কানাডায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সচরাচর কোনও রকম সহায়তার ব্যবস্থা থাকে না এখানে
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : কানাডায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারী আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের চরম অবস্থায় ঠেলে দিয়েছিলো। বিপুল মানসিক চাপে কানাডাজুড়েই তাঁদের আত্মহত্যায় মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যায়। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ওয়ান ভয়েস কানাডার এক রিপোর্টে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। খবর গ্লোবাল নিউজের।
কিন্তু লক্ষ্যনীয় যে, শিক্ষা অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় কানাডাকে গন্তব্য হিসাবে বেছে নিচ্ছে। এদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশী শিক্ষার্থীও আছে। বিভিন্ন দেশ থেকে কানাডায় শিক্ষা গ্রহণের অনুমতি পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০০০ সালে ছিল ১২২,৭০০। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪২,৫০০ জনে। ‘ইমিগ্রেশন, রিফিউজি এ্যান্ড সিটিজেনশীপ কানাডা’ এর সূত্র থেকে এই তথ্য জানা যায়।
এতে আরো বলা হয়, এই আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদেরকে ক্রমবর্ধমান হারে দক্ষ শ্রমশক্তির এক সম্ভাবনাময় উৎস হিসাবে দেখা হচ্ছে যাদেরকে কানাডার শ্রম বাজারে যোগ দেওয়ার জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। কানাডা সরকারের ২০১৯-২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক শিক্ষা কৌশলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদেরকে ‘পার্মানেন্ট রেসিডেন্সির জন্য উত্তম প্রার্থী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা তুলনামূলকভাবে তরুণ, অন্তত একটি দাপ্তরিক ভাষায় ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন, কানাডার শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন এবং কানাডার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ শ্রমবাজারের, বিশেষ করে উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমশক্তির চাহিদা পূরণে সহায়ক হতে পারে’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
তবে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার Surrey সিটিতে অবস্থিত অগ্নিহোত্রী ইমিগ্রেশন কনসালটিং-এর পরিচালক এবং ওয়ান ভয়েস কানাডার সহ-প্রতিষ্ঠাতা অগ্নিহোত্রী গ্লোবাল নিউজকে বলেন, ‘এটি হলো সাংস্কৃতিক অভিঘাতজনিত। তাঁরা কানাডায় এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যবস্থার মধ্যে পড়ে, এখানকার সামাজিক ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা সবকিছুই ভিন্ন।’
‘কানাডায় আসা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সচরাচর কোনও রকম সহায়তার ব্যবস্থা থাকেও না। কারও কারও থাকে, কারো কারো একেবারেই থাকে না।’
রিপোর্টে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাঁদের ভাষায়, কানাডাজুড়ে আত্মহত্যায় মৃত্যুর মর্মান্তিক প্রবণতার বিষয়টি। তাঁদের আত্মহত্যার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম, ‘শিক্ষার্থী রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ায় ব্যাপক প্রতারণা ও দুর্নীতি’, উচ্চ টিউশন ফি এবং এক ‘গোপন অর্থনীতি’ যেখানে শিক্ষার্থীরা অবৈধভাবে কাজ করে এবং তাঁদের নিয়োগদাতা কর্তৃক সুবিধা নেওয়ার শিকার হয়।
অগ্নিহোত্রী বলেন, ‘প্রতারণার শিকার হলে তাদের কোথাও যাবার উপায় থাকে না, কোথাও পালিয়ে যেতেও পারে না, তাদের কিছুই করার থাকে না।’
