প্রবাসে পরহিতপ্রবাসে পরহিতকর্ম -৭৮
জানুয়ারী ৬, ২০২১
ইউরোপের পথে পথে
“তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই
তোমারে আবার!
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পেছনে
সরু সরু কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা আমের,
ঝাউয়ের – আমের
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার, –
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!!”
জানিনা কতদিন পরে তোমাকে আবার পেলাম?? কুড়ির উপর ১/২/৩ যত শূন্য বসানো হোক না কেন; তোমার দেখাতো আমাকে পেতেই হতো। তুমিতো ছিলে আমার হৃদয়ের আকাশে। বাংলার আর এক শিল্পী জীবনানন্দ, যে তোমার-ই মত দুঃখের বারতা নিয়ে আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছিল। যত দেখছিলাম ভ্যান গগ এর শিল্পের সম্ভার। কেন যেন বারবার প্রিয় কবি জীবননান্দ দাশ আমার ঠোঁট আর মনের উপর ভর করছিলো।
নিজের জীবনের উপর শতভাগ তিক্ত, বিরক্ত একটা মানুষ কতদূর আর এগুতে পারে। সংসারের দারিদ্র ক্রমবর্ধমান হারে যেন বেড়েই চলছিল। আর ভ্যান গগ এর জীবনের আশার প্রদীপ তবুও তার ভেতরের পেইন্টারের অন্তরাত্মা তাকে ক্রমশ, রং আর তুলির দিকে ধাবিত করছিল। অতপর সে ঘর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তার হৃদয়ের ভেতরে তখন ক্রমশই পেইন্টিং এর তাড়না। তাই – সে চার্চের একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে, নিজের মত করে একটি আলয় সৃষ্টি করেন। এবং তিনি প্রচুর আর্ট করা শুরু করেন। এ সময় তার জীবনে ‘মিলেটের’ একটা প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তার জীবনের পরিসর ছিলো অতি ক্ষুদ্র। তার জন্ম হয়েছিল ৩০ মার্চ, ১৮৫৩ সালে নেদারল্যান্ডের জুনডার্ট শহরে। মৃত্যু হয়েছিল ফ্রান্সের Auvers-sur-Oise শহরে জুলাইয়ের ২৯ তারিখে। সালটা ছিল ১৮৯০।
মৃত্যুই তাকে ধাবিত করেছিল ফ্রান্সে হয়তোবা। তখন সমগ্র চেতানায় তাঁর ছিল পেইন্টিং। তাইতো প্রবল ভাবে তিনি প্যারিসে যেতে চাইলেন অতিতের এই সব দরিদ্রতাকে ছেড়ে। আর এই সময় তার প্রিয় ছোট ভাই থিউ (তিন ভাইয়ের মধ্যে ভ্যান গগ ছিলেন বড়, থিউ মেঝো এবং কোর সবার ছোট) অতি আনন্দের সাথে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন সব দিক দিয়ে। থিউ বেশ কয়েক বছর আগে প্যারিসে চলে যান। সেখানে ব্যবসার সাথে জড়িয়ে ছিলেন। এবং বিয়ে করে সংসারী হয়েছিলেন।
অতএব ভ্যান গত তার প্রিয় ছোট ভাই থিউ’র কাছে যেয়ে উঠেন, ১৮৮৬ এর দিকে। থিউ এবং ভ্যান গগের মধ্যে ভাইয়ের থেকেও বন্ধুত্বের সম্পর্কই বেশী ছিলো। তারা একসাথে কেবল আড্ডাবাজিই করতো না। বরং একসাথে মদ্যপানও করতো। এমন কি এতোদিনেও তার জীবনে কোন স্থায়ী ভাবে কোন নারীর আগমন ঘটেনি। তাই থিও’র স্ত্রী জোহানা অনেকটা বাংলাদেশের স্টাইলে বিভিন্ন স্থানে মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন ভ্যান গগের জীবন সঙ্গী করার জন্য। কিন্তু কোন না কোন ভাবে সে চেষ্টা সফল হয়ে উঠেনি তখন।
ঠিক এ সময়ই তার জীবনে একটি অসাধারণ বন্ধুর আগমন হয়। বিখ্যাত পেইন্টার পল গগুইন (Paul gauguin). যদিও ভ্যান গগ মনেট (Claude Monet ) এর আর্টের একজন মারাত্মক ভক্ত ছিলেন। তথাপী গগুইন এর আর্টও তিনি পছন্দ করতেন। একসময় তারা দুজনে ক্রমশ এমন হলো যেন, হরিহর আত্মা হয়ে গেলেন। একজন আরেকজনকে ছাড়া চলতেই পারতেন না।
