ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তা

নভেম্বর ৪, ২০১৮

রোজানা নাসরীন

ব্যক্তি চেতনার সর্বাত্মক উপলব্ধিতে সৃষ্ট চিন্তার বিকাশমান স্বকীয়তা যখন মুক্তি লাভ করে তখন তাকে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলা যেতে পরে। ব্যক্তি একটি একক সত্তা। স্বাধীনতা মূলতঃ ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, স্বকীয় চিন্তা ও ব্যক্তি সার্থের স্বীকৃতিই ব্যক্তিস্বাধীনতার মাপকাঠি। সমাজকে সুগঠ্তি,সুশৃঙ্খলিত ও দীর্ঘজীবী করার লক্ষে সমাজে নানাবিধ আইন কানুনের উদ্ভব ঘটেছে যা প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষের স্বার্থ রক্ষার প্রয়াশ হিসাবে গৃহিত হয়। কিন্তু কখনও কখনও এ আইন ব্যক্তির মৌলিক স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির সবাক হয়ে ওঠার নাম মত প্রকাশের স্বাধীনতা যা ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্রিয়াশীল প্রকাশ। স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক ও প্রাকৃতিক অধিকার। এ অধিকারকে সুষ্ঠুভাবে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হলে প্রয়োজন চিন্তার বিকাশ। ব্যক্তিসত্তা যখন ব্যক্তিচিন্তার দ্বারা কোন ফলপ্রসূ স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম হয় তখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ব্যক্তিপরিচয়কে বিশেষিত করে তার স্বকীয়তা ও চিন্তাশীলতার মাধ্যমে। ব্যক্তির চিন্তাশক্তি তখনই তার ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সুষ্ঠু জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয় যখন সে মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারে। মুক্তচিন্তার দ্বারা ব্যক্তিস্বার্থ ও মানব কল্যান রক্ষিত ও প্রগতিশীল হয়ে উঠতে পারে। যে চিন্তা কোন প্রকার সংস্কার,প্রথা ও আদেশ নিষেধ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সত্যনিষ্ঠা,নৈতিকবোধ ও যুক্তি দ্বারা গতিমান হয় সে চিন্তা নিঃসন্দেহে মুক্তচিন্তা এবং তা ব্যক্তির জন্য সর্বাধিক কল্যানকর। কারণ সংস্কার,প্রথা ও পূর্ববর্তী ধ্যানধারনা সময়ের স্বার্থে রচিত হয় যা কোন নির্দিষ্ট সময়ের পর ব্যক্তি স্বার্থকে চরমভাবে লঙ্ঘিত করে থাকে। ফলে সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন সময়োপযোগী চিন্তা যা একমাত্র মুক্তচিন্তা থেকে জন্ম লাভ করতে পারে। ব্যক্তির স্বাধীনতা তাকে যুগ কালের বন্ধন থেকে মুক্ত করে প্রগতির পথে নামিয়ে দেয় যার নেপথ্যে লুকানো থাকে সৃজনশীলতার উপকরণ।

ব্যক্তি রাষ্ট্রের ও সমাজের ক্ষুদ্রতম অংশ। প্রতিটি ব্যক্তির সফল অংশগ্রহনে রাষ্ট্র ও সমাজ হতে পারে সুখময় ও প্রগতিশীল। প্রতিটি ব্যক্তির সর্বাধিক স্বাধীনতা রক্ষিত হলে এবং প্রতিটি ব্যক্তি সর্বোচ্চ সুখী হলেই রাষ্ট্র ও সমাজ সুখী ও কল্যানকর হয়ে উঠতে পারে। যেখানে ব্যক্তি মুক্তচিন্তার অধিকারী সেখানে ব্যক্তির মুক্তমনের চিন্তা থেকেই উন্মেষ ঘটে সময়ের শ্রেষ্ঠতম সমাধানের। ব্যক্তি যদি নিজস্ব চিন্তাশীলতা দ্বারা ব্যক্তিজীবনকে সুখময় করে তুলতে সক্ষম হয় এবং অপরের কল্যানে অংশগ্রহন করতে পারে তবেই তাকে ব্যক্তিস্বাধীনতার সুন্দরতম বিকাশ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তা অর্থ কখনো ব্যক্তির কুপ্রবৃত্তিগুলিকে চরিতার্থ করা নয় বরং সর্বদাই ব্যক্তি চরিত্রের মাধুর্যময় বৈশিষ্টের রূপায়ন স্বরূপ।

