এই পরবাসে রবে কে-৯

ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৯

নাজমুল ইসলাম

পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার ঘটনা বিরল। আমাদের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সেদিক থেকে একটি অনন্য ঘটনা। অনেক দেশের নিজস্ব ভাষা প্রায় হারিয়ে গেছে। ব্রিটিশ কলোনিয়ালিজমের সুবাদে আফ্রিকান অনেক দেশেরই রাষ্ট্রভাষা ইংরেজী। প্রায় বছর দশেক আগে আমার এক ইথিওপিয়ান কোর্সমেট কান্ট্রি প্রেজেন্টেশন দেয়ার সময় খুব গর্বভরে বলেছিল যে, তারাই আফ্রিকার একমাত্র দেশ যারা বৃটিশ কলোনী ছিল না এবং তাদের নিজস্ব ভাষাই তাদের দেশের রাষ্ট্রভাষা। তার প্রতিউত্তরে আমার কান্ট্রি প্রেজেন্টেশনের দিন আমিও শুনিয়ে দিয়েছিলাম যে, প্রায় দু’শো বছর শাসন করেও বৃটিশরা আমাদের ভাষা বদলাতে পারেনি। আরও বলেছিলাম, আমরাই পৃথিবীতে একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। আমার ভাষার কবি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে আমাদেরই জন্য।

বছর ঘুরে প্রতিবারই আসে ফেব্রুয়ারী মাস। আমাদের ঐতিহ্যবাহী ভাষা আন্দোলনের মাস। এই মাস এলেই শুরু হয় ভাষা নিয়ে বড় বড় আলোচনা সভা, শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে শহীদ মিনার ঘষামাজা পরিস্কারের উদ্যোগ, প্রভাতফেরী, বইমেলা, প্রত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি, কাব্য সাহিত্য ইত্যাদি নানান আয়োজনে মেতে উঠি আমরা। ‘নানান দেশে নানান ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা’ অথবা ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা’, এমন অসংখ্য দেয়াল লিখনে ভরে যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা, গর্বের ভাষা। বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে ইতোমধ্যেই বিস্তর লেখালেখি হয়েছে অনেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনাও হয়েছে। আমি ভাষা বা সাহিত্যের ছাত্র নই। অতিশুদ্ধ বা বিশুদ্ধ বাংলায় আমিও কথা বলি না। এখনও নিজ এলাকার মানুষ পেলে খাস আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে আরাম এবং মজা দু’টোই পাই। তারপরেও দৈনন্দিন জীবনে আমাদের এই প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষার স্ট্যান্ডার্ড ফর্ম বা প্রমিত রূপ ব্যবহারের জন্য আকুলতা অনুভব করি। একদিকে এই চাওয়া অন্যদিকে গণমাধ্যমসহ (প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক) আচার অনুষ্ঠান, পোস্টার, সাইনবোর্ড ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত বাংলাভাষার যথেচ্ছ এবং ভুল ব্যবহার দেখার পীড়াদায়ক অনুভুতি, এই দুইয়ের প্রাত্যহিক সংঘাত থেকেই আমার আজকের এই লেখার অভিপ্রায়।

এ ছাড়া আরও একটি কারণ আছে। প্রায় দশ বারো বছর আগে দৈনিক পত্রিকায় ‘টেলিভিশন নাটকে আটপৌরে ভাষার ব্যবহার’ শিরোনামে ড. মেহতাব খানমের একটি লেখা পড়েছিলাম। এর পরপরই লেখাটির উপর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিভিন্ন শিরোনামে মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী এবং উম্মে মুসলিমাসহ আর দু’এক জনের লেখা পড়েছিলাম মনে পড়ে। ড. মেহতাব খানম প্রমিত বাংলা ব্যবহারের বিষয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং যুক্তিযুক্ত বক্তব্য দিয়েছিলেন যার সঙ্গে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন জনাব ফারুকী। ফারুকীর বক্তব্যেও যে যুক্তি ছিল না, তা নয়। সেই আটপৌরে ভাষা বিতর্ক চলেছিল বেশ কিছুদিন। সেই লেখাগুলো ছাড়াও বাংলা ভাষার কথ্য ব্যবহারের উপর, পাওয়া বিভিন্ন মতামতের  উপর পাঠক হিসাবে আমার কতিপয় সবিনয় পর্যবেক্ষণ। এ আমার একান্তই নিজস্ব মতামত। সাহিত্যের ছাত্র না হয়েও এরকম দুঃসাহস দেখানোর জন্য পাঠকদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