এবং যেহেতু ভ্যান গগ একসময়ে তার ছোট ভাই থিও’র বাসা থাকতেন তাই নিজস্ব খরচার জন্য তিনি তার প্রচুর আর্ট বিক্রি করে ফেলেন। মজার ব্যাপার, তারা দুজন এতটাই বন্ধু হয়ে যান যে, একসময় তার ভাইয়ের বাসা ছেড়ে অন্যত্র একটা বাসা ভাড়া করেন। এবং পল গগুইন তার সাথে থাকতে চলে আসেন। ভ্যান গগ এর জীবনের বিখ্যাত কয়েকটি পেইন্টিং এর একটি হলো ‘সানফ্লাওয়ার’। যেটি তিনি পেইন্টিং করে তার প্রিয় বন্ধু পল গগুইন এর কক্ষে ফ্রেম লাগিয়ে ঝুলিয়ে দেন। তার নীচে লিখে দেন, বন্ধুত্বের শ্রদ্ধার্ঘ। এতটাই তিনি ভালবাসতেন তাকে। আর ভাবিষ্যতে এই সানফ্লাওয়ার নিয়ে ভক্তকূলের মধ্যে মারাত্মক সাড়া পড়ে যায় আশ্চার্যজনক ভাবে। উনি তার সেই পেইন্টিং এর ছোট্ট্র পরিসরে অর্থাৎ ১০ বছরের জীবনে সানফ্লাওয়ার বারবার আঁকতেন। কারণ সানফ্লাওয়ার কে তার মনে হয় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বিশ^স্ত একজন ‘প্রেমিক’। যে তার সৃষ্টিকর্তার দিকেই চেয়ে থাকে সর্বদা। তাই ভ্যান গগ তার জীবনে ১১ থেকে ১২ বার সানফ্লাওয়ার কে নানা ভাবে অঙ্কন করেছেন।
সত্যিকার অর্থে ভ্যান গন জীবনে একজনকেই ভালবেসেছেন। তার একজন ‘কাজিন’ কে। যিনি বিধবা ছিলেন। এবং খুবই সুশ্রী ছিলেন। তিনি সেই বিধবা কাজিনকে ‘Kee Vos-Stricker’ কে বিয়ে করতে চান। কিন্তু তার ধার্মিক পরিবার তাকে মেনে নিতে চাননি। এরপর ভ্যান গগ উল্টাপাল্টা বিভিন্ন নারীর সাথে জড়িয়ে পড়েন। যদিও তিনি সত্যিকারের প্রেমে পড়েন একজনারই, সে ছিলো Agostina. এটা পল গগুইন এর দাবী। তিনি নিজে এটা দেখেছেন। যদিও তার এ দাবী নিয়ে বিতর্ক আছে।
পল গগুইন এর সাথে তার যেমন গলায় গলায় বন্ধুত্ব হয় তেমনি আবার তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিতর্কও হতো। মাঝেমধ্যে সেই সব বিকর্ত ভব্যতাকে পর্যন্ত ছাড়িয়ে যেত। একবার দুজনের এতটাই বিতর্ক হলো যে, সেটা অত্যন্ত অসঙ্গতিপূর্ণ ভাবে হলো এবং পল গগুইন ভ্যান গগ কে ছেড়ে অন্যত্র বাসা নিয়ে চলে যান। এই সময় ভ্যান গগ মূলতই অত্যন্ত ডিপ্রেসড ছিলেন। বলা চলে ডিপ্রেশনের চরমে চলে যান। বন্ধু বিচ্ছেদে (তার জীবনে আসলে বন্ধু বলে তেমন কেউ ছিল না, পল গগুইনই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন) তিনি এতটাই ভেঙ্গে পড়েন যে, দাঁড়ি কাটার রেজার দিয়ে তিনি নিজেই নিজের বাম কানের লতি কেটে ফেলেন। যখন সেখান থেকে দরদর রক্ত ঝরে পড়ছিল তখন তিনি নিজেই ব্যান্ডেজ করে আবার তার নিজের সেই অবস্থার চিত্র আঁকেন।
এ সময় তার মধ্যে প্রভূত পাগলামী, বিষন্নতা দারুন অসুস্থতা এমনকি হেলুসিনেশন পরিলক্ষিত হয়।
অতপর তিনি নিজেই জায়গা বদলের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি প্যারিস ছেড়ে ফ্রান্সের একটি অন্য প্রভিন্স ‘Auvers-sur-oise’ এ চলে যান। এখানে তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ পেইন্টিংগুলো আঁকেন। এটা ১৮৮৮ এর দিকে। এবং ১৮৯০ তে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মজার ব্যাপার এই দুই বছরে তিনি একমাত্র পেইন্টিংই করেছেন। সমস্ত পৃথিবী তিনি বিস্মৃত হন। মাত্র এই দুই বছরে তিনি তের শ’রও বেশী পেইন্টিং করেছেন। Portrait ব্যাপারে আমরা কম বেশী সকলেই জানি। যার বিক্রিত মূল্য আজ পর্যন্ত সর্বাধিক। ৮২.২ মিলিয়ন ডলারে এটা বিক্রি হয়। যেটাকে আজ পর্যন্ত বিক্রিত পেইন্টিং এর সর্বোচ্চ মূল্য ধরা হয়।
