কাহিনী বিচিত্রা

সাইদুল হোসেন

অতি দানশীল টরোন্টোনিবাসী জনগণ

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। কানাডায় তখন শীতের প্রচন্ড প্রকোপ। দৈনিক পত্রিকা পড়ে জানতে পারলাম যে-

গত সপ্তাহে তিন বছর বয়সের Elijah খালি গায়ে ঘরের সবার অজ্ঞাতে ওর বাড়ির বাইরে চলে যায় এবং প্রচন্ড ঠান্ডায় বরফে জমে গিয়ে রাস্তাতেই মারা যায়। ওর এই বেদনাদায়ক মৃত্যুর খবর TV-Radio ইত্যাদির মাধ্যমে জানতে পেরে সহৃদয় এক টরোন্টো শহরনিবাসী মৃত শিশুটির funeral expenses

 জোগাড়ের উদ্দেশ্যে Internet-এ Online appeal জানায়। এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে মাত্র ২৪ ঘন্টায় শহরের ৩,৩০০ নাগরিক ১৩৫,০০০ ডলার সেই উদ্দেশ্যে দান করেছে!

অবিশ্বাস্য! টরোন্টো শহরবাসীদের হৃদয় এত কোমল, এত উদার!

একটি Suit-এর মূল্য কত হতে পারে?

অন্য ধরনের দানশীলতার উদাহরণ।

২০১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। Toronto Star

এর খবরে প্রকাশ – ঐ বছরের (২০১৫) ২৫ জানুয়ারী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট Barack Obama ইন্ডিয়াতে সফরে গিয়েছিলেন। ইন্ডিয়ার প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে Suit -টা পরে প্রেসিডেন্ট ওবামার সংগে সাক্ষাৎ করেছিলেন সেটা নিলামে (auction)-এ বিক্রি হয়েছে, কিনেছেন একজন ইন্ডিয়ান diamond trader, তার নাম লালভাই তুলসিভাই প্যাটেল। কি মূল্যে কিনেছেন তিনি সেই Suit -টা? অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে সেই অংকটা সাত লাখ ডলার!

সেই ডলারগুলোর কি হবে? অতি উত্তম কাজে সেটা ব্যয় করা হবে। নোংরা ও বিষাক্ত জলে ভরা ইন্ডিয়ার গংগা নদীকে দূষণমুক্ত করার কাজে লাগানো হবে সেই ডলারগুলো। উদ্দেশ্যটা মহৎ নিঃসন্দেহে।

মৃত্যু, সেকি বন্ধু না শত্রু?

সময়টা ২০১৫ সালের মার্চ ১২। আগেরদিন হাসপাতালে কাজের ফাঁকে ফাঁকে এক প্রশ্ন বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ঃ মৃত্যু মানুষের শত্রু না বন্ধু? বহুক্ষণ নিবিষ্ট মনোযোগ দিয়ে অতীত ও বর্তমানের আমাদের পরিবারে (বাংলাদেশে) কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লে­ষণ করেও প্রশ্নটার কোন গ্রহণযোগ্য উত্তর খুঁজে পেলাম না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কোন এক কবিতায় লিখেছেন ঃ “মরণরে, তুহুঁ মম শ্যাম সমান”।

শ্যামের অর্থ করা হয়েছে বন্ধু। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, সব মৃত্যুকেই কি বন্ধু বলে বিবেচনা করা যায়?

মৃত্যুকে নিয়ে একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করলাম বহুক্ষণ ধরে কিন্তু বেশী দূর এগুতে পারলাম না-

মৃত্যুর নিষ্ঠুর থাবা অহরহ নেয় ছিনিয়ে

অতি আপনজনকে- অকষ্মাৎ অথবা ধীরে ধীরে।

মৃত্যু, সে বধির, শোনেনা কোন বিলাপ

অথবা আর্তনাদ হৃদয়বিদারক,

দাঁড়ায় না সে থমকে।

তার গতি ক্ষিপ্র, সর্বত্র, অপ্রতিরোধ্য,

মানে না সে বয়স বা সম্পর্ক,

তাকে নিয়ে চলে না কোন বিতর্ক।

মৃত্যু, সে সর্বগ্রাসী, সর্বনাশী,

দেখা দেয় সে কোথা থেকে আসি’?

সে কি আসে আপন ক্ষমতাবলে?

অথবা দেখা দেয় অপর কোন শক্তির নির্দেশে?

