কোভিড বিশ্বে অমিক্রন নামে নতুন আতংক

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

আমাদের একবিংশ শতাব্দীর এই পৃথিবী যেন সুস্থ হয়েই উঠছে না। চীনের উহান প্রদেশ থেকে আসা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে করোনা ভাইরাস সমস্ত পৃথিবীকে বিধ্বস্ত লন্ডভন্ড তছনছ করেই চলেছে আর মৃত্যুর মিছিলে আমাদের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব আর ভালবাসার মানুষের নাম সংজোযন করে তালিকা দীর্ঘায়িত করেই যাচ্ছে প্রতিদিন। গত দুই বছর ধরে চলা একের পর এক নতুন-নতুন করোনা ভাইরাসের তান্ডবের  প্রকোপ গত কয়েক মাস ধরে পৃথিবী জুড়ে কমে আসছিল। কানাডায় কভিড-১৯ টিকা (ফাইজার- মডার্না- এস্ট্রেজেনিকা) দুই ডোজ করে নেবার পর কভিড আক্রান্ত সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ে চলে এসেছিল আর কেউ কেউ আক্রান্ত হলেও হাসপাতালে ভর্তি হবার আশংঙ্কা থেকে মুক্ত ছিল। ২০২১ সালে ওন্টারিওতে ৯০.৬% সিংগেল ডোজ এবং ৮৮% ডাবল ডোজ ভেক্সিন পেয়ে যাবার সুফলে মুটামুটি ভাবে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। অন্যান্য প্রভিন্সেও মোটামুটি একই পরিস্থিতি বিরজমান ছিল।

এখন পর্যন্ত কানাডায় লোকজন ৮০% এক ডোজ আর ৭৬%  দুই ডোজ টিকা পেয়েছ। মুখে মাস্ক বেঁধে আর সেইফ ডিস্টেন্স মেনে চলে ব্যবসা বাণিজ্য স্কুল-কলেজ, সরকারি আফিস- আদালত (সীমিত আকারে), পরিবহন ব্যবস্থা অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গিয়ে ছিল। রেস্টুরেন্ট, বার, জিম, থিয়েটার, স্টেডিয়ামগুলো পুরোপুরি খুলে গিয়েছিল।

মন্ট্রিয়লে করোনার ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যেও লোকজন লাইনে অপেক্ষা করছেন। ছবি : গ্রাহাম হিউজ/কানাডিয়ান প্রেস

কিন্তু গত নভেম্বরের প্রথম দিকে সাউথ আফ্রিকার প্রেটোরিয়া’র লেন্সেট নামক ল্যাবরটিরির এক ল্যাব টেকনিশিয়ান কভিডের এক নতুন ধরনের ভাইরাস সনাক্ত করে যার নাম Omicron Variant। যেটা আগের যে কোন (বেটা-আলফা -গামা -ডেল্টা) ভাইরাসের তুলনায় আরো দ্রুতগতিতে ছড়ানোর ক্ষমতা রাখে। নতুন ভেরিয়েন্ট ঠেকাতে কানাডা- আমেরিকাসহ অনেক দেশ আফ্রিকার সাতটি দেশের সাথে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আজ ২০ ডিসেম্বর/২১,পর্যন্ত পৃথিবীর ৮৯ দেশে ওমিক্রন সনাক্ত হয়েছে এবং ভয়ংকর দ্রুত গতিতে সংক্রমণ হচ্ছে। গতকাল ২২ ডিসেম্বর/২১ থেকে নেদারলেন্ডে নেশন ওয়াইড লক ডাউন শুরু হয়েছে। আমেরিকা এবং  কানাডা  ইজরাইলের সাথে  সকল বিমান চলাচল  বন্ধ করে দিয়েছে গত বুধবার। আমেরিকায় এক সপ্তাহ গড়ে প্রতিদিন রোগীর সংখা প্রায় ১৫০,০০০ এবং প্রতিদিন মৃত্যু হচ্ছে ১৪৫০ জনের। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের রিসার্চ টিম এক বার্তায় জানিয়েছে আগামী বছর জানুয়ারী-মার্চ পর্যন্ত ১৪০ মিলিয়ন রোগী হতে পারে। প্রতিদিন ইনফেকশন হতে পারে ১৪০ মিলিয়ন। বর্তমানে ৭১% রোগী অমিক্রন ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত। আজ ২৩ডিসেম্বর /২১ আমেরিকায় নতুন রোগী ২৪৪,০০০ এবং মোট রোগী ৫২,৭৪৪,৪৫১। এদের মধ্যে ৬৭% ডাবল ডোজ ভেক্সিনেটেড। রোগী ৪৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। মৃত্যু ৮৩৪,৪৫৫।  আমেরিকাতে মাত্র ৬১% ডাবল ডোজ ভেক্সিনেটেড।

