টরেটক্কা টরন্টো

সামাজিকতা ও ধর্মপালন -৭

সম্ভবত সেটা ছিল ১৯৭৮ কিংবা ১৯৭৯ সাল। ঢাকার লালমাটিয়ার বিবি মসজিদের কম্পাউন্ডের ভিতর একটি নতুন সাইন বোর্ড আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সেখানে বড় করে লেখা ছিল – ‘মসজিদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা’। আর সেটার নীচে ছোট করে লিবিয়া সরকারের অনুদানের কথা উল্লেখ ছিল। যেহেতু সেই সাইন বোর্ডটা ছিল আমাদের বাসার ঠিক পেছনের গলিতেই, তাই যেতে আসতে সব সময়ই সেটা আমার চোখে পড়ত। আমার কিশোর মনে ‘মসজিদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা’ কথাটা গেঁথে গিয়েছিল যদিও সেটার যে কী অর্থ তা কিন্তু আমার কাছে পরিস্কার ছিল না। তবে এটা বুঝতে পারতাম যে এখানে এমন সমাজ গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে যার কেন্দ্র হবে মসজিদ। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব হবে না সেটার কোন কার্যক্রম অবশ্য চোখে পড়ত না। সেই সময়টাতে আবার লিবিয়ার নেতা মোয়াম্মার আল গাদ্দাফীর লেখা ‘কিতাবিল আখদার’ কিংবা ‘দ্য গ্রীন বুক’-এর বাংলা সংস্করণ ‘সবুজ গ্রন্থ’ বাংলাদেশে পাওয়া যেত। শোনা যায় বাংলাদেশের বিখ্যাত চিন্তাবিদ আহমেদ ছফা নাকি এই বইয়ের অনুবাদের সাথে জড়িত ছিলেন। আজ এত বছর বাদে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সেই ‘মসজিদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা’-এর সাথে ‘সবুজ গ্রন্থ’-এর কোন যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে। যা হোক আমার কিশোর মনে গেঁথে থাকা ‘মসজিদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা’-এর ব্যবহারিক রূপ দেখতে পাই টরন্টোতে এসে পরিণত বয়সে।

মসজিদের সংখ্যাধিক্যের কারণে ঢাকাকে যদি ‘মসজিদের শহর’ বলা হয়ে থাকে তবে টরন্টোকে বলতে হয় ‘চার্চের শহর’। কারণ এই শহরের আনাচে কানাচে রয়েছে অনেক চার্চ, বিশেষ করে ডাউন টাউন এলাকায়। যদিও কালের পরিক্রমায় ওল্ড স্টক কানাডিয়ানদের বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই আর চার্চমুখী নন, ফলে দৃষ্টিনন্দন সেই চার্চগুলো আজ শুধু টরন্টো শহরের শোভা বর্ধনের কাজটুকুই করে আসছে। তবে বিশেষ কিছু নব্য ইমিগ্র্যান্ট গোষ্ঠী যেমন আরব খৃস্টান, ক্যারাবিয়ান, ফিলিপিনো কিংবা সাউথ কোরিয়ানদের কারণে বেশ কিছু চার্চ আবার নতুন জীবন ফেরৎ পেয়েছে। সুদূর অতীতে এক সময় ক্যাথলিক চার্চ ইউরোপের সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করত কিন্তু কালের পরিক্রমায় চার্চের সেই ক্ষমতা এখন হ্রাস পেয়েছে। রবিবারের বিশেষ প্রার্থনা অধিবেশন বা সার্ভিসের মধ্যেই চার্চের কার্যক্রম আজকাল সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে এই টরন্টো শহরেই আবার মুসলিম ইমিগ্র্যান্টদের কারণে নতুন নতুন মসজিদের গোড়া পত্তন শুরু হয়েছে। কানাডার প্রথম মসজিদ ‘আল-রশীদ মস্ক’ এডমনটনে ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৬৯ সালের আগ পর্যন্ত টরন্টোতে কোন মসজিদ ছিল না। সেই সময় ডান্ডাস ওয়েস্ট রোডের একটি পরিত্যক্ত লেদার শপকে যদিও মসজিদ হিসেবে চালানো হত কিন্তু তার ধারণ ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত কম। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আজ থেকে প্রায় তিপ্পান্ন বছর আগে ১৯৬৯ সালে বলকান বা আলবেনিয়ান কমিউনিটির একদল মুসলমান ‘হাইপার্ক প্রেসবাইটেরিয়ান’ নামক একটি চার্চকে কিনে সেটাকে ‘জামি মস্ক’ নামক মসজিদে রূপান্তরিত করে। আলবেনিয়ান কমিউনিটি এই মসজিদ প্রতিষ্ঠার আগে ১৯৬১ সালে ‘মুসলিম সোসাইটি অব টরন্টো’ বা সংক্ষেপে ‘এমএসটি’ নামের একটি সংগঠন তৈরি করে। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ডঃ মির্জা বেগ তার ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে তদকালীন সৌদী আরবের বাদশাহ ফয়সল কাছ থেকে মসজিদ প্রতিষ্ঠা প্রকল্পের জন্য কিছু অনুদান আনতে সমর্থ হন। ‘এমএসটি’ সেই অনুদানের অর্থের সাথে নিজেদের কমিউনিটির লোকদের দেয়া চাঁদার টাকা যোগ করে এবং বাকীটা ব্যাংক লোনের মাধ্যমে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার ডলারের বিনিময়ে চার্চটি কিনতে সমর্থ হয়। কিন্তু মসজিদ চালু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কমিটির ভেতর শুরু হয় আভ্যন্তরীণ কোন্দল যা কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। ইতিমধ্যে মির্জা বেগকে কমিটি থেকে অপসারণ করা হয় এবং ব্যাংক লোনের টাকায় মসজিদ প্রতিষ্ঠা করাটা সহীহ নয় বিধায় মসজিদটিকে বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ মসজিদের সামনে খোলা চত্বরে বরফের ভেতর শূন্য ডিগ্রী তাপমাত্রায় তেরোজন মুসল্লি নিয়ে মির্জা বেগ নামায আদায় করে নিউজ পেপারের ফ্রন্ট পেজের খবরে চলে আসেন। তার বক্তব্য হচ্ছে মসজিদ কখনোই মুসল্লিদের জন্য তার দুয়ার বন্ধ করতে পারে না। উল্লেখ্য যে ডঃ মির্জা বেগ ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে ইসলামিক স্টাডিজের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে যুক্ত ছিলেন। নতুন কমিটি গঠনের মাধ্যমে সেই কোন্দল এক সময় মিটে যায়। সেই সময় সেটাই ছিল প্রায় পাঁচ হাজার মুসল্লির জন্য টরন্টোর একমাত্র মসজিদ। তখনকার সময়ে ‘জামি মস্ক’ মসজিদটি তবলীগ জামাতের লোকেদের দ্বারা পূর্ণ থাকত। সত্তুর দশকের প্রথম ভাগে একদল গুজরাটি সুন্নী মুসলিম ‘জামিয়াতুল মুসলেমিন অব টরন্টো’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন এবং সেই সংগঠনের পক্ষ থেকে জেরাড স্ট্রীটে একটি বেইজমেন্ট ভাড়া করে সেখানে মুসাল্লা চালু করেন। একটি বড় আকারের মসজিদ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা ধীরে ধীরে ফান্ড রেইজ করা শুরু করেন এবং ১৯৮৩ সালে সাত লক্ষ ডলারে ড্যানফোর্থ এলাকায় ‘সেকেন্ড চার্চ অব ক্রাইস্ট, সায়েন্টিস্ট’ নামক একটি চার্চকে কিনতে সমর্থ হন। সেই চার্চকে যখন ‘মদিনা মস্ক’ নামক মসজিদে রূপান্তরিত করা হয় তখন টরন্টোর মুসলমানদের দীর্ঘ দিনের একটি স্বপ্ন পূর্ণ হয়। তবলীগ জামাতের লোকেরাও তখন ‘জামি মস্ক’ ছেড়ে এই ‘মদিনা মস্ক’-কে চলে আসেন এবং সেখানেই তাদের সেন্টার গড়ে তুলেন।