আমার দাদা মারা গেলেন ১৯৬০-এ, তিনি বেঁচে ছিলেন পূর্ণ ১০০টি বছর, অথচ বাবা যখন মারা গেলেন (১৯৫৫ সেপ্টেম্বর ১৫) তখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৭ বছর। আমার বয়স তখন ২২ বছর। সেই মাসেই বি.কম. পাস করেছি। মা, ছোট দুই ভাই ও দুই বোনের দায়িত্ব পড়ল আমার কাঁধে। নগণ্য মাসিক বেতনের কেরাণী সরকারী অফিসে। চোখে সর্ষে ফুল দেখছি। ওদিকে মৃত্যু তো নির্বিকার চিত্তে তাঁর পরিবারকে অকূলে ভাসিয়ে বাবার প্রাণটি ছিনিয়ে নিয়ে গেল!

এখানে এসেই থমকে দাঁড়াতে হয়। বাবার মৃত্যুটা আকষ্মিক ছিল না, তবু সেটা ছিল হৃদয়বিদারক। কিন্তু অপরদিকে তাঁর জন্য সেটা ছিল আশীর্বাদ, মুক্তিদাতা, কারণ তিনি তখন দুরারোগ্য ক্যানসারে ভুগেভুগে অপরিসীম যাতনায় দিন কাটাচ্ছিলেন। বাবার জন্য তাঁর মৃত্যুটা ছিল প্রত্যাশিত বন্ধুর আগমনের মতই আনন্দ সংবাদ। সে শত্রুরূপে দেখা দেয়নি,  এসেছিল মিত্ররূপেই, তাকে আলিংগণ করেছিলেন তিনি সাদরে।

অপরদিকে আমার ছোট এক চাচাতো বোন বিধবা হয়ে গেল অতি অল্প বয়সে ছোটছোট তিনটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে। স্বাস্থ্যবান যুবক স্বামীর মৃত্যু ঘটল আকষ্মিকভাবে, পরিবারটিকে অসহায় করে দিয়ে। এখানে মৃত্যুর আচরণটা ছিল নিষ্ঠুর শত্রুর মত। আমার সেই চাচা মারা গেলেন পরিণত বয়সে যখন তাঁর বয়স ছিল ৭৫ বছর, আক্ষেপ করার মত কিছু নেই।

চোখের সামনে ঘটমান বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন বয়সের মৃত্যুগুলোর রহস্যময়তার উদ্ঘাটন কি মনুষ্যজীবনে কখনো সম্ভব হবে? মিলবে কি সব প্রশ্নের জবাব কখনো?

একজন দুঃখী স্ত্রীর কান্না

Hospital-এর অ-২০০ A-200 Information Desk -এ বসে কাজ করছি এমন সময় এক বয়স্কা ইন্ডিয়ান মহিলা এসে অপারেশন শেষে তার স্বামীকে দেখতে যেতে অনুমতি চাইলেন। যথাস্থানে ফোন করে অনুমতি এনে আমি তাকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে কাজে ফিরে এলাম। মাত্র পাঁচ মিনিটের visit শেষ করে তিনি আমার কাছে ফিরে এলেন। ইংরেজীতে জিজ্ঞাসা করলেন আমি হিন্দি ভাষা বুঝি কি না। বললাম : হ্যাঁ, বুঝি। মহিলা তখন হিন্দিতে তার মনের দুঃখটা এভাবে বর্ণনা করলেন।

আমার স্বামী একজন শরাবী, আজীবন মদ খেয়ে মাতলামি করে চলেছে। ওর বয়স এখন ৭২ বছর। নানা ধরনের অসুখে ভুগে সে যার বেশীর ভাগই অতিরিক্ত মদ খাওয়ার কারণে। আজকের এই stomach operation এর মূলেও শরাব অর্থাৎ মদ। সন্তানাদি নিয়ে জীবনটা কাটাচ্ছি বড় কষ্টে, নরকবাস বলতে পারেন। আমি হিন্দু স্ত্রী, স্বামীকে ছেড়ে কোথাও যাবার উপায় নেই আমার। বহু চেষ্টা করেছি, হাতেপায়ে ধরেছি, কান্নাকাটি করেছি এই নেশাটা ত্যাগ করতে কিন্তু কোনই লাভ হয়নি, সে তার মতই চলছে।

লোকটা এতোই শরাবী (মদে আসক্ত) যে এই একটু আগে আমি যখন ওর বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন ওর এনেস্থেসিয়ার প্রভাবটা কেটে গেছে। আমাকে চিনতে পেরে প্রথম প্রশ্নটা কি করলো জানেন? সে প্রশ্ন করলো : মেরি শরাব? অর্থাৎ আমার মদের বোতল এনেছো তো?

তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন ঃ ওহ সুধরেগা নেহী, জল্দিহি শরাব উসকো খতম কর দেগা অর্থাৎ আমার স্বামীর এই বদঅভ্যাসটা আর শোধরাবে না, শিঘ্রই মদ ওর মৃত্যু ডেকে আনবে।

বহু সন্তানের মা হতে চাই

(এক)

Hospital -এর A-200 Information Desk-এ কাজ করছি এমন সময় এলেন এক অল্প বয়েসী মোটাসোটা মহিলা, সংগে ছোট ছোট দু’টি বাচ্চা। তার স্বামীর একটা অপারেশন আছে সকালে, তার সংগে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে, অনুরোধ জানালেন। খোঁজখবর নিয়ে মহিলাকে জানালাম যে তাকে সেজন্য বহুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। বাচ্চা দু’টি অসম্ভব রকম চঞ্চল, ওদের সামলানো দায়। বললাম, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে ওদের দু’টি চকলেট দিতে পারি, কিছুক্ষণ হলেও শান্ত থাকবে। খুশী হয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন : দিন। দিলাম। তিনি দু’টি বাচ্চার হাতে wrappe খুলে চকলেট দু’টি দিয়ে শান্ত করে আমার দিকে ফিরে বললেন : শোকরান অর্থাৎ Thank you.

তারপর নিজের জীবনের গল্প শুরু করলেন।

আমি একজন ইজিপসিয়ান, কিন্তু born and raised in Canada. আরবী লিখতে-পড়তে জানি না, শুধু বলতে জানি। মা-বাবার একমাত্র সন্তান আমি, তারা আজীবন খুবই ব্যস্ত লোক, আমাকে কম্পেনি দেয়ার মত সময় তাদের ছিল না। তাই আমার জীবনটা কেটেছে একাকী, very lonely . কষ্ট হতো। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যে ব্যস্ত থাকার জন্য বিয়ের পর অনেকগুলো সন্তানের মা হবো। বাস্তবে তা করলামও। আমার বিয়ে হয়েছে একজন ইজিপসিয়ানের সংগে। বিয়ের পর আমার মনের বাসনাটা তাকে জানালাম। তিনি হেসে বললেন : আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু সব ঝামেলা তোমাকেই সামলাতে হবে, আমাকে share করতে বলতে পারবে  না।

একে একে পাঁচটি সন্তানের মা হলাম অতি দ্রুত, কিন্তু ক্রমে বোঝলাম যে অধিক সন্তানের মা হওয়াটা নিতান্তই বোকামি- আর্থিক, দৈহিক, মানসিক, সামাজিক সবদিক দিয়েই। অবসর বলে কোন মুহূর্ত খুঁজে পাওয়া না। সবর্দাই ক্লান্তি। আমাকে সাহায্য করার কেউ নেই। সংসার প্রায় অচল হয়ে পড়বে এমন অবস্থা। অনুভব করলাম যে আমার অপরিণত বয়সের সিদ্ধান্তটা ছিল মস্ত বড় একটা ভুল। তাই স্বামীকে বললাম : যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। এবার আমার Ligation করিয়ে দাও। তিনি হাসলেন, তবে কথাটা শুনলেন। Ligation করিয়ে নিলাম। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। ওরা যতই বড় হচ্ছে ওদের কেন্দ্র করে indoor, outdoor নানা activity-তে ব্যস্ততাও ক্রমেই বাড়ছে। But I deeply love my children. May Allah bless them all. Ameen.

(দুই)

চারটি সন্তানই কানে কম শোনে

এক ক্যানাডিয়ান মা তার ৮ থেকে ৩ বছর বয়সের অতি চঞ্চল চারটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে Hospital

-এর Front Information Desk-এ এসে জানতে চাইলেন Audiology Clinic টা কোথায় এবং কি করে সেখানে পৌঁছা যায়?

জিজ্ঞাসা করলাম : বাচ্চাদের মাঝে কোনটা কানে কম শোনে?

ম্লান হেসে তিনি বললেন : সবকটা-ই কানে কম শোনে, বড় যন্ত্রণায় আছি ওদের নিয়ে।

শুনে সহানুভূতি জানিয়ে বললাম ঃ সব ঠিক হয়ে যাবে, দুশ্চিন্তা করবেন না।

তারপর Audiology Clinic -এ যাওয়ার পথটা দেখিয়ে দিলাম।

মহিলা আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেদিকে পা বাড়ালেন।

আমার বউটা দারুণ সুন্দরী!

