প্রবাসে পরহিতকর্ম -৬৮

এপ্রিল ৯, ২০২০

ইউরোপের পথে পথে

রীনা গুলশান

প্যারিসের মাটিতে পা দিতেই, শরীরের ভেতরের গোটা সত্ত্বাই যেন শিরশির করে কেঁপে উঠলো। এই সেই প্যারিস। যে মাটিতে পা দেবার স্বপ্ন সেই কৈশর কাল থেকেই।

সুন্দরী তনয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের নিজেদের পরিচয় দিতে হলো না। কিভাবে জানি বুঝে গেল, আমরাই সেই জন, যাদের জন্য সে দাঁড়িয়ে আছে। প্লাকার্ডে, আমাদের দুজনারই নাম লেখা ছিল। অতএব, আমরা নিজেরাই এগিয়ে ‘হাই’ বললাম। সেও মধুর হাস্যে হাত বাড়িয়ে বললো, ‘আমি নিকোল’। বেশ স্পষ্ট উচ্চারনে ইংরেজী বললো। আমার খুব ভয় ছিল, না জানি কিভাবে কথা বলে। কারণ ফরাসীদের নিয়ে প্রচুর গুজব চালু আছে; তার মধ্যে প্রধানত, এরা ইংরেজী বলতেই চায় না। আর বললেও একদম বোঝা যায় না। কিন্তু নিকোল দারুন ইংরেজী বলে। এমনিতে বোঝা যায়, তার ফরাসী উচ্চারণ। নিকোল, নৃতত্বে মাস্টার্স করছে। এবং পার্টটাইম  সে টুরিস্ট গাইড হিসাবে কাজ করে।

আমাদের নিয়ে সে একটি এসইউভি গাড়িতে উঠলো। দেখলাম সেখানে আর একটা ইয়ং কাপল আগে থেকেই বসে আছে। তারা আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি থেকে এসেছে। সাদা পুরুষ, কালো রমনী। খুব হাস্যজ্জল। নিজেরাই হেসে হেসে তাদের পরিচয় দিল। পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগলো। মেয়েটা জেমিমা, খুবই প্রাণোচ্ছল। সেটা আমাকেও স্পর্শ করলো। একদিকে বয়স, অন্যদিকে আমার এই অসম্ভব এক্সিডেন্টের জন্য বেশ কিছুটা মৃয়মান মনোভাব যেটা ভর করেছিল, জেমিমা এবং নিকোলের প্রনোচ্ছলতায় এক ফুৎকারে উড়ে গেল।

প্যারিসের লেুভর আর্ট গ্যালারির সামনে লেখক ও তার স্বামী

যাত্রার প্রারম্ভে নিকোল (নিকোল ড্রাইভারের পাশে বসেছিল) প্যারিসের কিছু ইতিহাস বর্ণনা করলো। এবং প্যারিস কি কি কারণে বিখ্যাত। দর্শনার্থিদের কি কি দর্শন করা অবশ্যই জরুরী।

সমস্ত প্যারিস শহরটাই ৭টি আইল্যান্ডের সমন্বয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস। এটি শুধুমাত্র ফ্রান্সের রাজধানী, সেই কারণেই বিখ্যাত নয়। নানা কারণে প্যারিস বিখ্যাত। যার এক নম্বরই হলো ফ্যাশন ডিজাইনের জন্য বিখ্যাত। আর্ট এবং কালচারাল দিকে তো তারা জগৎ বিখ্যাত। আবার অন্য একটা দিকেও তারা জগৎ বিখ্যাত। সেটা হলো রন্ধন শিল্প। রন্ধন শিল্পে তাদের উদ্ভাবন ক্ষমতা এখন রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছে। রন্ধন শিল্পে নতুন নতুন আর্ট এবং অদ্ভ‚ত ধরণের রেসিপিতে তারা সত্যিই সারা পৃথিবীতে নিজস্ব একটা স্থান করে নিয়েছে।

প্রথমেই আমাদের টুরিস্ট গাইড, ড্রাইভার ডেভিড (সে নিজেও একজন টুরিস্ট গাইড) আমাদের মোটামুটি গোটা প্যারিস শহরটা একবার দিনের আলোতে প্রদক্ষিণ করাতে নিয়ে চললো। এবং ঘুরতে ঘুরতে গাইড ডেভিড বললো, তোমাদের দিনের আলোতে একবার ঘুরাচ্ছি কারণ, রাতে তোমাদের আরো একবার ঘোরাবো প্যারিস শহরটি। তখন বুঝবে, দুটোর তরতম্য। তবে দিনে না দেখলে প্যারিসের অরিজিনালিটি বুঝতে পারবে না। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় গাড়িটা থেমে গেল। বিশাল একটা গেট, এবং পাশে ফাঁকা মাঠের মত। মাঠের মধ্যে একটি লম্বা স্মৃতি স্তম্ভ আছে। মাঠের সামনের দিকে কিছু রেস্টুরেন্ট বা স্টলের মতও আছে। আমাদের মত বেশ কিছু টুরিস্ট আগে ওখানে অবতরণ করেছিল। তারা তখন ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিল। ডেভিড বললো, এই বিশাল স্তম্ভটি দেখছো এটার নাম ‘লাকদিওন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের প্রচুর মানুষ নিহত হয়েছিল। তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যেই এই লাকদিওন স্তম্ভ। বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে প্যারিসের এই স্থানে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। তারা সভা করে। ফুল দেয়। এবং কিছু মানুষ স্মৃতিচারণ করে। তবে এটা ঠিক, এরা যে স্মৃতিচারণ করে তার ভেতরে কোন মেকি মানসিকতা থাকে না। যথার্থ শোক ভাব থেকেই তারা স্মৃতিচারণ করে এবং তাঁদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে। আমরা বেশ কিছুক্ষণ ওখানে একটু হাটাহাটি করলাম এবং বেশ কিছু ছবি তোলা হলো। অতপর পুনরায় গাত্রোত্থান।

