নতুন দেশে অভিবাসীদের অভিযোজন

জুলাই ৬, ২০১৮

সুকাইনা জাফের

নিজের বেছে নেওয়া একটি নতুন দেশে পৌঁছার পর অভিবাসীরা কেমন অনুভব করেন তা অনুধাবন করা কঠিন। সারা বছর ধরে উষ্ণ আবহাওয়ার উপযোগী পোশাক পরার পর হঠাৎ বরফ-শীতল জলের মধ্যে আছড়ে পড়ার অবস্থাটা কল্পনা করুন! আপনার চিরচেনা খাবারের ঘ্রাণ, প্রার্থনার আওয়াজ থেকে শুরু করে আপনার পোশাক-আশাক, এমনকি পাল্টে যাওয়া কাজের ধরণ সবকিছুই যখন নতুন রূপ পায় তখন আপনি কেমন অনুভব করবেন? ভাষার ব্যবধান যখন বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন মহিলারা কীভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন?

অন্টারিওর সর্বত্র নারীরা একটি নতুন দেশে সফল জীবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।

২০১৬ সালের এপ্রিলে সিঙ্গাপুর থেকে আসা অভিবাসী হেদায়া আল-দালিলের পরিবারের জন্য এখানকার আবহাওয়া রীতিমত আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উষ্ণমন্ডলীয় জলবায়ুর দেশ থেকে আসার কারণে তারা শীতকালীন পোষাক পরায় অভ্যস্ত নন। আল-দালিল বলেন, “এখানে আসার পর প্রথম শীতকালটা আমাদের জন্য ছিলো কঠিন সময়। বাচ্চারা বরফ দেখে খুশি হয়েছে, কিন্তু বরফের মধ্যে হাঁটতে বা গাড়ি চালাতে আমার ভয় হতো।”

সেইসঙ্গে নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রাথমিক দিনগুলোতে আর্থিক সীমাবদ্ধতাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেয়। তিনি বলেন, “প্রথম কয়েক মাস ছিলো সবচেয়ে কঠিন সময়। কারণ এসময়টা ছিলো সম্পূর্ণ অনিশ্চিত এবং ভবিষ্যতের কোনও স্পষ্ট ছবি দেখতে পাচ্ছিলাম না। এটি ছিলো অত্যন্ত পীড়াদায়ক মুহূর্ত। তবে, ভাগ্য ভালো যে আমার স্বামী এখানে আসার কয়েক মাসের মধ্যে একটি কাজ পেয়ে যান। কিন্তু তার পেশাগত জীবনের যে ‘অবনতি’ ঘটেছে সেটা নিরন্তর সংগ্রামের অংশ হয়ে থাকবে।”

শুরুর দিকে আল-দালিল চুল কাটা ও স্পা সেন্টারের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে নিজের ম্যাসেজ পার্লারের ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ডর্ন পদ্ধতিতে রোগীর গলা, ঘাড় ও পিঠের ব্যথা উপসমের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন। কিন্তু এই পদ্ধতি নিরাপদ ও ব্যথামুক্ত হলেও বেশিরভাগ ইন্স্যুরেন্স পলিসির আওতায় বাইরে এবং কানাডায় একেবারেই অচেনা একটি বিষয়। অনেক চেষ্টাচরিত্র করার পর শেষ পর্যন্ত কয়েক মাসের মধ্যেই ব্যবসাটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আল-দালিল স্মৃতিচারণ করে বলেন, “কোন সামাজিক মহল বা গ্র“পকে পাশে না পাওয়ায় আমার পক্ষে কাস্টমার পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে।” কিন্তু এতে হতোদ্যম না হয়ে তিনি পিল-এ নবাগতদের সেন্টারে একটি ব্যবসায় বিষয়ক কোর্সে ভর্তি হন। এর মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এই কোর্স তাকে “অর্থনীতি, কর ব্যবস্থা, সম্পদের ব্যবস্থাপনা, বিপনন ও ব্যবসায়িক যোগাযোগের পাশাপাশি নেটওয়ার্কিং” সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেয়।