কানাডাতে আজ রোগীর সংখ্যা ১৪,৯৮৭, মৃত্যু ২৮। মোট রোগী ১,৯৪৫,৭৫৪, মৃত্যু সংখা ৩০,১৩১।

গ্রেট বৃটেন মোট রোগী ১১,৭৬৭,২৬২, মৃত্যু ১৪৭,৭২০।

বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী বরিস জনসন আজ ২৪ ডিসেম্বর/২১ জাতির উদ্দ্যেশে  বলেছেন অমিক্রনের আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আসুন সবাই ভেক্সিন নিয়ে নেই। এটা প্রথম দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় যেটাই হোক। আপনি নিজে বাঁচুন প্রিয়জনকে বাঁচতে দিন।  

গত ২১ ডিসেম্বর থেকে চীনের উত্তর পশ্চিম প্রদেশ  Shaanxi তে সম্পূর্ন ভাবে লক ডাউন জারী করা হয়েছে। প্রদেশের ১৩ মিলিয়ন নাগরিকদের মধ্যে যাদের বাড়ীর বাইরে আসা অত্যন্ত  জরুরী প্রয়োজন  তারা  বাইরে আসতে পারবে দুইদিন পর মাত্র একবার। ব্যবসা, বাণিজ্য পরিবহন কল-কারখানা অফিস-আদালত যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

২৩ ডিসেম্বর/ কানাডার অন্টারিও প্রভিন্সে নতুন আক্রমণের সংখ্যা ছিল ৫৭৯০ এবং কুবেক প্রভিন্সে ৯৩৯৭।

আজ ২৪ ডিসেম্বর অন্টারিওতে নতুন রোগীর সংখ্যা গিয়ে দাড়িয়েছে ৯৫৭১ যা গতকালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন এবং গত দুই বছরের পেন্ডামিক ইতিহাসে সর্বাধিক।  গত সপ্তাহে  ওন্টারিও হেলথ তাদের বার্তায় এমনই এক অশনি সংকেত দিয়ে জানিয়েছিল যে  রোগীর সংখা প্রতিদিন ১০,০০০ হতে পারে। যা আজ প্রমানিত হল। ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট  ভয়ংকর ভাবে বৃদ্ধির কারণে কুইবেক প্রভিন্সে গতকাল ২২ ডিসেম্বর থেকে বার, জিম এবং স্টেডিয়াম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

ওমিক্রন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ছড়ানোর ফলে কানাডা আমেরিকা ইউরোপ সহ অনেক দেশে স্বাস্থ্য বিভাগ এবং এয়ার লাইন্স প্রতিষ্ঠানে কর্মী স্বল্পতার দারুন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে আজ আমেরিকার প্রায় ২৫০টি ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায়। পৃথিবীব্যপী সাপ্লাই চেইন ভেংগে পরার কারণে  প্রয়োজনীয় খাদ্য সমগ্রীসহ অনেক দ্রব্যের মূল্য বেড়ে গিয়েছে। করোনার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও স্ক্রিনিংয়ের জন্য শ্রমিক স্বল্পতার কারণে চীন কোন ভাবেই তাদের পূর্ব নির্ধারিত সময়ে মালামাল রফতানি করতে পারছে না।

কানাডা -বৃটেন এবং আমেরিকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মী স্বল্পতার কারণে যাদের সম্ভাব্য কভিড কেইস এবং খুব সাধারণ উপসর্গ (সর্দি-জ্বর- হাঁচি -কাশি ) ধরা পরেছে তারা সাত দিন আইসলেশন থেকে কাজে ফিরে যেতে পারবে। বড় দিন এবং নতুন বছর উপলক্ষে  টরন্টোতে বিভিন্ন জায়গায় টেস্ট কিট (যা থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেজাল্ট জানা যায়) বিতরণের কার্যক্রম চলছে। টরন্টোর ইউনিয়ন স্টেশনে প্রচন্ড শীতের ভিতর তিন চার ঘন্টা লাইনে দাড়িয়েও শত শত মানুষ  টেস্ট কিট পায়নি। ঘন্টা খানিকের মধ্যেই কয়েক হাজার কিটস বিতরণ শেষ হয়ে যায়। একই  ঘটনা ঘটেছে  টরন্টোর বিভিন্ন স্কুলে। হাজার- হাজার মানুষের লাইন ছিল ভোর রাত থেকে, অনেকেই খালি হাতে ফিরেছেন।