পুরনো সেই লেখাগুলো পড়ে আজ হঠাৎ মনে হলো, মিশ্র বা জগাখিচুড়ি আটপৌরে ভাষার প্রভাবে প্রমিত বাংলা বা শুদ্ধ বাংলা কি সত্যিই দ্রুত বদলে যাবে? বাংলা আমাদের অনেক গর্বের ভাষা। কিন্তু বেশ কিছুকাল যাবত আমাদের এই প্রিয় ভাষার কথ্য ব্যবহারে যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে (যাকে আমরা অনেকেই ভাষার বিবর্তন বলে গ্রহণ করেছি এবং করছি), তাতে মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার স্ট্যান্ডার্ড ফর্ম বা প্রমিত রূপ থেকে যেন দ্রুতই সরে যাচ্ছি।

আগেই বলেছি, আমি নিজেও সবসময় স্ট্যান্ডার্ড বাংলায় কথা বলি না। আমাদের পারিবারিক আটপৌরে ভাষাও প্রমিত বাংলা নয়। তারপরেও ড. মেহতাব খানমের সঙ্গে একমত হয়ে আমিও বলতে চাই যে, ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড বা মান রক্ষা করা উচিত। অন্তত কথ্য ভাষার সার্বজনীন ব্যবহারের ক্ষেত্রে তো বটেই। শুদ্ধ বাংলা নিয়ে যেন ভুল বোঝার অবকাশ না থাকে সেজন্যে একটি বিষয়ে বলে রাখা ভাল। অনেকেই শুদ্ধ বাংলা বলতে পশ্চিমবঙ্গে বিশেষত কোলকাতায় ব্যবহৃত কথ্য বাংলাকে বুঝে ফেলেন। এটা ঠিক নয়। তাদের এরকম ধারণার কারণও বোধগম্য নয়। ‘বলেছি’-কে ‘বলেচি’, ‘এসেছো’-কে ‘এয়েচো’, ‘করেছিলি’-কে ‘করেছিলিস’, ‘বুঝতে পারছি না’-এর বদলে ‘বুজদে পাচ্চিনে’, বাংলা ভাষার এই কথ্য রীতিটি নিশ্চই প্রমিত রীতি নয়। আমরা বা আমি অন্তত এরকম বাংলা কখনও শিখেছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু তাই বলে আমাদের বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকায় মানুষের মুখে বাংলা ভাষার যে ফর্মটি ব্যবহৃত হয় বা গত দেড় দুই দশক ধরে হচ্ছে, তাকেও কি শুদ্ধ বাংলা বলা যাবে?

প্রমিত বাংলার বিপক্ষে যেসব যুক্তি দেয়া হয়, সেগুলো যুক্তির খাতিরে মেনে নিলেও পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত হওয়া যায় কি? নিশ্চই না। বরং এ নিয়ে চিন্তার অবকাশ থেকেই যায়। প্রমিত বাংলা উচ্চারণের পাশাপাশি আমাদের যে আঞ্চলিক শব্দ এবং ডায়লেক্ট রয়েছে, ঢাকায় এসে সেগুলো সব মিলেমিশে একটি খিচুড়ী রূপ পরিগ্রহ করেছে। জনাব ফারুকী যেটিকে ‘মেট্রোপলিটন কলোকুয়াল’ নামে অভিহিত করেছেন।

