প্রবাসে পরহিতকর্ম -৭৯

ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২১

ইউরোপের পথে পথে

এক্সিবিশনের সময়সীমা শেষ। সবাই একে একে বের হচ্ছে। প্রচুর মানুষের লাইন। নিকোল এর মুখটা দেখতে পেলাম। রীতিমত যেন ধাক্কা-ধাক্কি। একসময় বের হলো। নিকোলের মুখে এক ফালি হাসি। মেয়েটার হাসিটা বড়ই নির্মেঘ। আমাদের জড়িয়ে ধরে বললো – আমি জানি, তুমি আর্টের একজন নিবেদিত ভক্ত। তোমার জন্য সময়টা বড় বেশী কম। তবে আশা করছি, পরের বার আরো অনেক সময় নিয়ে এগুলো দেখতে পাবে।

আমি সেই স্বপ্ন নিয়ে এবং চূড়ান্ত বিপরীত ধর্মী মানসিকতা নিয়ে বের হলাম। একদিকে ভালো লাগার সমুদ্রের মধ্যে ভাসছি এবং একই সময়ে এক গভীর হতাশার মধ্যে নিপতিত মন। তখনই পরপর মনে আসছিলো শেক্সপিয়ার, বিটোফেন, কিটস, আন্তভ চেখভ, ইভান বুনিন এরকম আরো শ’খানেক নাম জানা দুঃখী শিল্পী যারা প্রায় সকলেই আছেন ভ্যান গগ এবং জীবনানন্দের মত।

যাই হোক অনেক কষ্টে শেষ পর্যন্ত বাইরে বের হয়েই আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ওমা যে প্যারিসকে পেছনে ফেলে ‘মুসে ডি অরসি’তে গিয়েছিলাম, সে কোথায়? এ যেন সেই লাস ভেগাসের মত রাতের রানী। দিনের বেলায় খুব সাদা মাটা লাগা প্যারিস এখন রীতিমত জেগে উঠেছে। চারিদিকে ঝকঝকে আলোর মালা। মানুষজনও যেন এখন আরো আনন্দের মাঝে ডুবে গেছে। বেশীর ভাগই দেখলাম জোড়ায় জোড়ায় ঘুরছে।

আমাদের গাইড রবার্ট এবারে খুব জোরে গাড়ি চালাচ্ছে না। প্রথমে একটা আউটলেট মলে গেল। সেখান থেকে আমাদের সঙ্গী জেমিমাদের তুললো। তারা দেখলাম প্রচুর শপিং করেছে। দু’হাত উপচে পড়ছে। আমি যখন ভ্রমণে বের হই, কখনোই আমি শপিং করিনা। জেমিমা আমাকে বললো : তুমি শপিং করবে না?

আমি বললাম : তোমার ভ্রমণ কি আজই শেষ হয়ে গেল? আর কোথাও যাবে না?

নাহ! আমরা ৩ দিনের ট্যুরে এসেছিলাম। দু’দিন লন্ডন। একদিন প্যারিস। আগামী কাল সকালেই ওয়াশিংটন চলে যাবো।

ওহ, তাহলেতো ঠিক আছে। আমাদের ভ্রমণের তো এখনও শুরু। আমরা ১ মাসের জন্য ইউরোপ ট্যুরে এসেছি।

জেমামা চোখ দুটো গোল গোল করে উচ্ছাসে ফেটে পড়লো। পরে আমাকে খুব জোরে হাগ করে বললো, ওহ ডিয়ার, আই উইস। আমিও তখন হাসলাম ওর সাথে গলা মিলিয়ে।

ততক্ষনে নিকোল কথা বলা শুরু করেছে। সে আমাদের প্যারিসের আর্ট গ্যালারীর বিক্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছে। এটা সব দেশেই আছে। ঐ দেশের যতরকম নিজস্ব প্রখ্যাত জিনিশ, তার সবই শো-পিস আকারে পাওয়া যাবে। বিশাল আকারের দোকান। মজার ব্যাপার, সারাদিন ধরে যা কিছুই দেখেছি তার প্রতিটি জিনিশেরই ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি এখানে আছে। আইফেল টাওয়ারের ছোট প্রতিকৃতি যে কত ধরণের আছে… ক্রিস্টাল এবং বিভিন্ন ধরণের মেটালের। আমি জীবনে যত জায়গায় ঘুরেছি সব জায়গা থেকে একটা করে ‘মগ’ কিনি। কিন্তু এবারে কেনা হলো না। কারণ আমি এখনো কত জায়গাতে যে ঘুরবো তার কোন ঠিক নেই। এবং এবারে আমার নিজের যে হাল! অতএব ২টি স্টিকার কিনলাম। এটাও অনেক ধরণের আছে। এটার একটির মধ্যেই ফ্রান্সের বিখ্যাত সব কিছুর একটি করে প্রতিক আছে। পেছনে ম্যাগনেট দেয়া থাকে, ফ্রিজে লাগিয়ে রাখা যায়। দুই ছেলের জন্য ২টা টি শার্ট কিনলাম। জেমিমা এখানেও বিশাল ১ ব্যাগ জিনিশ কিনলো।