এবার হসপিটালের বাইরের গল্প।

আমার হাঁটুতে ব্যথার কারণে বহুদিন ধরেই আমি TTC Wheel-Trans -এর গাড়িতে চড়ে হসপিটালে যাওয়া-আসা অথবা দূরের কাজগুলো করে থাকি। সেই সব ট্যাক্সি ড্রাইভাররা থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোক- সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ইরিট্রিয়া, ঘানা অথবা নাইজেরিয়ার লোকই অধিক। আমার আজকের ড্রাইভারটা ছিল সোমালি, খুবই কালো, দেখতেও সুদর্শন নয়। তবে শিক্ষিত, নানা বিষয়ে উত্তম জ্ঞান রাখে, এবং বেশ আলাপী। জিজ্ঞাসা করলাম ঃ কাজের শেষে ঘরে ফিরে গেলে তোমার দেখাশোনা করে কে?

সে বললো : আমার ওয়াইফ। তারপর একটু হেসে যোগ করলো : আমার ওয়াইফ খুব সুন্দরী (V-ery beautiful ).

বললাম : এই শহরে তো বহু সোমালি মেয়ে দেখি প্রতিদিন কিন্তু ভে-রী বিউটিফুল কোন মেয়ে তো আজো চোখে পড়েনি।

শুনে একটু যেন challenge -এর স্বরেই বললো : V-ery beautiful Somali girl তাহলে আপনাকে দেখাচ্ছি। তারপর ওর পকেট থেকে সেলফোনটা টেনে বের করে দু’তিন বার slide করে একটা ফটো বের করে ফোনটা আমার মুখের সামনে তুলে ধরলো। বললো : দেখুন আমার বিউটিফুল ওয়াইফকে।

ফটোটার দিকে তাকিয়ে চমৎকৃত না হয়ে পারলাম না। সুন্দর সাজপোশাকে সজ্জিতা কালো অথচ অতি আকর্ষণীয় চেহারা ও দেহের অধিকারিণী একটি যুবতী হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে যার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরানো যায় না সহজে। অতি সুন্দরী এক সোমালি নারী। অবিশ্বাস্য! বললাম ঃ হ্যাঁ, স্বীকার করছি তোমার ওয়াইফ বাস্তবিকই সুন্দরী নারী। ইউ আর লাকি!

বড় একটা হাসি মুখে ফুটিয়ে লোকটা তখন গর্বভরে বললো : Thank you. I told you, sir. I made love to her, she made love to me.

বোঝলাম প্রেম-ভালোবাসার বিয়ে ওদের। শেষে মন্তব্য করলাম : Good choice.

হাসিটা আরো করে বললো : শোকরান (Thank you).

মায়ের জন্যে মেয়ের উদ্বেগ, দুর্ভাবনা

(এক)

আমার মা তাহলে কোথায় গেল?

পরশুদিন (২৪ তারিখ) সকালে হসপিটালের ফ্রন্ট ইনফ্রমেশন ডেস্কে বসে ভলানটিয়ারিং ডিউটি করছিলাম। আমার সামনে একের পর এক পেশেন্ট/ভিজিটরের আগমণ, তাদের নানা প্রশ্ন/চাহিদা, এবং তৎসংগে in-patient -দের খবর নেয়ার জন্য বাইরে থেকে অনবরত টেলিফোন। Very busy desk, pressure খুব বেশী, নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাওয়া যায় না। অথচ এই ডেস্কে কাজ করতে আমার খুব ভালো লাগে। মনে হয় যেন সত্যিকারের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি। যাহোক সেদিনের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলছি।

বাইরে থেকে এক মহিলা ফোন করে জানতে চাইলো তার মা আমাদের হসপিটালে পেশেন্ট হিসাবে ভর্তি হয়েছে কিনা। বললাম : তোমার মায়ের first name and last name বল। নাম বললে সেটা লিখে নিলাম, কিন্তু পেশেন্ট লিস্টে সেই নাম পাওয়া গেল না। বললাম মহিলাকে সেকথা। শুনে সে হেসে দিল, তারপর বলল ঃ আমার মা তবে গেল কোথায়? দু’দিন ধরে সে বাসায় অনুপস্থিত। মনে হচ্ছে সব হসপিটালেই খোঁজ নিতে হবে। তোমাদেরটা আমাদের বাসার খুব নিকটে, তাই তোমাদেরকেই প্রথম ফোন করলাম। খুঁজতে থাকি, দেখি, এক জায়গায় না এক জায়গায় তো পাওয়া যাবেই। যাহোক তোমাকে ধন্যবাদ, বলে মহিলা লাইন কেটে দিল।

মহিলার মা দু’দিন ধরে বাসায় নেই, নিখোঁজ, অথচ মেয়ের মুখে হাসি, কোন উদ্বেগ বা শংকার চিহ্ন পেলাম না তার কণ্ঠস্বরে। ব্যাপারটা কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক ঠেকলো আমার কাছে। লোক চরিত্র বোঝা কঠিন।