ভাষা পরিবর্তনশীল একথা ঠিক। কিন্তু সেই পরিবর্তন কত দ্রুত হবে বা কত দ্রুত আমরা সেদিকে ধাবিত হবো, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত বাংলা বিবর্তনের বিষয়ে জনাব ফারুকী পাল যুগ থেকে শুরু করে ফোর্ট উইলিয়াম, রবীন্দ্রনাথ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত বিবর্তিত বাংলা ভাষার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু পাল যুগ থেকে সুদীর্ঘকাল ধরে মোটামুটি একটি সহনীয় বা গ্রহণীয় গতিতে বাংলা ভাষার যে বিবর্তন ঘটেছে, গত দেড়-দুই দশকে হঠাৎ যেন সেটি বুলেটের গতি পেয়েছে। ভাষায় বা সাহিত্যে ক্রমবিবর্তনশীল বিষয়গুলো অতিদ্রুত বদলে যাওয়া কতখানি কাঙ্খিত সে প্রশ্নও তোলেন অনেকে। উত্থানের চাইতে পতন প্রক্রিয়া যে দ্রুতগতিসম্পন্ন, তা নিশ্চই বলার অপেক্ষা রাখে না। হঠাৎ করে ভাষার কথ্য রীতিটি অতি দ্রুত ‘জগাখিচুড়ি ভাষা’ হয়ে যাওয়াটা ভাষার উৎকর্ষ লাভের ক্ষেত্রে উত্থান নাকি পতন, সেটি কেবল বিতর্কের বিষয়ই নয় বরং ভাষাবিদদের ভাবনারও বিষয়।

টিভি নাটক বা সিনেমাতে ভাষার যে ব্যবহার হচ্ছে তাতে সেই কথিত ‘মেট্রোপলিটন কলোকুয়াল’ ভাষার ব্যবহার দেখা যায় অহরহই। বরিশাল, কুষ্টিয়া এবং ঢাকা শহরের গল্প প্রসঙ্গে যে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা না। বস্তুত আমারও দ্বিমত নেই। নিশ্চই ঢাকা শহরের গল্প প্রমিত বাংলায় হতে হবে এমন কোন কথা নেই। কিন্তু ঢাকা শহরের গল্প কি খাস ঢাকার ভাষাতে হচ্ছে? আর হলেও সেসব নাটক সিনেমার জনপ্রিয়তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বেশ কিছুকাল ধরে টিভি নাটকে বা অনুষ্ঠানে যে ধরণের কথ্য ভাষা ব্যবহার হয়ে আসছে তা নিয়ে অনেকেরই আপত্তি লক্ষ্য করা যায়। আমিও তার ব্যতিক্রম নই।

‘কি দেখতেছ’, ‘কী করতেছ’,‘কথা বলতেছ না কেন’, ‘খাইতে পারবানা’, ‘এইগুলা কী বলতেছ’, ‘মাইরা ফালাবি নাকি’, ‘আমি ক্যামনে বলমু’, ‘কবে যাবা’ এগুলো কি ঢাকার ভাষা? নাকি কোন বিশুদ্ধ আঞ্চলিক ভাষা? কোনটিই নয়। এগুলো হলো সেই ‘জগাখিচুড়ি’ বা ‘মেট্রোপলিটন কলোকুয়াল’। বিশুদ্ধ আঞ্চলিক ভাষা চর্চায় তো কোন দোষ নেই। বরং আঞ্চলিক ভাষা নিজ নিজ অঞ্চলের মানুষের কাছেই শুধু নয়, ক্ষেত্রবিশেষে তা অন্য অঞ্চলের মানুষের কাছেও উপভোগ্য। উদাহরণস্বরূপ আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকার আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত বেশ কিছু টিভি নাটকের উল্লেখ করা যেতে পারে।

