প্রবাসে পরহিতকর্ম -৬৯
এপ্রিল ৯, ২০২০
ইউরোপের পথে পথে
রীনা গুলশান
(পূর্ব প্রকাশের পর)
“এত কলরব, তবু দু’-একটি মুহ‚র্ত স্থির হয়ে থাকে
মানুষের শান্তিময় পৃথিবীর স্বপ্ন ভেসে যায়
ঝুল বারান্দায় শুধু দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বিষন্ন মানুষ
সে জেনেছে
চুড়ান্ত মৃত্যুর আগে রাশি রাশি অপূর্ণ বাসনা বেঁচে থাকে\”
এবারে গাড়িতে উঠার পর অসহ্য আনন্দে আবার বিষন্নতা ঝুলে রইলো মনের ভেতরে। ভাবিনি মাত্র চার মাস আগেও আমি হাঁটতে পারবো। আর আজ আমি ইউরোপ ভ্রমণে বের হয়েছি। স্বপ্নের ‘লুভর’ আর্ট মিউজিয়াম দেখতে যাচ্ছি। সুনিলের এই কবিতাটি তাই মনে এলো। আধা আনন্দে কিছু আসেনা। অতি দুঃখেও কিছু আসে না।
বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে অবশেষে ‘লুভর’ মিউজিয়মের সামনে আমাদের নিয়ে এলো। এখন সময় দিলো ২ ঘন্টা। কারণ এরপরই রোমান্টিক নৌ-বিহার এবং ইত্যাদি। উহ! মনটা বিগড়ে গেল। আমার মুড দেখে নিকোল বললো, চিন্তা করো না। সবশেষে শপিং (পারসোনাল) এর জন্যও এক ঘন্টা থাকে। অতএব, জেমিমা-রা আর্ট গ্যালারীতে ইন্টারেস্টেড নয়। তুমি ঐ সময়টাতেও ‘Musée d’Orsa’ তে অবস্থান করবে। কারণ শেষ সময়টা ঐ মিউজিয়াম। তাই তুমি ৩ ঘন্টা সময় পাবে। আমি বল্লাম, ঠিক আছে। ওখানেই আছে আমার স্বপ্নের ভ্যানগগ, রেনিঅর, গাওগুইন, সেজান এমনি আরো বিখ্যাতরা। স্বপ্নের মধ্যে জেগে থাকা, এই সব আর্ট গ্যালারীর প্রথমটাতে প্রবেশ করলাম। এর সম্পর্কে আগেই মোটামুটি বেশ ভালোই ধারণা ছিল। তবু সেতো কেবলই থিওরীগত ধরণা। আজ দেখছি সেই স্বপ্নের ‘লুভর’ মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামটা পৃথিবীর সব থেকে বড় মিউজিয়াম। জানিনা এটা হয়তো প্রাচীনগত দিক দিয়ে, নাকি কলাকৌশলে? তবে সীমানাগত দিক দিয়ে আসলেই বিশাল আকৃতির মিউজিয়াম। মিউজিয়ামটা অনেকটা ‘ইউ’ প্যাটার্নের, কিন্তু সামনেই একটা বিশাল আকৃতির পিরামিডের মত স্থাপত্য।
‘লুভর’ মিউজিয়াম, এটা প্রথম শুরু করেছিলেন রাজা ‘ফিলিপ অগাস্টাস’ ১১৯০ সালে। এরপর এটা পৃথিবীর কাছে মারাত্মক ভাবে সমাদৃত হয় ১৭৯৩ সাল থেকে। এর ভেতরকার স্থাপত্য শিল্পকলা জগৎ বিখ্যাত। এর স্থাপত্যে সহায়তা করেছিলেন বিখ্যাত তিনজন আর্কিটেক্ট; পিয়েরে লেসকট, লুইস লে ভাও এবং ক্লাউড পেরাল্ট।
