টরেটক্কা টরন্টো

সামাজিকতা ও ধর্মপালন -১

কাজী সাব্বির আহমেদ

মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ কখনই একা বাস করতে পারে না। নিজ জন্মভূমিতে কিংবা বিদেশ বিভূঁই-এ যেখানেই বাস করুক না কেন মানুষকে বাস করতে হয় সমাজবদ্ধ হয়ে। একজন অভিবাসী মানুষের জন্য একটি অপরিচিত সমাজ ব্যবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়াটা অবশ্যই কোন সহজ ব্যাপার নয়। তাকে প্রথমেই যে জিনিষটিকে বিসর্জন দিতে হয় সেটি হলো তার নিজস্ব চেনা পরিচিত দেশ এবং সমাজ। যে দেশ এবং সমাজের মাঝে সে বড় হয়েছে, গড়ে উঠেছে তার মূল্যবোধ এবং দৃঢ় হয়েছে তার মানসিক মনোবল, একে একে এই সবগুলোকেই তাকে খোয়াতে হয় যখন সে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে অজানা অচেনা অন্য একটি দেশে পাড়ি জমায়। তার জন্য তখন প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় অ্যাসিমিলেশন। অর্থাৎ নতুন দেশটির সমাজ ব্যবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া। কারণ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন মানুষই জীবন যাপন করতে পারে না। নতুন দেশের সমাজ ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য যে বিষয়গুলি বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে তার ভিতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাতিগত প্রভেদ, ভাষাগত সমস্যা এবং ধর্মীয় বিধিনিষেধ। তবে সব ইমিগ্র্যান্টকেই যে এই তিনটি বাঁধাকেই অতিক্রম করতে হবে তা কিন্তু নয়। যেমন আইরিশ কোন নাগরিক যদি কানাডার টরন্টোতে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে আসতে চায় তবে হয়ত এই তিনটি বাঁধার একটিকেও তাকে অতিক্রম করতে হবে না। অন্যদিকে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আসা প্রায় প্রতিটি ইমিগ্র্যান্টকেই আবার এই তিনটি বাঁধার সব গুলোরই সম্মুখীন হতে হবে। ইস্ট ইউরোপীয়ানদের ক্ষেত্রে হয়ত ভাষাটাই একটু বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় কারণ জাতিগত কিংবা ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিতে তারা এখানকার ওল্ডস্টক সাদা কানাডিয়ানদের সমতুল্য। সেজন্য তাদেরকে অন্যান্য ইমিগ্র্যান্টদের মতন ‘ভিজিবল মাইনরিটি’-এর কাতারে ফেলা হয় না। অ্যাসিমিলেশন নামক এই সমীকরণের আরেকটি জটিল অংশ হচ্ছে নতুন ইমিগ্র্যান্ট গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সেই দেশের নীতিমালা এবং তার ব্যবহারিক প্রয়োগ। এ ক্ষেত্রে ইমিগ্র্যান্ট গ্রহণকারী দেশগুলি সাধারণত হয় ‘মেল্টিং পট’ নয় ‘মোজাইক’ নীতি গ্রহণ করে থাকে। অ্যাসিমিলেশনের ব্যাপারে কানাডার নীতি হচ্ছে মোজাইক, অর্থাৎ সবাই নিজ নিজ কালচারকে এখানে যথাযথভাবে পালন করে যেতে পারবে। এই মোজাইক নীতির কারণে কানাডা গোড়া থেকেই নিজেকে একটি সত্যিকারের মাল্টি-কালচারাল দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছে। ফলে এদেশে বিশেষ করে টরন্টোতে আমরা দেখতে পাই মোজাইক দানার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন কালচারের এবং বিভিন্ন কমিউনিটির মানুষেরা। সবাই সবার কালচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানের কারণে টরন্টো হয়ে উঠেছে ইমিগ্র্যান্টদের কাছে সবচেয়ে পছন্দের শহর। তবে এ কথা সত্য যে টরন্টো বাদে অন্যান্য শহরগুলি ইমিগ্র্যান্ট অথবা ভিসিবল মাইনোরিটিদের বসবাসের জন্য অনেক সময় কিছুটা চ্যালেঞ্জিং। সম্প্রতি লন্ডনে ২০ বছর বয়স্ক এক সাদা কানাডিয়ান যুবক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এক ফ্যামিলির চারজন সদস্যকে গাড়ীচাপা দিয়ে হত্যা করেছে। এই হামলায় শুধুমাত্র নয় বছর বয়স্ক এক বালক প্রাণে বেঁচে গেলেও সে ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হয়। পুলিশের ভাষ্যমতে শুধুমাত্র ইসলামবিদ্বেষের কারণে সেই যুবকটি এই হত্যাকান্ডটি চালায়। নর্থ আমেরিকাতে যে শুধু মুসলিম ইমিগ্র্যান্টরা বিদ্বেষের শিকার হয় তা কিন্তু নয়, কিছুদিন আগে আমেরিকার আটলান্টা সিটিতে ২১ বছর বয়স্ক এক সাদা আমেরিকান ৮ জন এশিয়ানকে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনার প্রতিবাদে নর্থ আমেরিকার চাইনিজ কমিউনিটি ‘স্টপ এশিয়ান হেইট’ প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নেমে আসে। অর্থাৎ ‘ভিসিবল মাইনরিটি’-দের জন্য অ্যাসিমিলেশনের চ্যালেঞ্জ আরও বেশী।

