ভােলা মন
শুজা রশীদ
মালতির বাসায় ওর মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রাসেল। মালতি তার দুঃসম্পর্কের বোন হয়। দেশে থাকতে খুব একটা যোগাযোগ ছিল না কিন্তু বছর দশেক আগে কানাডা এসে তার সাথে দেখা হবার পর থেকে খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। দুই পরিবারের কোন অনুষ্ঠানে কেউ বাদ যায় না। মেয়ের জন্মদিন প্রতি বছর ধুম ধাম করেই করে মালতি। এবার ষোল-তম, সুতরাং মহা ধুম ধাম যে হবে আন্দাজ করেছিল রাসেল। কিন্তু ষাট সত্তর জনের ভিড় আশা করে নি। তাকে দেখেই ছুটে এলো মালতি। ‘এতো দেরী করে এলে রাসেল ভাই? কেমন আছ মিতা ভাবী? রোজ! কি সুন্দর লাগছে তোকে সালওয়ার কামিজে! তাড়াতাড়ি এসো তোমরা। আগে কেকটা কেটে ফেলি। কে কখন চলে যায়। আমি চাই না কেউ কেক পর্বটা মিস করুক।’
মালতি সাধারণত কথাবার্তা একাই চালিয়ে যায়, অন্যেরা তার কথার তুবড়িতে ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা করলে সে বিরক্তই হয়। কিন্তু তারপরও সে সবার প্রিয় পাত্রী। মাসে মাসে শুধু পার্টি নয়, সে দরকারে অদরকারে সকলের খোঁজ খবর নেয়, কেউ অসুস্থ হলে দশ পদ রান্না করে ঘরে বয়ে খাবার দিয়ে আসে – মহিলারা মালতি ভাবী বলতে অজ্ঞান।
মালতি তাদের তিন জনের ছোট ক্যারাভানটাকে ভিড়ের ভেতর দিয়ে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে যেতে সকলের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে লাগল। অনেককেই চেনে তারা, তবে কিছু অপরিচিত পরিবারকেও দেখা গেল। লিভিং রুম পেরিয়ে মালতির বিশাল কিচেন এলাকায় আসতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মালতি। ‘জয়নাব ভাই! জয়নাব ভাই! দেখেন কে এসেছে!’
জয়নাব লম্বা চওড়া, শক্তিশালী দর্শন। একপাশে দাঁড়িয়ে জনা দুই ভদ্রলোকের সাথে আলাপ করছিল। মালতির চীৎকার শুনে তাকিয়ে রাসেলকে দেখেই সে মনে হল একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল। রাসেল মুচকি হেসে হাত নাড়ল। পাশে তাকালেই সে খেয়াল করত মিতা এবং রোজ, তার স্ত্রী এবং বারো বছরের মেয়ে, দু’জনার মুখ শুকিয়ে গেছে। জয়নাবকে দেখে তারা বিশেষ প্রীত হয়েছে বলে মনে হল না। জয়নাব আসতে দেরী করছে দেখে মালতি আবার ডাকল, ‘কি হল জয়নাব ভাই, আমার ভাইটাকে চিনতে পারছেন না? আপনারা না দু’জনে একই ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন? আমি তো শুনেছি আপনাদের গলায় গলায় ভাব ছিল।’
জয়নাব একটু দ্বিধা করে এগিয়ে এলো। গম্ভীর মুখে বলল, ‘কেমন আছিস রাসেল? ভাবী, কেমন আছেন? রোজ, স্কুল কেমন চলছে?’
মিতা এবং রোজ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করল। রাসেল হাসি মুখে বলল, ‘কি রে, কেমন আছিস? অনেক দিন দেখি কোন খোঁজ খবর নিস না? ভাবী কোথায়? তোর ছেলেটা এসেছে? ওতো বোধহয় এবার ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে।’
জয়নাব হাত মেলানোর চেষ্টা করে নি। রাসেল হাত বাড়িয়ে দিল। এবার হাত মেলাল দু’জন। মালতি বলল, ‘রাসেল ভাই, শুনেছ তো জয়নাব ভাই যে ভাইস প্রেসিডেন্ট অব সেলস হয়ে গেছে? তুমি তো তোমার কোম্পানিতে কত দিন ধরে কাজ করছ। তোমাকে ডিরেক্টর বানিয়ে বসিয়ে রেখেছে।’
রাসেল হাসি মুখে বলল, ‘আমি জানতাম জয়নাব ভিপি হবে। কংগ্রাচুলেশনস দোস্ত!’
জয়নাব ম্লান হেসে মিতা এবং রোজের দিকে অস্বস্তি নিয়ে তাকাল। রোজ হঠাৎ বলল, ‘আব্বুর আজকাল অনেক কিছু মনে থাকে না। তাই না আম্মু?’
