রায়ারসনের গলায় দড়ি, মাথায় মুগুরের বাড়ি

খুরশিদ আলম

ইতিহাস বড়ই নির্মম। কাউকেই সে ক্ষমা করে না। আর মানুষের দুর্ভাগ্য এই যে, সে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। যুগে যুগে আমরা এমনটাই দেখে আসছি।

অত্যাচারী ক্ষমতাবানরা যখন ক্ষমতায় থাকেন তখন তাঁরা ধরাকে সড়া জ্ঞান করেন। তাঁরা ধরে নেন যে তাঁদের কোনদিন পতন হবে না। আমৃত্যু তাঁরা ক্ষমতায় থাকবেন এবং তাঁদের অপকর্মের বা অত্যাচারের কোন বিচার হবে না। তাঁরা ইশ^রের প্রতিনিধি। সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে তাঁরা।

কিন্তু না। তাঁরা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে নন। একসময় তাঁদেরও পতন ঘটে। সম্প্রতি রায়ারসনের করুণ পরিনতি সেই কথাটিকেই আবার নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিল সবাইকে। টরন্টোর ডাউন টাউনে ডানডাস আর ভিক্টোরিয়া স্ট্রিট এর ইন্টারসেকশনে অবস্থিত যে ইউনিভার্সিটিটি রয়েছে সেটির নামকরণ করা হয়েছিল এই রায়ারসনের নামেই। তাঁর পুরো নাম এগারটন রায়ারসন। ইউনিভার্সিটি চত্বরে এই রায়ারসনের একটি ভাস্কর্যও ছিল। গত ৬ জুন বিক্ষুব্ধ জনতা তাঁর ঐ ভাস্কর্যটির গলায় দড়ি বেধে টেনে হিচড়ে মাটিতে নামিয়ে আনেন এবং মুগুর দিয়ে পিটিয়ে মাথা ভেঙ্গে দেন। কারণ এই রায়ারসন ছিলেন আদিবাসী শিশুদের জন্য আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠার রূপকারদের একজন যেখানে শিশুদের উপর চালানো হয়েছিল নির্মম নির্যাতন। তারা পর্যাপ্ত খাবার পেতো না, ক্ষুধার্ত থাকতো। অপুষ্টির শিকার ছিল তারা। অনেক শিশু যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়েছে।  

সম্প্রতি এরকম আরো কিছু পরিনতি আমরা দেখেছি উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে। এর সূত্রপাত ঘটে গত বছর ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য মিনেসোটায় শে^তাঙ্গ এক পুলিশ সদস্য কর্তৃক জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার পর। হত্যাকান্ডের বিষয়টি ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মধ্যমে ছড়িয়ে দেন প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা। এর পরই শুরু হয় বিক্ষোভ। প্রথম দিকে প্রতিবাদটি সীমাবদ্ধ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তবে করোনার এই মহামারী কালেও যুক্তরাষ্ট্রের মাটি ছাপিয়ে এই আন্দোলনের বাতাস যখন কানাডা ও ইউরোপের দেশগুলোতে লাগে তখন এটি আরও বেগবান হয়। এখন এই আন্দোলন শুধু ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’, ‘আই কান্ট ব্রিদ’ লেখা প্ল্যাকার্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই আন্দোলন রূপ নিয়েছে বর্ণবাদবিরোধী কঠিন আন্দোলনে। বিভিন্ন শহরে বর্ণবাদের সঙ্গে জড়িত মানুষের ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে, সড়কের নাম বদলে দেওয়া হচ্ছে।

গত ৬ জুন বিক্ষুব্ধ জনতা রায়ারসনের ভাস্কর্যটির গলায় দড়ি বেধে টেনে হিচড়ে মাটিতে নামিয়ে আনেন এবং মুগুর দিয়ে পিটিয়ে মাথা ভেঙ্গে দেন। ছবি : অলিভর মননিয়ার/এফপি

আশ্চর্যের বিষয় হলো, যুগ যুগ ধরে প্রায় দেবত্বের আসনে বসিয়ে এই বর্ণবাদী, দাস ব্যবসায়ী আর গণহত্যা পরিচালনাকারীদের জন্মদিন- মৃত্যুদিন পালন করা হয়ে আসছে। এদেরকে ‘জাতীয় বীর’ বা ‘মহানায়ক’ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় স্থান দেয়া হয়েছে, এদের ‘অবদান’-কে মূর্ত্যমান করার জন্য মূর্তি বা ভাষ্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে।

