সোমালীরা আমাদের নামের সংগে বাবার নাম এবং দাদার নামও জুড়ে দিই, এটাই আমাদের tradition.

হাসি একটা আনন্দের ব্যাপার কিন্তু যদি বলা হয় ব্যাপারটা হাস্যকর তখন কিন্তু মুখের হাসি উবে যায়, লোকে অপমানিত বোধ করে। ঠিক তেমনি হাস্যাস্পদ ব্যক্তি কখনো হাসে না, দুঃখ পায়, অথবা রেগে যায়। একই কারণে কেউ হাসির পাত্র হতে চায় না। Laugh but never laugh at others- হাসো কিন্তু কাউকে নিয়ে হাসাহাসি করো না কারণ এটা নিষ্ঠুরতা। বিশ্বাসযোগ্য না হলে আমরা অনেক ব্যাপারই হেসে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করি।

হাসির একটা গুণ হলো যে সে সংক্রামক-একজনকে হাসতে দেখলে উপস্থিত অন্যান্যরাও হাসতে শুরু করে। কথায় আছে : বোকার হাসি তিনবার- প্রথমবারে না বুঝেই হাসে, দ্বিতীয়বারে বুঝে হাসে এবং তৃতীয়বারে প্রথমবারে না বুঝে হেসেছিল সেকথা মনে করে আবার হাসে।

হাসির অপর গুণ হলো যে হাসিমুখ মানুষের হৃদয় জয় করতে পারে অতি সহজেই : A beautiful and smiling face can win every heart. মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়ার পাসপোর্ট হলো সুন্দর মুখের হাসি।

হাসি ও কান্না মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংগ, দু’টিই তার আবেগের প্রকাশ। হাসি, বিশেষ করে গলা ছেড়ে হো – হো করে হাসি, মনের সঞ্চিত অভিযোগ দূর করে মনকে হাল্কা করে, মনের ভার দূর করে, মনকে নির্মল করে, তাতে মানুষ সহজ হতে পারে, কাজ করার উদ্দীপনা ফিরে পায়। হাসতে জানে যে বাঁচতে জানে সে। ডাক্তারদের মতে- Laughing and crying are similar psychological reactions. Both occur during states of high emotional arousal, involve lingering effects, and don’t cleanly turn off and on. Both laughter and crying can ease stressful experience.

প্রাণখোলা হা-হা হো-হো করে হাসি দেহে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, ফুসফুসে ফ্রেশ এয়ার টেনে নেয়, এটা স্বাস্থ্যকর। হার্টের জন্যে উপকারী। নিয়মিত অভ্যাস করতে পারলে ভাল হয়। পত্রিকায় পড়েছি, ইন্ডিয়ার পুনা অথবা বোম্বে শহরে কিছু হাসির ক্লাব আছে যাদের মেম্বাররা প্রতিদিন অফিসে ঢোকার আগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দলবেঁধে বিনা কারণেই খানিকক্ষণ হা-হা হো-হো করে হেসে নেয়, তারপর কাজে যায়। এমন ক্লাবের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। আমাদের ক্যানাডাতেও JUST FOR LAUGHS নামে চারজন অভিনেতা মিলে পাবলিককে হাসানোর জন্যে নানা শহরে বছরব্যাপী অনুষ্ঠান করে থাকে। এই অভিনেতাদের একজন হচ্ছেন ইন্ডিয়ান, নাম শাওন মজুমদার। এদের অনুষ্ঠান খুবই জনপ্রিয়।

হাসির নাটক অথবা হাসির গান, কমেডি সিনেমা জনপ্রিয় কারণ লোকেরা হাসতে চায়, হেসে আনন্দ পেতে চায়, সাময়িকভাবে হলেও তাদের দুঃখকষ্ট ভুলতে চায়। তেমনি কার্টুনও মানুষের মুখে হাসি ফোটায়, মনে আনন্দ আনে। অনাবিল হাসি শান্তির অগ্রদূত; শিশুর খলখল হাসি মায়ের হৃদয়ে স্বর্গসুখ ছড়িয়ে দেয়।