মিতা বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, ইদানীং একটু ভোলামন হয়েছে। মালতি, আমার কিছু একটা খেতে হবে। ডায়াবেটিস আছে তো।’
মালতি খুব লজ্জা পেয়ে বলল, ‘দেখ তো, সব ভুলে বসে আছি। বয়েস হচ্ছে না? শুধু আমার ভাইটার দোষ দিয়ে কি হবে, আমি তো ওর চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট অথচ আমারই আজকাল কিচ্ছু মনে থাকে না। জিনিষপত্র কোথায় রাখি খুঁজেই পাই না। চল, চল, টেবিল ভর্তি খাবার। রাসেল ভাই, তোমরা দুই বন্ধুও এসো। আবিদা ভাবী কোথায় গেল? আসেন জয়নাব ভাই। একটু পরেই কেক কাটা হবে। টেবিলের সামনেই দুই বন্ধুতে দাঁড়িয়ে যান।’
জয়নাব মনে হয় সটকে পড়তে চেয়েছিল কিন্তু মালতি তাকে কোন সুযোগ দিল না। রাসেল কৌতূহলী মুখে বলল, ‘কি রে, তুই এমন চুপচাপ কেন? তুই তো হৈ চৈ করা মানুষ। ভিপি হয়েছিস বলে ডাঁট মারছিস না তো?’
জয়নাব লাজুক মুখে হেসে মাথা নাড়ল। ‘আরে না! কি বলছিস? গাল ভরা পদ। কাজ বেড়েছে, আর কোন লাভ হয় নি।’
মালতিকে অনুসরণ করে একটা মাঝারী আকারের গোলাকার টেবিলের সামনে এসে আরোও ডজন খানেক নারী পুরুষের সাথে জড় হল ওরা। টেবিলে বিশাল একটি চকলেট কেক। মালতির মেয়ের পছন্দের কেক। জয়নাব কিছুতেই সহজ হতে পারছে না। মাত্র বছর খানেক আগে রাসেলের সাথে যে ব্যবহার করেছিল তাতে দু’জনার মধ্যে আবার কখন কথাবার্তা হবে চিন্তাও করে নি সে। মালতির অবশ্য সেই ঘটনা জানার কথা নয়, যদি না রাসেলরা কিছু বলে থাকে। ঘটনা ঘটেছিল জয়নাবের বাসায় এক পার্টিতে, সেখানে মালতির পরিচিত কেউ ছিল বলে তার মনে পড়ে না। খুবই লজ্জাজনক ঘটনা। ভোলার মত নয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে রাসেলকে দেখে মনে হচ্ছে না তার সেসব কিছু মনে আছে। বেচারির কি সত্যি সত্যিই স্মৃতি লোপ পেতে শুরু করেছে?
মালতি ঝট করে কয়েক মুহূর্তের জন্য উধাও হয়ে গিয়েছিল। সে কোথা থেকে আবিদাকে ধরে নিয়ে এলো। রাসেলদেরকে দেখেই আবিদা কাঠ হয়ে গেল। মালতি হাসি মুখে বলল, ‘দেখেছ, কার সাথে কখন কোথায় দেখা হয়ে যায় কে বলতে পারে?তোমরা কথা বল আমি কেকটা কাটার ব্যবস্থা করি।’
মালতি হন্ত দন্ত হয়ে চলে গেল। আবিদা মিতার দিকে তাকিয়ে শুকনো মুখে বলল, ‘ভালো আছ মিতা? অনেক দিন পর দেখা হল।’
মিতার ইচ্ছা হল কড়া করে কয়েকটা কথা শোনায়। বছর খানেক যে তাদের সাথে দেখা হয়নি ভালোই ছিল। আজ মালতির এখানে এরা আসবে জানলে সে আসতই না। যদিও রাসেলের ব্যাবহারে সে যথেষ্ট অবাক হচ্ছে। ইদানীং এটা সেটা সে ভুলে যায় কিন্তু তাই বলে এতো বড় একটা ব্যাপার কেউ ভোলে?