এই ‘মহানায়ক’রা তাঁদের ‘স্বর্ণযুগে’ মানুষের পায়ে শিকল পরিয়েছিলেন, মানুষকে পণ্য বানিয়েছিলেন, দাস বানিয়ে বিক্রি করেছিলেন, নারী দাসদের ধর্ষণ করেছিলেন, মানুষের বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পত্তি এমন কি দেশ পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিলেন। দখলের জন্য প্রয়োজনে গণহত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছেন। মানুষের বর্ণের জন্য তাঁদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছেন, তাঁদেরকে ঘৃণা করেছেন।

অথচ কি আশ্চর্যের বিষয়, যুগ যুগ ধরে এই মানুষগুলোই ‘প্রাতঃস্মরণীয়’ বা ‘পূজনীয়’ হয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাই করে নিয়েছেন। সে কোন যাদুমন্ত্রবলে? এতসব অপকর্ম করেও তাঁরা কি ভাবে কোন কৌশলে মানুষের মনে সুদীর্ঘকাল ধরে ‘উজ্জল নক্ষত্র’ হয়ে ‘জাজ¦ল্যমান’ হয়ে আছেন? সে এক অপার রহস্যই বটে।

এই ‘প্রাতঃস্মরণীয়’দেরই একজন হলেন রায়ারসন। টরন্টোতে যাঁরা থাকেন তাঁরা প্রায় সবাই রায়ারসন নামটার সঙ্গে পরিচিত। টরন্টোর ডাউনটাউনে অবস্থিত রায়ারসন ইউনিভার্সিটি তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়েছে। আর এই ইউনিভার্সিটির চত্ত্বরেই সুদীর্ঘ সময় ধরে বিরাজ করছিল তার একটি ভাস্কর্য যা গত ৬ জুন ভেঙ্গে ফেলেন একদল বিক্ষোভকারী।

এই রায়ারসন যে শুধু একজন বর্ণবাদী ব্যক্তি ছিলেন তাই নয়, নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিনি নারীদের উচ্চ শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। আদিবাসী শিশুদের জন্য আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠার বিষয়েও এই রায়ারসন সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। টিএনসি নিউজ জানায় ইতিপূর্বে আন্দোলনকারীরা প্রায় পাঁচ হাজার স্বাক্ষর সম্মলিত এক পিটিশন উপস্থাপন করেন যাতে বলা হয়, রায়ারসন বর্ণবাদ, নারী বিদ্বেষ এবং সাংস্কৃতিক গণহত্যার প্রতীক। ইউনিভার্সিটি চত্ত্বর থেকে তার ভাস্কর্য অবিলম্বে সরাতে হবে।

বলা হয়ে থাকে যে টরন্টোর রায়ারসন ইউনিভার্সিটি ‘ডাইভার্সিটি’র এক অনন্য উদাহরণ। কিন্তু ১৯৪৮ সালে এই ইউনিভার্সিটির নামকরণ করা হয়েছে এক বিতর্কিত ব্যক্তির নামে। ২০১৭ সালে এই ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের পক্ষ থেকে একটি আন্দোলনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল রায়ারসনের ভাস্কর্যটি সরানোর জন্য। কিন্তু ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তখন তাতে সায় দেয়নি। তবে ভাস্কর্যটির পাশে একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল যেখানে সাংস্কৃতিক গণহত্যায় এগারটন রায়ারসন এর ভূমিকা কি ছিল তা লেখা রয়েছে।

সাম্প্রতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রায়ারসন ইউনিভার্সিটির একজন সাবেক ছাত্র ‘মাজ খান’ গ্লোবাল নিউজকে ইতিপূর্বে বলেছিলেন, আন্দোলনের কিছুটা সাফল্য দেখে তিনি রায়ারসনের ভাস্কর্য সরানোর দাবীতে পিটিশন শুরু করেছিলেন। তিনি আরো বলেন, রায়ারসন ইউনিভার্সিটি সবসময় সমতা এবং অন্তর্ভুক্তি’র কথা প্রচার করে আসছে। কিন্তু এই ইউনিভার্সিটির নামকরণ এবং তার চত্ত্বরে এমন একজন লোকের ভাস্কর্য স্থাপন করে রাখা হয়েছে যা সমতা ও অন্তর্ভুক্তির উল্টো অর্থ বহন করে। আমরা এমন এক ব্যক্তিকে বিভিন্ন উপলক্ষে স্মরণ করি যাঁর অতীত কর্মকান্ড কানাডার বর্তমান আদর্শ ও মূল্যবোধের ঠিক উল্টোটি।

