অভিবাসী নারীদের অধিকার নিয়ে কানাডাতেও আপস করা হচ্ছে

এপ্রিল ৮, ২০১৯

প্রদীপ রদ্রিগেজ

১৮ বছর বয়সী সৌদি মেয়ে রাহাফ আল-কুনুন যখন পারিবারিক নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে কানাডায় আশ্রয় চায় তখন গোটা বিশ্বের লাখো মানুষ উল্লাস প্রকাশ করেছিলো। স্বয়ং কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড টরন্টোর পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে কুনুনকে গ্রহণ করে তাকে “সাহসী নতুন কানাডীয়” বলে অভিহিত করেছিলেন।

এই সৌজন্যমূলক আচরণ আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর জন্য ছিলো নারীদের কল্যাণে কানাডার আস্থা ও অঙ্গীকারের পুনঃনিশ্চয়তা দানের আরেকটি সুযোগ। তিনি এক্ষেত্রে এটাও যোগ করেন যে “বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের পক্ষে, নারী অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো” খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেশিরভাগ কানাডীয় বিশ্বাস করেন যে, বিদেশের মাটিতে নারীর প্রতি পুরুষের এধরণের নিপীড়নের ঘটনার প্রেক্ষিতে সাহসী নতুন কানাডীয়দের এদেশে চলে আসা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গর্বের এবং আত্মগৌরব বিষয়। কিন্তু একই ধরণের কঠোর পরিস্থিতির শিকার হাজার হাজার নারী নিশ্চয়ই কুনুনের প্রতি মনে মনে বিদ্বেষ পোষণ করেন।

সামাজিক মিডিয়ায় সুদক্ষ রাহাফ আল-কুনুন যখন তার নতুন দেশে কানাডীয় নারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং এই দেশ সম্পর্কে আরও বেশি জানার চেষ্টা করেন তখন তিনি হয়তো তারই মতো অনেক তরুণীর দেখা পান যারা খোদ এই কানাডাতেই নিজের পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন।

কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড (ডানে) টরন্টোর পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে সৌদি মেয়ে কুনুনকে(মাঝে) গ্রহণ করে তাকে “সাহসী নতুন কানাডীয়” বলে অভিহিত করেছিলেন। ছবি : সিবিসি

তিনি জানতে পারবেন সেই সত্যিকারের সমস্যা সম্পর্কে যেখানে হাজার হাজার নারী শারীরিক, মানসিক, আবেগগত ও আর্থিক নির্যাতন থেকে শুরু করে নানা ধরণের পীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রথম প্রজন্মের অনেক কানাডীয় বাবা-মা তাদের সন্তানদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও বিধিবিধান মেনে চলতে বাধ্য করার জন্য যে কোনও ধরণের নির্যাতনের আশ্রয় নেন। কানাডায় জন্মগ্রহণকারী তাদের সন্তানদের অনেকেই নিজেদের পছন্দ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কুনুনের মতো স্বাধীনচিত্ত হতে পছন্দ করেন এবং সেজন্যে বাবা-মার আচরণ তাদের চিন্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে।

জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে অনেক পরিবারেই এধরণের ঘটনায় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আচরণের একটি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় যার পরিণামে নারীরা ভীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় এবং আবেগগত দিক থেকে নিজেদেরকে অসদাচরণের শিকার বলে মনে করে।

মিজ. কুনুন কানাডার মতো দেশেও সম্মান রক্ষার জন্য হত্যার (অনার কিলিং) মত ঘটনার দেখা পাবেন। ব্যাপকভাবে প্রচারণা পাওয়া একটি ঘটনা ছিলো যশবিন্দর কাউর বা জেসি সিধুর অনার কিলিং। পরিবারের আপত্তি উপেক্ষা করে ‘হীন’ বর্ণের এক তরুণকে বিয়ে করায় তার পরিবার ২০০০ সালে ভারতের পাঞ্জাবে নিয়ে তাকে হত্যা করে।