কথাবার্তা বিশেষ একটা হল না। এক সময় খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশত ফলে পরিচিত অনেকেই উভয় পক্ষেরই বন্ধু। তেমন কয়েকজনকে পাওয়া গেল। সেই ন্যক্কারজনক ঘটনার সময় এরা কেউই ছিল না। বাঁচোয়া! রাসেল বেশ স্বাভাবিকভাবেই আলাপ জুড়ে দিয়েছে জয়নাবের সাথে, যেন দু’জনার মধ্যে কখনই কিছু হয় নি। জয়নাব এখনও হু হা করেই কাটিয়ে দিচ্ছে। মিতার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না রাসেল কোন এক অজ্ঞাত কারণে এমন একটা ভয়ানক ব্যাপার সম্পূর্ণ ভুলে গেলেও জয়নাব ভোলে নি। মানুষ ভুল করতে পারে। সেই জন্য তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে। এই বদমাশটা কখনও একটা ফোন পর্যন্ত করে নি।
কেক কাটা হল। সবাই একজোটে ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ গান গাইল। খাওয়া দাওয়া হল। ছেলেরা এক দিকে দল বেঁধে হৈ চৈ করে গল্প জুড়ে দিয়েছে। মিতা লক্ষ্য করল রাসেল এবং জয়নাব বেশ স্বাভাবিক ভাবেই আলাপ করছে। দেখে মনেই হচ্ছে না তাদের মধ্যে কোন সমস্যা আছে। আবিদা তার সাথে এসে আলাপ করবার চেষ্টা করল, বোধহয় স্বামীকে সহজ হতে দেখে তারও দ্বিধা কেটে গেছে। মিতা এড়িয়ে গেল। বাথরুমে গিয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। মালতি এসে ডাকাডাকি করতে বের হল।
পার্টি শেষ হবার আগেই রাসেলকে একরকম জোর করে বিদায় নিতে বাধ্য করল মিতা। তার আর সহ্য হচ্ছিল না। জয়নাবের সাথে খুব গলা মিলিয়ে হাসা হচ্ছে! আবিদা নিশ্চয় তাদেরকে নির্লজ্জ ভাবছে। রোজও মনে হল তার বাবার উপর খুব ক্ষেপে আছে।
গাড়ীতে উঠে বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে থাকল। শেষ পর্যন্ত মুখ খুলল মিতা। ‘ব্যাপারটা কি বলত? জয়নাব ভাই যে সবার সামনে তোমার গালে চড় মেরেছিল তোমার মনে নেই? তোমাকে দেখে মনে হল যেন কখন কিছু হয় নি।’
রোজ উত্তপ্ত কণ্ঠে যোগ করল, ‘আব্বু, তুমি কি সত্যিই সব ভুলে যাচ্ছ?’
রাসেল অবাক হয়ে বলল, ‘চড় মেরেছিল? একটু ঝগড়া ঝাটি হয়েছিল মনে আছে কিন্তু চড় থাপ্পড় মারার তো প্রশ্নই ওঠে না।’
মিতা রাগী গলায় বলল, ‘তুমি সত্যিই ভুলে গেছ? আমার সারা জীবনে আমি এতো অপমানিত হই নি। প্রমোশন নিয়ে কথা হচ্ছিল। তুমি মনে হয় ঠাট্টা করে বলেছিলে জয়নাব ভাই প্রমোশন পাবার জন্য বসদেরকে খুব তেলাচ্ছে। জয়নাব ভাই সেই কথায় হঠাৎ খুব রেগে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল, তুমি থামতে বলায় চটাস করে তোমার গালে একটা চড় মারল। তুমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলে। সেই সুযোগে ধাক্কা দিয়ে তোমাকে মেঝেতে ফেলে দেয়।’
রোজ তিক্ত কণ্ঠে যোগ করল, ‘জয়নাব আঙ্কেল তোমাকে একটা লাথিও মেরেছিল। আমার মনে আছে।’
মিতা গজরাতে গজরাতে বলল, ‘এতো বড় একটা ঘটনা কি করে ভুলে গেলে তুমি? ঐ বদমায়েশটার সাথে আবার হেসে হেসে কথা বলছিলে! ছিঃ ছিঃ!’
মাথা চুলকাল রাসেল। ‘তোমরা একটু বাড়িয়ে বলছ। বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে এই রকম একটু ঝগড়া ঝাটি হয়েই থাকে। ওসব মনে রেখে বসে থাকলে চলবে?’
মিতা মুখ শক্ত করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল। কিছু বলল না। রোজও তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকাল। সেও খুবই বিরক্ত রাসেলের ব্যবহারে।
রাসেল চুপি চুপি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। অযথা কথা বলে আরোও তিক্ততার সৃষ্টি করতে চায় না। পৃথিবীটা সোজা জায়গা নয়। টিকে থাকার জন্য মানুষকে কত কি করতে হয়। একটু স্মৃতি ভ্রম হওয়া তো কিছুই নয়। জয়নাব ভিপি হয়েছে, যার অর্থ তার হাতে এখন প্রচুর সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা চলে এসেছে। রাসেলের কোম্পানি তাদের সাথে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে। কিছু বড় সড় প্রজেক্ট এনে দিতে পারলে রাসেলও দ্রুত ভিপি হয়ে যেতে পারে। মালতিকে ব্যবহার করতে হয়েছে, সুতরাং তাকে সব খুলে বলতে হয়েছে। মিতা এবং রোজকে কিছু বলে নি। তারা বুঝবে কিনা সন্দেহ ছিল। সে নিঃশব্দে গাড়ি চালাতে থাকে।
শুজা রশীদ, টরন্টো