প্রবাসে পরহিতকর্ম -৭১
ইউরোপের পথে পথে
জুন ১৬, ২০২০
রীনা গুলশান
“আমি আকাশ দেখলেই
ভুলে যাই কষ্ট,
নিঃশ্বাস টেনে
ছড়ি যত ক্লান্তি,
উড়িয়ে দেই অপূর্ণতা…।’
লা-সেন নদীর ভ্রমণটা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। নৌ-বিহারের ফাঁকেই চোখ পড়ছিলো, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম আশ্চর্য ‘আইফেল টাওয়ার’। এ যেন সেই ছড়াটির মত – “তাল গাছ, এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে-
উঁকি মারে আকাশে।”
ঠিক সেই তালগাছের মতনই, এই টাওয়ার উঁকি মারছিলো। অবশেষে এর সীমানায়ই আমাদের নামিয়ে দিল। ক্রুজের ধারা বর্ণনায় অবশ্য শেষের দিকে, এই আইফেল টাওয়ার সম্পর্কেই বলছিল। আমি খুব মন দিয়ে শুনছিলাম না। কি আর শুনবো? সেই জন্মের পর থেকেই এক ছবি দেখে আসছি। আজ চাক্ষুস করবো। শোনার আর দরকার নাই।
নদী থেকে ভূমিতে পদার্পন করতেই কেমন জানি সবার মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গলো। মনে হচ্ছিল, যেন কে আগে যাবে, ওখানে? আমি চুপচাপ দেখছিলাম ওদের কান্ড। আমাদের গাইড নিকোল আসেনি। তার বদলে ড্রাইভার এসে বললো, তোমারা মেইন গেটের সামনে যেয়ে ডান দিকের ঐ কর্নারে অপেক্ষা করো।
আমরা চারজন একত্রে মেইন গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কোন কথাই বলতে পারছিলাম না। খুব বেশী বিস্ময় এক সাথে এলে যেটা হয়। স্থানুর মত দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেকটা সময়। তাছাড়া খুব বেশী কাছে যেতে ইচ্ছা করছিলো না। এত বেশী বড় আকৃতি, এটা দূর থেকে যত সুন্দর লাগে, কাছে থেকে অত সুন্দর লাগে না। আমি এর আগেও এটা অবলোকন করেছি। যখন ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ দেখতে গিয়েছিলাম। তখন নৌ-যানের থেকে এত সুন্দর লাগছিল যে, মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু, কাছে যেতেই ঐ মুগ্ধতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজও তাই হলো যেন। প্যারিসের রাস্তা দিয়ে যখন ঘুরছিলাম এবং লা-সেন নদীতে ভ্রমণ করতে করতে যখন দেখছিলাম, তখন এক অজানা অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিলাম। এত সুন্দর। এত বৃহৎ। সেই দূরের আকাশ ছাড়িয়ে যেন ঐ আরো দূরে দাড়িয়ে আছে, যুগ যুগ ধরে, শ্বাসত কাল থেকে। কত শতকের সভ্যতার স্মৃতি নিয়ে, কালের স্তম্ভ হয়ে!! লক্ষ লক্ষ মানুষের অপার বিষ্ময় নিয়ে আইফেল টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে!!