কুনুন হয়তো জানতে পারবেন আকসা পারভেজের মর্মান্তিক সেই ঘটনাও যেখানে কেবল পাশ্চাত্য রীতির পোশাক পরা এবং অন্য কানাডীয় সহকর্মীদের মত একটি খন্ডকালীন চাকরি নেওয়ার অপরাধে ১৬ বছর বয়সী আকসাকে হত্যা করে তার নিজের বাবা ও ভাই। অন্যভাবে বললে, নিছক কানাডীয় হতে চাওয়ার জন্যই তাকে হত্যা করা হয়।

এরপর তিনি এরইমধ্যে তার নতুন স্বদেশে কীভাবে নারীর প্রতি অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে সে বিষয়ে আগ্রহী হয়ে  উঠেছেন এবং ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করে শিগগিরই জানতে পেরেছেন মুহাম্মদ শাফিয়া, তার দ্বিতীয় স্ত্রী তুবা মুহম্মদ ইয়াহিয়া, তাদের ছেলে হামিদ শাফিয়ার ঘটনা। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিলো শাফিয়ার প্রথম স্ত্রী ও তিন মেয়েকে হত্যার। শাফিয়ার প্রথম স্ত্রী ও তিন মেয়েকে পাওয়া গিয়েছিলো অন্টারিওর কিংস্টোনে একটি খালের মধ্যে ডুবে থাকা গাড়ির ভেতর।

কুনুন নিশ্চয়ই এধরণের ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে অনুধাবন করতে পারবেন যে, কেবল তার ক্ষেত্রেই বিষয়টি ভিন্ন ফল দিয়েছে। তিনি নিজেই সন্ত্রস্ত বোধ করবেন এটা জেনে যে, কানাডায় এমন অনেক পরিবার আছে যারা তার পরিবার থেকে পালিয়ে আসা সমর্থন করে না এবং তারা বিশ্বাস করে যে কুনুন পালিয়ে এসে এবং বিদ্রোহী হয়ে পরিবারের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছেন। এটাও অবশ্যম্ভাবী যে, নতুন কানাডীয় পরিবারগুলোর অনেক বড় অংশ কুনুনের পরিবারের জন্য দুঃখ অনুভব করে এবং কুনুনের প্রতি কেবলই ক্রোধ ও ঘৃণা বোধ করে। অনেক মানুষ আছে যারা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অবশ্যই কুনুনের আচরণের নিন্দা করবে এবং আশা করবে যে, তাদের মেয়েরা যেন কুনুনের মত বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে না যায়।

কিছু রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ২০০২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কানাডায় ১৩টি অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। আর এমন হাজারও ঘটনা ঘটেছে যেখানে নারীদের মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে এবং নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হয়েছে।

যখনই গণমাধ্যম এধরণের ঘটনাগুলো ফলাও করে প্রচার করেছে তখনই অনেক কানাডীয়র প্রতিক্রিয়া ছিলো প্রধানত নিশ্চুপ থাকার। এধরণের ঘটনায় রাজনীতিকদের নিরবতা সুতীব্র হয়ে উঠলে প্রগতিশীল নারী সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এসব গ্র“পে সচরাচর ককেসীয় অঞ্চলের প্রাধান্য থাকে। ফলে এসব গ্র“পের দেওয়া কোনও বিবৃতিকে বর্ণবাদী ও অবিবেচনাপ্রসূত বলে ব্যাখ্যা করা হয়। তারা মনে করে, এধরণের ঘটনা সবচেয়ে ভালোভাবে সামলে নিতে পারে স্থানীয় কমিউনিটি। তারাই ব্যাখ্যা করতে পারে চাপা দেওয়া অনেক লাশ ও গোপনীয়তার মতই কেন এধরণের বিষয়গুলো চাপা দিয়ে দেওয়া হয়।