রায়ারসন এর জন্ম ১৮০৩ সালে। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ ও খ্রীষ্ট ধর্মের প্রচারক এবং রাজনীতিবিদ। কানাডিয়ান ‘পাবলিক স্কুল সিস্টেম’ এর একজন পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে কানাডায় ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুল সিস্টেমেরও একজন পরিকল্পনাকারী ছিলেন। ১৮৪৪ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল চার্লস মেটকালফ কর্তৃক আপার কানাডার ‘চীফ সুপারিনটেন্ডেন্ট অফ এডুকেশন’ পদে নিয়োগ পান রায়ারসন। এক সময় ‘দি ক্রিশ্চিয়ান গার্ডিয়ান’ নামের একটি সাময়িকীর সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। লেখক, ক্রীড়াবিদ, শিক্ষাবিদ, ধার্মিক ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত এই ব্যক্তির নামে শুধু যে ইউনিভার্সিটির নামকরণ করা হয়েছে তা নয়। অন্টারিও’র পেরি সাউন্ড ডিস্ট্রিকে ছোট একটি শহরের নামকরণ করা হয়েছে তাঁরই নামে যেটি ‘রায়ারসন টাউনশীপ’ নামে পরিচিত। অন্টারিও’র উত্তর প্রান্তে Owen Sound নামের একটি ছোট শহরে তাঁর নামে রয়েছে একটি পার্ক।

রায়ারসন আপার কানাডায় ‘ইউনিফরম স্কুল টেক্সবুক’ এর প্রবক্তা ছিলেন। সকল শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্কুল শিক্ষা ফ্রি করার জন্যও তিনি লড়েছেন। তিনি চাইতেন দরিদ্র পরিবারের শিশুরাও যাতে উপযুক্ত শিক্ষা পায়। তারই অক্লান্ত পরিশ্রমে একদিন কানাডায় স্কুল শিক্ষা ফ্রি হয়।

এরকম একজন ব্যক্তির ভাস্কর্য আজ ভূলুণ্ঠিত! গলায় দড়ি বেধে টেনে হিচড়ে মাটিতে নামানো হয়েছে তাঁর ভস্কর্যটি। চুন-কালি মাখিয়ে দেয়া হয়েছে মুখে এবং মুগুর দিয়ে আঘাত করে মাথাও ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে।

অবাক হওয়ার মত কান্ড বটে! কিন্তু তারপরও ঘটনাটি ঘটেছে এবং তা জনসমর্থনও পাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষও বলছেন তাঁরা রায়ারসনের ভাস্কর্য পুনঃস্থাপন করবেন না। শুধু তাই নয়, রায়ারসন ইউনিভার্সিটির নাম বলদ করা যায় কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য ‘টাস্ক ফোর্স’-ও গঠন করা হয়েছে সম্প্রতি।

এদিকে ইউনিভার্সিটির অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ইতিমধ্যেই তাঁদের কাগজ পত্রে ‘রায়ারসন ইউনিভার্সিটি’ না লিখে ‘এক্স ইউনিভার্সিটি’ লিখতে আরম্ভ করেছেন। রায়ারসনের নাম তাঁরা আর উচ্চারণ করতে চান না।

ইতিহাস বলে, কানাডার শিক্ষা ব্যবস্থায় রায়ারসনের অসামান্য অবদান থাকলেও একই সাথে রয়েছে তাঁর ধ্বংসাত্মক বা অনিষ্টকর ভূমিকাও। এবং আজ এত বছর পরে হলেও রায়ারসনের অতীত অবদানকে ছাপিয়ে তাঁর অনিষ্টকর ভূমিকাটিই সবার চোখে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। কানাডার শিক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রাখার পাশাপাশি তিনি এমন একটি উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন যার কারণে হাজার হাজার আদিবাসী শিশু ও তাঁদের পরিবারকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। সেই উদ্যোগটি ছিল কানাডায়  ‘ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুল সিস্টেম’ চালু করা।

ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুল সিস্টেম মূলত চালু হয় খ্রীষ্টান চার্চ এবং কানাডার সরকারের যৌথ উদ্যোগে। উদ্দেশ্য ছিল কানাডার আদিবাসী শিশুদেরকে শিক্ষিত করা, ধর্মান্তরিত করা এবং কানাডার মূলধারায় সম্পৃক্ত করা। কিন্তু এটি করতে গিয়ে আদিবাসী শিশুদের উপর চালানো হয়েছিল নির্মম নির্যাতন। শিক্ষার্থীরা হাম, যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হতো। তারা পর্যাপ্ত খাবার পেতো না, ক্ষুধার্ত থাকতো। অপুষ্টির শিকার ছিল তারা। অনেক শিশু যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়েছে। তাঁদেরকে আবাসিক স্কুলে ভর্তি করার জন্য জোরপূর্বক পরিবার থেকে আলাদা করা হতো। ভর্তির পর পরিবারের কাছে যেতে দেয়া হতো না। তাঁদেরকে নিজ ভাষায় কথা বলতে দেয়া হতো না। জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হতো এই শিশুদেরকে। বলা হয়ে থাকে এটি ছিল কালচারাল জেনোসাইড।

এক অনুসন্ধানে জানা গেছে এই আবাসিক স্কুলগুলোতে পড়ার সময় ৪ হাজারেরও বেশী শিশু মৃত্যুবরণ করে। ১৮৮০ সালের দিকে কানাডার আদিবাসীদের প্রায় দেড় লাখ শিশুকে সরকার পরিচালিত আবাসিক স্কুলে নিয়ে আসা হয়েছিল। এসব শিশুদেরকে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল পুরোপুরি ভাবে। এক শতাব্দিরও বেশি সময় কানাডা সরকার স্কুলগুলোতে অর্থায়ন করলেও এগুলো পরিচালনা করতো ক্যাথলিক গির্জা। সবশেষ স্কুলটি ১৯৯৬ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

২০১৫ সালে কানাডার ‘ট্রুথ এ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশন’ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আদিবাসী শিশুদেরকে তাঁদের বাবা-মা ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে সাংস্কৃতিক গণহত্যা চালানো হয়েছিল। সেই কমিশন খ্রীষ্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার দাবিসহ ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ পেশ করেছিল। বিবিসি’র এক খবরে এ তথ্য জানানো হয়।

ঐ খবরে আরো জানানো হয় যে, ২০১৭ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জি-৭ সম্মেলন পরবর্তী সফরের অংশ হিসাবে ভ্যাটিকান গিয়েছিলেন এবং পোপ ফ্রান্সিস এর সঙ্গে দেখা করেন। ঐ সময় তিনি ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত স্কুলগুলোতে আদিবাসী শিশুদের উপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছিল তার জন্য পোপ ফ্রান্সিসকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ আহ্বানে পোপ সাড়া দেননি। এমনকি গত মে মাসে বিট্রিশ কলম্বিয়ায় প্রাক্তন এক আবাসিক স্কুলে যখন আদিবাসী স্কুল শিক্ষার্থীদের গণকবর আবিস্কৃত হলো তখনও পোপ ফ্রান্সিস ক্ষমা চাননি বিভিন্ন মহল থেকে আহ্বান সত্বেও। কেবল দুঃখ প্রকাশ করেই দায় সেরেছেন।

তবে ২০০৮ সালে কানাডার সরকার আদিবাসী স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়।

উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ঐ আদিবাসী স্কুলটিকে ঘিরে নানা বিতর্ক প্রচলিত ছিল আগে থেকেই। এবার ২১৫ জন শিশুর দেহাবশেষ আবিস্কারের ফলে আবারও সামনে এসেছে আদিবাসীদের উপর চলা নির্যাতনের ইস্যু। আর শুধু ‘কামলুপস’ এ নয়, কদিন আগে সাসচাচ্যুনের মেরিভ্যাল ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের মাঠ থেকেও ৭৫১ জন শিশুর গণকবর আবিস্কৃত হয়। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে কানাডায়। চরম বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে কানাডার সরকার। সংকটের মধ্যে নিপতিত হয় কানাডার ভাবমূর্তি।

