টান

গোলাম মোস্তফা আকন্দ

উনি প্রতি বুধবার বিকেল তিনটায় আমাকে ফোন করতেন। একই সময়ে। এর কোন হেরফের হতোনা। আমাকে ফোন করেই বলতেন, “ভাই, ডিস্টার্ব করলাম নাতো?”
: আরে নাহ! কি যে বলেন? আমি তো আপনার ফোনের অপেক্ষায়ই ছিলাম
: ফোনের অপেক্ষায় থাকেন কেন? আপনি নিজেও তো আমাকে একটা ফোন করতে পারেন।
: আমি তো আপনাকে ফোন করি; কিন্তু আপনার ফোন তো বিজি থাকে। বিশ্বাস করেন, একবারও কল ঢোকেনা।
অপর প্রান্ত থেকে উনি প্রসঙ্গ পাল্টায়। তারপর সেই চিরাচরিত জিজ্ঞাসা।
: কেমন আছেন বলেন? বাচ্চারা ভালো তো? বউ ভালো আছে?
: হ্যা, আমরা সবাই ভালো। আপনি কেমন আছেন?
: বোঝেনই তো বয়স হয়েছে। জীবনে সব চাওয়া পাওয়া শেষ। এখন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা আর কী।
ফোনে কথা বলার সময় আরো কত প্রসঙ্গ যে আসে তার ইয়ত্তা নাই। ইদানিং করোনা নিয়েই কথা হয় বেশী। করোনায় কোন দেশে কত লোক মারা গেল। ক্যানাডায় ভ্যাকসিনের হার কেমন। এখানে লকডাউন কবে থেকে শিথিল হবে। বাংলাদেশে করোনা এত শক্তিশালী হত না যদিনা ভারতে এর সিরিয়াস বিস্তার না ঘটত। তিনি আরো যোগ করেন, আমেরিকায় জো বাইডেন আসার পর করোনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফলে ক্যানাডায় তা নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়েছে। বাংলাদেশের পাশে বড় দেশ ভারতে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বাংলাদেশে তা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হত।
নিজের প্রসঙ্গে বলেন, ছেলেটা আর মানুষ হলনা। মেয়ে গুলো তাও মাঝে মাঝে খোঁজখবর নেয়, কিন্তু ছেলেটা একবারও কোন খোঁজ নেয়না। মাথাটা এখন পুরোই নষ্ট। করোনা যে কবে যাবে তখন জীবনটা একটু মুক্ত হবে।
এ রকম নানা বিশ্লেষণ চলতে থাকে। আমি বেশীরভাগ সময় শুধু শুনে যাই।
ওনার নাম আবিদুর রহমান। উনি একজন বয়স্ক মানুষ। সত্তরের ওপরে বয়স। একসময় দেশে-বিদেশে বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকুরী করেছেন। অনেক টাকা পয়সা কামিয়েছেন। কিন্তু রাখতে পারেন নাই। ওনার বাংলাদেশে খুব একটা থাকা হয় নাই। বঙ্গবন্ধুকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসেন। রিটায়ারমেন্টের পর বাংলাদেশে না গিয়ে ক্যানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
আমার বাবা যে বয়সে মারা যান, ওনার বয়সটা ঠিক সে রকমই। ওনাকে আমার বাবার মত মনে হয়। সে জন্য উনি আমাকে ফোন দিলে আমি ওনার কল কখনো মিস করিনা। ফোন দেয়ার পর পাক্কা দশ মিনিট কথা হয়। এর কোন হেরফের হয়না। তারপর তিনি ফোন রেখে দেন।
ক্যানাডার টরোন্টো শহরে আমি কিছু কমিউনিটি ওয়ার্ক করি। মানে বিনা পয়সায় মানুষকে হেল্প করার চেষ্টা করি। এগুলো করতে গিয়েই আবিদুর রহমান সাহেবের সাথে আমার পরিচয়। উনি একটা হেল্পের জন্য আমাকে একদিন ফোন দেন। সেদিন থেকে ওনার সাথে আমার যোগাযোগ শুরু। উনি বয়স্ক মানুষ, কিন্তু একা থাকেন। যখনই তিনি নি:সঙ্গ বোধ করেন, তখনই তিনি আমাকে ফোন দেন। দশ মিনিট কথা বলেন।