কানাডার প্রথম মসজিদ ‘আল-রশীদ মস্ক’, এডমনটন, ১৯৩৮ (ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে)

টরন্টো শহরে একটি নতুন মসজিদ তৈরি করা সহজ কোন কাজ নয়। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিস্কার হবে। মিসিসাগার মেয়র বনি ক্রম্বি ২০১৫ সালে সিটি কাউন্সিলের মিটিং-এ একটি নতুন মসজিদ তৈরির প্রস্তাবের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেন। তার যুক্তি ছিল, মসজিদ তৈরি হলে এলাকায় ট্রাফিক এবং নয়েজ বাড়বে, সেই সাথে বিভিন্ন ধরনের ক্রাইমও বাড়বে আর এটা হচ্ছে কানাডিয়ান ভ্যালুজের জন্য ক্ষতিকর। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলু-এর স্কুল অব আর্কিটেক্ট-এর মাস্টার্স লেভেলের বাংলাদেশী-কানাডিয়ান ছাত্র সাদমান আহমেদ তার ‘কনটেমপোরারি চ্যালেঞ্জেজ অব ইসলামিক আইডেনটিটি ইন কানাডা’ প্রবন্ধে বিশদভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কানাডাতে মসজিদ তৈরির ইতিহাস। তার এই প্রবন্ধে ফুটে উঠেছে প্রতিটি মসজিদ তৈরির পিছনে কী ধরণের প্রতিকূলতা ছিল সেগুলোর বিশদ বর্ণনা। আর্কিটেক্টচারাল ভিউ পয়েন্ট থেকে তিনি প্রথমেই মসজিদগুলিকে দুইটি ভাগে ভাগ করেছেন, একটি হচ্ছে পারপাস-বিল্ট অর্থাৎ মসজিদ তৈরির উদ্দেশ্য নিয়েই মসজিদটি তৈরি করা আর অপরটি হচ্ছে রিপারপাসড মস্ক, যখন কোন চার্চ কিংবা ওয়্যারহাউসকে মসজিদে রুপান্তরিত করা হয়। পারপাস-বিল্ট মসজিদগুলো ট্রাডিশনাল ইসলামিক স্থাপত্যশৈলী অনুসারে তৈরি করা হয় যা মেইনস্ট্রীম কানাডিয়ানদের কাছে যে খুব গ্রহণযোগ্য তা কিন্তু নয়। ফলে সিটি কাউন্সিল থেকে পারমিশন পেতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়। সাদমান আহমেদের প্রবন্ধটি ‘জার্নাল অব দি সোসাইটি ফর দি স্টাডি অব আর্কিটেকচার ইন কানাডা’-এর ভলিউম ৪৫, নাম্বার ২, ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠকগণ পড়ে দেখতে পারেন।

সাস্কাচুয়ান এবং ম্যানিটোবার প্রেইরী অঞ্চলে বড় হওয়া কানাডিয়ান মুসলিম মহিলা ফিল্মমেকার যারকা নাওয়াজ ‘লিটল মস্ক অন দি প্রেইরী’ টাইটেল দিয়ে একটি টেলিভিশন সিরিয়াল তৈরি করেন ২০০৭ সালে সিবিসি চ্যানেলের জন্য। সাস্কাচুয়ানের একটি কল্পিত ছোট্ট শহর মার্সি, যেখানে অ্যাঞ্জেলিক্যান চার্চের একটি ফ্লোর ভাড়া করে সেখানকার ক্ষুদ্র মুসলিম কমিউনিটি একটি মসজিদ স্থাপন করে। মসজিদের ইমাম এবং চার্চের প্যাস্টরের উদার মনোভাব কীভাবে সেই শহরের মুসলমান এবং খৃস্টানদের প্রাত্যহিক জীবনধারাকে প্রভাবিত করে সেটাই হাস্যরসের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই টিভি সিরিয়ালটিতে। তুমুল সাড়া জাগানো এই সিরিয়ালটি মেইনস্ট্রীম কানাডিয়ানদেরকে মুসলিম জীবনধারার সাথে কিছুটা হলেও পরিচিত করে তুলে। যারকা নাওয়াজ অবশ্য এর আগে ২০০৫ সালে ‘মি এন্ড দি মস্ক’ টাইটেলে আরেকটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন যেখানে তিনি মুসলিম মহিলারা মসজিদে কী কী অসুবিধার সম্মুখীন হন সেই বিষয়ে আলোকপাত করেন। বাংলাদেশে আমরা মনে করি যে মসজিদ শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য। আমি ১৯৮৭ সালে চীনের রাজধানী বেইজিং-এ গিয়ে প্রথম দেখতে পাই মসজিদে মেয়েদের জন্য আলাদা জায়গা রয়েছে। নর্থ আমেরিকার মসজিদগুলোতে মেয়েদের জন্য আলাদা প্রেয়ার স্পেস থাকে। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে মসজিদে মেয়েদের জন্য সুযোগ-সুবিধার কিছু ঘাটতি থেকে যায় যা কিনা ‘মি এন্ড দি মস্ক’ ডকুমেন্টারিতে ফুটে উঠেছে।