এবারে একেবারে হার্ট অব দা সিটিতে নিয়ে গেল। এটা প্যারিসের সেন্টার। তবে লন্ডনের মত না। এটা বেশ প্রসারিত। এখানে একটা শপিং সেন্টার এবং সব থেকে বড় অপেরা হাউসের সামনে আমাদের নামালো দেখবার জন্য। অসম্ভব মনোরম করে সাজানো গোটা সেন্টারের প্রতিটি কোন। মজার ব্যাপার ওদের লাইটিং বা এইযে ক্রিসমাসের জন্য ডেকোরেশন করেছে তার মধ্যেও একটা নতুনত্ব শৈল্পিক মনোভাব আছে। কি যে সুন্দর। দিনের আলোতেই এত ভালোলাগা, নাজানি রাতে আরো কত সুন্দর লাগবে। এবারে আমাদের হেটে হেটে এলাকাটা দেখতে হলো। এখানে না হেটে উপায় নেই। প্রতিটি বিল্ডিং এর একটা কাহিনী আছে। তাই ডেভিড সব বলে যাচ্ছিল। নিকোল আমার হাত ধরে হাটছিল। তাকে কন্টাক্ট করেছিলই আমাকে হেল্প করার জন্য। নিকোলকে পারসোনালি আমরা কন্টাক্ট করেছিলাম।

এবারে আমাদের প্যারিসের সব থেকে বড় মলের মধ্যে নিয়ে গেল। এটা ‘লেস গ্রান্ডস ব্লুভার্ড’ এরিয়াতে। এটা পৃথিবীর একটা বৃহত্তম মল। ‘লেস গ্যালারিস লাফেয়েটি (les galeries lafayette)’। এই মলের মধ্যে এমন কিছু নাই যে নাই। অসংখ্য টুরিস্ট শপিং করছে। অনেকে আবার এর উপর দিকে চলে যায় প্যারিসের সমগ্র ভিউটা দেখার জন্য। মলের মধ্যেই একটা বিশাল আকারের ‘ক্রিসমাস ট্রি’ দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা আমাদের কানাডার ইটন সেন্টারের মত। তবে ইটন সেন্টারের ক্রিসমাস ট্রি পৃথিবীর সব থেকে longest tree। এটা প্রোভাইড করে ‘সোরভাস্কি ক্রিস্টাল’ স্টোর। জার্মানেও পরে দেখেছি সোরভাস্কি প্রোভাইড করে। তবে প্যারিসে দেখলাম গোলাপির আধিক্য। সমস্ত ট্রি একটা গোলাপী লাইটিং এ সাজানো। ট্রি এর উপরেও গোলাপী রং এর অসংখ্য গিফট বক্স ঝুলানো।

চারপাশে ঘুরানো গ্যালারী। অনেকটা অপেরার মত। এবং অবশ্যই পুরানো ইউরোপিয়ান সভ্যতায় তৈরী এই মলটি। যদিও এটা মাত্রা ১৯৮১ সালে আট করেছে। পৃথিবীর যতরকম বিখ্যাত ফ্যাশন স্টোর সবই এখানে আছে। আবার প্যারিসের নিজস্ব ফ্যাশন স্টোর গুলোতো আছেই। আমি কিছুই কিনলাম না। ১৮ বছর ধরে মলে কাজ করেছি, তাই পৃথিবীর কোন মলে গিয়েই আমার মধ্যে একসাইটমেন্ট আসে না। মাত্র এক ঘন্টার মত ঘুরেই আমরা ফিরে এলাম আবার গাড়িতে। প্যারিসে এসে মলে টাইম নষ্ট করার কোন মানেই হয় না। তাও মাত্র একদিনের ট্যুরে।

এরপর আমাদের কথা হলো আর্ট মিউজিয়াম যেহেতু প্যারিসে অনেক, তাই সবগুলো দেখা মোটেই সম্ভব নয়। সেই জন্য আমরা প্রথমে যাব louver মিউজিয়ামে। তারপর অন্যান্য ট্যুর সেরে একদম শেষে যাবো musee d’orsay। গোট সত্ত্বা জুড়ে রইল একদিকে ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’ অন্যদিকে রেনিওর, ভ্যানগগ। (চলবে)

রীনা গুলশান টরন্টো।