চলচ্চিত্রে বা নাটকে চরিত্রের বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলতে পারফর্মার নির্বাচন নিয়েও সুন্দর যুক্তি দিয়েছিলেন জনাব ফারুকী। কেউ দ্বিমত করবেন না তাতে। চরিত্রের বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলতে পারফর্মার নির্বাচন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বয়স্ক চরিত্রের জন্য যেমন একজন কমবয়সী বা শিশু উপযুক্ত নয়, নারীর চরিত্রের জন্যও তেমনি পুরুষকে নির্বাচিত করারও কোন সুযোগ নেই। পারফর্মার নির্বাচনের সময় হার্ডওয়্যার অবশ্যই যথাযথ হতে হবে। কিন্তু ভাষা? ভাষা তো সফটওয়্যার। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবার ব্যবহৃত সফটওয়্যার তো একই। তাদের বয়স, চেহারা, বা লিঙ্গ ভিন্ন হলেও কথা তো তারা একই ভাষায় বলে। ভাষা সফটওয়্যার হলে ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপগুলো সেই সফটওয়্যারের বিভিন্ন ভার্সনের সঙ্গে তুলনীয়। ভার্সন আলাদা আলাদা হলেও মূল সফটওয়্যারে কিছু বিষয় যেমন অপরিবর্তিত থাকে, স্ট্যান্ডার্ড বাংলারও কিছু ফর্ম বোধহয় সেভাবেই রক্ষিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

চলচ্চিত্রে ‘বানোয়াট বাস্তবতা’ বলে আরও একটি বিষয়ের উল্লেখ করেছিলেন লেখক। এ বিষয়ে তার সঙ্গে আমিও একমত। নিশ্চই চলচ্চিত্রে বানোয়াট বাস্তবতা কারও কাম্য নয়। যদিও আমাদের দেশে গত দুই তিন যুগ ধরে যে শত শত বাজারী বস্তাপচা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, তা তো সেই বানোয়াট বাস্তবতারই ধারাবাহিকতা। এর কোন আশু পরিবর্তনের সম্ভাবনা লক্ষ্যনীয় নয়। চলচ্চিত্রে যে ভালগারিজম বা কুরুচির অনুুপ্রবেশ এবং বিস্তার ঘটেছে তা কি আটপৌরে ভাষাকেও সংক্রামিত করেনি? ফলাফল কি হয়েছে? মানুষ সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখা ছেড়ে দিয়েছে।

একটা সময় পর্যন্ত বাংলা সিনেমা ছিল বাঙালী মধ্যবিত্তের অন্যতম সুস্থ বিনোদন। যতদুর মনে পড়ে স্বাধীনতা উত্তরকালেও ছবি দেখার জন্য আমাদের পরিবারের বড়দের দল বেঁধে সিনেমা হলে যেতে দেখেছি। আমরা তখন প্রাইমারী স্কুল পড়ুয়া বলে আমাদের সঙ্গে নেয়া হতো না। ম্যাট্রিক পাশ করার আগে আমাদের হলে যেয়ে ছবি দেখার অনুমতিই ছিল না। সত্তর দশকেই আমাদের আগের প্রজন্ম সিনেমা হলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।

সিনেমায় বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলার বিষয়ে হয়তো কারই দ্বিমত থাকবে না। কিন্তু টেলিভিশন যেহেতু একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম। কাজেই টেলিভিশনের নাটক বা অন্যান্য অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে (আঞ্চলিক ভাষার নাটকগুলো ছাড়া) ভাষার স্ট্যান্ডার্ড ফর্মটিকে রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে মাথায় রাখা দরকার। অন্তত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।

আরও একটি বিষয়ে জনাব ফারুকী যথার্থ বলেছেন যে, ‘সংস্কৃতির এই যুগে টিকে থাকতে গেলে আমাদের ভাষা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি নিয়ে মিডিয়াকে দ্বিগুণ শক্তিশালীরূপে আবির্ভূত হতে হবে।’ আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে সেটিও অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত কথা। তবে আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতার নিরিখে আপাতত সেটি সম্ভব কিনা তাও ভেবে দেখার বিষয়। আর তাই আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে মিডিয়ার সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের বাংলা ভাষার স্ট্যান্ডার্ড ফর্মটিকে রক্ষা করার তাৎপর্যও কম নয়। সেদিকেও আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে।

একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তিগতভাবে আমরা এমন একটি বিশেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যখন পৃথিবীর একপ্রান্তের ঘটনা একই সময়ে (লাইভ) অন্যপ্রান্তে বসে দেখা যাচ্ছে। প্রযুক্তির কল্যাণে অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে সবকিছুর বিবর্তনই যেন খুব দ্রুত ঘটে চলেছে। জন্ম দিচ্ছে বিবিধ প্রশ্নের। বিবর্তনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এতকাল বাংলা ভাষা যেভাবে বিবর্তিত হয়েছে, গত দুই তিন দশকে কি সেই একই গতিতে হয়েছে? আগামী কয়েক দশকেও কি সেই একই গতিতে হবে?

ভাষা শুদ্ধরূপে এবং উচ্চারণে শেখার বিষয়টিও অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। বেশ কয়েক বছর আগে কোন এক ছাত্রনেতার পোস্টারে (সম্ভবত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পোস্টার) লেখা দেখেছিলাম, ‘বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্যোগ…….’। আহা! ছাত্রনেতাটি হয়তো জানেই না যে, সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘উদ্যোগ’ নয়, বরং ‘উদ্বেগ’ ছাড়তে বলেছিলেন। ‘উদ্যোগ’ আর ‘উদ্বেগ’ শব্দ দুটোর মধ্যে অর্থের যে বিস্তর পার্থক্য, তা হয়তো সে জানেই না অথবা কখনও শেখেইনি। ছোটবেলা থেকেই শব্দের প্রকৃত বানান বা উচ্চারনের মতো বিষয়গুলো শেখার ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম শেখার সময় যে শিশুটি ‘চৌচল্লিশ’ শুনবে সে তো কখনও জানতেই পারবে না যে, আসল শব্দটি ‘চুয়াল্লিশ’। শিক্ষক যদি ‘পঞ্চান্ন’ না বলে ‘পাঁচ পঞ্চাশ’ বলেন, তাহলে ছাত্র নিশ্চই ‘পঞ্চান্ন’ শিখবে না।

‘মেট্রোপলিটন কলোকুয়াল’-এর মতো ‘জগাখিচুড়ি ভাষা’ তো শিশুরা স্কুল কলেজে শিখছেই। সেখানে তাদের বাধা দেয়ার সুযোগ তেমন একটা নেই। শিশুদের জন্য প্রমিত বাংলার সংস্পর্শে আসার সুযোগটিই বরং অতিমাত্রায় সীমিত। সেক্ষেত্রে পারিবারিক চর্চা এবং গণমাধ্যমের ভুমিকা উল্লেখযোগ্য। কাজেই টেলিভিশনের মতো শক্তিশালী গণমাধ্যমে যদি সীমিত পরিসরেও প্রমিত বাংলার যথার্থ ব্যবহার হয়, তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মই শুধু নয়, প্রজন্ম পরম্পরায়ও সেটি টিকে থাকবার একটি সুযোগ থাকে।

আমরা থাকবো না। বিবর্তিত হয়েও থেকে যাবে ভাষা। তাই এবারের (২০১৯) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আসুন আমরা প্রমিত এবং শুদ্ধ বাংলাভাষা চর্চার অঙ্গীকার করি। আমাদের সন্তানদের শুদ্ধ এবং প্রমিত বাংলা শিখতে উৎসাহিত করি এবং শেখাতে চেষ্টা করি। ভবিষ্যতে এদের মাঝেই বেঁচে থাকবে আমাদের গর্ব, আমাদের মায়ের ভাষা, আ-মরি বাংলা ভাষা।

ফেব্রুয়ারী ২০১৯

টরন্টো, কানাডা।

nazmul13@gmail.com