মানুষের নি:সঙ্গতা ক্যানাডায় এখন অনেক বড় একটি সামাজিক ব্যাধি। এখানকার মানুষ না খেয়ে মরে না, মরে নি:সঙ্গতা আর ভালোবাসার অভাবে। শুধু ক্যানাডা কেন, সব শিল্পোন্নত দেশেই এ অবস্থা। মানুষ শুধু অর্থের পিছনে ছুটছে আর ছুটছে। যেন সবাই ব্যস্ত। কারো জন্য যেন কারো একটু সময় নেই। ক্যাপিটালিজমের বাই প্রোডাক্ট হল এসব মানসিক রোগ।
আমার স্ত্রী লিজা বলে, আমি নাকি নিজের খেয়ে বনের মহিষ তারাই! ওর মুখ থেকে এ ধরনের কথা শোনা মাত্রই বাতাস ছাড়া বেলুনের মত আমি চুপষে যাই। দুই একদিন এরকম চলে, তারপর আবার ফুলেফেপে উঠি প্রবল শক্তি নিয়ে। আবারও মানুষকে হেল্প করার চেষ্টা করি। আমার বাবাও যথাসাধ্য মানুষকে হেল্প করার চেষ্টা করতেন। বাবার কাছ থেকেই হয়ত আমি এগুলো শিখেছি।
আবিদুর রহমান সাহেব আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। তারপরেও আমি ওনাকে ভাই বলেই ডাকি। চাচা বলতে ওনার বারন। তিনিও আমাকে নাম ধরে ডাকেন। টরোন্টোর একটি ভাড়া করা এপার্টমেন্টে একাই থাকেন। স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে অনেকে আগেই। তিনি স্বাধীনচেতা মানুষ। একা থাকতেই পছন্দ করেন। ছেলেমেয়েদের সাথে থাকতে তার নাকি ভালো লাগেনা। একাই বাজার করেন; রান্না বান্না করেন। আমাকে ফোন করে আমার সাথে একটু কথা বলেন। তার মতে, এতে নাকি তার একাকিত্ব কাটে। মনের মধ্যে ভালো লাগে। আর উনি যা বলেন, আমিও তা মনোযোগ দিয়ে শুনি। ভুল-ভাল বললেও তার প্রতিবাদ করিনা। কোন বিষয়ে নিজের মতামত ওনার ওপর চাপিয়েও দেইনা। উনি মাঝে মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য চান। আমি অকপটে যোগার করে দিয়ে দেই। যার ফলে তিনি আমাকে অত্যন্ত পছন্দ করেন।
আবিদুর ভাই আমাকে অনেকবার ওনার বাসায় যেতে বলেছেন। কিন্তু যেতে পারিনি। তার মূল কারণ করোনা ভাইরাস। কারণ উনি বয়স্ক মানুষ। কভিডের কাছে উনি অত্যন্ত ভালনারেবল। ওনাকে শুধু আশ্বস্ত করে আসছিলাম এই বলে যে,‘আবিদ ভাই, করোনা চলে যাক, তারপর যাব।’
এভাবেই চলছিল টেলিফোনে আমাদের যোগাযোগ ও বন্ধ্ত্বু।
তারপর হঠাৎ কয়েকমাস কোন যোগাযোগ নেই। উনি কোন ফোন করেননা। আমি ফোন করলেও উনি ধরেননা। আমার কাছে ওনার ঠিকানাও নেই যে আমি নিজে গিয়ে দেখা করবো। মনের মধ্যে খচখচানি ভাবটা যায়না। লোকটার কী হল। খুব মিস করতে লাগলাম আবিদ ভাইকে। এরকম করে সপ্তাহ চলে গেল। কোন খবর নেই ওনার। কাজের মধ্যে ডুবে থাকি। আমি ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছি ওনাকে।

এরপর হঠাৎ একদিন সকালে উনি আমাকে ফোন করে বসলেন। শনিবার। অফিস ছুটি। একটু বেশী ঘুমাবো এরকম প্লান ছিল। খুব অবাক হয়ে ফোনটা ধরলাম। কোন ভূমিকা না রেখে ওনার জিজ্ঞাসা।
: আপনি আজকে একটা উপকার করতে পারবেন?
: কী উপকার বলেন?
