জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল পার্টির মাইনরিটি বিজয় এবং পশ্চিম কানাডার বিচ্ছিন্নতার চ্যালেঞ্জ

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

গত ২১শে অক্টোবর কানাডার ৪৩তম জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেল। জাস্টিন ট্রুডো, এন্ড্রু শিয়ার এবং জাগমিত সিং এই তিন দলীয় প্রধান জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে টানা একচল্লিশ দিন নিরলস নির্বাচন প্রচার অভিযান চালিয়েছেন, চষে বেড়িয়েছেন সমগ্র কানাডা। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সবদিকেই। প্রত্যেকে তারা তাদের নিজেদের দলীয় কর্মসূচী জনগনের কাছে মনোগ্রহী এবং আর্কষণীয় করার প্রাণপন চেষ্টা করে দলকে জিতিয়ে প্রধান মন্ত্রীর আসনে বসতে চেয়েছিলেন। কানাডার জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বাংগালী সমাজেও চলতে থাকে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা আর আলোচনা তর্ক বির্তকের ঝড়, কোথাও কোথাও চায়ের পেয়ালায় জমজমাট আড্ডায় কখনোবা ঘরোয়া জলসায় অথবা টিম হর্টেনের কফির আড্ডায় এবং ডেনফোর্থের (বাংগালী পাড়া) রেস্তোরায় বা চৌরাস্তার মোড়ে। সমগ্র কানাডায় চলতে থাকে নার্ভ ব্রেকিং করা এক টান টান উত্তেজনা- কে হতে যাচ্ছে আগামী প্রধান মন্ত্রী? কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান এন্ড্রু শিয়ার নাকি লিবারেল পার্টির প্রধান জাস্টিন ট্রুডো দ্বিতীয় বারের মতন হতে যাচ্ছে প্রধান মন্ত্রী? গত কয়েক বছর আগেও জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা ছিল তুংগে। ৪৫% কানাডিয়ান তাকে সমর্থন করে আসছিল। সবাই ধারণা করছিল জাস্টিন ট্রুডো আরো দুই তিন টার্ম লিবারেল দলের নেতা হয়ে প্রধান মন্ত্রীর আসনে বসে সহজেই দেশ শাসন করবে। কিন্তু নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছিল, সে আশা ততই দূরে সরে যাচ্ছিল। নিবার্চনের বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছিল লিবারেল এবং কনজার্ভেটিভের মধ্যে প্রচন্ড লড়াই হবে। কখনো লিবারেল কয়েক শতাংশ উপরে আবার কখনো কনজার্ভেটিভ কয়েক শতাংশ উপরে। জরিপে এভাবেই দেখা যাচ্ছিল একটি হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাষ।

শেষ সপ্তাহের জরিপে দেখা গিয়েছিল লিবারেলের জনপ্রিয়তা নেমে এসেছে ৩০ শতাংশে। কনজার্ভেটিভের জনপ্রিয়তা ছিল ৪১.৫ শতাংশ, এন ডি পি ১৯ শতাংশ আর এলিজাভেথ মে’র গ্রীন পার্টি ৩ শতাংশ। (নানোস জরিপ )। কিন্তু আবার প্রধান মন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান ভিন্ন জরিপে জাস্টিন ট্রুডো সব সময়ই এগিয়েছিল এন্ড্রু শিয়ার এবং জাগমিত সিং এর চেয়ে। তবে এবার টিভি বিতর্কে জাস্টিন ট্রুডো ভাল করতে পারেনি। সবাইকে চমকে দিয়ে এন ডি পি প্রধান জাগমিত সিং ফরাসী ভাষার উপর দুর্দান্ত দখল প্রদর্শন করে বিতর্কে সবচেয়ে ভাল পারফর্মেন্স দেখিয়েছেন। ফলে জরিপে তার জনপ্রিয়তা তর তর করে উপরে উঠে যাচ্ছিল – প্রায় ১৯%। যেটা ট্রুডোর জন্য ছিল দারুন দু:সংবাদ ।

জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা কমে যাবার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ছিল (১) এস এন সি লাভালিন কম্পানী কেলেংকারী। এবং তার সাথে জড়িত জাস্টিস মিনিস্টার জোডি উইলসন-কে মন্ত্রীত্ব থেকে বহিস্কার করা, (২) ট্রান্স কানাডা পাইপ লাইন নির্মাণ, (৩) অতীতে মুখে কালো রং বাদামি রং মেখে সং সেজে ফূর্তি করা যা রেসিস্ট হিসেবে প্রচারণা পায় বিরোধী শিবির কনর্জাভেটিভ দল থেকে। (৪) আর ট্রুডো কর্তৃক যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার ২১০০০ রিফুজিকে কানাডায় এনে পুনর্বাসন করা নিয়ে অনেকে অসন্তুষ্ট হয়েছেন।

এস এন সি লাভালিন কানাডার মনট্রিয়ালের এক বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং ও কনস্ট্রাকশন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি কানাডা সহ পৃথিবীর বহু দেশে কাজ করে। বাংলাদশের পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজ হাতিয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ঘুষ কেলেংকারীতে জড়িয়ে পড়ার ফলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দূর্নীতির মামলা করা হয় কানাডার কোর্টে।

৫. এস এন সি লাভালিন মন্ট্রিয়ালের Jacques Cartier সেতু প্রকল্পে ফেডারেলের এক কর্মকর্তাকে ২.৩ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দেয়ার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়। এছাড়াও ২০০১ -২০১১ সালে লিবিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফী’র ছেলেকে ৪৮ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়ে লিবিয়ায় বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পের টেন্ডার কম্পানীর অনুকুলে আনার জন্যে এই প্রতিষ্ঠানের বিরদ্ধে মামলা করা হয়। এই মামলায় প্রতিষ্ঠানটি দোষী সাব্যস্ত হলে দেশে তাদের ফেডারেল গ্র্যান্ট পাওয়া বন্ধ হবে এবং আন্তর্জাতিক টেন্ডারেও বিডিং করা থেকে ক্ষমতা হারাবে। আর এতে করে কয়েক হাজার কর্মী চাকুরী হারাবে এবং বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক আয় থেকে দেশ বঞ্চিত হবে। সম্ভবত: সেই কারনেই প্রধান মন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তার জাস্টিস মিনিস্টার জোডি উইলসনকে এই কেইসটি-কে পুনর্বিবেচনা করার জন্য ভেবে দেখতে বলেছিলেন। কিন্তু জোডি উইলনসন এ ব্যাপারটি তার দায়ীত্বে হস্তক্ষেপ বলে সেটা প্রত্যাখ্যান করেছিল। এই খবর মিডিয়ায় প্রচার পাওয়ায় ট্রুডোকে অত্যন্ত বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল। জোডি উইলসনকে তার জাস্টিস মিনিস্টার থেকে সরিয়ে দিয়ে ইন্ডিয়ান এ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয় দেবার প্রস্তাব দিলে জোডি উইলসন তা গ্রহণ করেনি। এখানে উল্লেখযোগ্য যে জোডি উইলসনই কানাডার ইতিহাসে প্রথম নেটিভ হাই প্রফাইল কেবিনেট মিনিস্টার। তার আগে নেটিভ ইন্ডিয়ানরা কোন মন্ত্রীসভায় স্থান পায়নি।

২১শে অক্টোবর, সোমবার ছিল নির্বাচন। অফিস আদালত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবই খোলা ছিল। টিভি রেডিওতে প্রচার হচ্ছিল ভোট দেবার সময়সূচি। সকাল ৯:৩০ থেকে রাত ৯:৩০ পর্যন্ত খোলা ছিল ভোট কেন্দ্র ভোট দেবার জন্য। ছেলে মেয়েদের পই -পই করে বলে দেওয়া হয়েছিল সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ভোট দিয়ে আসতে। আমি সস্ত্রীক ভোট দিতে গেলাম দুপুর তিনটায়। দুই মিনিটের মধ্যেই ভোট দেওয়া সেরে বাসায় ফিরলাম আমরা। সন্ধ্যায় মেয়ে শার্লীন ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে এসে ভোট দিয়ে এল আর ছেলে সারভী কাজ শেষে সন্ধ্যায় ভোট দিয়ে এল।

