কানাডা – প্রাচীন কথা

জানুয়ারী ১০, ২০২০

( ১) নারীর ভোটাধিকার ও রাজনীতি করার অধিকার

ফেমাস ফাইভ (উপরে বাঁ থেকে) Louise McKinney, Nellie McClung, Henrietta Muir Edwards. (নিচে বাঁ থেকে) Emily Murphy, Irene Parlby, ফেমাস ফাইভ এর গ্রুপ ছবি। : ছবি -Glenbow Archives.

বর্তমান বিশ্বে কানাডা একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে সুপরিচিত এবং বহুল প্রসংশিত। কিন্তু ভাবা যায় এই দেশটিতেই প্রায় শত বছর আগে নারীদের কোন ভোটাধিকার ছিল না! হ্যা, সত্যিই তাই। স্থানীয় এবং ফেডারেল পর্যায়ের কোন নির্বাচনেই তারা ভোট দিতে পারতেন না। তবে বছরের পর বছর নারী অধিকার আন্দোলন, নারী ভোটাধিকার অর্জনের জন্য অনেক সংগ্রামের পথ পেরিয়ে ১৯১৫ সালের ডিসেম্বরে মেনিটোবা প্রভিন্সের পার্লামেন্টে একটি আবেদপত্র জমা দেয়। ঐ আবেদপত্রে প্রায় চল্লিশ হাজার নারী পুরুষের স্বাক্ষর ছিল। মেনিটোবার তৎকালীন প্রিমিয়ার টি এস নরিস নারী অধিকার সমর্থন করে পার্লামেন্টে বিলটি উত্থাপন করে সেটা পাস করিয়ে নেন। সূদীর্ঘ যুগের অপ্রতিরোধ্য নিরলস আন্দোলনের পর কানাডার ইতিহাসে প্রথমবারের মতন প্রভিন্সিয়াল রাজনীতিতে নারী ভোট প্রদানের অধিকার এবং রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার অর্জন করে। কিন্তু সকল শ্রেণীর নারীর অধিকার তখনো অর্জন হয়নি। আর নারীদের ফেডারেল নির্বাচনে ভোটাধিকার তখনোও ছিল অধরা দূরের স্বপ্ন।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, ১৯৬১ সালে প্রথমে কানাডার তিনটি প্রভিন্সে তাদের ভোটাধিকর দেয়া হয়। প্রভিন্স তিনটি হলো, মেনিটোবা, সাচকাচুয়ান এবং আলবার্টা। আর ফেডারেল সরকার ১৯১৭ সালে যুদ্ধের সময় সীমিত আকারে কিছু নারীর ভোটাধিকার প্রদান করে। পরে ১৯১৮ সালে সব নারীর ভোটাধিকারই প্রদান করা হয়। ১৯২২ সালের মধ্যে কানাডার কুইবেক ছাড়া বাকী সব প্রভিন্সেই নারীদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। কুইবেকে এই স্বীকৃতি প্রদান করা হয় ১৯৪০ সালে। আর নিউফাউন্ডল্যান্ডে ১৯২৫ সালে নারীদের সম্পূর্ণ ভোটাধিকার দেয়া হয়। ঐ সময় নিউফাউন্ডল্যান্ড অবশ্য কানাডার অংশ ছিল না। স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচিত হতো। সূত্র -উইকিপিডিয়া।