পরবর্তীতে যুগে যুগে লুভর মিউজিয়াম ক্রমশ বিখ্যাত হতে থাকে প্রধানত তিনটি কারণে – ১. এর স্থাপত্য শৈলী। ২. এই মিউজিয়ামের সন্মুখ ভাগে অসাধারণ স্থাপত্য শৈলীতে ‘পিরামিড’। এই পিরামিডের ভেতর এবং বহিরভাগ দুটোই অসাধারণ। ৩. ‘মোনালিসা’ নামক একটি পেইন্টিং। যেটা অঙ্কন করেছিলেন ‘লিও নার্দো দ্য ভিঞ্চি’।
যদিও ভিঞ্চির আরো প্রচুর আর্ট আছে এবং সেগুলোরও খুব সমাদর আছে। জগৎ বিখ্যাত ওয়্যাল পেইন্টিংও আছে।
যাইহোক, আমাদেরকে নামিয়ে দিল। কাপল দুজন (জেমিমা-রা) লাফিয়ে লাফিয়ে ক্যাঙ্গারুর মত ভেতরের দিকে চলে গেল। ‘নিকোল’ আমার হাত ধরে ছিলো। যদিও এটাই আমাদের সাথে ওর কন্টাক্ট, আমাকে ধরে রাখবে। হাটতে সাহায্য করবে। কিন্তু, আমি ওকে চলে যেতে বললাম। কারণ আমি যে ভাবে আত্মহারা হয়ে দেখছিলাম এবং দেখবো, নিকোল সেটা পারবে না। সে এটা মাসের মধ্যে কুড়ি দিন দেখে। আমি আর আমার স্বামী কাজিমকে বললাম, তুমি আমাকে ধরে থাকো। প্রথমে বাইরে থেকেই ভাল করে অবলোকন করলাম। বিশাল এর আয়তন। ভাবছি দুই-আড়াই ঘন্টায় এটার কি-ই বা দেখবো? তবু যতটা পারা যায়। প্রথমেই পিরামিডের ভেতরে ঢুকলাম। আসাধারণ। এটা পুরানো ধাচের স্টাইলে করেছে, যদিও ভেতরে একদম আধুনিকতায় ভরা। প্রচুর মানুষ এই পিরামিডের ভেতরে। আমি তাই মেইন বিল্ডিং এর মধ্যে প্রবেশ করলাম।
কি বলবো? কি দেখবো? কিভাবেই বা বর্ণনা করবো? তাইতো বলা হয় লুভর মিউজিয়াম বিখ্যাত এর ইন্টেরিওর ওয়্যাল ডেকোরেশনে। অসাধারণ বললে অনেক কম বল হবে। আমি কোনটা রেখে যে কোনটা দেখবো নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। ভেতরের সমস্ত ওয়্যাল টু ওয়্যাল অসাধারণ সব কারুকাজ। এবং অপরূপ সব রঙের খেলা। অথচ কোন রঙ চোখে লাগছে না। তবে হালকা হলুদ এবং ফিরোজা, হালকা গোলাপী, সোনালী রঙের কারুকাজ অনেক বেশী। আবার প্রতিটি দেয়ালে ঠিক যেন যেখানে যেটা শোভা পাবে, ঠিক সেখানে সেই ওয়্যালপেইন্টিং-টা শোভা পাচ্ছে। মনে হলো কয়েক হাজার ছবি ওয়্যাল টু ওয়্যালে শোভা পাচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত কৃত্তিমান তুলি শিল্পী, ভাস্কর্য্য শিল্পীদের কৃতকর্মে আমি বিভোর হয়ে যাচ্ছি। খুব ছোট বেলা থেকেই তুলি শিল্পী’র প্রতি আমার অমোঘ টান ছিল। তাই এদের ব্যাপারে মোটুমুটি জানার আগ্রহ ছিল বরাবরই। তাইতো এদের সেই সৃষ্টির কাছে এসে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি নিজে ছবি তুলতে পারছিলাম না। অবশ্য অনেক জায়গাতেই ছবি তুলতে বারণ করা হয়েছিল।
আলোকচিত্র, ভাস্কর্য্য, তুলি শিল্প দেখতে দেখতে এতটাই তন্ময় হয়ে যাচ্ছিলাম যে, আমি আমার নিজের ছবি তুলতেও ভুলে গেছি। লুভর মিউজিয়ামে মোট ৩৮ হাজারেরও বেশী ছবি আছে।
