বহু সংস্কৃতিবাদ বিভক্ত করে না বরং একাত্মতার বোধ উৎসাহিত করে
নভেম্বর ৪, ২০১৮
মাইকেল অ্যাডামস ও রত্মা ওমিদভার
ম্যাক্সিম বার্নিয়ার যুক্তি দেখান যে বহু সংস্কৃতিবাদ হলো একটি বিভেদমূলক নীতি যা কানাডীয়দেরকে বৃহত্তর সমাজের পরিবর্তে তাদের নিজস্ব “উপজাতীয়” পরিচয় তুলে ধরতে উৎসাহিত করে। কিন্তু এ বিষয়ে প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে যাতে দেখা যায় যে, কানডীয়দেরকে বিভক্ত ও বিভেদরেখা দিয়ে যুক্ত পরিচিতি তুলে ধরা তো দূরের কথা বহু সংস্কৃতিবাদ (বা “আন্তসংস্কৃতিবাদ” কুইবেকে) বরং প্রকৃতপক্ষে একাত্মবোধ, অংশগ্রহণ এবং একীভূতকরণকেই উৎসাহিত করেছে। বিশেষ করে এটা শুধু অভিবাসীদের নয় বরং সব কানাডীয়কে দেশের বহুসংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা কাঠামোর অংশ হিসাবে বিবেচনা করার মাধ্যমে এটা সম্পন্ন করে (এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু পাঁচ শতাংশ কানাডীয় আদিবাসী যাদের মুষ্ঠিমেয় অংশ নিজেদেরকে বহু সংস্কৃতিবাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অংশ বলে মনে করে)।
আসুন বিষয়টি স্পষ্ট করে নিই। “বহু সংস্কৃতিবাদ” একটি ঐতিহাসিক সুনির্দিষ্ট নীতিগত পরিকাঠামো যা গৃহীত হয়েছিলো ১৯৭১ সালে। এখানে বাজেটের বিষয়টিও বিবেচ্য। ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে আগামী দু বছরের জন্য বহু সংস্কৃতিবাদ সম্পর্কিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দুই কোটি ৩০ লাখ ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে যা প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যয় হবে জাতীয় বর্ণবাদবিরোধী কৌশল প্রণয়ন এবং নবাগতদের সমাজে একীভূতকরণে সহায়তাকারী বিভিন্ন সামাজিক গ্র“পকে সহায়তাদানের কাজে। এই অর্থ হলো ৩৩৮ বিলিয়ন ডলারের কেন্দ্রীয় বাজেটের এক শতাংশেরও একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশমাত্র।
কিন্তু বহু সংস্কৃতিবাদ হলো এমন একটি বিষয় যা অপেক্ষাকৃত কম সংহত কিন্তু অধিকতর শক্তিশালী: এটি হলো একটি চেতনা যা নিজেদের সমাজে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে যাওয়া লাখ লাখ কানাডীয় গ্রহণ করেছে।
আমাদের বিশ্বাস, বেশিরভাগ জায়গায় বহু সংস্কৃতিবাদের চেতনা গড়ে উঠেছে দুটি উপাদানের ভিত্তিতে। একটি হলো জাতি, বর্ণ, সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতি স্বাভাবিক শ্রদ্ধাবোধ: এটি এমন একটি বোধ যাতে বৈচিত্র্যকে স্বাভাবিক এবং সমাধানযোগ্য বলে মনে করা হয়। অন্য উপাদানটি হলো এমন ধারণা যে, সংহতির বিষয়টি কাজ করে উভয় দিক থেকে: সমাজে খাপ খাইয়ে নিতে নবাগতদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হবে আবার যারা আগে এসেছে তাদেরকে এমন একটি পরিবেশ তৈরির জন্য ভূমিকা রাখতে হবে যে পরিবেশ অন্যদের একীভূতকরণে সহায়ক। আপনি এমন কোনও জনগাষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যেতে পারবেন না যারা আপনাকে গ্রহণ করতে বা আপনার সঙ্গে যথাযোগ্য আচরণ করতে অস্বীকার করে।
