প্রার্থনা

জুলাই ১৩, ২০২০

সালাহ উদ্দিন শৈবাল

আসুন আমরা সবাই সবার জন্য প্রার্থনা করি। যারা চির বিদায় নিয়েছেন তাদের জন্য প্রার্থনা কারি। যারা অসুস্থ হয়েছেন তাদের জন্য প্রার্থনা করি। যারা অসুস্থ হতে পারেন তাদের জন্য প্রার্থনা করি। যারা আমাদের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন তাদের জন্য প্রার্থনা করি।

“প্রার্থনার শক্তি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতোই সত্য। …এটা একমাত্র শক্তি যা প্রকৃতির আইনকেও পাল্টে দিতে পারে।”

“প্রার্থনা”

টরন্টোতে এইবারের সামারটা একটু খাপছাড়া। এই সুন্দর রোদ…চমৎকার উষ্ণতা। আবার একটু পড়েই মেঘ…বৃষ্টি। ধুম বৃষ্টি। আজকেও বৃষ্টি হলো। তবু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম।

হেঁটে হেঁটে লোকালয় দেখি। দোকান-পাট দেখি। আর দেখি ধর্মালয়। টরন্টোতে কত-শত ধর্মাশ্রম আছে তার হিসাব আমি জানি না। দুইশর বেশি জাতি-ধর্মের এই শহরে এই রকমই হওয়ার কথা। এই সাত বছরে এমন একটা নেইবারহুড বা মহল্লা আমি পাইনি যেখানে অন্তত: একটা ধর্মাশ্রম নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই সংখ্যা একাধিক। বিভিন্ন র্ধমের। বিভিন্ন মতের…পথের।

কারণ খুব পরিষ্কার। জরিপ অনুযায়ী টরন্টোর ৮০% মানুষ কোন না কোন ধর্মে বিশ্বাস করে। এর মধ্যে ৫৭% খৃষ্টান, ৮% মুসলিম, ৬% হিন্দু আর বাকিরা অন্যান্য। যে এলাকায় আজকে ঘুরেছি সে এলাকার আশে-পাশে পায়ে হেঁটে যতোটুকু ঘোরা যায় তার মধ্যে আমি ছয়টা চার্চ….গোটা তিনেক হিন্দু মন্দির আর দুটো মসজিদ খুঁজে পেয়েছি। আরো বেশি থাকতে পারে।

এই খানে একটা টুইষ্ট আছে। ধর্মে বিশ্বাস করে ৮০% মানুষ। কিন্তু নিয়মিত ধর্মাচার পালন করা বা মন্দির/মসজিদে যাওয়া লোকের সংখ্যা কিন্তু বেশ কম এই শহরে।

তারপরও উইকএন্ডে এগুলো জমজমাট থাকে। চার্চগুলোতে প্রার্থনা হয়। আবহাওয়া ভালো থাকলে বার্বিকিউ হয়। আমি একটু দূরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে মানুষ দেখি। সাদা, কালো বা আমাদের মতো বাদামী মানুষ দেখি। অনেক অস্বচ্ছল মানুষ দেখি। মানুষগুলো সপরিবারে আসে। পুরুষদের পড়নে ঢোলা-ঢোলা বেমানান স্যুট থাকে। বোঝা যায় কম দামে কোথাও থেকে কেনা হয়েছে। মহিলারা সেঁজে-গুজে আসে। বাচ্চারা সব আনন্দ নিয়ে আসে। একটু পরেই তারা সব বাইরে বেরিয়ে খেলা-ধুলা শুরু করে। তাদের হাতে খাবার থাকে। বোঝা যায় চার্চে খাবারেরও ব্যবস্থা আছে। খাবারের ব্যবস্থা মসজিদ- মন্দিরেও থাকে।

চার্চগুলোর নামের সংগে সুন্দর সুন্দর শব্দ বা স্লোগান লাগানো থাকে। Hope….Grace…Miracle…. বা পুরা একটা লাইন “I will give you a new heart”। হিন্দু মন্দিরগুলো ঠিক আমাদের দেশের মন্দিরের মতো মনে হয় না। বেশির ভাগ শিব মন্দির। প্রতিমাগুলোর চেহারা ভিন্ন মনে হয়।