আমরা সন্ধ্যায় বসে গেলাম টিভি সেটের সামনে অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে ফলাফল দেখার জন্য। ফলাফল আসতে শুরু করল সাড়ে আটটায় সময় থেকেই। প্রথম থেকেই লিবারেল দল এগিয়ে থাকে। সি টি ভি ২৪ , গ্লোবাল নিউজ রাত দশটার আগেই লিবারেল পার্টিকে মাইনোরিটি বিজয়ী বলে ঘোষনা দেয়। রাত বারটায় সব প্রভিন্সের ফলাফল চলে আসে। সর্বমোট ৩৩৮ আসনের মধ্যে লিবারেল পায় ১৫৭ , কনজার্ভেটিভ ১২১ ,এন ডি পি ২৪, ব্লক কুবেকুয়া ৩৩ (কুবেক প্রভিন্সের দল ) গ্রীন পার্টি ৩ , আর স্বতন্ত্র ১ (বহিস্কৃত মন্ত্রী জোডি উইলসন)। গত বার লিবারেল ১৮৪ আসন পেয়ে বিজয়ী হয়েছিল। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে হলে লিবারেলের প্রয়োজন ছিল কমপক্ষে ১৭০টি আসন। কিন্তু মজার ব্যপার হলো যে , প্রাক নির্বাচন জরিপে দেখানো হচ্ছিল তার উল্টো চিত্র। জরিপে দেখানো হচ্ছিল কনজার্ভেটিভ দলের মাইনরিটি বিজয়ের সম্ভবনায় তাদের সরকার গঠনের সম্ভবনা। এন ডি পি’র ৪৪ সিটের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে মোট ২৪টিতে। কনজার্ভেটিভ দল গতবারের ৯৯ আসন থেকে এবার ১২১টিতে উঠে আসে। কুবেকে প্রায় বিধ্বস্ত বøক কুবেকোয়া পার্টি গতবারের ১০ আসন থেকে ৩৩ উঠে আসে। ২০১৫ সালে তৎকালীন পার্টি প্রধান টম মলকেয়ারের রেখে যাওয়া এন ডি পি’র ৪৪টি সিট থেকে মাত্র ২৪টি সিট ধরে রাখতে পারল জাগমিত সিং।