: আপনি আমাকে আপনার গাড়িতে করে আমার মেয়ের বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন? মেেয়টাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
আমি সে মুহুর্তে বলতে পারতাম, “আবিদ ভাই আপনি ফোন দিলেই তো আপনার মেয়ের জামাই আপনাকে নিয়ে যেতে পারে।”
কিন্তু বলা হয়নি। ওনার মেয়ে টরোন্টার পাশ্ববর্তি একটি শহরে থাকে। বহুবার সে কথা তিনি আমাকে বলেছেন। ওনার মেয়ের জামাই ওনাকে টরোন্টা থেকে মাঝে মাঝে নিয়ে যায়।
বললাম, পারবো, কখন যেতে চান, কখন আসবো?
ওপ্রান্ত থেকে তিনি বললেন, পারলে এখনি আসেন।
দ্রুত উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। কোন রকমে হাতমুখ ধুয়ে একটু নাস্তা খেয়ে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ওনার দেয়া ঠিকানা মোতাবেক ঘন্টা খানেকের মধ্যেই টরোন্টা ডাউনটাউনের কাছেই একটি এপার্টমেন্ট ভবনের কাছে পৌঁছে গেলাম।
ওনার কী হয়েছিল, কেন এতদিন যোগাযোগ করেন নাই- এসব প্রশ্ন করার কোন সুযোগই পেলাম না। চিন্তা করলাম গাড়িতে ওঠার পর প্রশ্নগুলো করবো। গাড়িটা পার্ক করে ওনাকে ফোন দিতে যাব এমন সময় একজন বয়স্ক লোক আমার গাড়ির জানালার পাশে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কামাল ভাই না?
বললাম, হ্যা।
সে বলল, আমি আবিদুর রহমান।
আমি বললাম, গাড়িতে ওঠেন। তারপর তিনি এসে আমার গাড়িতে চড়ে বসলেন।
আমার পাশে বসতে বললাম। কিন্তু বোধহয় উনি স্পষ্ট কানে শুনতে পেলেন না। পিছনের সিটে গিয়ে বসলেন। হাতটা বাড়িয়ে একটি সাদা কাগজে সুন্দর হাতের লেখায় ওনার মেয়ের বাসার ঠিকানাটা দিলেন। উনি গাড়িতে ওঠার পর গাড়িটি হঠাৎ একটি সুমধুর গন্ধে ভরে গেল। বকুল ফুলের মত গন্ধ। বকুল ফুলের গন্ধটা আমার খুব পছন্দ। আমি সাধারণত পারফিউম পছন্দ করিনা। পারফিউমে আমার প্রচন্ড এলার্জি। কিন্তু এ গন্ধে আমার সে রকম কিছু মনে হলনা।
চিন্তা করলাম ভদ্রলোক হয়ত নামাজ কালাম পড়েন। গায়ে আতর মেখেছেন।
আমি আবারও বললাম, “আবিদুর ভাই, আমার পাশে এসে বসেন। তাহলে আমাদের গল্প করতে সুবিধা হবে।”
উনি এবারও আমার কথায় তেমন কোন কর্নপাত করলেন না। শুধু বললেন, করোনার সময় একটু দুরে থাকাই ভালো।
টরোন্টো শহরে আমি অনেক মানুষকে ফ্রি রাইড দিয়েছি। কিন্তু ওনার মত এমন অদ্ভুত যাত্রী এর আগে কখনো দেখিনি। যাইহোক, পথিমধ্যে দুএকবার টুকটাক কথা হল। বুঝতে বাকি রইল না যে ওনার মুড ভালো নাই। কিছুক্ষন পর লুকিং গ্লাসে দেখলাম উনি পিছনের সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
ওনাকে আর বিরক্ত না করে আমি গাড়িতে এফএম রেডি অন করলাম। আলিশা কারা, জাস্টিন বিবার, ড্রেক -এদের গান শুনতে শুনতে ‘বেরি’তে পৌছে গেলাম।
বেরি শহরে পৌছতে ঘন্টা দুয়েক লেগে গেল। তারপর ওনার মেয়ের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পৌঁছে গেলাম। একটি ছিমছাম বাংলো বাড়ি। বাড়ির সামনের ড্রাইভ ওয়েতে কোন জায়গা খালি নেই। তিনটা গাড়ি পার্ক করা। কাজেই বাধ্য হয়েই আমি রাস্তার পাশে আমার গাড়িটা পার্ক করলাম।
তারপর গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে আবিদুর ভাইকে বললাম, ভাই এসে পড়েছি। নামুন। চলেন আপনার মেয়ের বাড়িতে ঢুকি।
উনি তখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। মাথা উচু না করেই শুধু বললেন, আপনি আগে যান। চেক করে আসেন। দেখুন, আমার মেয়ে বাড়িতে আছে কীনা?
