বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারে হার আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৬ বছরে বাংলাদেশের ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি বছর পাচার হচ্ছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি।
জিএফআইর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২টি প্রক্রিয়ায় এই টাকা পাচার হয়েছে। এর মধ্যে আছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং)। কিন্তু এই প্রতিবেদনটি ২০১৫ সালের তথ্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। কারণ এ সময়ের পর জাতিসংঘকে বৈদেশিক বাণিজ্যের কোনো তথ্য দেয়নি বাংলাদেশ।
অবশ্য জিএফআইয়ের তথ্য আস্থায় নিতে রাজি নন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থপাচারের প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ।
বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদন বলছে, প্রধানত ১০টি দেশ এই অর্থপাচারের বড় গন্তব্যস্থল। দেশগুলো হলো কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড।
সন্দেহ নেই, পাচারকারীদের অন্যতম পছন্দের দেশ কানাডা। এই পাচারকারীদের কেউ কেউ দেশে বিপদে পড়লে কানাডায় এসে আশ্রয় নেন। সাম্প্রতিক সময়ে সর্বাধিক আলোচিত পি. কে. হালদারসহ আরো কয়েকজন কানাডায় এসে আশ্রয় নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, টাকা পাচারের বিষয়ে বাংলাদেশের সরকার অবহিত থাকলেও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কারণ প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীদের অনেকেই এই অর্থ পাচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি দেশের অনেক ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবীসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত।
ধারণা করা হয়, গত ১৬ বছরে যে পরিমাণ অর্থপাচারের কথা বলা হচ্ছে, তা বাংলাদেশের সর্বশেষ দুই অর্থবছরের মোট বাজেটের কাছাকাছি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ঢাকার কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারে যে তথ্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রকাশ করছে, সেটাও আংশিক। বাস্তবে পরিমাণ আরো অনেক বেশি। অনেক বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করেন। তাঁরা আয়ের বড় একটা অংশ অবৈধভাবে বিদেশে পাঠান। এটাও অর্থপাচার। এই তথ্য কিন্তু বৈশ্বিক সংস্থাগুলো উল্লেখ করে না।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, গত বছর শেষের দিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে.আব্দুল মোমেন বলেছিলেন কানাডায় টাকা পাচারের ২৮টি ঘটনার তথ্য পেয়েছে সরকার। তারও আগে কানাডায় এই টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে প্রায় মাসব্যাপী বিক্ষোভ হয়েছিল ফেসবুকে এবং বাঙ্গালী অধ্যুষিত ড্যানফোর্থ এর রাস্তায়। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে টাকা পাচারকারীদের কেউ কেউ হুমকীও প্রদান করেছিল।
অপ্রিয় বাস্তবতা হলো, এই টাকা পাচারকারীরা দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার অভ্যন্তরে থাকা কিছু অসাধু ব্যক্তির ‘স্নেহের’ ছত্রচ্ছায়ায় থাকার কারণে সবসময়ই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে সরকারের কোন উদ্যোগ, সাধারণ মানুষের কোন আন্দোলন এর কোনটাই কোন কাজে দিচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে যদি স্বচ্ছতা না আসে, যদি সুদ্ধি অভিযান না চালানো হয় এবং নেপথ্যে থাকা কালো টাকা পাচারকারীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতাদেরকে যদি আইনের আওতায় নিয়ে আসা না যায় তবে টাকা পাচার বন্ধে সরকারের কোন উদ্যোগই সফল হবে না।