বহু সংস্কৃতিবাদের ধারণা কানাডার প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যমান রয়েছেÑ সরকারি বিদ্যালয়, পাড়া-মহল্লা, কর্মস্থল, নাগরিক জীবন ও রাজনীতি সর্বত্র এটা বিরাজমান। আর কানাডার তিনটি বৃহত্তম শহরের ক্ষেত্রে এটা অনেক বেশি সত্য। সমৃদ্ধি এনে দেওয়া কর্মসংস্থান আলবার্টা ও সাসকাচাওয়ানের অপেক্ষাকৃত ছোট কেন্দ্রগুলোও হাজার হাজার নতুন অভিবাসীকে আকৃষ্ট করেছে; আটলান্টিক কানাডা নতুনদের আবাসনের স্থায়ী বসবাসের কেন্দ্র হিসাবে জায়গা করে নিতে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে; আর উত্তর-পশ্চিম টেরিটোরি সম্প্রতি সর্বোচ্চ সংখ্যক অভিবাসী আগমনের রেকর্ড গড়েছে। কানাডাজুড়েই কমিউনিটিগুলি অধিকতর বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে সমাজের সদস্যরা আনুষ্ঠানিক আচরণের ধারা এবং দৈনন্দিন জীবনে বহু সংস্কৃতিবাদের প্রতিনিধিত্বকারী অনানুষ্ঠানিক অভ্যাস গ্রহণ করতে শুরু করেছে।
আমরা বিশ্বাস করি বহু সংস্কৃতিবাদের এই নীতি ও তার চর্চা উভয়ই সেই বাস্তবতা ব্যাখ্যা করতে সহায়ক যে, কেন ৮৫ শতাংশ অভিবাসীই শেষ পর্যন্ত কানাডার নাগরিকত্ব অর্জন করে। নাগরিকত্ব অর্জনের এই হার অভিবাসী গ্রহণকারী অন্যান্য প্রধান দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এর বিনিময়ে তারা ভোটাধিকার ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অন্যান্য প্রক্রিয়ায় শরিক হতে পারে; বর্তমানে কানাডার এমপিদের মধ্যে ৪৬ জনেরই জন্ম কানাডার বাইরে- যে কোনও দেশের চেয়ে কানাডায় বিদেশে জন্মগ্রহণকারী আইনপ্রণেতার সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি। ( এসব এমপি কেবল তাদের নিজস্ব জনগোষ্ঠীর লোকেদের ভোটে নির্বাচিত হননি; কানাডায় মাত্র চারটি এমন নির্বাচনী আসন রয়েছে যেখানে কোনও একক সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির মানুষের প্রাধান্য রয়েছে।
বহু সংস্কৃতিবাদ আমাদের সমাজের এমন একটি অংশ যে সাম্প্রতিক একটি পরিবেশগত সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোন বিষয়টি কানাডাকে অভিনবত্ব প্রদান করে এমন একটি সর্বজনীন প্রশ্নের জবাবদাতাদের কাছে সর্বোচ্চ পছন্দের বিষয় ছিলো “বহু সংস্কৃতিবাদ/বৈচিত্র্য”। এটা সত্য যে, কানাডীয়রা কখনও কখনও বাস্তব জীবনের সুনির্দিষ্ট সমস্যার চেয়েও বহু সংস্কৃতিবাদের সাধারণ ধারণাই বেশি পছন্দ করেনÑ কিন্তু এতে করে বহু সংস্কৃতিবাদ অর্থহীন হয়ে পড়ে না। এর একটি কারণ হলো, এমনকি সব জাতিগোষ্ঠীর লোকেদের প্রকৃত অন্তর্ভুক্তি ও সমতার প্রত্যাশা সব সমাজে সমভাবে বিরাজ করছে এমন নয়। বহু সংস্কৃতিবাদের নীতিমালা এমন অনেক নিবিড় সাচ্ছন্দ্যের সুযোগ করে দিয়েছে যা দৈনন্দিন জীবন এবং পুলিশ ও সামরিক উর্দির প্রতীক উভয় ক্ষেত্রে নতুন রূপ পেয়েছে।