এরপর রবার্ট আমাদেরকে নিয়ে রাতের প্যারিস দেখাতে বের হলো। আশ্চার্য হয়ে দেখছিলাম, দিনের প্যারিস ছিল নির্বিকার। তারপর যেহেতু ওখানে তখন একটা ঝামেলা ছিল, তাই বিভিন্ন বড় বড় সড়কগুলোর বিভিন্ন জায়গাতে বিভিন্ন বয়সি ছেলে-মেয়েরা ফরাসিতে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে নিরবে প্রতিবাদ করছিল। তখন সারা ইউরোপেই চলছিল ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধি করার দাবীতে আন্দোলন। আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে পুলিশ পাহারা দিচ্ছিল। এই সব প্রতিবাদে আমরা অভ্যস্ত নই। আমরা বাংলাদেশে জ্বালো জ্বলো আগুন জ্বলো স্লোগান সহকারে মিছিল, বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, প্রাইভেট কারগুলো ধ্বংস করা, চিৎকার, ভাঙ্গচূড় এবং অগত্যা পুলিশের বাংলা মাইর, টিয়ার গ্যাসের নোনা কান্নায় বিশ্বাসী।

এখানকার পুলিশগুলো কি বোকা বোকা ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। কিচ্ছুুটা বলে না। উল্টো একটা মধুমাখা হাসি নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবখানা এইরকম যে, আমরা বাবা তোমাদের সাতেও নাই, পাঁচেও নাই। আমরা জাস্ট সানবাথ করছি।

রাতের প্যারিসে প্রতিবাদী মানুষগুলোও নাই। হয়তো বা তারা ক্লান্ত, ঘুমিয়ে আছে রাতের কোলে। আর এখন ঝকঝকে আলোর কারুকাজ। দিনের বেলায় যেখানে যেখানে ঘুরেছি, সব জায়গাতে ডেভিড আবারো নিয়ে যাচ্ছে। তবে এবার ডেভিড খুব ধীর তালে গাড়ি চালাচ্ছে। নিকোল খুব মিষ্টি করে তার ধারা বর্ণনা চালিয়ে যাচ্ছে। দিনের আলোতে দেখা খুব সাদামাটা ‘মেমোরিয়াল গেট’ এখন আলোক মালায় ঝক ঝক করছে। ওখানেও বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ইতি উতি। অনেক দূর থেকে দেখলাম ‘নেপোলিয়ানের টম্ব’, যেটা দিনের আলোয় দেখেছিলাম একটা বিশাল দূর্গের মত ছায়া ছায়া। বেশ উঁচুতে। এখন সেটাও আলোকিত।

নেপোলিয়নের টম্ব দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে তার নানান কীর্তি কলাপ নিয়ে ভাবছিলাম। হঠাৎ দূর থেকে মনে হলো আকাশের বুকে জেগে রয়েছে এক আলোক স্তম্ভ। আমি স্তব্দ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম। আইফেল টাওয়ারে এখন কেবল-ই নানান আলোকচ্ছটা। চারপাশে শুনশান নিরবতা, তার মধ্যে আকাশ ফুড়ে নানা বর্ণের আলোকিত আইফেল টাওয়ার এক অভাবিত সৌন্দর্য নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের আইফেল টাওয়ার দেখতে দেখতে আমি বিমোহিত হলাম।

এরপর প্রসিদ্ধ সড়কগুলো ঘুরিয়ে আবারো ‘লুভর’ আর্ট মিউজিয়ামের সামনে নিয়ে এলো। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়েছিলাম। এখানে ক্রীসমাসের কোন এক্সট্রা আলোকসজ্জা করা হয়নি। জাস্ট ‘লুভর’ এর নিজস্ব আলো। মনে হচ্ছে অন্ধকারের বুকে হালকা আলোয় থমথমে মিষ্টি একটা অভিমান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লুভর। আরো মজা পেলাম, লুভর এর সামনে আমাদের বাংলাদেশের ‘সিএনজি’ টাইপের একটি অটো রিকশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি এবারে একটু নামতে চাইলাম। সবাই নামলাম। এত সুন্দর আলো-আধাঁরের এই গভীর আনন্দ আমার পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব না। সব থেকে ভাল লেগেছে যে, এখানে কোন এক্সট্রা আলোকসজ্জা নাই। এই জন্য আরো ভালো লাগছে। বেশ খানিকটা সময় দাঁড়ালাম। ছবি তুললাম।