এবং এই ১৩০০ আর্টের মধ্যে তিনি এ সময়ে তার বিখ্যাত সেই চিত্রটিও অঙ্কন করেন। যার নাম তিনিই দেন ‘The Starry Night ’ তিনি এটি ১৮৮৯ এর জুন মাসে অঙ্কন করেন। এটি একটি অয়েল পেইন্টিং ছিলো। একটি কল্পিত গ্রামের ছবি। আগেই বলেছি, এ সময়ে সর্বাধিক চিত্র অঙ্কন যেমন করেন তেমনি আবার মানসিক ভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েন চরম ভাবে। প্রভূত পাগলামী করেন বিধায় তার প্রিয় ভাই থিও তাকে স্থানীয় একটি মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে দিয়ে আসেন। এখানে তার অবাধ বিচরন ছিল। পেইন্টিং এর জন্য তাকে প্রচুর স্বাধীনতাও প্রদান করা হতো। এবং প্রচুর পরিমানে সুযোগ সুবিধাও প্রদান করা হয়। বরং এখানে উনি খুব ভাল ছিলেন। এই মানসিক আশ্রয় কেন্দ্রে তার কক্ষের পূর্ব দিকের জানালা দিয়ে দেখা সেই কল্পিত গ্রামের ছবি The Starry Night অঙ্কন করেন। কারণ সেই সময়ে তার প্রচুর হেলোসিনেশ হতো। এ সময় ভ্যান গগ নিজেকেও নানাভাবে অঙ্কন করেছেন। যতভাবে তিনি ‘নিজেকে’ দেখতে চাইতেন।
মৃত্যুর দিনও তিনি একটি ছবি অঙ্কন করেছেন। একটি গম ক্ষেতের। এই গম ক্ষেতের ছবিটা অঙ্কন করার সময়ই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি নিজেকে হত্যা করবেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার সব থেকে প্রিয় মানুষ, প্রিয় ভাই থিউ-কে এ কথা বলে যান।
নানাভাবে থিউ চেষ্টা করেছেন ভ্যান গগের প্রশান্তির জন্য। কিন্তু এই অসাধারণ প্রতিভাধর পেইন্টার হয়তোবা এই জগত সংসারের জন্য ছিলেন না।
কেউ তাকে মূল্যায়িত করেননি। একমাত্র থিউ-ই বারবার তার পাশে ছুটে এসেছেন। তার জন্য যথাসাধ্য করাবার চেষ্টা করেছেন। তবু তাকে প্রশান্তি দিতে পারেননি।
আজ ভ্যান গগের পেইন্টিং পৃথিবীর সর্বাধিক দামে মূল্যায়িত হয়। বিশ^ব্যাপী আর্টের বুদ্ধিজীবীরা তাকে শ্রেষ্ঠত্বের স্থান দিয়ে থাকেন। অথচ এরাই বেচে থাকতে তাকে এতটুকু সম্মান দেননি। এমনকি তার পেইন্টিং এর ঐ ১০ বছরকে আর্টের অন্যতম যুগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আজ জার্মান, প্যারিস-সহ ইউরোপের নানান দেশে এমন কি নর্থ আমেরিকাতেও তার পেইন্টিং এর উপর রীতিমত রিসার্স হচ্ছে। তার The Starry Night এর মূল্য ধরা হয় ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশী। এ ব্যাপারে যথেষ্ট মাতনৈক্য আছে অবশ্য।
তবু সেই ভ্যাগ গগ কে কেন মাত্র ৩৭ বছরেই চলে যেতে হলো? যদি ‘কিটস’ এর মতো অসুস্থ্যতায় মৃত্যু হতো তবু না হয় নিজেকে সান্তনা দেওয়া যেত। এই মানুষটা জীবনে দারিদ্রতা আর বঞ্চিত প্রেম ছাড়া আর কিছুই পাননি।
মৃত্যুর আগে এই মহান শিল্পী কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন। এবং গত ক্ষেতের ছবিটি অঙ্কনের সময়ই সিদ্ধান্ত নেন নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার। আর তাই ২৭ জুলাই, ১৮৯০ তে তিনি নিজেকে নিজেই গুলিবিদ্ধ করেন তার বক্ষস্থলে। ভাই থিউ যখন এলো তখন মৃত্যুর যমদূত ভ্যান গগের দুয়ারে দাঁড়িয়েছে। এক অসম্ভব বিষন্ন মূহুর্তে থিও’র হাতে হাত রেখে কিছু কথা বলতে বলতে ভ্যাগ গগ এই নিষ্ঠুর পৃথিবীকে বিদায় জানান ২৯ জুলাই ১৮৯০ সালে। এই দুই দিন তিনি মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছেন।
ছবিগুলো দেখতে দেখতে এবং তার জীবনের ধারাবর্ণনা শুনতে শুনতে কখন জানি আমার চোখ দিয়ে জল ঝরছিলো, নিজেও জানিনা। কিন্তু কানে বাজছিলো থিউ-কে বলে যাওয়া তার হৃদয় নিঃসৃত বেদনাহত শেষ বাক্যটি – “ The sadness will last forever”। (চলবে)
রীনা গুলশান। টরন্টো।
gulshanararina@gmail.com