উল্লেখ্য যে, নারীদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে কানাডার ইতিহাসে পাঁচজন তেজী মেধাবী বিদুষী অগ্নীকন্যা কানাডার সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা করেছিলেন। ঐ মামলাটি ইতিহাসে ‘Persons’ Case  হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। বৃটিশ নর্থ আমেরিকান এক্ট ১৮৬৭ অনুযায়ী কেবলমাত্র ‘Persons’ -দের ( এই শব্দটি তখন শুধু পুরুষরদেরকে বোঝাতো ) ভোট দেবার অধিকার ছিল। ১৯২৭ সালের ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টে আলবার্টার পাঁচজন নারী এই বৃটিশ নর্থ আমেরিকান এক্ট এ বর্ণিত ‘Persons’ হিসেবে নারীরা অন্তর্ভুক্ত কিনা জানতে চেয়ে মামলা করে। ২৪শে এপ্রিল ১৯২৮ কানাডার সুপ্রিম কোর্ট সম্মলিত সিদ্ধান্তে Persons হিসাবে নারীরা অন্তর্ভুক্ত নয় বলে জানিয়ে দেয়। তারপর এই পাঁচজন বিদূষী নারী তাদের এই মামলাটি তখনকার সময় কানাডার সর্বোচ্চ আদালত Judicial British privy council আবেদন করে। ২৮শে অক্টোবর,১৯২৯ বৃটিশ জুডিশিয়াল প্রিভি কাউন্সিল তাদের পক্ষে রায় দিয়ে বলেন যে নারীরাও এই চবৎংড়হং হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। ঐ ঐতিহাসিক রায়ের পর কানাডায় নারীরা সিনেটে নিয়োগ প্রাপ্তির এবং রাজনীতি করার অধিকার পায়। আলবার্টার ফেমাস ফাইভ বলে যারা কানাডার ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন তারা হলেন:
1.Judge Emily Murphy
2.Henrietta Muir Edwards
3.Nellie McClung
4.Louise Crummy Mckinney
5.Irene Parl