ব্যক্তি মুক্তচিন্তার অধিকারী হলে মানুযের ন্যায়-অন্যায়বোধ তারই চৈতন্যে ধরা দেবে এবং ব্যক্তি যত শিক্ষিত হবে তার চিন্তা তত যুক্তিবাদী ও নৈতিক মানসম্পন্ন হবে এবং রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে তা উৎকৃষ্ট চিন্তা হিসাবে গ্রহনযোগ্য

হবে। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে,ব্যক্তিচিন্তা মূলতঃ শ্রেণীচিন্তার দ্বারা প্রভাবিত। কারণ শ্রেণীর অভিরুচি ব্যক্তিকে এমন কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে যে কখনই চিন্তার ক্ষেত্রে সকল ব্যক্তি মুক্ত নয়। ব্যক্তিচিন্তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শ্রেণীচিন্তা, সংস্কার ও প্রথা দ্বারা আক্রান্ত হয়ে শ্রেণীর স্তরের মধ্যেই বিরাজ করে। সামাজে প্রতিটি শ্রেণী ভিন্ন ভিন্ন রূপে বিশেষ বিশেষ চিন্তাকে লালন করে থাকে। ব্যক্তির অস্তিত্ব শ্রেণীর অস্তিত্বের মধ্যে বিরাজমান। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির সামগ্রিক চিন্তা তার শ্রেণীচিন্তার স্তরের মধ্যে বিবর্তিত হয় এবং আজন্ম সেখানে বসবাস করে। যার কারণে সমাজের প্রগতি অসম্ভব শ্লথ হয়ে পড়ে এবং বার বার জড়তায় আক্রান্ত হয়। যেহেতু ব্যক্তির চিন্তা শ্রেণীচিন্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেহেতু ব্যক্তির জীবন যাপনের সকল প্রকার সমসধান সে শ্রেণীচিন্তার কাছে কর্য করে। শ্রেণীচিন্তাগুলি যুগ যুগ ধরে একই স্তরে আবর্তিত হয় বলে ব্যক্তিচিন্তা বেগ হরিয়ে ফেলে। সে শ্রেণীচিন্তার কাছে তার জীবন ধারনের উপকরন স্বরূপ আদেশ নিষেধের কানুনগুলো হাতপেতে গ্রহন করে। এ কারনেই মানুষ শ্রেণীকে সহজে অতিক্রম করতে পরেনা। তার মননে মস্তিষ্কে শ্রেণীশিক্ষার উপকরণগুলি স্থায়ীত্ব লাভ করে। মার্কস্ শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, সমগ্র শ্রেণী তার আবেগ ও বিশ্বাসগুলোকে গঠন করে তার বস্তুগত ভিত্তির প্রেক্ষিতে এবং এই ভিত্তির ফলে গঠিত সামাজিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতে, প্রতিটি ব্যক্তি যখন ঐতিহ্য ও শিক্ষার আকরে এগুলি লাভ করে তখন সে একথাই অনুমান করে যে, এগুলিই হচ্ছে তার যথার্থ চলচ্ছক্তি এবং এখান থেকেই তার কর্মপ্রয়াসের প্রকৃতযাত্রা শুরু।“ বাস্তবিক অর্থে মার্কসের এ বস্তুবাদী মতবাদ যথার্থই সঠিক।