হঠাৎ মেঘ করলো। বাতাস শুরু হলো। নিমিষে চারিদিক আঁধার হয়ে গেলো। বুঝলাম পা চালিয়ে লাভ নেই। বৃষ্টি এড়ানো যাবে না। আশে-পাশে আশ্রয় খুঁজছিলাম। বৃষ্টি নেমেই গেলো। ইয়া বড় বড় ফোঁটা! এই আরেক নতুন জিনিস দেখছি এই বছর। কানাডার বৃষ্টি বেশির ভাগ ঝাপটা বৃষ্টি…টিপ টিপ বৃষ্টি। কিন্তু এই বছররের বৃষ্টি আলাদা। শুরুই হচ্ছে একেবারে বালতি-বালতি পানি ঢেলে। বিরাট বিরাট ফোঁটা..ভিজিয়ে দিচ্ছে। দৌড়ে একটা একতালা বিল্ডিংয়ের কোনায় আশ্রয় নিলাম। কোনাটা অন্ধকার। মাথায় ছাদ আছে। উপর থেকে বৃষ্টি পড়বে না। কিন্তু বৃষ্টির ঝাপটা লাগছিলো ঠিকই। গায়ের পানি ঝাড়তে গিয়েই কেমন অস্বস্থি হলো। মনে হলো আমি একা নই! অন্ধকার একটু সয়ে এসেছে। চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম আরেকজন মানুষ আমার দুই হাত দূরে দাড়িয়ে আছে। পড়নে গাঢ় রংয়ের পোষাক। মহিলা। মাথা নিঁচু করে দাড়িয়ে আছে। তার দাড়ানোর ভঙ্গিতে কিছু ছিলো। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে ভালো নেই। সে কাঁদছে। কিভাবে বুঝলাম? জানি না। এই অন্ধকার..বৃষ্টি…ঝোড়ো বাতাস। তারপরও বুঝলাম। অস্বস্থি বেড়ে গেলো। জায়গাটা খুব বড় না। আমার এখন এই জায়গা ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। এই মহিলার এখন একাকিত্ব দরকার। আমি বৃষ্টিতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম।

 “তুমি এখানে দাড়াতে পারো। বাইরে খুব বৃষ্টি। আমার সমস্যা হবে না।” কন্ঠস্বর ভেজা কিন্তু পরিষ্কার। মহিলাকে দেখলাম। চল্লিশ পার হয়েছে।

“থ্যাংক্স। আমি শৈবাল। নাইস টু মিট ইউ।”

“আমি মার্থা। নাইস টু মিট ইউ টু।”

আশে পাশে ভালো ভাবে নজড় দিয়ে বুঝলাম আমি একটা বেশ বড় সড় চার্চ ভবনের সাইড ডোরে দাড়িয়ে আছি। মূল ফটক আর বারান্দাটা আরো সামনে। সেখানে যেতে হলে বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। বৃষ্টি কমার অপেক্ষায় রইলাম। আমার আর কোন কথা বলা দরকার কিনা বুঝতে পারছিলাম না। মহিলা একটু সময় নিলো। তারপর কথা শুরু করলো।

“মনে হয় বৃষ্টি থামতে সময় নেবে। তুমি কি এই চার্চেই আসো?”

“না। আমি শুধু বৃষ্টিতে আশ্রয় নিয়েছি। তুমি?”