প্রাচীন এবং মধ্য প্রাচ্যের শৈল্পিক সভ্যতার সম্মেলন। আবাক হয়ে যাচ্ছিলাম, প্রাচীন সভ্যতার শিল্পকর্ম দেখে। কি যে সব তুলির আঁচর, তাদের অয়েল পেন্টিং! অতপর এক সময়ে স্বপ্নের সেই ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র আর্টের ওখানে এলাম। ইটালিয়ান এই শিল্পীর প্রচুর আর্ট-ই দারুন সাড়া ফেলেছে যুগে যুগে। তার ভেতরে ‘The last supper’ এবং ‘মোনালিসা’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। The last supper এটা ১৫ সেঞ্চুরীতে আঁকা, ১৪৯৫ থেকে ১৪৯৮ এর দিকে। এর আয়তন ৪.৬ x ৪.৪ মিটার।
এরপরই তার বিখ্যাত ‘মোনালিসা’। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এটি সৃষ্টি করেছিলেন তার জন্মস্থান ইটালিতে- ফ্লোরেন্স শহরে। ১৫০০/১৫০৬ সালের দিকে। পরবর্তীতে লুভর মিউজিয়ামে এর স্থাপনা হয়েছে ১৭৯৭ সাল থেকে। এর আয়তন ৭৭ x ৫৩ সেন্টিমিটার এবং এটি সেই ১৫০৩ সালেই উনি ৩৬০ ডিগ্রিতে তৈলচিত্রটি অঙ্কন করেছিলেন। অতি আশ্চর্য্যরে বিষয়। আপনি ছবিটির যে দিকেই যাবেন, মনে হবে সেদিকেই মোনালিসা আপনাকে দেখছে। এটি এমনই একটি আর্ট, যাকে নিয়ে পৃথিবীতে সব থেকে বেশী লেখা হয়েছে। এর উপর গান সৃষ্টি হয়েছে। এবং সবথেকে, আজ পর্যন্ত দর্শনার্থির সংখ্যাও বেশী এই ছবিটির জন্য।
যার জন্য এই ছবিটির আশে পাশে সব থেকে বেশী সিকিউরিটি। ছবিটি এখন খুব কাছ থেকে দেখবার উপায়ও নাই। ৬ ফুট দুরত্বে একটা বেরিকেড দিয়ে দিয়েছে। ওখান থেকেই দেখতে হবে। আর এত ভীড় যে সারাক্ষণ ধাক্কা-ধাক্কি অবস্থা। তারপর আবার দর্শনার্থীর মধ্যে ফাইন আর্টের স্টুডেন্ট বেশী। অবশ্য তাদের জন্য একটা সময়ও দেওয়া আছে, বিশেষ করে যারা ফাইন আর্টসের উপর উচ্চ শিক্ষার্থে প্যারিসে যায়। তারা এই ছবিটির সব থেকে বেশী ‘রেপ্লিকা’ তৈরী করে। এ ছাড়া আলোকচিত্র বাজারে হরহামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যায় ছবিটির পিছনের দিকটাতে কিঞ্চিত সবুজ এর জায়গাটাতে হলদে ছাপ পড়ছে। তাই সংরক্ষণ কমিটি এখন ক্যামেরাতে ছবি তুলতে নিষেধ করেছে। তবুও মানুষ লুকিয়ে তুলছে।
যাইহোক, নিকোল ২ ঘন্টা টাইম দিয়েছিলো। আমি প্রায় ৩ ঘন্টা পার করে ফেলেছি। অন্য কাপলটি বেশ বিরক্ত হলো আমাদের উপর। কারণ সব কিছু টাইমলি সেটআপ করা। আমরা দুঃখ প্রকাশ করে গাড়িতে উঠলাম।
এবার প্যারিসের অন্য কোথাও। অন্য কোন খানে। (চলবে)
রীনা গুলশান
টরন্টো। gulshanararina@gmail.com