নতুন দেশে পৌঁছার পর অভিবাসীরা কেমন অনুভব করেন তা অনুধাবন করা কঠিন। আর যেসব অভিবাসীর মাতৃভাষা ইংরেজি বা ফরাসী নয় অভিযোজনের ক্ষেত্রে তারা মারাত্মক সমস্যায় পড়েন। ছবি:Wikimedia Commons/DIAC

আল-দালিল বলেন, কোর্সে তিনজন উপদেষ্টার সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে তিনি এমন কিছু বিষয় জানতে পারেন যা তার আগ্রহের ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োগ করা সম্ভব। এটি ছিলো শিক্ষার এক বিরাট অভিজ্ঞতা যা আমার ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ভিত তৈরি করে দিয়েছে।

সাংস্কৃতিক বাধা

কিছু শিক্ষাবিদ নবাগতদের জন্য সামাজিক বৈষম্যকে প্রধান সাংস্কৃতিক বাধা হিসাবে উল্লেখ করেন। ড. সোমা চ্যাটার্জি ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির সামাজিক কর্ম অনুষদের সহকারী অধ্যাপক। তিনি বলেন, “কানাডার মূল ধারার জীবন পদ্ধতি বিশ্বের অন্য সব দেশের চেয়ে অধিকতর প্রগতিশীল বলে একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। আমার চেনা অনেক অভিবাসী নারী এই উচ্চতর মান অর্জন নিয়ে এক ধরণের চাপ অনুভব করেন।”

তিনি উল্লেখ করেন যে, নবাগতরা তখনই বৈষম্যের শিকার হন যখন তাদেরকে বাড়ি ভাড়া দিতে অস্বীকার করা হয় অথবা বাড়িতে তারা কী ধরণের খাবার রান্না করবেন এমন নানা আপত্তিকর প্রশ্ন করা হয়। এ ধরণের অভিজ্ঞতা নবাগতদেরকে তাদের অত্যন্ত গভীর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অনেকগুলোকেই পাল্টে ফেলতে বাধ্য করে।

এছাড়াও, বিশেষ করে ভাষাগত বাধা থাকলে সব অভিবাসীর পক্ষে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কাজটি সহজ হয় না। যেমনটা ঘটেছে এসরা আলীর ক্ষেত্রে। ইরাক থেকে আসার পর এই নারীর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ইংরেজি শেখা। এটা হচ্ছে এমন একটি বিষয় যার ভয়াবহতা পরিসংখ্যানগতভাবেই প্রতিষ্ঠিত। যেসব অভিবাসীর মাতৃভাষা ইংরেজি বা ফরাসী নয় তাদের ৭০ শতাংশেরও বেশি অভিযোজনের ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যায় পড়েন।

এসরা আলী নিজ দেশ ইরাকে জীববিজ্ঞানে ¯œাতক পাশ করেছেন কিন্তু এখানে আসার পর তিনি যে খন্ডকালীন চাকরি নিয়েছেন সেটা হলো একটি বেসরকারী স্কুলের খাবার ঘরের তত্ত্বাবধায়ক ও সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি এই স্বল্প সময়ের চাকরি বেছে নিয়েছেন যাতে তিনি নিজের সন্তানদের দেখাশোনায় বেশি সময় দিতে পারেন। তার মতো মধ্যবয়স্কা নারীদের ৩২ শতাংশই নিজের সন্তানদের দেখাশোনার জন্য একই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সমন্বয় যখন কঠিনতর

২০১৬ সালের আগস্টে দুবাই থেকে অভিবাসী হিসাবে টরন্টোতে আসা পাকিস্তানের সাদাফ হুসেইনের কাছে নতুন পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় করে নেওয়ার কাজটা ছিলো সত্যিই কঠিন। তিনি তার দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে এদেশে আসেন কারণ তার স্বামী তখনও আরব আমিরাতে কর্মরত ছিলেন।