এরপর রবার্ট আরো কিছু সময় ঘুরালো। যেহেতু ডিসেম্বরে ইউরোপ ট্যুরে এসেছি। তাই যতগুলো দেশ ঘুরেছি, সর্বত্রই ক্রীসমাসের আলোকসজ্জা। কিন্তু সব দেশেই দেখলাম গতানুগতিক। তবে সমস্ত ইউরোপকে টেক্কা মেরেছে লন্ডন ও প্যারিস। এই দুই জায়গায় একই রকম মনে হলো।

যাইহোক আমাদেরকে অতপর রেল স্টেশনে নামিয়ে দিল। স্টেশনে নেমেই জেমিমারা দৌড় লাগালো ‘বাই’ বলে। জানিনা কেন। এখনো এক ঘন্টা হাতে আছে। রাত ১০:১৫ মিনিটে ট্রেন ছাড়বে। তবে স্টেশনটা এত বড় যে আমার এক ঘন্টা লাগবে। আমিতো জেমিমার মত দৌড় লাগাতে পারবো না। সম্ভবত, ওদের ট্রেনটা ৯:৩০ এ ছাড়বে। যাইহোক স্টেশনে এসে হতভম্ব হয়ে গেলাম। এখান থেকেই সকালে গিয়েছিলাম। এখন এই রাতে এসে চিনতেই পারছিনা। এত সুন্দর লাগছে। প্রথমে দোতালায় উঠতে হলো। নিকোল আমাকে ধরে ধরে উঠালো। টিকিট দেখিয়ে কনফার্ম করলো। তারপর আবার আমাকে ধরে ধরে নীচে নামিয়ে নিয়ে একদম আমাদের ট্রেনের পাশে নিয়ে গেল। বেশ আনেকটা পথ হাটা লাগলো। আমি যে কামরায় উঠবো, ঠিক ওখানে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। একই ট্রেন, কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় আলাদা আলাদা ভাগ আছে। যার যেখানে গন্তব্য, সে সেখানে নামবে। আমরা নামবো লন্ডনের ‘St Pancras’ রেল স্টেশনে। হঠাৎ করেই নিকোলের জন্য মনটা কেমন করে উঠলো। সারাদিন আমাকে এত কেয়ার করেছে। কি যে মায়াবতী মেয়েটা। আমাকে হাগ করে, আমার গালে গাল ছোয়ালো। বললো, আবার দেখা হবে। তারপর খুব ধীরে ধীরে

চলে গেল। আমি খুবই ইমোশনাল টাইপের। আমার চোখ ভরে জল চলে এলো। ট্রেনটা ঠিক সময়েই ছেড়ে দিল। নিকোলের উদ্দেশ্যে মনে মনে বললাম, হয়ত আবার দেখা হবে, অথবা হবে না। কিন্তু মায়াবতী তোমাকে আমার মনে থাকবে। প্রতিটি মেয়ের মধ্যে একজন মা বাস করে। সেটা নিকোলকে দেখে আবারো প্রমানিত হলো।

ট্রেনের গতি বেড়ে চললো। বিদায় প্যারিস। হয়তো আবার কখনো আসবো, তোমার বুকে। তবে আজ সারাদিনের স্মৃতি বাকি জীবনটা ধারণ করবার জন্য যথেষ্ট। মাত্র একটি দিন যে কত দীর্ঘ হতে পারে আজই প্রথম বুঝলাম। প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট এবং ঘন্টা আমার কাজে লেগেছে। এবং সারাজীবনের স্বপ্নকে পূরণ করেছে।

একদম পারফেক্ট টাইমেই চলে এলাম। ২ ঘন্টা ৩২ মিনিটের মত লেগেছে। যদিও প্যারিসের সময়, লন্ডনের থেকে ১ ঘন্টা এগিয়ে আছে।

আবার সেই কোলাহল মুখর ‘St Pancras’ রেল স্টেশনে অবতরণ করলাম।

যেহেতু অনেক রাত। এত বড় কোলাহল মূখর স্টেশনটা এখন থম মেরে আছে। আমাদের ট্রেনের যাত্রীরাই হৈ চৈ করছে। স্টেশনের ক্লিনাররা এখন ক্লিন করছে। তার ভেতরেই আমরা আমাদের কাঙ্খিত ট্রেনের দিকে এগিয়ে চললাম। (চলবে)

রীনা গুলশান। টরন্টো।

gulshanararina@gmail.com