কানাডাতে ইমিগ্রেশন নিয়ে আসার আগে আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই চীন এবং সিঙ্গাপুরে অনেকগুলি বছর কাটিয়ে এসেছি। চীনে আন্ডারগ্রেড আর সিঙ্গাপুরে পোষ্টগ্রেড ডিগ্রী নিয়ে সেখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমেশিয়ান হিসেবে চাকরীও করেছি আমরা বেশ কয়েকটি বছর। সেই সুবাদে আমরা দুজনেই মাল্টিকালচারের সাথে বেশ পরিচিত। ফলে টরন্টোতে এসে আমাদেরকে তেমন কোন বেগ পেতে হয়নি এদেশের অন্যান্য কালচারের কমিউনিটির সাথে মিশতে। টরন্টোতে এসে দেখলাম যে এখানকার জীবনযাত্রা অনেকটাই কমিউনিটি কেন্দ্রিক। কাঁচা বাজার করার সময় আমরা বাংলাদেশীরা সাধারণত দেশী (বাংলাদেশী) অথবা দেসি (ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানী) গ্রোসারীতে যেতে পছন্দ করি কারণ আমাদের পছন্দের বাসমতী চাল, হালাল মুরগী কিংবা গরুর মাংস অথবা পদ্মার ইলিশ শুধুমাত্র সেখানেই পাওয়া যায়। একইভাবে সাউথ ইন্ডিয়ান লোকেরা ভীড় জমায় তাদের কমিউনিটির গ্রোসারীর দোকানগুলিতে। আবার কিছু কিছু আইটেম যেমন শাক-সব্জি, ফলমূল ইত্যাদির জন্য আবার সবার পছন্দ চাইনিজ দোকান। আমি এবং আমার স্ত্রী যেহেতু আগে থেকেই চাইনিজ কালচারের সাথে পরিচিত তাই আমরা আবার চাইনিজ গ্রোসারী থেকে শাক-সব্জি, ফলমূলের বাইরে লোকাল তাজা মাছ কিনতে পছন্দ করি।

ঈদুল ফিতরের নামাজের পর বেইজিং-এর এক মসজিদের ইমামের সাথে লেখক (১৯৮৯ সাল)