কুইবেক এর বিতর্কিত বিল-২১ (কুইবেক প্রভিন্সের কোন কোন সরকারী অফিসে কর্মরত নাগরিকেরা ধর্মীয় পোষাক বা প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না) এর বিপক্ষে গত ২০১৫ নির্বাচনে এন ডি পি প্রধান টম মলকেয়ার কুইবেকে অত্যন্ত দৃঢ় এং সাহসী অবস্থান নেয় এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে অনঢ় থাকে। সেই কারনে কুবেকের ৫৮ আসন থেকে ৪২টিই হারায়। এবার জাগমিত সিং বিল ২১ বিরুদ্ধে কোন সাহসী জোরালো পক্ষপাতের ভুমিকা নেয় নি তবুও দল প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কইুবেক শিবিরে। তাদের ১৬ আসন থেকে মাত্র একটি (১) ধরে রাখতে পেরেছে। বলা যেতে পারে এই পরাজয়ের একমাত্র কারণ বর্ণবৈষম্যে আচ্ছাদিত প্রভিন্স কুইবেক মাথায় লাল হলুদ পাগড়ী মুখ ভর্তি দাড়ি শিখ ধর্মালম্বী জাগমিত সিংকে প্রায় সম্পূর্ন ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। লিবারেলের ৪০ সিট কমে ৩৫ সিটে নেমে আসে এবং এন ডি পি’র ১৬ সিট কমে ১টিতে নেমে আসে। এবার কোন বড় দলই কুইবেকের বিতর্কিত বিল ২১ নিয়ে কথা বলেনি ভোটের হিসাব মাথায় রেখে। কিন্তু তিন দল তবুও তাদের সব আসন রক্ষা করতে পারেনি। নতুন বøক নেতা Yves Francois Blanche তাদের হিসাব নিকাশ বদলে দিয়েছে। মনে রাখা দরকার ১৯৯৩ নির্বাচনে বøক কুবেকুয়া ৫৪ আসন নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে কুইবেক প্রভিন্স গত ১৯৮০ সালে কানাডা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার জন্য রেফারেন্ডাম দিয়ে দেশভাগের পক্ষে ‘হ্যা’ ভোট পেয়েছিল ৪৪.৪৪ % আর ‘না’ ভোটের পক্ষে ছিল ৫৯.৫৬ %। পার্টি কুবেকুয়া কুবেক-কে স্বাধীন দেশ হিসেবে ফেডারেশন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে পারেনি। কিন্তু এই সেপারেসন আন্দোলনের মূল্য দিতে হয়েছে কুইবেক প্রভিন্সকে চড়া দামে, আশির দশকে বড় বড় কম্পানীগুলো মন্ট্রিয়াল শহর থেকে মুভ করে চলে আসে টরন্টোয়। তাদের অর্থনীতিতে প্রচন্ড ধস নামে। বেকারত্বের হার বেড়ে যায়। কিন্তু তার পর ১৯৯৫ সালে আবার ফেডারেল- বøক কুবেকুয়া নেতা Lucien Bouchard এবং প্রভিন্সিয়াল দল পার্টি কুবেকুয়ার নেতা Jackques Parizeau-র সম্মিলিত প্রচার এক আশাজাগানিয়া মোমেন্টাম সৃষ্টি করে। এর ফলে কুইবেক কানাডা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার দুর্দান্ত এক আশাব্যঞ্জক গতিপথ তৈরী হয় আবারো। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক রেফারেন্ডমে মাত্র কয়েক হাজার ভোটে পার্টি কুবেকুয়া দল পরাজিত হয় এবং তাদের স্বপ্নভংগ হয়ে যায়। দেশ ভাগের পক্ষে হ্যা ভোটার ছিল ৪৯.৪২% আর দেশ ভাগ চাই না’র পক্ষে ‘না’ ভোট ছিল ৫০.৫৮%। এভাবেই কুইবেক প্রভিন্স কানাডা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সুযোগ হারায়।

লিবারেল দল বহু বছর ধরেই অন্টারিও, কুইবেক আর আটলান্টিক কানাডায় জনপ্রিয়তা তাদের পক্ষে রাখার সাফল্য দেখিয়েছে। গতবারের মতন এবারেও টরন্টো মেট্রোপলিটনে ২৫টা সিটের সবগুলোই লিবারেলের দখলে গিয়েছে। অন্টারিওতে ১২১টি সিটের মধ্যে পায় ৭৯টি সিট। কিন্তু গতবার ছিল ৮০টি। কনজার্ভেটিভ পায় ৩৬টি যেগুলো সবগুলোই ৯০৫ এলাকায়। আর এন ডি পি পায় ৬টি আসন। বৃটিশ কলম্বিয়ায় লিবারেল আসন পায় ১১টি। কনজার্ভেটিভ পায় ১৭টি, এন ডি পি পায় ১১টি, গ্রীন পায় ২টি আর বহিস্কৃত মিনিস্টার জোডি উইলসন বিজয়ী হয় স্বতন্ত্র থেকে। এন্ডু সিয়ারের জন্য ক্ষমতায় যাবার সিড়ি ছিল ইস্ট কানাডার অন্টারিও প্রভিন্স। কারন ওয়েস্ট তাদের নিশ্চিত ভাবে দখলে ।