তিনি বলেন যে, প্রিয়জনকে পেছনে ফেলে আসাই ছিলো তার জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। কানাডার অতিব্যস্ত জীবনধারায় প্রথম কয়েক মাস তাকে নিঃসঙ্গতায় ভুগতে হয়েছে। এই নিঃসঙ্গতা তীব্রতর হয়ে উঠেছে শীতকালে যখন দিনের আকার ছোট হয়ে এসেছে এবং বাইরে কাজ করার সুযোগ কমে গেছে।

দৈনন্দিন জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজনটুকু যোগাড় করতে যে অব্যাহত দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে সেটি তাকে আরও বেশি হতশাগ্রস্ত করে তোলে। অনেক সময় প্রয়োজনীয় জিনিসটি পাবার জন্য তাকে একাধিক জায়গায় ছুটে বেড়াতে হয়েছে।

সাদাফ বলেন. “প্রয়োজনীয় জিনিসটি খুঁজে পাবার আগে আমাদেরকে সেটি কোথায় বিক্রি করা হয় তা জানার জন্য একের পর এক সুপারমার্কেটে ঘুরতে হয়েছে।” সেইসঙ্গে ব্যাপরটা আরও বেশি কঠিন হয়ে উঠেছে যখন তিনি কাক্সিক্ষত জিনিসটির স্থানীয় দামের সঙ্গে নিজ দেশের মুদ্রায় বিনিময়মূল্য পরীক্ষা করতে গেছেন।

আর তুষারপাত হয় এমন কোনও স্থানে কখনও বসবাস না করার কারণে এখানে বরফজমা রাস্তায় গাড়ি চালানোর মত নিয়মিত কাজ করতে গিয়েও তাকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।

নিজ দেশের সুদৃঢ় সামাজিক বন্ধনের বিষয়টি তার খুব মনে পড়ে। কারণ সেটি এখানে পাওয়ার সুযোগ নেই। “দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত আজানের ধ্বনি আমার মনে পড়ে। আমার মনে পড়ে কীভাবে রমজান মাসে (রোজার মাস) উৎসব পালিত হতো এবং পুরো আরব আমিরাতের মানুষ যেন একসঙ্গে ইফতার করতো।”

ধীরে ধীরে সাদাফ এখানে তার প্রাথমিক দিনগুলোর বিভিন্ন অসুবিধা কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়া শিখে নিয়েছেন। তবে এখন যেটিকে তিনি নিজের দেশ বলেন সেখানে আরও বেশি সময় কাটানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি অব্যাহতভাবে নিজেকে সবকিছুর সঙ্গে সমন্বিত করে নিচ্ছেন।

সামাজিক বোধ

অনেক অভিবাসীর কাছে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ধরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কয়েকটি দেশে বসবাসের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আল-দালিল কানাডায় বিদ্যমান বৈচিত্র্য মেনে নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তিনি তার সন্তানদেরকে তাদের সাংস্কৃতিক শেকড় সম্পর্কে বিরামহীনভাবে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমার সন্তানদের জন্য কানাডার নতুন জীবনধারায় চলার শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় রক্ষা করাও জরুরী।”

উল্লেখিত দুজন নারীই কানাডীয় জীবনের বহু ক্ষেত্রে সমন্বয় করতে বাধ্য হয়েছেন তবে তারা বর্তমানে যেসব সুযোগ লাভ করছেন সেজন্য কৃতজ্ঞ।

আল-দিলাল আরও বলেন, “এখানে ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও পেশা পরিবর্তনে অনেক বেশি সুযোগ রয়েছে। আমি কানাডায় এটা শিখেছি যে, আপনার পরিচয় কী বা আপনি কী হতে চান সেটা আপনার বর্তমান কাজের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় না। বিশ্বের অন্য অনেক দেশে সম্ভব না হলেও এখানে আপনি বিরাট স্বপ্ন দেখতে পারেন।

– সৌজন্যে : নিউ কানাডিয়ান মিডিয়া