আমরা তখন মাত্রই এসেছি টরেন্টোতে। ক্যারাবব কোর্টের এক অ্যাপার্টমেন্টে আমাদের বাস। সেই এলাকাতে চোখে পড়ল হালাল সাইন দেয়া চাইনিজ রেস্টুরেন্ট – নর্দার্ন চাইনিজ কুইসিন। টরেন্টোতে সাধারণত চাইনিজ রেস্টুরেন্ট বলতে বুঝায় ‘হাক্কা’ রেস্টুরেন্ট, যেগুলোর বেশীর ভাগই মালিকানা কলকাতার চায়না টাউন থেকে আসা ভারতীয় চাইনিজদের দখলে। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে এই হাক্কা রেস্টুরেন্টগুলির কাস্টমারের সিংহভাগই হচ্ছেন বাংলাদেশ থেকে আসা ইমিগ্র্যান্টেরা অর্থাৎ আমরা। বাংলাদেশীরা সাধারণত অন্যান্য চাইনিজ ফাইন ডাইনিং রেস্টুরেন্টে যায় না। কারণ কিছুটা হালাল খাবার পাওয়া যাবে কিনা আর বাকীটা খাবারের স্বাদ আমাদের মুখে রুচবে কিনা সেই দোটানায়। আমরা যেহেতু দীর্ঘদিন চীন এবং সিঙ্গাপুরে কাটিয়ে এসেছি এবং বিভিন্ন ধরণের চাইনিজ খাবারের সাথে পরিচিত তাই আমাদের কোন সংশয় ছিল না সেই নর্দান চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসে খেতে। সেখানে প্রথম দিন যখন আমরা খেতে যাই, রেস্টুরেন্টের মালিক নিজেই চলে আসেন আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে। আমরা মুসলিম জেনে উৎসাহিত হয়ে তিনি আমাকে তার রেস্টুরেন্টের একটা ডিসকাউন্ট কার্ডও গিফট করে বসেন। যাহোক মালিকের সাথে ভাষাগত কারণে আমাদের আলাপ জমে গেলো সহজেই। যেহেতু তিনি মুসলিম তাই তাকে আমরা ঈদের দিনে আমাদের ক্যারাবব কোর্টের অ্যাপার্টমেন্টে দাওয়াত দিলাম। ঈদের দিন তার রেস্টুরেন্টের কিছু স্পেশাল ডিস নিয়ে তিনি ঠিকই হাজির হলেন আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে। এভাবেই তার সাথে আমাদের বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে। আমরা আমাদের অন্যান্য বাংলাদেশী বন্ধু-বান্ধবদেরকে নিয়ে প্রায়ই হাজির হতাম তার রেস্টুরেন্টে। হাক্কা স্বাদের বাইরে এই ধরণের অথেনটিক চাইনিজ খাবারের স্বাদ চেখে আমাদের বন্ধু-বান্ধবদেরকে বেশ তারিফ করতে দেখেছি। এক সময় রেস্টুরেন্টের মালিক আমাকে এসে ধরলেন পাশের মসজিদের গণ্যমান্য কিছু লোকের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিতে। তিনি তাদেরকে দাওয়াত দিতে চান। তিনি তার রেস্টুরেন্টে চাইনিজ মুসলিম এসোসিয়েশন-এর বার্ষিক ডিনারের আয়োজন করছেন, সেই উপলক্ষ্যে। সহজ মনে রাজী হয়ে তাকে নিয়ে গেলাম মসজিদে মাগরিবের নামাজের সময়। বেচারার নামাজ পড়ার কসরৎ দেখেই বুঝতে পারলাম যে তিনি ‘চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এর মাঝে বেড়ে উঠা জেনারেশন। যাই হোক নামাজ শেষে তাকে নিয়ে গেলাম মসজিদ কমিটির কয়েকজনের কাছে। মনে হলো তারা যেন এই রেস্টুরেন্টের মালিককে ধরার জন্য তক্কে তক্কে ছিলো – আজ ‘মাওকা মিলেগা’। কথোপকথন শুরু হলো, দোভাষীর ভূমিকায় আমি। মসজিদ কমিটির কড়া প্রশ্ন – রেস্টুরেন্টের মাংস কি হালাল? রেস্টুরেন্টে কেন মদ বিক্রী হয়? বেচারা আমার মাধ্যমে বারবার নিশ্চিত করছেন যে মাংস হালাল আর মদ না রাখলে অন্যান্য চাইনিজ কাস্টমাররা ‘ফাইন ডাইনিং’-এ খেতে আসবে না। অনেকক্ষণ পর তারা সম্মত হলেন দু’জন প্রতিনিধি পাঠানোর। তাদের এই সম্মত হওয়ার পিছনে আমার অবশ্য ক্ষুদ্র অবদান ছিলো। আমি শুধু মসজিদ কমিটির লোকদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুসলমানরা যদি ‘চাইনিজ মুসলিম’-দেরকে আলাদা করে রাখে তবে কি সেটা সঠিক কাজ হবে। যাহোক মূল অনুষ্ঠানের রাতে আবারও আমাকে থাকতে হলো দোভাষীর ভূমিকায়। মসজিদ কমিটির ভদ্রলোক দু’জন এসেছেন বটে তবে উসখুস করছেন কখন তারা ছাড়া পাবেন এই যন্ত্রণা থেকে। খাবার তখন মাত্র সার্ভ করা হয়েছে, এ’শার আযানও শোনা গেলো কোন একজনের সেল ফোন থেকে। ভদ্রলোক দু’জন এখন উঠে পড়বেন মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ পড়ার অজুহাতে। এ কথাটা জানাতেই রেস্টুরেন্টের মালিকের মুখে হতাশার ছায়া। বুদ্ধি খাঁটিয়ে তাদেরকে বললাম, আমার জানামতে খাওয়া আর নামাজ যদি একসাথে হয়ে যায়, তবে আগে খাওয়ার বিধান এবং কোনরূপ তাড়াহুড়া না করে। আসলে এটি একটি হাদিস, মালেয়শিয়াতে এক সোমালিয়ান হাফেজ-এর কাছ থেকে আমার শেখা। অগত্যা তারা খেতে রাজী হলেন। আর রেস্টুরেন্টের মালিকেরও মন রক্ষা হলো। অবশ্য খাওয়া এবং নামাজ সংক্রান্ত এই হাদিস অন্য এক বাংলাদেশী মজলিসে রেফার করে তেমন কোন উপকার পাইনি। শীতের দিন দুপুরের এক দাওয়াতে সবাই একটু দেরী করে এসেছে, ফলে খাবার যখন সার্ভ হয়েছে তখন আসরের ওয়াক্ত প্রায় হয়ে এসেছে। খেতে বসতে না বসতেই হোস্ট নিজেই তাড়া দিচ্ছে তাড়াতাড়ি করে খেয়ে উঠতে কারণ সবাই মিলে নাকি পাশের এক মসজিদে জামাতে নামাজ পড়তে যাওয়া হবে। এই হাদিস অবশ্য তাদেরকে বিরত রাখতে পারেনি সেদিন, তবে শুনেছি সেই হোস্ট নাকি পরবর্তীতে সেই মসজিদে আর যেতেন না কারণ সেটা নাকি তাবলিগদের মসজিদ।