“আমিও আসি না। চার্চে আসা হয় না অনেক দিন। আজকে এসেছিলাম। না আসলেও হতো। হাসপাতালের নার্সিং ষ্টাফরাই সব ঠিক করে দিয়েছিলো। তারপরও এসেছিলাম। আমার ছেলের Sacrament of Anointing নিয়ে প্রিষ্টের সংগে কথা বলার জন্য এসেছিলাম।“

আমি থমকে গেলাম। Sacrament of Anointing মানে আমার জানা আছে। Anointing of the Sick|। মানুষ যখন প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে যায়..বা বয়স হয়ে যায়..বড় কোন সার্জারীর প্রয়োজন হয়…. হয়তো মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে যায় তখনই কেবল এই প্রেয়ার করা হয়। অনেকটা আমাদের দেশে প্রচলিত জালালী খতমের মতো। একজন প্রিষ্ট হাসপাতালে যান। অসুস্থের মাথায় হাত রাখেন। পবিত্র তেল দিয়ে কপালে ক্রশ আঁকেন। তারপর শেষ ভরসা হিসাবে এই প্রার্থনা করেন: “Through this holy anointing, may the Lord in his love and mercy help you with the grace of the Holy Spirit..”

আমি আস্তে করে বললাম, “সরি……তোমার ছেলে ভালো হয়ে যাবে। আমিও প্রার্থনা করবো।”

মহিলা মাথা নিঁচু করলেন…“জানিনা। আমি খুব ধার্মিক না। ডাক্তার বললেন তাদের আর খুব বেশি কিছু করার নেই। আমার ছেলে মার্ক….মাত্র ১৪ বছর বয়স। কি দেখেছে সে? জীবনের? কিছুই না…? কি যে হলো? জানি না। কেন এমন হয়…আমি জানি না। তোমাকে এই সব কেন বলছি তাও জানি না। সরি!”

আমরা অন্ধকারে দাড়িয়ে রইলাম। ঠিক এই মুহুর্তে আমার এই মাকে একটা কিছু বলতে ইচ্ছে হলো। মনে হলো এমন কিছু বলি যেটা শুনে তার মন একটু ভালো হবে। একটু শান্ত হবে। তিনি আশাবাদী হবেন। আমি শুরু করলাম।

“আমি মুসলিম। আমার মা যতদিন বেঁচে ছিলেন প্রতি ভোরে পবিত্র কোরআন পড়তেন। আমার ঘুম ভাঙতো তার পাঠ শুনে। তারপর তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে অনেক সময় নিয়ে প্রার্থনা করতেন। সবার জন্য। আমাদের জন্য। আমি তার প্রার্থনা শেষের জন্য অপেক্ষা করতাম। কারণ প্রার্থনা শেষে তিনি আমাকে ডেকে আমার বুকে তিন বার ফুঁ দিতেন। বলতেন, ‘আমি তোমার জন্য প্রার্থনা করেছি। আল্লাহ তোমাকে ভালো রাখবেন।’ আমার বুক সাহসে ভরে যেত। মনে হতো আমার কোনো খারাপ কিছু হবে না। আমি বিশ্বাস করি আমার মায়ের সেই দোয়া এখনো আমাকে ঘিরে আছে। ঢেকে রেখেছে । আমি বিশ্বাস করি মানুষের প্রার্থনা…ভালোবাসার মানুষের প্রার্থনা..তা যে ধর্মেই হোক না কেন….তার শক্তি অসীম। অষবীরং ঈধৎৎবষ একজন বিখ্যাত ফ্রেন্স সার্জন এবং বায়োলজিষ্ট ছিলেন। তিনি তার কাজের জন্য ১৯১২ সালে নোবেল পুরষ্কারও জিতেছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন – “Prayer is a force as real as terrestrial gravity. As a physician, I have seen men lifted out of sickness by the power of prayer. It is the only power in the world that overcomes the laws of nature.”

মার্থা চট করে আমার দিকে ঘুরে তাকালো। তার চোখে অন্য আলো।

“…তিনি এরকম বলেছিলেন? সত্যি এরকম বলেছিলেন?…এতো বড় ডাক্তার….!”

“হ্যাঁ বলেছিলেন। তুমি গুগল করতে পারো।…আর শুনলে তোমার ভালো লাগবে Alexis Carrel মাইগ্রেট করে কিছুদিন এই কানাডার মন্ট্রিয়লেও ছিলেন। ভালো থাকো। Take care!”

বাইরে বৃষ্টি ধরে এসেছে। মেঘ সড়ে গেছে। আমাকে এখন যেতে হবে।

সালাহ উদ্দিন শৈবাল। টরন্টো