অন লাইন বা ফোনে বুস্টার শট এর অপয়েন্টমেন্ট প্রায় করাই যাচ্ছে না। সেকারণেই বিভিন্ন স্কুল, ফার্মেসি, কমিউনিটি সেন্টারে এবং মলে মানুষের উপচে পরা ভীড় দেখা যাচ্ছে বুস্টার ডোজ নেবার জন্য।

এশিয়াতে ওমিক্রনের ভয়াবহতা এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি। এটার ভয়ংকর  আক্রমণ আমেরিকা কানাডা এবং ইউরোপের মধ্যেই রয়েছে।

ধনী দেশগুলোতে আমরা অনেকেই এক দুই এবং তৃতীয় ডোজ পেয়ে গিয়েছি। অপর দিকে আফ্রিকা এশিয়াসহ দরিদ্র দেশগুলোতে ভেক্সিন সর্টেজ থেকেই যাচ্ছে। তারা অর্থাভাবে ভেক্সিন কিনতে পারছে না। কভিস্ক থেকে বিনা মুল্যে কয়েক মিলিয়ন জনসন এন্ড জনসন ভেক্সিন গত অক্টোবর মাসে আফগানিস্তানে পাঠানো হয়েছিল যেগুলোর এক্সপাইরি ডেট ছিল মাত্র দুই মাস। আফগানিস্তান সাফল্যের সাথে সেই ভেক্সিনগুলো ব্যবহার করতে পেরেছিল। কিন্তু নাইজিরিয়াতে  উন্নত দেশগুলো থেকে কয়েক মিলিয়ন ভেক্সিন পাঠানো হয়েছিল। সেই ভেক্সিন গুলো মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত  ভেলেডিটি ডেট থাকার কারণে লক্ষ লক্ষ ভেক্সিন ব্যবহার করা যায়নি। ফলে ওগুলো গার্বেজ করা হয়। উন্নত বিশ্বের কাছে স্বাস্থ্য বিষেশজ্ঞদের আর্জিবার্তা – শুধু মাত্র নিজেদের সুরক্ষা দিলেই চলবে না, তাতে করে নতুন-নতুন ভেরিয়েন্ট এর আক্রমণ থেকে বাঁচা যাবে না, যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীর সব দেশ সমান ভাবে ভেক্সিন পেয়ে সুরক্ষার আওয়ায় না আসে। ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট ডেন্টা ভেরিয়েন্ট তার উজ্বল দৃষ্টান্ত। মাত্র মাস খানিক সময়ের মধ্যে পৃথিবীর এক প্রান্তের (সাউথ আফ্রিকা) রোগ পৃথিবী অন্য প্রান্তে পৌঁছে গিয়ে পৃথিবীতে আরেক নতুন আতংক তৈরী করেছে। আজ ২৪ ডিসেম্বর/২১ পর্যন্ত পৃথিবীর ১১০ দেশে অমিক্রন ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পরেছে। কাজেই নিজের দেশকে (উন্নত বিশ্ব) সুস্থ রাখতে হলে নিজেদের গরজেই পৃথিবীর অন্যান্য দেশকেও সাথে সাথে সুস্থ রাখতে হবে। এর বিকল্প যে নেই সেটাই প্রমানিত হচ্ছে বার বার। কানাডার প্রধান মন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অমিক্রন সংক্রমণের ভয়াবহতা নিয়ে স্বাস্থ্য বিষয়ক এক বার্তায় জাতির উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘এখন কোন ভ্রমণের সময় নয়। অতি প্রয়োজন না হলে কেউ দেশ ছাড়বেন না।’  কানাডা এখন অমিক্রন ভেরিয়েন্টের আক্রমণে বিধ্বস্ত। গত এক সপ্তাহ ধরে অন্টারিওতে রোগীর সংখ্যা যেভাবে দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেটা চলতে থাকলে নতুন বছরের শুরুতে নানা ধরনের বিধিনিষেধ সহ আবারো লক ডাউন আসতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। তবে এই প্রচন্ড অস্থির সময়ের মধ্যে সুখবরটি হলো অমিক্রন ভেরিয়েন্টটি ডেলটার মতন ভয়ংকর নয়। জ্বর -ব্যথা- কাঁশি  এটার প্রাথমিক উপসর্গ। অমিক্রন আক্রমনে হাসপাতাল পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক রোগীকে যেতে হয়েছে। তবুও আসুন আমরা সবাই Stay Safe- Stay Alert and Maintain Social Distance এই নীতিতে চলি আমাদের সবারই স্বার্থে।

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

টরন্টো