শিক্ষাঙ্গনে যৌন সহিংসতা বিষয়ে ‘সম্মতি’ বিষয়ক কোর্স প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু শিক্ষার্থী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরও বেশি কিছু দরকার
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : গত সেপ্টেম্বরে অন্টারিও’র ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ওরিয়েন্টেশন উইকের সময় যৌন হামলার চারটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগের পর সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া অভিযোগের এমন ঝড় বয়ে যায় যা ছিলো রীতিমত হতবুদ্ধিকর। এরপর ক্যাম্পাসে যৌন সহিংসতা, শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের সংস্কৃতির নিন্দা জানিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে বিশাল পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
“দুটি সপ্তাহ ছিলো সত্যি কঠিন সময়,” বলেন ছাত্রনেতা মিস ইউনিস ওলাডেজো। এরপরও ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টস কাউন্সিলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইউনিস ওলাডেজো যিনি সম্প্রতি রাজনীতি বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তার লন্ডনের শিক্ষালয়ে ও তার বাইরে যে জটিল আলোচনা চলছে তা অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, “এগুলো এমন কোনও বিষয় নয় যা কেবল ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতেই ঘটছে, অনেক শিক্ষাঙ্গনেই এগুলো ঘটছে।”
ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি যৌন সহিংসতার বিষয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে এবং নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে যেমন, শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা এবং আরও বেশি সংখ্যক নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দেয়া। যা ঘটেছে তা মাধ্যমিক-উত্তর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলমান যৌন সহিংসতার সমস্যা এবং প্রতিষ্ঠানগুলো এই বিষয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্টাফদের শিক্ষিত করার জন্য কী করছে সে প্রসঙ্গে অন্যান্য স্থানেও নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে।
শিক্ষাঙ্গনে যৌন সহিংসতা সম্পর্কে মাধ্যমিক-উত্তর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে নীতিমালা প্রযোজ্য তা বিভিন্ন প্রদেশে এবং প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন। কিছু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও স্টাফদের জন্য যৌনতায় ‘সম্মতি’ (যৌনকর্মে যোগ দেয়ার জন্য বিপরীত পক্ষের স্বেচ্ছামূলক ও সুস্পষ্ট সম্মতি।) বিষয়ে বাধ্যতামূলক কোর্স থাকলেও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো স্বেচ্ছামূলক কর্মশালা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনওটিতে যৌন সহিংসতার বিষয়গুলি দেখার জন্য যে লোকবল নিযুক্ত আছে তার সংখ্যা কোনও প্রতিষ্ঠানে হয়তো ১০ জন, কোনওটিতে একজন।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার ২০২০ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, এর আগের বছর ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনাকাক্সিক্ষত যৌন আচরণের মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে ক্যাম্পাসে এবং ক্যাম্পাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘটিত ঘটনার পরিসংখ্যানও ধরা হয়েছে। আর এসব ঘটনায় বিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী অথবা অন্য কেউ জড়িত।