আমি যখন ২০০৬ সালে টরন্টোতে আসি তখন এই শহরে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বড় মসজিদ তৈরি হয়ে গেছে যার ভেতর ‘নাগেট মস্ক’-এর নাম বেশ শোনা যেত। কারণ এটা শুধু মসজিদই নয়, এর সাথে স্কুলও রয়েছে। এছাড়া আমাদের প্রথম আবাসস্থল ক্যারাবব কোর্ট সংলগ্ন শেপার্ড এবং বার্চমাউন্ট ইন্টারসেকশনের একধারে স্ট্রিপ মলের দোতলায় ছিল ‘নামিরা মস্ক’ যেখানে আমি জুম্মার নামাজ এবং তারাবীর নামাজের জন্য যেতাম। নামিরা মস্কটি ছিল ছোট আকারের মসজিদ যার প্রেমেসিসটি ছিল একজন ল্যান্ডলর্ডের কাছ থেকে ভাড়া নেয়া। পরবর্তীতে ল্যান্ডলর্ড লিজ রি-নিউ না করাতে নামিরা মস্ককে অপেক্ষাকৃত আরও ছোট প্রেমিসিসে স্থানান্তরিত হতে হয়। সেই হিসেবে নাগেট মস্কের অবস্থান অনেক বেশ শক্ত, কারণ এটি একটি পারপাস-বিল্ট মস্ক। নিজস্ব জমির উপর মিনার দেয়া বিরাট প্রেমেসিস। ভেতরের ডেকোরেশনও সুন্দর, মেইন প্রেয়ার হলের সিলিং থেকে দামী শ্যান্ডেলিয়ার ঝুলানো। মাল্টি লেভেল পার্কিং লটের সুবিধা। তবে নাগেট মস্ককে এই অবস্থানে আসতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। মূলত টরন্টোর স্কারবরো এলাকার মুসলমানদের বিশেষ করে পাকিস্তানি এবং গুজরাটি মুসলমানদের প্রচেষ্টায় এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়। টরন্টোতে আমার প্রথম রমযানে তারাবীর নামাজ নামিরা মসজিদে আদায় করলেও ২৭শে রমযানের তারাবীতে গিয়েছিলাম নাগেট মসজিদে। সেখানে যখন নামাজের মাঝখানে একটু বিরতি নেয়া হলো ডোনেশন কালেকশনের জন্য তখন আমি ভেবেছিলাম আমাদের বাংলাদেশের মতন লাইন কালেকশন হবে। কিন্তু আমার ধারনাকে ভুল প্রমাণ করে শুরু হলো ডোনেশন ড্রাইভিং স্পীচ যা ছিল আমার জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা। কারণ এর আগে আমি বাংলাদেশ কিংবা সিঙ্গাপুর, মালেয়শিয়াতে এ ধরণের কার্যক্রম দেখেনি। সিঙ্গাপুর অথবা মালেয়শিয়ার মসজিদগুলির নির্মাণ ব্যয় এবং অপারেটিং কস্ট যেহেতু সরকার বহন করে তাই সেখানকার মসজিদগুলোকে এই নিয়ে ভাবতে হয় না। বাংলাদেশের ব্যাপার কিছুটা আলাদা। অনেক ধনাঢ্য লোকেরা নিজেদের উদ্যোগেই তাদের এলাকাতে মসজিদ গড়ে দেন এবং তার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করে থাকেন। তাছাড়া ধর্মভীরু মানুষেরা স্বপ্রণোদিত হয়েই মসজিদের দানবাক্সে টাকা-পয়সা আবার অনেকক্ষেত্রে সোনাদানাও দান করে থাকেন। কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের দানবাক্সগুলি প্রতি তিন-চার মাস পর পর খোলা হয় এবং সেখানে নাকি কোটি কোটি টাকা ছাড়াও ডলার, পাউন্ড এমন কি সোনার অলঙ্কার পর্যন্ত পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশে এক শ্রেণীর মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে নিজেদের আখের গুছানোর কাজে। এরশাদ আমলের ধর্ম মন্ত্রী আব্দুল মান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি নাকি অনৈতিকভাবে বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলো থেকে চাঁদা নিয়ে ইনকিলাব নামক একটি দৈনিক পত্রিকা বের করেন।