গত মে মাসে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ‘কামলুপস’ ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলটিতে মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশকারী রাডার ব্যবহার করে শিশুদের দেহাবশেষ আবিষ্কার করা হয়েছে। ‘Tk’emlúps te Secwépemc’ ফার্স্ট নেশন-এর চিফ ‘রোজান ক্যাসিমির’ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে খবরটি জানিয়েছেন। ‘ক্যাসিমির’ জানিয়েছেন সেখানে প্রাপ্ত শিশুদের দেহাবশেষের মাঝে কয়েকজনের বয়স ৩ বছরেরও কম ছিলো। স্কুলটি ১৯৭৮ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং এই শিশুরা ওই স্কুলেরই শিক্ষার্থী ছিল।

এ ঘটনাকে হৃদয়বিদারক বলে আখ্যা দিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। এক টুইটবার্তায় তিনি লেখেন, দেশের ইতিহাসে অন্ধকার ও লজ্জার এক অধ্যায় মনে করিয়ে দিচ্ছে এ ঘটনা। তিনি আরো বলেন, চার্চের অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে কানাডায় আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁদের ভূমিকার কারণে।

কানাডার আদিবাসীবিষয়ক মন্ত্রী ক্যারোলিন বেনেত বলেন, আবাসিক স্কুলগুলো ছিল ‘লজ্জাজনক’ ঔপনিবেশিক নীতির অংশ।

কানাডায় আদিবাসী শিশুদের জোর করে ধরে এনে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার পিছনে এগারটন রায়ারসনের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই আদিবাসী-সহ কানাডিয়ানদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে ক্ষেপে ছিলেন তাঁর প্রতি। আর এবার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ‘কামলুপস’ আবাসিক স্কুলে সেই শিশুদের গণকবর আবিস্কৃত হওয়ার পর সেই ক্ষোভ রূপ নেয় চরম আন্দোলনে। আন্দোলনকারীরা রায়ারসনের ভাস্কর্যটির গলায় দড়ি বেধে টেনে হিচড়ে মাটিতে নামিয়ে আনেন এবং মুগুর দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেন। ভাস্কর্যের মুখে-চুন কালিও মেখে দেন তাঁরা।    

রায়ারসনের জন্য এটিই ছিল প্রাপ্য। আজকে তাঁর যে পরিনতি ঘটলো এর বীজ তিনি নিজেই বপন করে গিয়েছিলেন বহুকাল আগে।

উল্লেখ্য যে, এমনি পরিণতি ঘটেছে কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড এর কয়েকটি ভাস্কর্যের বেলায়ও। কানাডার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় তাঁর ভাস্কর্য ভাংচুরের শিকার হয়েছে। কারণ, ম্যাকডোনাল্ড কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি ছিলেন প্রচন্ড ভাবে বর্ণবাদী! তিনি কানাডার আদিবাসীদের দেখতে পারতেন না। কানাডার আদিবাসীদের সনন্তানদের জোর করে ধরে এনে বিতর্কিত আবাসিক স্কুলে ভর্তি করানোর পিছনেও তার ভূমিকা ছিল জোরালো।

ইউনিভার্সিটি অব রিজাইনা’র এ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর এবং লেখক জেমস ডাচেক লিখেছেন, ‘স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড দেশটি গড়ে তুলেছেন। কিন্তু তার সিদ্ধান্ত ছিল আদিবাসীদের কোন স্থান নেই এই দেশটিতে। তাঁরা ডিসপোজএবল।” 

স্মরণ করা যেতে পারে যে, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ভিক্টোরিয়া সিটি কর্তৃপক্ষ ইতিপূর্বে কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং দেশটির আবাসিক স্কুল ব্যবস্থার প্রবর্তক স্যার জন এ ম্যাকডোনাল্ডের একটি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য সিটি হলের প্রবেশদ্বারের পাশ থেকে সরিয়ে ফেলেছে। এটি স্থানীয় আদিবাসী জনগণের সঙ্গে সৌহার্দ্য সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি সৌজন্যমূলক পদক্ষেপ বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আদিবাসীরা স্যার ম্যাকডোনাল্ডের ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছিলেন।

ভিক্টোরিয়ার মেয়র ‘লিসা হেলপ্স’ ঐ সময় বলেন, আবাসিক স্কুল ব্যবস্থার নির্মমতার ইতিহাস থেকে ম্যাকডোনাল্ডকে আলাদা করার কোনও উপায় নেই। তার ভাস্কর্য অপসারণ করার প্রয়োজন ছিল। এক ব্লগ পোস্টে ‘হেলপ্স’ তাঁদের সিদ্ধান্তের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, নিপীড়িত শিশুদের পরিবারের সদস্য ও অন্য আদিবাসীরা যখনই তাঁদের নগর সরকারের কাছে আসবে তখনই তাঁদেরকে ঔপনিবেশিক সহিংসতার বেদনাদায়ক ওই স্মৃতিচিহ্নের পাশ দিয়ে যেতে হবে- এমনটা এড়ানোর জন্যই ভাস্কর্যটি সরানো জরুরী ছিল।’