এবার বর্তমান অন্টারিও কনজার্ভেটিভ দলের প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড ক্ষমতা গ্রহনের পর পরই তার জনপ্রিয়তায় মারাত্মক ধস নামে। সেটার মূল কারণ হচ্ছে তার হেলথ কেয়ারে বাজেট কাট। শিক্ষাখাতে বাজেট কাট। অন্টারিওতে প্রায় সারে তিন হাজার শিক্ষক চাকুরীচ্যুত হতে যাচ্ছে এই বাজেট কাটের ফলে। হাসপাতালে নার্স পর্যাপ্ত সংখায় না থাকার ফলে রোগীদের সেবাপ্রদানের মান নিম্নমুখী হয়। একারনে এন্ডূ শিয়ার তার অন্টারিও নির্বাচনী প্রচারনায় ফোর্ডকে দূরে রেখেছিলেন, এমনকি ইটোবিকো-তে ফোর্ডের বাড়ীর পাশে এসেও তাকে প্রচারনায় ডাকা হয়নি। এটা ছিল ফোর্ডের জন্য চরম অপমানজনক ঘটনা। শিয়ারের ধারনা ছিল অন্টারিওতে ফোর্ডকে সাথে রাখলে কনজারভেটিভের ভোট পাবার সংখ্যা কমে যাবে। কিন্তু এতকিছু করেও শিয়ার অন্টারিওতে সুবিধা করতে পারেনি।

এবারের নির্বাচনে লিবারেল দল মোট ভোট পেয়েছে ৩৩.১% আর কনজার্ভেটিভ দল পেয়েছে ৩৩.৪%। সারা দেশে কনজারভেটিভ দল লিবারেলের চেয়ে এক মিলিয়ন ভোট বেশি পেয়েও তাদের আসন সংখা ছিল মাত্র ১২১ আর লিবারেলের আসন সংখা ১৫৭।

এবারের নির্বাচনের ফলাফল জাস্টিন ট্রুডোর সামনে সম্পূর্ণ নতুন এক বিরাট চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। কারণ, পশ্চিম কানাডা তাকে সম্পূর্ন ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। (আলবার্টা এবং সাস্কাচোয়ান) এ কারনে আলবার্টা প্রিমিয়ার Jason Kenney কানাডা থেকে আলাদা হয়ে যাবার হুশিয়ারী দেয়। সাস্কাচোয়ান প্রিমিয়ার Moe Scott কার্বন টেক্সের বিরুদ্ধে কেনির সাথে একাত্বতা ঘোষনা করে। আলবার্টা ৩৪টি আসন আর সাস্কাচোয়ানে ১৪টি আসনের একটাও লিবারেল পায়নি। আলবার্টায় গতবারের ৪টি এবং সাস্কাচোয়ানে একটি আসন ছিল লিবারেলের। সাস্কাচোয়ানে হেভিওয়েট প্রার্থী দলের প্রবীন নেতা Ralph Goodale আর আলবার্টায় আমিরজিত সহি (পরিবেশ মন্ত্রী) পরাজিত হয়। আলবার্টার প্রিমিয়ার Jason Kenney নির্বাচন প্রচারনায় সরাসরি জাস্টিন ট্রুডোর বিপক্ষে এন্ড্রু শিয়ারের সাথে টরন্টোতে জনসংযোগ করে। কেনি’র বিরোধীতার প্রধান কারনগুলো হচ্ছে , কার্বন টেক্স, ট্র্যান্স কানাডা পাইপ লাইন নির্মাণ প্রকল্প আর ফেডারেল গ্র্যান্ট এর সম বিতরণ। আলবার্টা গত বছর ফেডারেল সরকারকে ৫১ বিলিয়ন টেক্স প্রদান করে এবং ফেরত পায় মাত্র ২১ বিলিয়ন ডলার। ফেডারেল সমবিতরন প্রকল্পের ৭০ বিলিয়ন থেকে কুইবেক সবচেয়ে বেশী গ্র্যান্ট পায় যা গতবছর ছিল ১৩ বিলিয়ন ডলার যা কানাডার মাথাপিছু সর্ব উচ্চ টেক্স প্রদানকারী প্রভিন্স আলবার্টার টেক্সের ১৯ বিলিয়ন ডলার জমা পরে Equalization programe ফান্ডে। যে সকল প্রভিন্স ফেডারেল গ্র্যান্ট পায় প্রতি বছর তারা হল, প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড, নভাস্কোসিয়া, নিউ ফাউন্ডলেন্ড, মেনিটোবা, নিউ ব্রান্সউইক আর কুইবেক। গ্র্যান্টের সিংহভাগ পায় কুবেক প্রভিন্স। আলর্বাটার মাথাপিছু টেক্স ৫১৪৫ ডলার যায় ফেডারেলে খাতে। খনিজ তেল সমৃদ্ধ প্রভিন্স আলবার্টা। আন্তর্জাতিক তেল বাজারে ধস নামে ২০১৪ সাল থেকে। ফলে তাদের অর্থনীতি প্রচন্ডভাবে বিধ্বস্ত হয়। বেকারত্বের সংখা প্রচুর বেড়ে যায়।