২১ বছর বয়সী অমরিন্দ্র সিং-এর ক্ষেত্রেও এটাই ছিলো দুঃখজনক বাস্তবতা। তার বন্ধু সুখপ্রীত সিংয়ের তথ্যমতে, অমরিন্দ্র গত সেপ্টেম্বরে আত্মহত্যা করে।
বন্ধুর লাশ ভারতে ফেরত পাঠানোর জন্য সুখপ্রীত গোফান্ডমি নামে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়। সুখপ্রীত বলেন, ডগলাস কলেজের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অমরিন্দ্র চরম আর্থিক চাপের মধ্যে ছিলো। মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কোনও সহায়তাও সে পায়নি।
শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারা দাপিন্দর সিং বর্তমানে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার Surrey-তে একটি খালসা (শিখ) স্কুলে কর্মরত। তিনি বলেন, এই চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগপর্যন্ত গত বছর তিনি এক অন্ধকার জগতে বাস করছিলেন।
গ্লোবাল নিউজকে তিনি বলেন, ‘এই খালসা স্কুল আমাকে আবারও ওড়ার মতো ডানা দিয়েছে।’
তিনি বলেন, মহামারি তাকে কঠিন আঘাত হেনেছে। সরকারি অর্থসহায়তা তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। তিনি ছিলেন বিচ্ছিন্ন, তার মা ভারত থেকে এখানে আসার পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হন এবং পুরো ঘটনায় মূহ্যমান হয়ে পড়েন। দাপিন্দর বলেন, তাঁর স্টাডি পারমিটের মেয়াদ শেষ হবার পর ওয়ার্ক পারমিটের জন্য আবেদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তিনি হারিয়েছেন যা তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়িয়ে দেয়।
‘এটা এমন সময় ঘটে যখন আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম, আমার এই জীবনের কী অর্থ? আমি এখানে কী করছি?’
এখন দাপিন্দর বলছেন, তার জীবনের ঘটনাবলি সেইসব শিক্ষার্থীদের জন্য আশার সঞ্চার করবে যারা এখনও সংগ্রাম করে চলেছেন। তিনি বলেন, তার সাফল্যের চাবিকাঠি ছিলো মানুষের সঙ্গে কথা বলা।
‘এখানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা যেন একটি বাহিনীর নিঃসঙ্গ সৈনিক, কারণ তাদেরকে শুধু তাদের কাঁধের ব্যাগে নয় মস্তিষ্কেও বহু জিনিস একা বয়ে নিতে হয়,’ গ্লোবাল নিউজকে বলেন দাপিন্দর।
ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ছাত্র গুরকিরাত সিং। গত বছর তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং এখন একটি ক্রাইসিস লাইনের স্বেচ্ছাসেবক। তিনি বলেন, কানাডায় বসবাসকারী তার চাচার সহায়তা ও নির্দেশনা না পেলে তার অবস্থা অনেকটাই ভিন্নতর হতে পারতো।
‘আমার মনে হয়, আমাকে একটি সত্যিকার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে শেষ হয়ে যেতে হতো,’ বলেন গুরকিরাত।
‘আমি কানাডায় আসি ২০১৫ সালে এবং তারপর থেকেই আমরা এই প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি যা দিনের পর দিন বাড়ছিলো। কারণ, প্রতি দুই বা তিন মাস পর পরই কোনও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পাওয়া যাচ্ছিলো, আর সেটি ছিলো উদ্বেগজনক।’
তিনি বলেন, মহামারি অনেক শিক্ষার্থীকে চরম অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ সময় তিনি একাকীত্ব, অতিরিক্ত চাপ অথবা দুশ্চিন্তার সঙ্গে লড়াই করে যাওয়া যে কাউকে সাহায্য নিতে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করেন।
‘আমরা ক্রইসিস লাইনে খুব বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কল পাই না। এটা হতে পারে এজন্যে যে, এ ধরণের ক্রাইসিস লাইনের অস্তিত্ব সম্পর্কে তারা খুব একটা জানে না।’
ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার স্টুডেন্টস ফেডারশন সব শিক্ষার্থী বিশেষ করে বিদেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য বর্ধিত মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী উভয়ের ক্ষেত্রেই এখন ক্যাম্পাসে পরামর্শ দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকার সময় অত্যধিক দীর্ঘ।
ওয়ান ভয়েস কানাডা ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কালের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী কর্মসূচির ওপর সমীক্ষা করা, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ফি নিয়মিতকরণ ও কমানো এবং শিক্ষাঙ্গনে বিশেষায়িত পরিষেবা খাতে তহবিল ও প্রশিক্ষণ বাড়ানোর জন্য প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছে।
‘আমরা সব শিক্ষার্থীর কল্যাণের বিষয়ে যত্নশীল। আমি ওয়ান ভয়েস কানাডার প্রকাশিত রিপোর্ট ও সুপারিশমালাকে স্বাগত জানাই।’ বিসির অগ্রসর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যান কাঙ এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, আগের সরকারের সময় বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা অবাধে দ্রুত বাড়ানো হয়েছে যা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদেরকে বেশুমার চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে।’
প্রাদেশিক সরকার বলেছে, তারা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অভিজ্ঞতা উন্নয়নের জন্য একটি কৌশল প্রণয়নে কাজ করছে।
কানাডা সরকার ওয়ার্ক পারমিটের ক্ষেত্রে সাময়িক কিছু পরিবর্তন এনেছে যাতে তারা মহামারির আগের কোর্স সম্পন্ন করার জন্য অতিরিক্ত ১৮ মাস সময় পাবে। তবে শিক্ষার্থীদের পক্ষের লোকেরা বলছেন, এই সময় যথেষ্ট নয়।
হিয়ার-ট-ুটক (Here2Talk) নামে মাধ্যমিকোত্তর শিক্ষার্থীদেরকে জন্য এই প্রদেশের একটি মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা রয়েছে। কোনও অ্যাপ, টেলিফোন অথবা অনলাইনে এক বৈঠকের এই পরিষেবা দেয়া হয় এবং তার গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। এটি দিনরাত সুলভ এবং পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন ভাষায় এই পরিষেবা নেওয়া সম্ভব।
এদিকে ভ্যাস্কুভার সান পত্রিকা তাদের এক রিপোর্টে জানায়, কানাডা এবং বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা কেবল যে উচ্চতর গ্রেড অর্জনের জন্য চাপে থাকে তা নয়। অনেকেই ক্রমশ বেশি বেশি আশা করতে থাকে তাদের বেছে নেওয়া দেশটিতে স্থায়ী বাসিন্দা হবার যাতে তারা পরে তাদের বাবা-মা ও পরিজনকে এখানে আসার জন্য স্পন্সর করতে পারে।
একটি ভিন্ন দেশে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইরত অনেক তরুণ শিক্ষার্থীর মনে এই প্রবল আশাবাদের কারণেও তাদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তাদের সবচেয়ে কাক্সিক্ষত গন্তব্য কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনে।
দ্য চায়না ডেইলি পত্রিকায় সম্প্রতি ‘বিদেশে অধ্যয়নরত বহু চীনা আত্মহত্যার করছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছেপেছে যাতে বলা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়ন ও কর্মরত তিন লাখ ৩০ হাজার চীনা শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ভয়ানকভাবে বেড়েছে।
চীনের বৃহৎ এই পত্রিকাটিকে অনেকে সেদেশের সরকারের নীতিনির্দেশক বলে মনে করেন। পত্রিকাটি সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি চীনা শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ খুঁজে বের করার আহবান জানিয়েছে। এটি কি তাদের ‘ব্যর্থতার এবং বাবা-মাকে হতাশ করার ভয়’ থেকে ঘটছে নাকি ‘সম্পূর্ণ একাকী লড়াই করে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট একাকীত্বের কারণে’ ঘটছে?