সমীক্ষায় অংশ নেয়া প্রতি ১০ জন নারীর একজন বলেন, তারা যৌন হামলার শিকার হয়েছেন। কিন্তু যৌন হামলার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র আট শতাংশ নারী ও ছয় শতাংশ পুরুষ এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও কাছে অভিযোগ করেছেন। কেউ কেউ বলেন, তারা বিষয়টিকে অভিযোগ দেওয়ার মত গুরুতর ভাবেননি; অন্যরা বলেন, তারা জানতেন না এ নিয়ে কী করা যেতে পারে কিংবা সংশ্লিষ্টরা কীভাবে বিষয়টি সামলাবেন সে বিষয়ে তারা বিদ্যালয়ের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি।
ওলাডেজো বলেন, “এসব নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখা জরুরী কারণ আমরা চাই না বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হোক।” শিক্ষাঙ্গনে যৌন সহিংসতার বিষয়ে অন্টারিও সরকার যেন কঠোর নীতি গ্রহণ করে সে প্রশ্নে আন্দোলনকারী অন্টারিওর আন্ডারগ্রাজুয়েট স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্সের প্রেসিডেন্ট হিসাবেও বাড়তি দায়িত্ব পালন করছেন ওলাডেজো। তিনি বলেন,“আমরা নিশ্চিতভাবেই চাপ অব্যাহত রাখতে চাই।”
বাধ্যতামূলক কোর্স ‘এক জোরালো বার্তা’
২০১৫ সাল থেকে অন্টারিও, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, ম্যানিটোবা, প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড ও কুইবেক এই সব প্রদেশই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন সহিংসতা বিষয়ক স্বতন্ত্র নীতিমালা প্রণয়ন বাধ্যতামূলক করে আইন পাস করে; নোভা স্কশিয়াও এই ধারণা গ্রহণ করে।
ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে নীতিমালা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় যৌনতায় সম্মতি সম্পর্কে একটি বাধ্যতামূলক অনলাইন কোর্স চালু করা হয়, যার নাম দেয়া হয়, এটি আমাদের সবার জন্য প্রয়োজন: যৌন সহিংসতামুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তোলা (মন্ট্রিলের স্কুল কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটির অনুরূপ একটি কোর্সের ওপর ভিত্তি করে এই কোর্স তৈরি করা হয়)।
নতুন শিক্ষার্থী, অনুষদ সদস্য ও স্টাফের প্রত্যেককে এই কোর্স করতে হবে প্রতি শরতের একটি নির্দিষ্ট সময়ে। নবাগত শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন সপ্তাহের কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার অগেই এই কোর্স অবশ্যই সমাপ্ত করতে হবে, তার ওপর, এই কোর্স সম্পন্ন করা ছাড়া তারা তাদের পরবর্তী শীতকালীন ক্লাসের জন্য রেজিস্ট্রেশনও করতে পারবে না। জানান, ম্যাকগিলের ন্যায্যতা ও শিক্ষানীতি বিষয়ক সহযোগী প্রভোস্ট মিজ. অ্যাঞ্জেলা ক্যাম্পবেল।
তিনি বলেন, কোর্সটি বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি “আমাদের কমিউনিটির প্রতিটি সদস্যের কাছে জোরালো বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে যে, আমরা বিষয়টিকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি এবং
এটি আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের
কমিউনিটির সব সদস্যেরই যৌন সহিংসতা কী, সম্মতি কী এবং যৌন সহিংসতার ঘটনা প্রকাশ করতে কীভাবে কার্যকর ও সহানুভূতির সঙ্গে সাড়া দেয়া যায় সে বিষয়ে অন্তত একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে।”
ম্যাকগিলের শিক্ষার্থী ক্রিস্টাইন ওয়াং-এর কাছে কোর্সটি অত্যন্ত সংযত বলে মনে হয়েছে যদিও এ বিষয়ে এবং কোন শ্রেণির মানুষ যৌন সহিংসতার শিকার হবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকেতে আছে সে সম্পর্কে আগে থেকেই তার কিছু জানাশোনা ছিলো। কোর্সে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে, বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে এবং সবশেষে সহায়ক তথ্য ও জ্ঞাতব্য পরিবেশন করা হয়েছে।
ফিজিওথেরাপির মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ওয়াং বলেন, “ক্যাম্পাসের সংস্কৃতি পাল্টানোর ক্ষেত্রে এটি এক শুভ সূচনা।”