আমি বললাম, আপনি ফোন করে আসেন নাই?
উনি বললেন, না।
কথাটা শুনে আমার একটু রাগই হল। গাড়ি চালিয়ে এতদুর এসেছি। আর ভদ্রলোক কোন ফোন করে আসে নাই। এটা কোন কথা হল।
যাক, একটু বিরক্তির ভাব নিয়ে আমি একাই গিয়ে দরজায় নক করলাম।
মিনিট দুয়েক পরে আমার চেয়ে কম বয়সি একটা লোক এসে দরজা খুলে দিল।
: কাকে চান?
: শাওনের সাথে একটু কথা বলতে চাই। উনি কী আছেন?
: উনি তো বাসায় নাই। আমি মশিউর রহমান, শাওনের হাজবেন্ড। কী বলবেন আমাকে বলেন?
: আমি বললাম, আমি আপনার শ্বশুর আবিদুর রহমান সাহেবকে নিয়ে এসেছি টরোন্টো থেকে।
তিনি গাড়িতে বসে আছেন।
: কী আবোল-তাবোল বলছেন? আমার শ্বশুরকে আপনি কোথায় পাবেন? আপনি ভুল করছেন।
মাথাটা কী রকম যেন একটু ঘুরে গেল। জোরে জোরে বারকয়েক শ্বাসপ্রশ্বাস নিলাম।
: আবিদুর রহমান সাহেব তো আপনার শ্বশুর তাই নয় কি?
: হ্যা, তা ঠিক।
: তিনি তো টরোন্টাতে থাকে এই ঠিকানায় (আমি ঠিকানা বললাম)?
: ঠিকই বলেছেন। ওখানেই উনি থাকতেন। এখন থাকেন না।
: এখন কোথায় থাকে?
: উনি তিন-চার মাস আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আপনি তাকে কোথায় পেলেন? আপনার মাথা কী ঠিক আছে? নাকি আপনি আমাকে ব্ল্যাক মেইল করতে এসেেছন? আমি কিন্তু আপনাকে পুলিশে দেব। এখনই নাইন ওয়ান ওয়ানে কল করছি।
: আচ্ছা, সেটা চাইলে আপনি করতে পারেন। তার আগে আমার কথাটা শুনুন। আপনি আমার গাড়ির কাছে একটু চলুন। দেখুন, উনি গাড়িতে বসে আছেন।
ভদ্রলোক আমার কথায় একটু নরম হলেন। আর কোন কিছু চিন্তা না করেই আমার সাথে সাথে গাড়ির কাছে চলে এলেন।
গাড়ির ভিতরে উকি দিয়ে দেখলাম কোন মানুষ নেই। তখন আমার মাথাটা ঘুরে গেল। তারপরেও চারিদিকে তাকালাম। কিন্তু কোন মানুষের চিহ্ন নেই।
কী বলবো ভেবে পাচ্ছি না। একটু দম নিলাম। তারপর আমার পুরো পরিচয় দিয়ে পুরো ঘটনাটি মশিউর সাহেবকে বললাম।
মশিউর সাহেব বললেন, আমি এখন বুঝতে পেরেছি। শোনেন, আপনার কথা উনি আমাদেরকে অনেকবার বলেছেন। কিন্তু আপনাকে করোনার কারনে ওনার মৃত্যুর খবরটা দিতে পারি নাই। আপনার টেলিফোন নম্বরটাও ছিলনা আমাদের কাছে। আপনার প্রতি ওনার ভালবাসা আপনাকে এখানে টেনে এনেছে। অলৌকিক বলে যে কিছু আছে তা আজকে বিশ্বাস করলাম। আপনি আমার স্ত্রীর সাথে দেখা না করে কিন্তু যেতে পারবেন না।
আমার তখনও ঘোর কাটেনি। আমি কী স্বপ্ন দেখছি? উপায়ান্তর না দেখে মশিউর সাহেবের পিছু পিছু তার বাসার দিকে হাঁটতে লাগলাম।

লেখক: গোলাম মোস্তফা আকন্দ, মেন্টাল হেল্থ ওয়ার্কার, টরোন্টো, ক্যানাডা।