গত বছর রিচমন্ডের তরুণ বিদেশী শিক্ষার্থী লিনহাই ইয়ুর আত্মহত্যার পর মেট্রো ভ্যাঙ্কুভারের ৫৩ হাজার চীনা শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যার ব্যাপকতায় ভ্যাঙ্কুভারের চীনা কাউন্সেলর জেনারেলও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কাউন্সেলর জেনারেল জুয়ান ঝেং বলেন, ‘চীনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এধরণের ঘটনার হার খুবই উঁচু।’
ভ্যাস্কুভার সান আরো জানায়, বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার দুঃখজনক ঘটনা জানা যাচ্ছে সারা কানাডা এবং বিশ্ব থেকেই। চলতি শরতে অন্টারিওর একজন ভারতীয় শিক্ষার্থী অজেশ চোপরার আত্মহননের জন্য কানাডার অভিবাসন দপ্তরকে অভিযুক্ত করেন তার বন্ধুরা। কারণ, দপ্তরটি তাকে আরও বেশিদিন কানাডায় থাকার জন্য ওয়ার্ক পারমিট দেয়নি। সারা বিশ্ব থেকে একই ধরণের ঘটনার খবর বিদেশি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যগত চাপের উচ্চ ঝুঁকির বিষয়টি স্পষ্ট করে দেয়।
এদিকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়ানক মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা অব্যাহতভাবে বাড়ার পাশাপাশি তাদের সংখ্যা নজীরবিহীনভাবে বাড়তে থাকায় রাজনীতিক ও শিক্ষা প্রশাসনের লোকজন খুশিতে আটখান। কারণ এই শিক্ষার্থীরা স্থানীয় অর্থনীতিতে ও শিক্ষাদানকারীদের বেতন খাতে শত শত কোটি ডলার ঢালছে।
উচ্চতর শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার দীর্ঘ সময় ধরেই গুরুতর পর্যায়ের। ব্রিটিশদের এক রিপোর্টে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতি চারদিনে একজন আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এদের মধ্যে বড় অংশই পুরুষ শিক্ষার্থী।
ভ্যাস্কুভার সানের রিপোর্টে বলা হয়, বাইরের দেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবেগগত চাপ আরও বেশি চরম পর্যায়ের বলে জানিয়েছেন অস্ট্রেলীয় গবেষকরা। এই গবেষকরা বিদেশি শিক্ষার্থীদেরকে একাকীত্ব, আবাসন, ভাষা, শিক্ষা ও অভিবাসী মর্যাদার বিষয়গুলো নিয়ে যে কঠিন আবেগগত চাপের মুখে পড়তে হয় সে বিষয়ের তত্ত্বতালাশে কানাডীয় পেশাজীবীদের চেয়ে এগিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার মৃত্যুর তথ্য সংরক্ষণ কর্মকতা, কন্স্যুলেটসমূহ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈদেশিক শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর বিস্তারিত তথ্য চেপে রাখে বলে জানা গেলেও দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার আগে স্বীকার করেছিল যে, কোনও এক বছরের ১২ মাস সময়কালের মধ্যে ৫১ জন বিদেশি শিক্ষার্থী মারা গেছে। তবে ওইসব মৃত্যুর প্রধান কারণ যে আত্মহত্যা ছিলো সেটি তদন্ত করে বের করেছিলো বাইরের তদন্তকারীরা।
অস্ট্রেলিয়ার জার্নাল অব সাইকোলজির এক গবেষণায় দেখা যায়, চীনা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা তাদের অস্ট্রেলীয় প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেকটাই বেশি উচ্চ পর্যায়ের মানসিক চাপে ভোগে। শিক্ষামন্ত্রী সিমন বার্মিংহাম চলতি বছর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদেরকে আরও ভালো সহায়তা দেওয়ার আবেদনের প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিয়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমন্বিত তথ্য-উপাত্ত বিস্তারিতভাবে প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ার সমাজবিজ্ঞানী হেলেন ফরবেস-মেওয়েট উদ্ঘাটন করেছেন যে, অনেক বাবা-মা এমন ধারণা থেকে তাদের মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত সন্তানকে বিদেশে পাঠান যে, সংশ্লিষ্ট দেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা তাদের নিজ দেশের চেয়ে ভালো। মোনাশ ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক বলেন, কিন্তু বাড়তি চাপ এবং মানসিক রোগ সম্পর্কে ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক খারাপ ধারণা বিদেশি শিক্ষার্থীদের নাজুকতা জটিলতর করে তোলে।