“সমর্থন দেবার জন্য, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী, যেমন ট্রান্সজেন্ডার, জাতিগত সম্প্রদায়ের এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সমর্থন দেয়ার ক্ষেত্রে আরও অনেক কিছু করার এখনও বাকি আছে।”
‘যৌন সহিংসতা জীবনের সব দিককে প্রভাবিত করে’
“যৌন সহিংসতা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন নয় বরং জীবনের সমস্ত দিককেই প্রভাবিত করে, তবে আমি মনে করি, আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে বিষয়টি বুঝতে পারে তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকা রাখতে পারে।” বলেন, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতা বিষয়ক সহকারী পরিচালক লিন্ডসে অ্যান্ডারসন।
ইউনিভার্সিটির কাউন্সেলিং সেন্টারের ব্যবস্থাপক এবং এই বিষয়ের আলোচনায় সহ-আয়োজক ব্রায়ান ম্যাকঅলে বলেন, “এটি এমন একটি বিষয় যা অনেকের জন্য, বিশেষ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী যারা ‘তাদের বাবা-মার নৈতিকতার আদর্শ থেকে সরে এসে নিজেদের আদর্শ গড়ে তুলতে শুরু করছে’, তাদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জের হতে পারে।”
বহুমুখি উদ্যোগ, যাতে ‘আনন্দপূর্ণ’ শিক্ষণও অন্তর্ভুক্ত
যৌন সহিংসতা নিয়ে গবেষণাকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ ও বিশেষজ্ঞরা একমত যে, শিক্ষাঙ্গনের সবাইকে এ বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলার জন্য বহুমুখি উদ্যোগের প্রয়োজন।
রায়ারসন ইউনিভার্সিটির, সবার আগে দরকার সম্মতি (Consent Comes First office) বিষয়ক দপ্তরের ব্যবস্থাপক ফারাহ খান বলেন, প্রতিটি প্রদেশ ও টেরিটোরিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যৌন সহিংসতা বিষয়ক নীতিমালা থাকা বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হামলার বিষয়গুলি দেখাশোনার জন্য আর্থিকভাবে স্বচ্ছল একটি দপ্তর ও যথেষ্ট সংখ্যক জনবল রাখা, কীভাবে তদন্ত ও ন্যায়বিচার বাস্তবায়ন হচ্ছে সে বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকা আর একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মীদের সুস্পষ্ট প্রশিক্ষণ এই সবই হলো সমস্যার জট খোলার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
মিজ. খান মাধ্যমিক-উত্তর শিক্ষালয়গুলোতে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা অবসানের লক্ষ্যে নেয়া জাতীয় প্রকল্প কারেজ টু অ্যাক্ট-এর সহযোগী পরিচালক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়েও যৌন সম্মতি বিষয়ক শিক্ষাদানের জন্য প্রদেশগুলোর প্রতি আহবান জানান, যাতে করে “বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ক্যাম্পাসে পা রাখার আগেই” এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে তোলা যায়।
তিনি বলেন, টরন্টোর কেন্দ্রে অবস্থিত এই শিক্ষাঙ্গনে যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষক সামান্থা বিটির উদ্যোগে নিয়মিতভাবে ‘সেক্সি সেক্সুয়াল হেলথ ট্রিভিয়া’ নামে নৈশ সমাবেশের আয়োজন করা হয় যেখানে শিক্ষার্থীরা যৌন সম্মতি বিষয়ে প্রশ্ন করতে এবং ইতিবাচকভাবে শিখতে পারে।
আরেকটি চলমান ও জনপ্রিয় উদ্যোগ হলো কৌতুহল নিবারণ কর্মশালা (Curiosity Labs)। এটি উইলফ্রিড লরিয়ের ইউনিভার্সিটির সহযোগে একটি উদ্যোগ যেখানে শিক্ষার্থীরা যৌন আনন্দ, সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা, সম্পর্কের ভাঙ্গন এবং প্রেমে প্রতারণার মত বিভিন্ন বিষয়ে আনন্দের পরিবেশে আলাপ-আলোচনা করার একটি অবকাশ পায়।
খান বলেন, এসব কর্মসূচির সার্বিক লক্ষ্য হলো যৌন সম্মতির বিষয়ে সচেতনতা এবং এ প্রসঙ্গে আলোচনার একটি অভিন্ন ভাষা গড়ে তোলা। সূত্র : জেসিকা উয়ং / সিবিসি নিউজ