“ভয় আর ভালোবাসার গল্প”

ডিসেম্বর ৩, ২০২০

সালাহ উদ্দিন শৈবাল

ঘৃনা করতে সাহস লাগে না। ঘৃনা করতে ভয় লাগে। ভীতু হওয়া লাগে। পশ্চিম দেশ ভয়ে আছে ইসলাম তাদের সমাজ পাল্টে দেবে। দেশ পাল্টে দেবে। মুসলিমরা ভয়ে আছে নবীজিকে ছোট করা হবে। অপমান করা হবে। কালাম ভাই কানাডায় সারা দিন সারা রাত ভয়ে থাকেন। মেয়ের বাবা তিনি কানাডায়। মেয়ে বড় হচ্ছে। কখন বিধর্মী বিয়ে করে আনে। মেয়েকে ঢেকে ঢুকে রাখেন। একা একা ছাড়েন না কোথাও। হাসনাত ভাই ছেলের বাবা। তিনিও ভয়ে আছেন। কখন তার ছেলে আরেকটা ছেলেকেই বিয়ে করে ফেলে। কানাডায় এই সবের সরকারী অনুমতি আছে। আরমান ভাইয়ের ছেলে নামাজ পড়ে, দাড়ি রেখেছে..। সেও ভয়ে আছে। ছেলে না আবার জংগী হয়ে যায়।

শারমিন ভয়ে আছে কে তার হিজাব খুলে ফেলে। সামিয়া ভয়ে আছে কে তার ছোটো পোষাক পড়া বন্ধ করে দেয়।

বিকেল পাঁচটা বাজলেই দুমদাম অফিসের কম্পিউটার বন্ধ। জুতা-মোজা পড়ে বাইরে। বিরাট অলস আমি শুধু একটা কাজ করতে সব সময় ভালো লাগে। হাঁটতে ভালো লাগে। লোকালয় ধরে-রাস্তায়..রাস্তায়। নতুন পাড়া-নেইবার হুডে হাঁটতে খুব ভালো লাগে।

এখন কিছুটা ঠান্ডা পড়ে গেছে কানাডায়। তাতে কি। মোটা হুডি পড়ে নিলেই হলো। কানাডার অনেক কিছু ভালো লাগে। এই ভালো লাগার মধ্যে একটা হলো সারা শহর জুড়ে ফুটপাথ। চমৎকার গাছে ছাওয়া ফুটপাথ বেশির ভাগ রোডের পাশ ধরেই চলে গেছে। মাইলের পর মাইল। সুন্দর..নিরিবিলি সব বাড়ীর সামনে দিয়ে, সবুজ ঘাসের বুক চিরে..ফুটপাথ একেবেকে চলে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে কতো কিছু দেখা যায়। ভালো লাগে। আগে মানুষের সঙ্গে ক্রস হয়ে গেলে..একটু হাসি-হ্যালো..এটাই নিয়ম। ভদ্রতা।

এখন প্রথম কাজ একটু দূরে সরে দুরত্ব তৈরি করা যেন মিটার তিনেক জায়গা থাকে। মজার বিষয় হলো কে আগে সরে যাবে এটা নিয়ে কিছুটা প্রতিযোগিতা আছে। প্রথম প্রথম আমার মানুষকে দেখে দূরে সরে যেতে অস্বস্থি লাগতো। মনে হতো মানুষটিকে অসম্মান করা হলো। অস্পৃশ্য বলা হলো। কিন্তু দিন পাল্টে গেছে। ধরা যাক আমি ফুটপাথ ছেড়ে পাশে ঘাসের উপর সরে গেলাম। তাহলে যিনি ফুটপাথে রইলেন তিনি ক্রস করার সময় হাত তুলে ধন্যবাদ জানাবেন। জায়গা ছেড়ে দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাবেন। এটাই রীতি। মানুষ কতো দ্রুতই না পাল্টে গেছে।

আজকে আমার পাড়ার ক্যাথিরিনের সংগে দেখা হয়ে গেল। রিটায়ার্ড সাদা মহিলা। বয়স ৬৫-৭০ হবে। আমি আর ছন্দ বলি তেজি মহিলা! একাই থাকেন। স্বামী মারা গেছেন অনেক দিন। মেয়ে দূরে থাকে। সে একা বাসায় থাকে। একা বাসা দেখা শোনা করে। গাড়ী চালায়। বাজার করে। শীতকালে বিরাট বেলচা নিয়ে ঠেলে ঠেলে বরফ পরিষ্কার করে। গ্রীস্ম কালে বড় ঘাস কাঁটা মেশিন দিয়ে ঘাস কাটে। বাসার সামনে পেছনে ফুলের বাগান করে। দিন রাত পরিচর্যা করে। সে অত্র এলাকার সবচেয়ে সুন্দর বাগানের গর্বিত মালিক আর ‘বাসাবাড়ী বাগান সমিতি’র সভাপতি!