বিখ্যাত হাস্যরসিক ভানু বন্দোপাধ্যায়কে বাঙ্গালীদের কে না চেনে? তিনি তার ঢাকার বিক্রমপুরী রসালো বাংলায় উভয় বাংলার বাঙ্গালীদের হাসিয়ে গেছেন যা অডিও ক্যাসেট এবং CD-তে পাওয়া যায় যা আজো বাঙ্গালীদের অবিরাম হাসির খোরাক জোগাচ্ছে। আরো আগের গোপাল ভাঁড়ের এবং বীরবলের রসিকতা তো প্রবাদসম। অপরদিকে নাসিরউদ্দিন হোজ্জার হাসির গল্প তো জগৎ বিখ্যাত। ঢাকাইয়া কুট্টিদের রসিকতাও এককালে প্রচুর জনপ্রিয় ছিল। ইংরেজী-বাংলা হাসির বই (Joke books) বাজারে পাওয়া যায়, এগুলো ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা ভাল; তেমনি audio tapes-ও। এগুলো মাঝেমাঝে পড়লে বা বাজিয়ে শুনলে মন প্রফুল্ল­ ও সতেজ থাকে।

হাস্যরসিক লোক সমাজে সমাদৃত কারণ তারা কোন আলোচনার/পরিবেশের একঘেয়েমি ভংগ করে সেখানে প্রাণসঞ্চার করতে পারে, লোকজনকে tension-free করতে পারে। তবে মনে রাখা উচিৎ যে রসিকতা ভাল কিন্তু বদরসিকতা ভাল নয় কারণ তাতে কুরুচির প্রকাশ ঘটে।

সত্যজিৎ রায় তাঁর বিখ্যাত “হীরক রাজার দেশে” মুভিতে এক চরিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন : “জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই”। কিন্তু  তা সত্বেও চলুন আমরা মজাদার কিছু হাসির গল্প জানার চেষ্টা করি।

ঢাকাইয়া কুট্টির গল্প।

(এক)

পথিক গলা ছেড়ে গান গেয়ে চলেছে : আমি বনফুল গো……

রাস্তার পাশের কুট্টি চায়ের দোকানদার পাশের লোককে ডেকে বলছে : কয় কি, হালায় নাকি বনফুল? হুইংগা দে হালারে, হুইংগা দে!

(দুই)

পাড়ার পিং পং কমপিটিশনের শেষে পুরষ্কার বিতরণী সভায় পাড়ার কুট্টি সর্দারের ভাষণ :

যে হালায় র্হাচে ওরেভী আমি সাবাসি দিতাচিনা, যে হালায় জিত্চে ওরেভী আমি সাবাসি দিতাচিনা, সাবাসি দিতাচি আমি হেই হালারে যে হালায় ঐ আন্ডাডারে বানাইচে। দুইজনে মিইলা কত পিটান পিটাইল মগর হালায় ওডারে ভাংগবার পারলো না! (সাবাসি অর্থ প্রশংসা)

অন্য ধরনের গল্প।

(এক)

প্রেমিকার বাবা : তুমি কি আমার মেয়ের সব ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে?

প্রেমিক : জ্বী, পারব।

প্রেমিকার বাবা : এত শিউর হচ্ছ কি করে?

প্রেমিক : আপনার মেয়ে বলেছে সে আমাকে ছাড়া আর কিছুই চায় না!

(দুই)

পুলিশ চোর ধরে নিয়ে থানায় যাচ্ছে। পথিমধ্যে-

চোর : স্যার, এখানে একটু দাঁড়ান, প্ল­ীজ। আমি আপনার জন্যে সিগারেট কিনে নিয়ে আসি।

পুলিশ : ব্যাটা, তুই আমাকে বোকা পেয়েছিস? সিগারেট আনতে গিয়ে তোর পালিয়ে যাবার মতলব আমি বুঝিনা ভাবছিস? তারচেয়ে বরং তুই এখানে দাঁড়িয়ে থাক, আমি গিয়ে সিগারেট কিনে নিয়ে আসি!

(তিন)

বাড়ির মালিক (বাগানের মালিকে) : আজ ফুল গাছে পানি দিয়েছ?

মালি : জ্বী না, স্যার। আজ সারাদিন খুব বৃষ্টি হয়েছে তো, তাই।

মালিক (রেগে গিয়ে) : বৃষ্টি হয়েছে তো কি হয়েছে? ছাতা মাথায় দিয়ে গাছে পানি দিতে পারলে না?

(চার)

স্কুলে লেইট। টিচার জিজ্ঞাসা করলেন : রবার্ট, লেইট হলো কেন?

ছাত্রঃ আর বলবেন না, স্যার। ভোরের দিকে স্বপ্নে ব্রাজিল বনাম জার্মানির একটা ফুলবল ম্যাচ দেখছিলাম। নির্ধারিত সময়ে কোন গোল না হওয়ায় এক্সট্রা টাইম ধরে খেলা চলতে থাকে। আর ঐটুকু দেখতে গিয়েই স্কুলে লেইট হয়ে গেল!

সাইদুল হোসেন

মিসিসাগা