আলবার্টায় গত ২০০০-২০১৪ সাল পর্যন্ত চলে স্বর্ন যুগ। কানাডার বিভিন্ন প্রভিন্স থেকে সেখানে কর্মসংস্থানের জন্য যায় অনেক লোকজন। এখন সেই আলবার্টার জনজীবনে বেকারত্বের গ্লানি অভিশাপ। গত ২০১৬ সালে ফেডারেল সরকার আলবার্টা থেকে বৃটিশ কলম্বিয়া পর্যন্ত প্রায় ১২০০ কিলো মিটার দীর্ঘ একটা পাইপ লাইন নির্মাণ করার প্রস্তাব আনে এবং সেটার বিল পাস হয়। এটা হবে দ্বিতীয় আরেকটা পাইপ লাইন যা বর্তমান অবস্থিত পাইপ লাইনের সমান্তরাল। যে পাইপ লাইন দিয়ে তেল আসবে এডমিন্টন থেকে কোস্টাল বৃটিশ কলম্বিয়ায়। বর্তমান পাইপ লাইন দিয়ে দিনে ৩৩,০০০ হাজার ব্যারেল তেল সরবরাহ করা হয় আর নতুন লাইন দিয়ে আসবে প্রতিদিন এক মিলিয়ন ব্যারেল তেল, ফলে বৃটিশ কলোম্বিয়ায় তেলের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ব্যবসার পথ সুগম হবে। চীন এবং ভারতসহ এশিয়ার বাজার ধরার জন্য বিরাট সুযোগ তৈরী হবে। কিন্তু এই পাইপ লাইনের বিরোধীতা করছে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার এন ডি পি দল। গতবার বৃটিশ কলম্বিয়ায় তাদের লিবারেল দল ক্ষমতায় ছিল বলে সেখান থেকে কোন সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়নি। তবে কুইবেক প্রভিন্স বলে দিয়েছে তাদের নতুন কোন পাইপ লাইনের আগ্রহ নেই। কুইবেক প্রভিন্সে প্রতিদিন ৬০০,০০০ ব্যারল গ্যাসোলিন ব্যবহার হয় যা সোদী আরব ও ভেনিজুয়ালা থেকে আমদানী করা হয়। তার উপর চলছে এই প্রকল্পের উপর নানা রকম মামলা মকোদ্দমা। বৃটিশ কলম্বিয়ার কোর্ট পরিবেশ দূষনের আশংকায় এই প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছে। আর আদি অধিবাসীদের বিভিন্ন গোষ্ঠিরাও তাদের মতামত অগ্রাজ্য করায় এবং পরিবেশ দূষনের সম্ভাব্য কারনে মামলা করে যাওয়ায় প্রকল্পটি বন্ধ রয়েছে গত দুই বছর যাবৎ। প্রকল্প কম্পানী Kinder Morgan এ কারনে প্রতি বছর ৬০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তারা এবছর ঘোষনা দিয়েছে যে এত মামলা মাথায় নিয়ে একটি অনিশ্চিত প্রকল্প চালিয়ে নিয়ে যাবে না। সেই কারনে এবছর লিবারেল সরকার প্রকল্পটি কিনে নেয় ৪.৫ বিলিয়ন ডলার দিয়ে এবং নাম বদল করে প্রকল্পের নাম করা হয় ট্র্যান্স কানাডা মাউন্টেন পাইপ লাইন। এই প্রকল্পটির নির্মাণ খরচ ৭.৪ বিলিয়ন প্রথমিক হিসাব ধরা হলেও এখন ধারনা করা হচ্ছে এটার খরচ প্রায় ১০/১২ বিলিয়নে গিয়ে দাড়াবে। সরকার আশা করছে এই প্রকল্পে বার্ষিক ৫০০ মিলিয়ন ডলার মুনাফা হবে। যা কানাডার রাজস্বে বিরাট সহায়তা আনবে। বর্তমান অবস্থতিত ট্রান্স কানাডা পাইপ লাইন দিয়ে আলবার্টার তেল দক্ষিনে নর্থ ডেকোডা , মেনিসোটা দিয়ে আমেরিকায় যায়। তেলের বাজার শুধু আমেরিকায়ই সীমাবদ্ধ। ফলে কানাডা তাদের তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা করতে পারছে না।