প্যানডেমিকের শুরুতে মনে মনে তাকে খুঁজছিলাম। ভাবছিলাম দেখা হলে বলবো..তোমার কোন সাহায্য লাগলে বলো। বয়স্ক একা মানুষ। দেখা হচ্ছিলো না। একদিন দেখা হয়ে গেল। দূরে দাড়িয়ে গলা উঁচু করে কথা হচ্ছিলো। আমি মনে মনে ভাবছিলাম..কি ভাবে তাকে অসম্মান না করে সাহায্যের কথা বলা যায়। যদি সে আবার অপমান বোধ করে। আমি আমার বক্তব্য ঠিক করার আগেই সে বলে ফেললো..“তুমি কি দোকানে যাও? না গেলে আমাকে বলো। আমি মাস্ক পড়ে সপ্তাহে একদিন দোকানে যাই। তোমার কিছু লাগলে কিনে দিতে পারবো।”

ধুৎতার-এই ঘাড় সোজা “বু-কে” কে সাহায্য করতে চায়!!

আজকে ক্যাথারিনকে কিছুটা অফ মনে হলো। হ্যালো বলে শুকনা মুখে চলে যাচ্ছিলো। কি মনে করে থেমে দাঁড়ালো। গলা উচু করে দূর থেকে বললো..“আমার বোধ হয় আর ইউ. এস যাওয়া হবে না। বর্ডার এখনো খুলছে না। তুমিতো জানো আমার মেয়ে থাকে ইউ. এস.। তার প্রথম বাচ্চা হয়েছে সেই ফেব্রুয়ারীতে। ছেলে হয়েছে। কি সুন্দর যে হয়েছে! নাম রেখেছে কেইলান। আজো আমি ছুঁয়ে দেখতে পারলাম না। শুধু দূর থেকে ক্যামেরায় দেখি। মন মানে না। সিনিয়র সিটিজেন হওয়াতে আমার রিস্ক বেশি। এই জঘন্য ভাইরাস-সব শেষে করে দিলো। বাচ্চাটাকে কি দেখে যেতে পারবো।”

ক্যাথারিনের জন্য খারাপ লাগলো। আমি জানি ক্যাথারিন হয়তো গত এক বছর ধরেই তার নাতিকে দেখার জন্য হাজারো আয়োজন করে রেখেছে। এমনি সে খুব গোঁছানো মানুষ। বিরাট উত্তেজনায় দিন গুনেছে। কি কি করবে মনে প্ল্যান করেছে। তার এই একা রিটায়ার্ড জীবনে মেয়ে আর সন্তানের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো বিরাট কিছু। হচ্ছে না। কবে হবে কেউ জানে না। মনে হলো তাকে সান্তনা দেয়ার জন্য কিছু বলি।

“ক্যাথারিন-তুমিতো জানো..আমি আমার সব আত্মীয় স্বজন ছেড়ে এই হাজার মাইল দূরের প্রবাসে এসেছি আজ দশ বছর। আমার আর ছন্দর পরিবারের কেউ এদেশে নেই। দেশ দেখার জন্য-প্রিয়জনদের সঙ্গে মেলার জন্য-আমরা সব সময় অস্থির থাকি। যাওয়ার সুযোগ ২/৩ বছরে একবার হয়। এ বছর ভেবেছিলাম যাবো। হলো না।”

ক্যাথারিনের মুখ নরম হয়ে গেল। আস্তে আস্তে বললো-

“তোমার ছেলেটা খুব ভালো। কিউট। মনে করতে খারাপ লাগছে তার কোন কাজিন এই দেশে নেই। আমরা ছোটো বেলায় কাজিনদের সঙ্গে কতো মজা করেছি। পিকনিক করেছি। পার্টি করেছি। আমার এক কাজিন এই কাছেই একটা ওল্ড হোমে থাকে। মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। দেখা হয়। কথা হয়। এক সঙ্গে কফি খাই। সেই ছোটোবেলার মজার স্মৃতি নিয়ে কথা বলি। ভালো লাগে।”

ক্যাথারিনের কথা শুনে বুঝলাম তার মন কিছুটা হালকা হয়েছে। সে এখন আমার কথাও ভাবছে। ভাবছে তার মতো সবারই কিছু না কিছু না পাওয়ার কষ্ট থাকে। বেদনা থাকে। অপ্রাপ্তি থাকে। এই কিছুক্ষন আগেও সে তার নিজের কষ্ট নিয়ে একা ছিল। এখন আর একা না। পৃথিবীর দুই প্রান্তেরৃদুই র্ধমের-দুই সংস্কৃতির-দুই বয়সের..দুই জেন্ডারের পুরাপুরি ভিন্ন দুইজন মানুষ হয়েও আমি তার কষ্টের সংগী হয়েছি। আমাদের কষ্টগুলো..ভালোবাসাগুলো অদ্ভুত রকম এক! তার এখন কিছুটা হালকা লাগছে। ভালো লাগছে।

আমার কাজ শেষ হয়েছে। এখন আবার হাঁটা শুরু করতে হবে। এক ঘন্টা টার্গেট ছিল। মাত্র দশ মিনিট হেঁটেছি। গল্পের উসিলায় হাঁটা বাদ দেয়া মোটেও উচিৎ কাজ হবে না।

“টেক কেয়ার ক্যাথারিন! পরে আবার দেখা হবে। বাই!”

সালাহ উদ্দিন শৈবাল । টরন্টো