অন্যদিকে নিউ কানাডিয়ান মিডিয়ার এক রিপোর্টে বলা হয়, আর্থিক টানাপড়েনের প্ররোচনা, ফেল করা পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগ এবং সাংস্কৃতিক আঘাত এসবই হলো কানাডায় ভারতীয় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ, যাকে অনেকে বলছেন, এক ‘অস্বস্তিকর প্রবণতা’।
এইসব চাপের সঙ্গে যোগ হয়েছে কোভিড-১৯ এর তাণ্ডব। তবে এক্ষেত্রে সহায়তা পাওয়ার সুযোগ আছে।
২০২০ সালে ছয় জন ভারতীয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন, আর এ বছর আত্মহনন করেছেন দুজন। সম্প্রতি কানাডায় ভারতীয় হাইকমিশনার অজয় বিশারিয়া সহযোগ কানাডা Sahyog Canada আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এ তথ্য জানান। সহযোগ কানাডা একটি সামাজিক উদ্যোগ যা ভারতীয় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদেরকে আপদকালীন সহায়তা দেয়।
আত্মহননের অনেক ঘটনা জানা যায় না
মন্ট্রিয়লের নেতৃস্থানীয় এনেস্থেসিউলজিস্ট ডা. দ্বিবেদী বলেন, তার ধারণা, আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের যে তথ্য প্রকাশ পায় তা ‘হিমবাহের শিখর’ মাত্র। প্রকৃত সংখ্যা ‘উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হতে পারে, কারণ অনেক মৃত্যুর ঘটনা জানানো হয় না, নিশ্চিত করা হয় না অথবা বিভিন্ন সংস্থা ও বন্ধুদের দ্বারা নিষ্পন্ন করা হয়ে যায়।’
তার এই সংশয় সম্পর্ক নিশ্চয়তা দেন ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক এমিরিটাস ড. অমরেশ শ্রীবাস্তব।
সাংবাদিক এবং অভিবাসন, নৈতিকতা ও বৈচিত্র্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডগলাস টড-এর মতে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বিষয়টি নিয়ে খুব সামান্যই আলোচনা হয়। ডগলাস এ বিষয়ে বই লিখেছেন ২০১৯ সালে। টড বিসির মৃত্যুর তথ্যাবলি সংরক্ষণ পরিষেবার কাছ থেকে (ঈড়ৎড়হবৎং ঝবৎারপব) যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন তাতে দেখান যে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ওই প্রদেশে কমপক্ষে ১৫ জন বিদেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলো তরুণ। এ তথ্য জানা যায় নিউ কানাডিয়ান মিডিয়ার সূত্রে।
শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ মানসিক চাপ
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে আর্থনৈতিক দুরবস্থা, সাংস্কৃতিক অভিঘাত, দুর্বল স্বাস্থ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্বল ফলাফল এবং সামাজিক সহায়তার অভাব। বললেন ড. শ্রীবাস্তব। তিনি অন্টারিওর লন্ডনে অবস্থিত লাওসন হেল্থ রিসার্চ ইন্সটিটিউটের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিজ্ঞানীও।
তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যেসব মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার মুখোমুখি হয় তার মধ্যে মানসিক চাপ হলো সবচেয়ে বড় উপাদান।’
নিউ কানাডিয়ান মিডিয়া’র সূত্র থেকে আরো জানা যায়, এ বিষয়ক একটি বইতে বলা হয়েছে, কানাডার জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষা একটি লোভনীয় ব্যবসা। কিন্তু ভারত থেকে আসা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য এটি এক বিরাট অর্থনৈতিক বোঝা, বিশেষ করে যখন অনেক পরিবার টাকা ধার করে তাদের সন্তানকে কানাডায় পাঠায়।
‘এই অর্থনৈতিক বোঝা সামলে নিতে অনেক শিক্ষার্থী অবৈধভাবে কাজ করে। এটি তাদেরকে এক বিপন্নতার মধ্যে ঠেলে দেয়, অনেকেই শ্রম শোষণের শিকার হয়। মেয়ে শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা বিশেষ ভাবে বিচলিত হবার মত বিষয়, কারণ এটি তাদেরকে যৌন নিগ্রহের শিকার পরিণত করে।’