এবার জাস্টিন ট্রুডোর দল কোন যৌথ সরকার প্রস্তাব নাকোচ করে দিয়েছে (এন ডি পি এবং গ্রীন পার্টি মন্ত্রীত্বে আংশ গ্রহন)। লিবারেল ১৫৭ আসন নিয়েই মাইনোরিটি সরকার গঠন করবে কিন্তু তারা কোন বিল পাস করাতে হলে যে কোন একটি দলের সাহায্য লাগবে। জাগমিত সিং আগেই বলে রেখেছে লিবারেলের সাথে কাজ করতে তাদের কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু ট্রান্স কানাডা ইস্যুতে এন ডি পি এবং ব্লক না থাকার সম্ভবনা প্রচুর। তবে কনজার্ভেটিভ দল এই বিল পাস করাতে সাহায্য করতে পারে। জাস্টিন ট্রুডোর দল ১৫৭ আসন নিয়ে মাইনোরিটি সরকার হলেও খুব শক্ত অবস্থানে রয়েছে। ক্লাইমেট চেঞ্জ ইসুতে তারা এন ডি পি এবং ব্লক কুইবেকার সাহায্য পাবে। এবার লিবারেল দলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে কনজার্ভেটিভ, এন ডি পি এবং ব্লক তাদের একত্রে অনাস্থা ভোটের প্রয়োজন হবে সেটা হবে বেশ কঠিন কাজ। কারণ ব্লক এর কখনো কনজার্ভেটিভের সাথে থাকার ইতিহাস নেই। তবে কানাডার ইতিহাসে মাইনোরিটি সরকারের স্থায়ীত্ব দুই বছরের বেশি হয় না কিন্তু এবারের চিত্রটি মনে হচ্ছে একটু ভিন্ন। এবার জাস্টিন ট্রুডো তার গত চার বছরের অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে তার নতুন মন্ত্রীসভায় প্রাজ্ঞ মেধাবী ও অভিজ্ঞতালব্দ নতুন পুরান প্রতিভাপূর্ণ সদস্যদের দায়ীত্ব দিয়ে কানাডাকে আরো সমৃদ্ধশীল শান্তিপূর্ণ অভিবক্ত দেশ আমাদের উপহার দেবেন বলে আমরা বিশ্বাসী। পশ্চিম কানাডার (আলবার্টা আরো সাস্কাচোয়ান) আকাশে যে তীব্র অসন্তোষ, বিচ্ছিন্নতার ক্ষোভ আর অর্থনৈতিক ঝড় উঠেছে সেগুলো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর তার মেধাবী চৌকুস দলকে নিয়ে একটি সুন্দর গ্রহনযোগ্য সমাধানের পথ তৈরী করবে সেটা কানাডিয়ানদের একান্ত আকাংখা। জাস্টিন ট্রুডোর প্রতি সমুদ্রসম শুভেচ্ছা আর শুভকামনা ।

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

নভেম্বর ৪,২০১৯। টরন্টো, কানাডা