আমাদের রাজনীতিকরা নিজ দেশের অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে একই ধরণের ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে বরং মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার রক্ষায় ব্যর্থ অন্য দেশের নিন্দা করতে এবং সেইসব দেশকে নারী অধিকার সমুন্নত রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে বেশি পছন্দ করেন। কখনও খোদ এই কানাডাতেই অভিবাসী সংগঠনগুলো যখন এমন সব বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও আচরণের প্রকাশ ঘটায় যা কানাডার মূল্যবোধ ও নারী অধিকারের সঙ্গে যায় না তখন সেটি না দেখার এবং এক ধরণের বিচ্যুতি হিসাবে বিবেচনা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অভিবাসী সমাজের ভেতরে এবং বাইরেও এক ধরণের নিরবতার সংস্কৃতি বিদ্যমান রয়েছে।

উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ব্রামটন ও মিসিসগার মত জায়গায় এবং আরও কিছু অভিবাসী সমাজে মেয়ে ভ্রুণ হত্যার মত বড় ঘটনার কথা। গর্ভপাতের মাধ্যমে মেয়ে ভ্রুণ হত্যার মত ঘটনা ঘটছে এবং দক্ষিণ এশীয় নারীদেরকে প্রায়শ তাদের পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী অ্যাবরশন করাতে হচ্ছে। অ্যাবরশন যে হচ্ছে তার প্রমাণ মিসিসগায় প্রতি হাজার ছেলে শিশুর বিপরীতে মেয়ে শিশুর সংখ্যা ৯০৪ জন আর ব্রামটনে ৮৬৪ জন। অথচ কানাডায় জাতীয় পর্যায়ে এই অনুপাত হলো ১০৫ ছেলে: ১০০ মেয়ে। স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত পেশাজীবীরা এই বিষয়টি জানেন। তারা কখনও উদ্বেগ প্রকাশ করলে খুব শিগগিরই সেটা চাপা পড়ে যায়।

আপনি কি কখনও শুনেছেন এই বিষয়টিকে ইস্যু করে কোনও রাজনীতিককে বক্তব্য দিতে? না। আসলে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন যে, যেসব বাবা-মা কন্যাসন্তান চান না, দিনের আলো চোখে দেখার আগেই তাদের অ্যাবরশন করে ফেলে দিতে চান, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ঠিক আছে!

অনেক অভিবাসী সমাজে নির্যাতিত নারীদের কী অবস্থা? স্ত্রীকে পেটানোর অনেক ঘটনা ঘটে কিন্তু খুব কমই রিপোর্ট হয়, কারণ তাতে কমিউনিটির বদনাম হবে। পিল-এর সামনের কাতারের সমাজকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে দেখুন, তারা নতুন কানাডীয় নারীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা আপনাকে অফ দ্য রেকর্ড জানাবে।

আমি যেখানে থাকি ঠিক সেই মহল্লার একটি ঘটনা জানি যেখানে একটি পরিবারে ১৬ বছরের একটি মেয়ে পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত না ঢেকে তার রুম থেকে বেরুতে পারে না যখন তার ভাইরা বন্ধুদের সঙ্গে থাকে। ভাইরা তার ওপর নজর রাখে। শোনা যায়, আগে এই মেয়েটির মানসিক স্বাস্থ্যগত জটিলতা ছিলো। তার ঘটনাটি একেবারেই মিজ. আল-কুনুনের জীবনের ঘটনার মত।

দুঃখজনক এই যে, এই মেয়েটি বা তার মত আরও অনেক মেয়ে মিজ. কুনুনের মত পরিবার থেকে পালিয়ে যেতে বা অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়ার আবেদন করতে পারছে না। তাদের মধ্যে এমনকি একজনও যদি তা করতে পারতো তাহলে খোদ এই কানাডায় যা ঘটছে সেটা ইস্যু হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতো। – সৈজন্যে : সিআইনিউজ