কারণ ব্যক্তি প্রথমেই বস্তুদর্শনের ভেতর দিয়ে তার বোধের সীমানা গঠন করে এবং বস্তু যখন মানব জীবনের পর্যায়গুলির সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে যুক্ত হয় তখন বস্তুর চরিত্রই মনুষের চরিত্রকে শাসন করে, ফলে ব্যক্তি চরিত্রে একটি সহজ অনুকরণপ্রিয়তার সৃষ্টি হয়। বস্তুত ব্যক্তিচিন্তা যখন শ্রেণীচিন্তার গন্ডিতে আবদ্ধ হয়ে যায় তখন তার চিন্তাশক্তি স্থির হয়ে পড়ে এবং সে শ্রেণীচিন্তার কাছে সর্বাত্মকভাবে ঋণগ্রস্থ হয়ে তার চিন্তার ক্ষেত্রে একটি স্থবিরতার অচলায়তন রচনা করে। কিন্তু মানুষ ও তার মস্তিস্ক পূর্নাঙ্গ অর্থে নিরেট বস্তু নয় তার জীবনীশক্তির অন্তর্নিহিত শক্তি হিসাবে কল্পনাশক্তির একটি আশ্চর্যরকম সংযোজন থাকে যা কখনো কখনো এমন তীব্র ও শক্তিমান হয়ে প্রকাশ পায় যে সে বস্তুশক্তিকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। মানুষের সেই মহান চিন্তাশক্তির দ্বারা সে সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথে পথচারী হতে পেরেছে। প্রথমে কল্পনা অবশেষে বস্তুর কাঠামোগত পরিবর্তন; এভাবেই সভ্যতার অগ্রযাত্রা। সুতরাং মুক্তচিন্তা সমাজ ও রাষ্ট্রদর্শনকে শাবলীল করে তোলে। কিন্তু ব্যক্তি যখন শ্রেণীর পিঞ্জিরায় বন্দি হয়ে চোখ কান ঢেকে স্বপ্নচারী হয় তখন শ্রেণীচিন্তার শাসন তার কাঁধে ভূতের মত চেপে থাকে। চিন্তার ক্ষেত্রে প্রতিটি শ্রেণী তাদের জীবন বোধকে একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞার মধ্যে খুঁজে মরে। যেমন চিন্তাশক্তির তারতম্যই এক একটি জাতিকে ভিন্ন ভিন্ন সত্তায় সত্তাবান করে রাখে। সে ক্ষেত্রে চিন্তা ব্যক্তি থেকে শ্রেণীতে এবং শ্রেণী থেকে জাতীতে ব্যাপ্তি পায়। ফলে চিন্তা প্রায়সই ব্যক্তির স্বাধীন সত্তায় সত্তাবান থাকেনা। কিন্তু বর্তমান সভ্যতার ক্রমধারাকে যেসকল জাতি দ্রুতগতি দান করেছে তারা শ্রেণীচিন্তার চেয়ে মুক্তচিন্তার অধিকারী অধিক পরিমাণে। কারণ সেখানে শ্রেণীর চেয়ে ব্যক্তিকে বেশি মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। উন্নত দেশগুলিতে প্রায় সব মানুষই চেতনায় স্বাধীন এবং সেই স্বাধীন চেতনার

ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে নতুন নতুন চিন্তা যার ফলে সভ্যতা বেগবান হয়। কোন নির্দিষ্ট চিন্তা, কোন নির্দিষ্ট শ্রেণীর নির্দিষ্ট চৈতন্য সকল সময়ের জন্য সফল নয়। সময়ের গতি বদলে দেয় সময়ের চাহিদাকে এবং সময়ের শাসন মানুষকে বাধ্য করে তার জীবনধারার পরিবর্তন ঘটাতে। এ পরিবর্তন শাশ্বত। বিবর্তন হচ্ছে জীবনের অন্তরশক্তি,তাই পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে নতুন নতুন রূপে জীবনের সঙ্গে আবিষ্কারের নতুন মাত্রা যোগ করে দেয়।