অভিবাসীদেরকে গ্রহণ করতে হবে এমন কোনও মূল্যবোধের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে কানাডায় এবং কানাডার বাইরে জন্মানো সব নাগরিকই সবচেয়ে বেশি যে জবাব দেয় তা প্রায় অভিন্ন: কানাডার ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিষয়টি আসে সবার আগে, এর পরেই আসে ইংরেজি ও ফরাসী ভাষা জানার প্রশ্ন, পরমত ও পরধর্মে সহিষ্ণুতা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধার বিষয়।
উভয় ধরণের নাগরিকদের মধ্যেই একটি বিপুল অংশ মনে করেন যে, অভিবাসীরা এখানে জন্মগ্রহণকারী যে কোনও নাগরিকের মতোই সুনাগরিক হতে পারে। অভিবাসীরা বরং কানাডায় জন্মানো নাগরিকদের চেয়ে একটু বেশিই গর্ব প্রকাশ করতে পারে যদিও উভয় শ্রেণীর নাগরিকদের একটা বিরাট অংশই তাদের দেশ নিয়ে গর্বিত। অভিবাসীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিজেদেরকে কানাডার নাগরিক হিসাবেই পরিচয় দেন (৭৮ শতাংশ), আর যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন সে দেশের নাগরিক হিসাবে পরিচয় দেন মাত্র ১২ শতাংশ অভিবাসী।
বহু সংস্কৃতিবাদের মূল নীতিগত পরিকাঠামোর স্থপতিরাও সম্ভবত ধারণা করতে পারেননি যে, জাতীয় পরিচিতির ক্ষেত্রে এটি এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এমনকি যাদের পূর্বপুরুষেরা কানাডায় একক বা দ্বি-সাংস্কৃতিক ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন তাদের উত্তর পুরুষেরাও যে এই বহু সংস্কৃতিবাদকে এতটা গভীরভাবে গ্রহণ করবেন সেটিও ধারণার বাইরে ছিল।
কিন্তু তারা সম্ভবত সমসাময়িক কানাডার প্রকৃত গঠন সম্পর্কে ধারণা করতে না পারলেও একটি শক্তিশালী সামাজিক কাঠামোর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। কানাডার বহু সংস্কৃতিবাদের লক্ষ্য সব সময়ই ছিলো সুসংহতির দিকে, বিভাজনের দিকে নয়। এই নীতির চারটি মৌল ভিত্তির তিনটিতেই অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে, আর মাত্র একটিতে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে নির্দিষ্ট গ্র“পগুলোকে সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্র“তি ব্যক্ত করা হয়েছে।
প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল পরে বহু সংস্কৃতিবাদ এখন সরকারের যে কোনও নীতির চেয়েও বৃহৎ ও গভীরতর। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমাদের সমীক্ষায় দেখা গেছে, অভিবাসন সম্পর্কিত মর্যাদা এবং স্বতন্ত্র গ্র“পের ভিত্তিতে বহু সংস্কৃতিবাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা কানাডীয়দের পরিচিতির খুব সামান্যই হেরফের ঘটে। মি. বার্নিয়ার যদি কানাডার বহু সংস্কৃতিবাদকে আক্রমণ করতে চান তাহলে তার বিরোধিদের মধ্যে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্ত থেকে আসা এবং এখানে বহু প্রজন্ম ধরে বসবাসরত অসংখ্য কানাডীয়ও অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। অন্য কথায়, তারা অনেক বেশি কানাডার মতো দেখতে হবেন।
– – globe and mail