(দুই)

মেন্ডাভি : মাকে ভালোবাসি

আজ সকালে Fracture Clinic -এ দেখা হলো এক Indian origin Guyanese মা ও মেয়ের সংগে। মা বৃদ্ধা, অসুস্থ, তাই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে মাকে ডাক্তার দেখাতে হসপিটালে নিয়ে এসেছে তার পঞ্চাশোর্ধ বয়সের মেয়ে- নাম Mendavi (মেন্ডাভি)। মেন্ডাভি খুব ভদ্র এবং আলাপী।

মেন্ডাভি জানালো যে মায়ের দেখাশোনা সে-ই করে থাকে নিয়মিত। মা তো একজনই, মরে গেলে আর তো মা পাওয়া যাবে না। মা তার সন্তানদের জন্য নিজের জীবনের সব সুখ-আনন্দ বিসর্জন দিয়েছেন, অসীম কষ্ট ও যাতনা সহ্য করেছেন। বাবা আকষ্মিকভাবে মারা গেলেন মাত্র ৪৪ বছর বয়সে, মায়ের বয়স তখন মাত্র ৩১ বছর। পাঁচ-পাঁচটি কচিকচি সন্তান নিয়ে মা বিধবা হলেন।  আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, এতগুলো সন্তানের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মা দিশেহারা হয়ে গেলেন, কিন্তু ভয় পেলেন না। তার সন্তানদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গড়ার সংগ্রামে লিপ্ত হলেন। তিনি আমাদের যথাসাধ্য শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে মানুষ করেছেন, নিজেদের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এই আমার মা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম না করলে, sacrifice না করলে, আমরা পাঁচ ভাইবোন কোথায় ভেসে যেতাম কে জানে! আমিই সন্তানদের মাঝে বড়, আমার দায়িত্ব সবার চেয়ে বেশী, যদিও আমি তার মেয়ে। মার চেষ্টা আমাদের জীবনে সাফল্য, সুখ-শান্তি এনে দিয়েছে। বাবাকে তো মনেই পড়ে না বলতে গেলে, মা-ই সব। এই আমার মা বলে মাকে দু’হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

মায়ের চোখে আনন্দের অশ্রু। মা আমাকে জানালেন যে তাঁরা হিন্দু কিন্তু ভালোবেসে মেন্ডাভি একজন খৃষ্টানকে বিয়ে করেছে, সে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে ঘর করছে। কিন্তু মা- অন্ত প্রাণ আমার মেন্ডাভি, আমাকে একদিনের জন্যও ভুলেনি, অবহেলা করেনি, আমার সেবা সে করেই চলেছে। ভগবান ওর মংগল করুন।

ওঁ নমঃ শিবায়

আজ ফ্র্যাকচার ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য এসেছিলো এক ক্যানাডিয়ান যুবক, সংগে তার শ্যামলা রংয়ের ইন্ডিয়ান গার্লফ্রেন্ড যুবতী। যুবকটির ডান হাতে দু’টি bracelet- – একটি plastic -এর, অপরটি steel -এর। কাছে এলে পড়ে দেখলাম প্লাস্টিকের bracelet-এ হিন্দি অক্ষরে লেখা রয়েছে ওঁ নমঃ শিবায়। Steel-এর bracelet

-এর লেখাটা অস্পষ্ট। কি লেখা আছে ওটাতে জানতে চাইলে যুবকটি জানালো ওটাতেও ঐ একই কথা লেখা রয়েছে। এবং আরো জানালো যে steel bracelet-টা ওর বাবা ইন্ডিয়ার কোন এক সাধুপুরুষের হাত থেকে আশীর্বাদস্বরূপ পেয়েছেন।

তাকে জিজ্ঞাসা করলাম : তুমি কি হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছ?

উত্তরে সে বললো : No, I am not a follower of any particular religion. I am a citizen of the world. I have no religion but I do not disrespect any religion. I am seeking internal peace and wish peace for every person in the world.

এবার যুবতীটিকে জিজ্ঞাসা করলাম : তুমি তো হিন্দু? সে হেসে বললো : Sure.

তারপর জানতে চাইলাম : তুমি কি গায়ত্রী মন্ত্রটা জানো?  বললো : Yes, I know, and I love to recite it regularly. তারপর মন্ত্রটা সে গড়গড় করে আউড়ে গেল। শুনে বললাম : Wonderful! তারপর আমাকে Thank you জানিয়ে দু’জনে ক্লিনিক থেকে বের হয়ে গেল।