এই পরিবর্তনের ফলে মনুষ আদিমতাকে অতিক্রম করেছে, অতিক্রম করে এসেছে দুস্তর পথ। এপথের সমাপ্তি নেই, এপথ ফুরাবেনা। সভ্যতার প্রথম পর্যায়ের   চিন্তাগুলির দাবী তাই ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে চিন্তার নতুন নতুন ক্ষেত্র, নতুন দাবী। সভ্যতার প্রথম পর্যায়ের চিন্তাগুলি সেই সময়কে শাসন করেছে কিন্তু তাবৎ সময়ের জন্যে তা উপযোগী ও প্রযোজ্য নয়। চিন্তার শুরু থেকে কালানুক্রমিক চিন্তা যে পর্যায়গুলিকে অতিক্রমনের পালায় গতিমান হয়েছে তা কেবল মাত্র গতীতেই পূর্ণতা পাবে। সুতরাং চিন্তার প্রাথমিক অবস্থাকে চিরস্থায়ী ও অ্যবসলিউড বলে গ্রহন করলে মানুষের সত্যাসত্য বোধ হ্রাসপ্রাপ্ত হবে এবং এক পর্যায়ে তার চিন্তাশক্তি স্থবিরতায় রূপ নেবে। যে স্থবিরতার অপর নাম মৃত্যু। এ জন্যে ব্যক্তিচিন্তাকে মুক্ত করা প্রয়োজন। চিন্তাকে মুক্ত করতে হলে তাকে শ্রেণী, গোষ্ঠী, জাতি ও সমাজকে অতিক্রম করতে হবে।

এ প্রশ্নে ব্যক্তিচিন্তাকে সকল শ্রেণীচিন্তার আগ্রাসন থেকে মুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ প্রতিটি শ্রেণীর চিন্তাই পরিমাপযোগ্য বলে ব্যক্তিচিন্তা সীমাবদ্ধতায় হাপিয়ে মরে। প্রতিটি শ্রেণী তার চিন্তার স্তরকে বেছে নিয়েছে নিজস্ব পারিপার্শ্বিকতার ভিত্তিতে। এখানে শ্রেণীচিন্তাই শ্রেণীচৈতন্যের একমাত্র উপকরণ

এবং শ্রেণীচৈতন্যের বৈশিষ্ট্যগুলি থেকে জন্ম নেয় নানাপ্রকার সামাজিক অসঙ্গতিগুলি। ব্যক্তি তার শ্রেণীচরিত্র অনুযায়ী সামাজিক স্তর রচনা করে। যেহেতু চিন্তায় সে শ্রেণীবদ্ধ বলে কোনক্রমেই শ্রেণীচরিত্রকে অতিক্রম করতে পারেনা, ফলে সামাজিক স্তরগুলি বিবাদমান অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। যার ফলে সমাজে একটি স্নায়ুযুদ্ধ বদ্ধমূল হয়ে থাকে যাকে কোন শ্রেণী, গোষ্ঠী অথবা ব্যক্তি ডিঙ্গিয়ে আসতে পারেনা।

আজ কেবল মাত্র মানবতার মূল্যে মানুষ বঁচে নেই। মানুষ বঁচে আছে সংঘবদ্ধতার ভিত্তিতেও। সংঘবদ্ধতা সবক্ষেত্রে মানবতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনা, গড়ে ওঠে সমমানের চিন্তা, রুচি ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে। এবং এর অন্তরালে নিহিত থাকে শ্রেণীসংঘাতের বীজ। সুতরাং কেবলমাত্র মানবিক সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজন চিন্তার স্বাধীনতা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা। এ সকল স্বাধীনতা মানব জীবনকে নিরাপদ রাখে শ্রেণীসংঘাতের অভিঘাত থেকে। ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তা মানুষের জীবনকে অনেকখানি মানবীয় করে তুলতে সহায়তা করে। বৃদ্ধ সংস্কার ও অচল বিশ্বাসকে অতিক্রম করে সময়ের দাবি অনুসারে মানুষকে বাঁচতে শেখায় মুক্তচিন্তা। সমাজের প্রতিটি মানুষ মুক্তচিন্তার অধিকারী হয়ে উঠলে মানব জীবনে ও সমাজ জীবনের সকল প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর হয়ে কেবল বেঁচে থাকবে সুন্দরতম মাধুর্যময় মহামানবতা।

– রোজানা নাাসরীন

টরন্টো