যাই হোক, নাগেট মসজিদের সেই দিনের তারাবী নামাজ থামিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী ডোনেশন ড্রাইভ আমার কাছে অস্বস্তিকর লেগেছিল। যে জিনিষটা আমার কাছে বেশী অবাক লেগেছিল সেটা ছিল অনেকটা নিলাম ডাকার মতন করে যখন বিভিন্ন অংকের ডোনেশন চাওয়া হচ্ছিল। আমরা জেনে এসেছি ইসলামে বলা হয়ে থাকে যে, তোমরা এমনভাবে ডান হাতে দান করবে যেন বাম হাতও টের না পায়। কিন্তু এই নিলাম ডেকে ডোনেশনের পক্ষে অনেকে এই বলে ব্যাখ্যা দেন যে আমাদেরকে সৎ কাজের জন্য প্রতিযোগিতা করতে বলা হয়েছে। তবে আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে এই দান করাটা যেন লোক দেখানো কিংবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে না হয়ে থাকে। সুরা বাকারার ২৬২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তা’য়ালা আল্লাহ্র পথে দান করার পর সেটা নিয়ে বড়াই করা কিংবা অন্য কাউকে কষ্ট দিতে স্পষ্টতই মানা করে দিয়েছেন। পরে অবশ্য দেখেছি যে এটা শুধু নাগেট মসজিদ বলেই নয়, টরন্টোর প্রায় সব কয়টি মসজিদ একইভাবে ডোনেশন কালেকশন করে থাকে। কারণ এই শবে কদরের রাতে তারা যে পরিমান ডোনেশনের প্রতিশ্রুতি পান তা দিয়ে তাদের সারা বছরের খরচের সংস্থান করতে হয়। পরবর্তীতে আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই টরন্টোর নর্থ ইয়র্কের আবু হুরাইয়া মসজিদে নিয়মিত জুম্মার এবং তারাবীর নামাজ পড়া শুরু করি। টরন্টোর সোমালিয়ান কমিউনিটির উদ্যোগে এই মসজিদটির গোড়াপত্তন হলেও এখানে বিভিন্ন কমিউনিটির লোকজনেরা নামাজ পড়ার জন্য আসে। বিশেষ করে এই মসজিদে দেশ বিদেশ থেকে আসা নামকরা ইসলামিক স্কলারদের লেকচার আমাদের কাছে বেশ ভালো লাগত। ডঃ বেলাল ফিলিপ্স এই মসজিদে নিয়মিত লেকচার দিতেন। কিন্তু এক সময় এই মসজিদের জনপ্রিয় সোমালিয়ান ইমাম সাইয়েদ রাগি তার বৈবাহিক জটিলতার কারণে সোমালিদের কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠেন, ফলশ্রুতিতে তাকে ইমামের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। তিনি নিজেই তখন স্কারবরোতে একটি পুরানো ওয়্যারহাউস কিনে সাকিনা মসজিদ তৈরি করেন এবং আবু হুরাইয়া থেকে একদল মুসল্লি তখন তার সাকিনা মসজিদে যোগ দেন। একজন ইমাম তার ব্যক্তিগত কারণে আরেকটি মসজিদ তৈরি করার মাধ্যমে মুসল্লিদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করাটা কতখানি যৌক্তিক তা ইসলাম বোদ্ধারা ভালো বলতে পারবেন। হাদীসে উল্লেখ আছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে মসজিদ তৈরি করবে আল্লাহ্ তা’য়ালা তার জন্য বেহেস্তে অনুরূপ গৃহ নির্মাণ করবেন (সহীহ বুখারী ৪৫০, সহীহ মুসলিম ৫৩৩)। এই হাদীসকে রেফার করে অনেক সময় নতুন মসজিদ তৈরির সময় মুসল্লিদেরকে গোটা মসজিদের একটি জায়নামজ পরিমান ব্যয় বহন করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। কিন্তু আমাদেরকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে মসজিদটি যেন একমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই তৈরি হচ্ছে, কোন ব্যক্তি বিশেষ বা কোন সংগঠনের নিজস্ব কোন উদ্দেশ্য পূরণে যেন তৈরি না হয়। ব্যক্তি কিংবা সংগঠন বিশেষের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মসজিদটি তৈরি হলে তা কিন্তু আমাদের ভেতর কোন্দল আর বিভেদই সৃষ্টি করবে। পবিত্র কোরানের সুরা আল ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তা’য়ালা আমাদেরকে পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন হতে মানা করেছেন।

আমি ২০০৬ সালে টরন্টোতে আসার পর আমার প্রথম কর্মস্থল ছিল ঠিক ব্লোর এবং ইয়াং-এর ইন্টারসেকশনে অবস্থিত বে বিল্ডিং-এর একদম টপফ্লোরে। লাঞ্চ আওয়ারে ব্লোর অথবা ইয়াং স্ট্রীটে হেঁটে বেড়ানো আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এ রকম হেঁটে বেড়ানোর সময় ২০০৯ সালের দিকে আমার নজরে আসে ইয়াং স্ট্রীটের উপর একটি শপের দোতলায় ‘টরন্টো ইসলামিক সেন্টার’ লেখা একটি ব্যানার। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম যে এটি একটি মসজিদ। প্রায় দুই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে কিছু উদ্যোগী মানুষ এই মসজিদটি চালু করেছেন যার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে দাওয়াহ। নন-মুসলিমদের মাঝে বিতরণের জন্য এখানে বিনা মূল্যে বিভিন্ন ধরণের ইসলামিক বইয়ের প্যাকেজ রাখা থাকত। এছাড়া এদের নিজস্ব পাবলিকেশনও প্রচুর। ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও বিভিন্ন ধরণের ইসালামিক বই তারা প্রকাশ করে থাকত। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর সেখানে ‘দি ম্যাসেজ’ নামের একটি বাংলা নিউজ লেটার বিতরণ করা হত যেখানে আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশী কমিউনিটির সদস্যেরা কীভাবে তাদের সন্তানদেরকে ইসলামের শিক্ষা দিয়ে লালন পালন করবেন সেটার উপর জোর দেয়া হত। এখন সেই নিউজ লেটারটি আর হয়ত প্রকাশিত হয় না, তবে তারা ইতিমধ্যে ইনস্টিটিউট অব ফ্যামিলি ডেভেলপমেন্ট প্রকাশনীর মাধ্যমে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট, ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট এবং প্যারেন্টিং-এর উপর প্রচুর বই প্রকাশ করেছেন। আমির জামান এবং নাজমা জামানের লিখিত ‘আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে হজ্জ ও উমরাহ’ বইটি দ্বারা আমি বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছি ২০১৮ সালে পবিত্র হজ্জ পালন করার সময়। তাদের প্রকাশিত বইগুলি সম্পর্কে জানতে চাইলে আগ্রহীজনেরা ‘যঃঃঢ়://িি.িঃযবসবংংধমবপধহধফধ.পড়স/’ ওয়েবসাইটে খোঁজ করে দেখতে পারেন। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

টরন্টো