আমরা মেইন গেট দিয়ে দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ দেখলাম। জেমিমা অনবরত ছটফট করছিল, কখন ভেতোরে যাবে? মিছিলের মত লম্বা ৩/৪ সারিতে দাঁড়িয়ে আছে দর্শনার্থীরা। এত ভিড়? আমি খুবই বিস্মিত হয়ে দেখছিলাম মানুষের বিরক্ত এবং অসহিষ্ণু মুখগুলো। ঐ ভীড়ের সামনের দিকে হঠাৎ নিকোল মাথা বাড়িয়ে আমাদের কিঞ্চিত হাত নাড়ালো। তখন ড্রাইভার বললো- আসল ঘটনা। নিকোল আমাদের জন্য টিকিট কেটেছে অনেকটা বাংলাদেশের স্টাইলে। তা নাহলে ৪/৫ ঘন্টা পর্যন্ত লাগে টিকিট পেতে। নিকোলের ব্যবস্থ্য করা আছে, যারা টিকিট বিক্রি করে তাদের সাথে। আমরা আমরা বা যখনই কেউ প্যারিস ভ্রমণের জন্য টিকিট বুক করে এবং তরা যা কিছু দেখতে চায়, এরা (এই কোম্পানী) আগে থেকেই সেই ডেট দিয়ে বুক করে রাখে। আইফেল টাওয়ার এর টিকিটও আমাদের ৪ জনের জন্য ৬/৭ সপ্তাহ আগে থেকেই বুক করা আছে। তবু এই লম্বা সময়। বিপত্তি। পরে অবশ্য শুনলাম নিকোলের কাছে, কতজন মানুষ আমরা সেই হিসাবে ‘কিঞ্চিত’ অর্থদন্ডও দিতে হয়েছে। আইফেল টাওয়ারের ভেতরে নিকোলকেও যেতে হবে। অন্যান্য জায়গাতে, যেমন আর্ট গ্যালারি এবং নৌ-বিহারে নিকোলকে ভিতরে যেতে হয়নি। কিন্তু আইফেল টাওয়ারে সেটা হবে না। কারণ, এর ভেতরে অনেক ঝামেলা আছে। বোঝানোর আছে। যেটা পরে বুঝেছিলাম।
এই সময়টা একদম মাথার উপর ছিল দুপুর। যাকে বলে চড়া রোদ। ম্যাক্সিমাম মানুষের ক্ষুধাও লেগেছিল। নৌ-বিহারে আমরা ১ পিস স্যান্ডউইচ খেয়েছিলাম ভাগ্যিস। কারণ এখন শুনলাম ভেতরে কোন এক্সট্রা ব্যাগ নিতে দিবে না। পার্সটা যাও নিতে হবে এয়ারপোর্টের স্টাইলে। চেক ইন হবে। জেমিমা প্রচন্ড ছটফটে বালিকা। তারপর তার লেগেছে ক্ষুধা। আমি যদিও নৌ-বিহারে আমাদের থেকে একটা স্যান্ডউইচ দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সে মারাত্মক ক্ষুধার্থ বোধ করছিল।
আইফেল টাওয়ার থেকে প্যারিস শহরের দৃশ্য । ছবি : লেখক
যাইহোক দীর্ঘক্ষণ পর একটা গেটে আমাদের ঢুকালো। সেখানে রীতিমত সাড়াশি তল্লাশ। একেবারে ব্যাগ খুলেটুলে বেড়াছেড়া অবস্থা। তারপর ‘মারসি বুকু’ (অনেক ধন্যবাদ) বলে মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে ভেতরে যেতে বললো।
ভেতরে ঢুকার পর চোখ পড়লো বাম দিকে আইফেল টাওয়ার। ডান দিকে বিশাল খোলা প্রান্তর। যেখানে সার সার সব বিভিন্ন ধরণের দোকান। অর্থাৎ ব্যবসায়িক পণ্যের পশরা সাজিয়ে বসেছে। এবং প্রতিটি দোকানেই উপচে পড়া ভিড়। এর মধ্যে ৫/৬ টি খাবারের স্টল। ঠিক এগুলোকে রেস্টুরেন্ট বলা যাবে না। কারণ এখানে কিছু রান্না করা হয় না। রেডিমেড খাবার বিক্রি হয়। সম্ভবত পরিবেশ নষ্ট হবে বলেই রান্নার সিস্টেম নাই। সব ড্রাই ফুড। এবং অন্যান্য স্টোরগুলো সব ‘স্যুভেনির’ এর। সমগ্র প্যারিসের দ্রষ্টব্য যা কিছু আছে তার প্রায় সবই ‘স্যুভেনির’ আকারে এখানে পাওয়া যায়। টুরিষ্টরা দেখলাম প্রকৃত আইফেল টাওয়ার এর দৃশ্য উপভোগ করার বদলে তার স্মল পিস কেনার উপরই বেশী ঝোঁক। কি আশ্চর্য তাই না? এই যে আকাশ ছোঁয়া আইফেল টাওয়ার যা কিনা আমি ঘাড় সবটুকা কাত করেও দেখতে পাচ্ছি না। এবং সবটুকু কোনভাবেই ছুঁতে পারবো না, তার স্মল পিস কিনে কি করবো। থাকনা কিছু জিনিশ আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তা না হলে এই যে অজানারে জানার, এবং অচেনাকে চেনার এই দূর্নিবার টান কেন রইবে আমাদের ভেতরে চিরকাল।
প্রথিবীর এ মাথা থেকে ও মাথা কেবোলই আমরা ছুটে চলি সব জানাতে। চিনতে। ছুঁতে। তবু পারি না। আমরা কোনদিন শেষ পর্যন্ত, কোন কিছু ছুঁতে আর পারি না। (চলবে)
রীনা গুলশান টরন্টো। gulshanararina@gmail.com