(২) ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ার

Tommy Douglas- Pic-Timetoast timelines

আমারা যারা কানাডার নাগরিক এবং যারা এদেশের অধিবাসী তারা সকলেই বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পেয়ে থাকি। কারো -কারো বেলায় কিছু -কিছু অত্যন্ত কঠিন জটিল রোগের জন্য লক্ষ -লক্ষ ডলারের চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনা ম‚ল্যে করা হয়। আমাদের দেশ কানাডা ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ারের আশীর্বাদের ফলে আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান সেকথা নি:সন্দেহে বলা চলে।
যে মহৎজন আমাদের জন্য এই স্বাস্থ্যসেবার প্রকল্পটি বাস্তবে রুপ দিয়েছিলেন তার নামটি আমরা হয়ত অনেকেই জানিনা, আসুন জেনে নেই -সেই কানাডা হেলথ কেয়ারের জনকের নাম, এবং এক কঠিন জন্ম ইতিহাস। তাঁর নাম Tommy Douglas. বৃটেনে জন্ম গ্রহণ করেন ১৯০৪ সালের ২০শে অক্টোবর। তিনি কানাডার মেনিটোবা’র ব্রেনন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্টারিওর ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। এছাড়াও ডক্টরেট করার জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু নানান কারণে তা শেষ করতে পারেননি।
প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন ধর্ম যাজক । পরে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৩৫ সালে কানাডার পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন কোঅপারেটিভ কমনওয়েলথ ফেডারেশন (CCF) দল থেকে। টমি ডগলাস সাসকাচুয়ানের প্রিমিয়ার হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন ১৯৪৪ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৭ সালে ডগলাস সাস্কাচুয়ানে সর্বসাধারণের জন্য মেডিক্যান ইনসুরেন্স প্রবর্তন করেন। তারপর বিভিন্ন মহলের প্রবল বাধা বিপত্তি ও রাজনৈতিক সংগ্রাম প্রতিবন্ধকতার ভিতর দিয়ে তার দল ১৯৬২ সালের পহেলা জুলাই সমস্ত প্রভিন্স জুড়ে সরকারি ভাবে সবার জন্য স্বাস্থসেবা প্রণয়ন করেন। ১৯৬০ সালের জুন মাসের প্রভিন্সিয়াল রাজনীতির সর্বপ্রধান এজেন্ডা ছিল হেলথ কেয়ার। এই হেলথ কেয়ারের বিপক্ষে সর্বাত্মক শক্তি নিয়ে অবস্থান নেয় কানাডা মেডিকেল এসোসিয়েশন, সাস্কাচুয়ান মেডিকেল স্কুল, ডাক্তার, নার্স, আমেরিকা মেডিকেল এসোসিয়েসন সমস্ত ইন্সুরেন্স কম্পানি, শহরের স্বনামধন্য পাদ্রি এবং প্রভিন্সের বড় বড় ব্যবসায়ী দল। শুধু তাই নয়, সাস্কাচুয়ান ডাক্তাররা হেলথ কেয়ার এজেন্ডার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জুন ০১-২৩ পর্যন্ত তিন সপ্তাহব্যপী হরতাল পালন করে। এই নির্বাচনে হেলথ কেয়ারের বিপক্ষে সর্বাত্মকভাবে প্রচার প্রচারণা চালানো হয় এবং তারা প্রচার প্রপাগান্ডা অভিযানে ১০০,০০০ ডলার খরচ করে। সে সময় এই পরিমাণ অর্থ কোন রাজনৈতিক দল কর্তৃক তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যয় করার সাধ্য ছিল না। তারা রেডিও, টিভি, মিটিং, মিছিল, জনসভা এবং ফ্লায়ায়ের মাধ্যমে তুমুল প্রপাগান্ডা চালায়। তারা বলতে থাকে ডগলাসের এটা হবে সোসালিস্ট মেডিকেয়ার। KOD (keep our doctors) নামের একটি দল প্রচারণায় ব্যাপক অংশ নেয় । তারা প্রচারণা চালায় এই বলে যে, এতে করে জনসাধারণ নিজেদের ডাক্তার নির্ধারণ করতে পারবে না, জোর করে এবর্সন করানো হবে, ভিন্ন মতাবলাম্বীদের মানসিক বৈকল্যে এবং ভারসাম্যহীন হবার অজুহাতে সরকারী বুরোক্রেটরা তাদের মানসিক হাসপাতালে প্রেরণ করবে। সরকার সোসালিস্ট কমিউনিস্ট আদলে দেশ চালবে। আমাদের দেশের মেধাবী চিকিৎকরা দেশ ছেড়ে চলে যাবে, ফলে ইউরোপের নিম্নমানের ডাক্তাররা এসে ডাক্তারী পেশার জায়গা দখল করবে এবং আমাদের চিকিৎসার মান হবে অত্যন্ত নিম্ন। এ সকল প্রচার অভিযানের ফলে দুটি শিবিরের সমর্থক দল শহর বন্দরে প্রচন্ড রাজনৈতিক সংঘর্ষে লিপ্ত হবার জন্য উত্তপ্ত হতে থাকে। ফলে সাস্কাচুয়ানের জনসাধারণ পরিস্কার দুটো দলে ভাগ হয়ে যায়। হেলথ কেয়ারের পক্ষে এবং বিপক্ষে। হেলথ কেয়ার ইস্যুতে ধীরে ধীরে প্রভিন্সটি এতই উত্তপ্ত হতে থাকে যে সম্ভাব্য একটি গৃহযুদ্ধের মুখামুখি হয় দুই পক্ষ। নির্বাচন উপলক্ষে দাঙ্গা হাঙ্গামা ও উত্তাপ পেরিয়ে টমাস ডগলাসের দল CCF ৪২% ভোট পেয়ে ৫৪টি আসনের মধ্যে ৩৭টি আসন জিতে নেয়। সাস্কাচুয়ানের হেলথকেয়ার প্রোগ্রাম চালু হবার পর ১৯৫০ সালে বৃটিশ কলম্বিয়া এবং আলবার্টায় সাস্কাচুয়ানের আদলে হেলথ কেয়ার সিস্টেম চালু করে। কানাডার ফেডারেল সরকার পুরো কানাডায় প্রভিন্সিয়াল সরকারের সহায়তায় হেলথকেয়ার সিস্টেম চালু করে ১৯৬২। ফেডারেল সরকার প্রভিন্সিয়াল সরকারদের ৫০% অর্থায়ন করবে যাতে প্রভিন্সগুলো ইন্সুরেন্স কম্পানীর সাথে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়। যেটা পরবর্তিতেকালে সমগ্র কানাডায় ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ার নামে প্রণয়ন করা হয়। এই ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ারে অধীনে আমরা বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পাবার সৌভাগ্য অর্জন করি। টমাস ডগলাস তার প্রভিন্স সাস্কাচুয়ানে হেলথকেয়ের বাস্তবায়নের পর প্রভিন্সিয়াল রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে ১৯৬১ সালে জন্ম নেয়া নতুন ফেডারেল রাজনৈতিক দল NDP দলের প্রধান হয়ে নেতৃত্বের দায়িত্ব নেন। কানাডা হেলথকেয়ারের জনক টমাস ডগলাসের প্রতি আমাদের গভীরতম শ্রদ্ধা এবং আকাশসম কৃতজ্ঞতা ।
মোয়াজ্জেম খান মনসুর। টরন্টো।