টরন্টোতে দ্বিতীয় যে চাইনিজ মুসলিম ব্যক্তির সাথে আমাদের পরিচয় হয় তার নাম মুসা। মুসা ট্রু। আসলে আমার স্ত্রীর সাথে মুসার স্ত্রীর আলাপ হয় প্রথম, নাগেট মসজিদে ইফতারী করার সময়। মুসা ব্যবসার খাতিরে দীর্ঘদিন পাকিস্তানে ছিল। তাই সে সহজেই পাকিস্তানি কিংবা গুজরাটি মুসলিমদের সাথে মিশতে পারে যেটা অন্যান্য চাইনিজ মুসলিমদের ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায় না। মুসা পেশায় বাড়ী বেচাকেনার সাথে জড়িত অর্থাৎ রিয়েলেটর, আবার সেই সাথে একটি চাইনিজ মুসলিম এসোসিয়েশনের একজন সক্রিয় সদস্য। তার বদান্যতায় আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল চাইনিজ মুসলমানদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার। লক্ষ্য করে দেখলাম মুসা যে চাইনিজ মুসলিম এসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত আর হালাল চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মালিকের যে এসোসিয়েশন, তাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই। কেউ কাউকে চেনে না। আবার আরেক দল চাইনিজ মুসলিমের দেখা পেয়েছিলাম ‘আবু হুরাইরা’ মসজিদে। তারা রমজানের সময় তারাবী পড়তে আসত। তারা ছিল আসলে বেশ কয়েকটি ফ্যামিলির সমষ্টি আর সেই ফ্যামিলির ভিতর ছিলেন এক বাংলাদেশী ভদ্রলোক যার স্ত্রী চাইনিজ মুসলিম। তাদের নেতৃত্বে যিনি ছিলেন, তিনি নাকি চীনের এক মসজিদে ইমামতি করতেন। বয়সে বেশ তরুণ সেই ইমামের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম যে তিনি এখানকার বিভিন্ন চাইনিজ মুসলিম এসোসিয়েশন সম্পর্কে জ্ঞাত, তবে তাদের ব্যাপারে আগ্রহী নন। আমি এবং আমার স্ত্রী যেহেতু চাইনিজ বলতে পারি এবং দীর্ঘদিন চীনে কাটিয়ে এসেছি তাই সহজেই সেই সব চাইনিজ মুসলিমদের সাথে হার্ট টু হার্ট কথা বলতে পারি। তারা সহজেই আমাদের কাছে তুলে ধরে চীনে তারা ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে কী কী অসুবিধার সম্মুখীন হতেন। সাত বছর কাটিয়ে এসেছি চীনে, অথচ আমার চোখে কখনো পরেনি সেগুলো। হয়ত আমার সেই অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টির অভাব ছিলো তখন।