ম্যাকডোনাল্ড এর ভাস্কর্য বা নাম সরিয়ে ফেলার দাবী কানাডার অন্যান্য অঞ্চলেও জোরদার হচ্ছে। গ্লোবাল নিউজ এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দি এলিমেন্টারী টিচার্স ফেডারেশন অব অন্টারিও দাবী করে আসছে এখানকার কিছু স্কুল থেকে তার নাম মুছে ফেলার জন্য। ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ম্যাকডোনাল্ড এর নাম একটি অনিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করছে শিশুদের মনে যখন তারা জানতে পারছে যে তিনি আদীবাসী জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর একজন স্থপতি।

গত বছর অক্টোবর মাসে কুইন্স ইউনিভার্সিটি বলেছে, তাঁরা তাঁদের আইন স্কুল স্যার জন এ ম্যাকডোনাল্ড হল-এর নতুন নামকরণ করবে। যথেষ্ট বিচার বিবেচনা ও কয়েক মাস ধরে জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ম্যাকডোনাল্ড এর আরেকটি ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে গত ১ জুন প্রিন্স এ্যাডওয়ার্ড আইল্যান্ড এর শার্লটটাউন থেকে। নগর কাউন্সিল সোমবার সন্ধ্যায় ভোটের মাধ্যমে কানাডার ম্যাকডোনাল্ডের ভাষ্কর্য অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। পরেরদিন সকাল ৭টার মধ্যে নগরকেন্দ্রের চত্বরে সেটি আর দেখা যায়নি।

আমরা জানি উত্তর আমেরিকায় যুগ যুগ ধরে আদিবাসী জনগোষ্ঠি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শিকার হয়েছেন বৈষম্য ও বঞ্চনার। আজো হচ্ছেন। তবে আশার কথা এই যে, দিন দিন এই পরিস্থিতি ধীর গতিতে হলেও উন্নত হচ্ছে। আজ রায়াসনের ভাস্কর্য উপড়ে ফেলা হয়েছে। ম্যাকডোনাল্ড এর ভাস্কর্যও ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে বা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। আমেরিকার তথাকথিত ‘আবিস্কারক’ ক্রিস্টোফার কলম্বাস এখন আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের হোতা এবং স্থানীয় আদিবাসীদের হত্যার অগ্রদূত হিসেবে নিন্দিত হচ্ছেন এবং ধিকৃত হচ্ছেন। কলম্বাস দিবস পালনের যৌক্তিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন ম্লান

হয়ে যাচ্ছে। কলম্বাসের প্রতি আমেরিকানদের আগ্রহ এবং শ্রদ্ধাবোধে চির ধরছে। হারিয়ে যাচ্ছে কলম্বাস দিবস পালনের সংস্কৃতি ও উৎসব। তাঁকে গণহত্যার জন্য দায়ী করে আমেরিকার বিভিন্ন শহর-নগর এমনকি রাজ্য কলম্বাস দিবস বর্জন করে আদিবাসী দিবস পালনের ধারা চালু করছে।

তবে আদিকালের অনেক অত্যাচারী ও বর্ণবাদী ‘প্রাতস্মরণীয়’ ব্যক্তির ভাস্কর্য এখনো কানাডা ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে বিরাজমান। ইতিহাসের পাতায়ও তাঁরা এখনো বীর বা মহান ব্যক্তি হিসাবে বিবেচিত। কারণ তাঁদের সমর্থক গোষ্ঠি এখনো বিদ্যমান এই দুই দেশে। কিন্তু আন্দোলন যখন শুরু হয়েছে তখন দূর ভবিষ্যতে হলেও এদের ভাস্কর্যের স্থান হবে হয় যাদুঘরে না হয় পদতলে যেমনটা হয়েছে রায়ারসনের বেলায়। ইতিহাসের পাতায়ও তাঁরা চিহ্নিত হবেন নতুন পরিচয়ে যে পরিচয়ের সাথে জড়িয়ে আছে কলংক আর নৃশংসতা। কারণ ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবাসী কণ্ঠ