চীনের সংখ্যা গরিষ্ঠ ‘হান’ জাতির মধ্যেও মুসলমানদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সরকারী ভাবে তাদেরকে আলাদা করা হয়েছে ‘হুই’ জাতি হিসেবে। বেইজিং-এর আনাচে কানাচে রয়েছে বেশ কিছু মসজিদ, সেগুলোতে যখন জুম্মার নামাজ পড়তে যেতাম তখন সেই সব ‘হান’ (অথবা ‘হুই’) মুসলিমদের দেখা পেতাম। লক্ষ্য করে দেখেছি যে চীনের মসজিদ্গুলোর নির্মাণশৈলীতে ব্যবহৃত হয়েছে প্রথাগত চৈনিক স্থাপত্যকলা, গম্বুজাকৃতি কাঠামোকে অনুসরণ করা হয়নি। ঈদের নামাজ পড়ার জন্য আমরা যেতাম বেইজিং-এর বিখ্যাত ‘নিউ চিয়ে’ মসজিদে। ঈদের দিনগুলোতে ‘নিউ চিয়ে’ মসজিদ চত্বরের ভীড় ছিলো লক্ষ্য করার মতো। মসজিদ ছাড়া ‘হুই’ মুসলিমদের দেখা পেতাম কাঁচা বাজারের মাংসের দোকানে, সেখানে তারা হালাল মাংস বিক্রী করত।

কম্যুনিস্ট চায়নার একটি কালো অধ্যায় হচ্ছে তার ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’। সেই সময়ে আরোপিত অন্যান্য বিধিনিষেধের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উপর বিধিনিষেধ। এতে ‘হুই’ মুসলমানরা প্রায় ভুলতে বসে তাদের ধর্মীয় অনুশাসন। আর তাদের পরবর্তী প্রজন্ম বেড়ে উঠে ধর্মীয় জ্ঞান ব্যতিরেকে। তারা শুধু ধারণ করেছিল তাদের চাইনিজ নামের পাশাপাশি বাবা-মা’র রাখা একটা মুসলিম নাম, যা শুধু মাত্র ডাকা হতো বাড়ীতে একটা বিশেষ বয়স পর্যন্ত। হংকং-এর এক কফিশপে একবার পরিচয় হয়েছিলো গণচীনের এক উঠতি আর্টিস্টের সাথে। আমাদের মুসলিম পরিচয় পেয়ে সে বলেছিলো তার বাবা-মা তার একটা মুসলিম নাম রেখেছিলো ‘কাদির’, যার কথা সে অনেকটা ভুলেই গিয়েছিলো। ‘কাদির’-এর মতো আরও অনেকের সাথে দেখা হয়েছিল আমার চীনের জীবনে।

টরন্টোতে এ পর্যন্ত যত চাইনিজ মুসলিমদের সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে তারা সবাই মূলধারার অর্থাৎ ‘হান’ চাইনিজ। কোথাও কোন উইঘুর মুসলিমের দেখা না পেয়ে ভেবেছিলাম তাদের জন্য যেহেতু ইমিগ্রেশন নিয়ে অন্য কোন দেশে পাড়ি দেয়াটা কঠিন তাই হয়ত টরন্টোতে তাদের তেমন দেখা পাওয়া যায় না। কিন্তু সৌভাগ্যক্রেমে একদিন দেখা পেলাম এক উইঘুর রেস্টুরেন্টের। আমরা যেখানে গ্রোসারি শপিং করি, সেই স্ট্রিপ মলে দেখি নতুন এক রেস্টুরেন্ট খুলেছে – নাম ‘ক্রোরান’, উইগুর কুইসিন। যে কোন নতুন রেস্টুরেন্টের প্রতি আমাদের আগ্রহ থাকে প্রচুর, তার উপর এটা হচ্ছে উইগুর খাবারের রেস্টুরেন্ট। ঢুঁ মেরে দেখতে গেলাম। মালিকের নাম মাহমুদ। বেইজিং-এর বিখ্যাত ‘রেন-মিন তা সুয়ে’ অথবা ‘পিপলস্ ইউনিভার্সিটি’ থেকে পাশ করা, মাঝে অনেক বছর জাপান প্রবাসী ছিলেন টরেন্টোতে আসার আগে। ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে ‘রিফাত’ আর সহধর্মিনী ‘ফাতিমা’কে নিয়ে তিনি চালান এই রেস্টুরেন্ট। মাহমুদকে বলে আসলাম যে একদিন আসব তোমাদের রেস্টুরেন্টে খেতে।

চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমি বেইজিং-এ সাতটি বছর কাটিয়েছি, যখন চীন তার ‘লৌহ যবনিকা’ অল্প অল্প করে তুলে নিচ্ছিলো ‘ওপেন ডোর’ পলিসির মাধ্যমে। আমার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হচ্ছে এই সাতটি বছর। প্রথম বছরটি কাটিয়েছি ‘বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইনিস্টিটিউট’-এ ভাষা শিক্ষার জন্য। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকেই ছাত্ররা আসে এখানে চাইনিজ শিখতে। এখানকার ক্যাম্পাসটি ছিলো বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন ভাষাভাষীর আর বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের এক মহা মিলনমেলা। আমার সামনে পুরো পৃথিবীর দুয়ার যেন উন্মুক্ত করে দিয়েছিল এই ইনিস্টিটিউট। বছর খানেক পর ভাষা শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে চলে আসি আমার মূল ইউনিভার্সিটিতে। পুরো ক্লাসে আমরা ছিলাম মাত্র চারজন ফরেন স্টুডেন্ট। সমগ্র চায়নার বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের বেশীর ভাগই আগে কখনো বিদেশী মানুষ দেখেনি স্বচক্ষে – ফলে আমাদের প্রতি তাদের সবারই ছিলো অপরিসীম আগ্রহ। আর যখন তারা দেখত আমরা অবলীলায় বিশুদ্ধ চাইনিজে কথা বলতে পারি, তখন তাদের বিস্মিত চেহারা হতো দেখার মতন। তাদের অনেকেই আমাদের মতন বিশুদ্ধ উচ্চারণে চাইনিজ বলতে পারত না -আঞ্চলিকতার টান থাকত। হাজারো ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে আলাদা করে আমার চোখে পড়ে ‘আইনূর’ আর ‘আলী’-কে। তাদের উইঘুর জাতীয়তার কারণে তাদের চেহারা ‘হান’ জাতির চাইনিজদের থেকে অনেকটাই আলাদা। চীনে আসার পরপরই লক্ষ্য করেছিলাম রাস্তার পাশে কিছু লোক সস্তায় গরম গরম ভেড়ার মাংসের ‘শিক কাবাব’ বিক্রি করছে – পরে জেনেছিলাম তারা হচ্ছে ‘শিন চিয়াং’ প্রদেশ থেকে আসা উইঘুর জাতির লোক। এই ‘শিক কাবাব’-এর চাইনিজ নাম হচ্ছে ‘ইয়াং রো ঠুয়ান’, অথবা বেইজিং-এর উচ্চারণে ‘ইয়াং রো ঠুয়ার’। বেইজিং-এর মূল বাসিন্দা ‘হান’ চাইনিজেরা আবার এই ‘ইয়াং রো ঠুয়ার’-এর বিশেষ ভক্ত। রাস্তার পাশে সাইকেল থামিয়ে জিরা আর ঝাল মরিচের গুঁড়ো মিশানো এই শিক কাবাব তারা সাবাড় করে দেয় একটার পর একটা। অবশ্য ‘হান’ চাইনিজেরা আমাকে এই শিক কাবাব বিক্রেতাদের সম্পর্কে বলত, ওদের থেকে সাবধান, ওদের সাথে সবসময় ছুরি থাকে, ওরা কিন্তু সাংঘাতিক। এই হচ্ছে উইঘুর সম্প্রদায় সম্পর্কে তাদের স্টেরিও টাইপ ধারণা।

আইনূর আর আলী হচ্ছে আমার প্রথম দু’জন কাছ থেকে দেখা উইগুর জাতির মানুষ। উইঘুরেরা মূলত ‘সেন্ট্রাল এশিয়া’র মানুষ, ধর্মে মুসলমান। কিন্তু রাজনৈতিক প্রহসনের কারণে আজ তারা চীনের অধিবাসী। বেইজিং-এর ‘মিন-জু’ (এথেনিক মাইনরিটি) ইউনিভার্সিটিতেই উইঘুর ছাত্র-ছাত্রীর আধিক্য বেশী। তবে অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদেরকে পড়তে দেখা যায়। বলে রাখা ভালো যে বেইজিং-এর কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়াটা সহজ কোন ব্যাপার নয় -এর জন্য পার হয়ে আসতে হয় ন্যাশন ওয়াইড এক কঠিন ভর্তি পরীক্ষার বৈতরণী। তৃতীয় যে উইঘুর ব্যক্তিটি আমার মেমোরীতে স্থান করে নিয়েছে, তার নাম ‘উয়ার খাইশি’। অধিকতর গণতন্ত্রের দাবীতে বেইজিং-এর ছাত্রছাত্রীরা যখন ১৯৮৯ সালে থিয়েনআনমেন চত্বরে আন্দোলন করে, ‘উয়ার খাইশি’ তখন হয়ে উঠেছিলো একজন শীর্ষস্থানীয় ছাত্র নেতা। আন্দোলন শেষে তাকে অবশ্য দেশ ত্যাগ করে আমেরিকাতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যেতে হয়েছিলো।

এরপর একদিন রাতে ঘটা করে খেতে গেলাম সেখানে। আমরা ছাড়া আরো দুটি টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছেন কয়েকজন। বেশ কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে সারা রেস্টুরেন্টময়। মাহমুদ আমাদেরকে দেখেই চিনতে পারল, আগে একবার এসে ঢুঁ মেরে গিয়েছিলাম। ফাতিমা মেন্যু নিয়ে এলো। বেশ কিছু পরিচিত খাবারের নাম দেখলাম মেন্যুতে –

সেগুলো থেকেই অর্ডার দিলাম আমরা। খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাহমুদ আর রিফাত। আর সেই ফাঁকে ফাতিমা এসে বসল আমাদের টেবিলে। কথা শুরু হলো আমাদের বেইজিং-বাসের অভিজ্ঞতা দিয়ে। সেও প্রাণ খুলে তার জীবনের কথা বলা শুরু করলো। ‘শিন চিয়াং’-এ তার বৃদ্ধ বাবা-মা আর এক ভাই থাকে। সেই ভাই-ই বাবা-মার দেখভাল করে। বছরে কিংবা দুই বছরে তিনি তাদেরকে দেখতে যান। তবে ‘শিন চিয়াং’-এর পরিস্থিতি নিয়ে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন। পত্রিকাতে পড়েছিলাম চীন সরকারের কঠোর দমন নীতির কথা। ধর্ম পালনের ব্যাপারে নির্মম বিধিনিষেধের কথা। এই প্রথম কোন উইঘুরের মুখে সেই ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার ছায়া দেখতে পেলাম। কোন এক বাংলা পত্রিকায় ছবিসহ নিউজ হয়েছিল যে, ‘শিন চিয়াং’ -এ ইমামদের বাধ্যতামূলকভাবে পাশ্চাত্য গানের সাথে নাচতে হচ্ছে। ফেসবুকে আমার এক বন্ধু কমেন্ট করেছিলো, এদেরকে আসলে ব্যায়াম করানো হচ্ছে এবং যেটা তাদের জন্য খুবই দরকারী। আমি কখনই ফেসবুকে কমেন্টের উত্তরে কমেন্ট করিনা। কিন্তু আমি জানি ‘শিন চিয়াং’-এ যা হচ্ছে তা শুধু অন্যায় নয়, অমানবিকও বটে। চীনের ‘লৌহ যবনিকা’র ফাঁক গলে সেই চিত্র বাইরের পৃথিবীতে কখনোই এসে পৌঁছায় না। যাই হোক যথাসময়ে খাবার এসে গেলো। ফাতিমাও আমাদেরকে নিরিবিলিতে ‘উইগুর খাবার’-এর স্বাদ নেয়ার সুযোগ করে দিয়ে উঠে পড়ল। আমরাও সেই খাবারের স্বাদ নিতে নিতে বেইজিং-এর সেই পুরানো দিনগুলিতে হারিয়ে গেলাম। আইনূর, আলীর কথা মনে এলো, জানিনা আজ তারা কোথায় আছে, কেমন আছে।

কাজী সাব্বির আহমেদ

টরন্টো