এই পরবাসে রবে কে-৬

অক্টোবর ১১, ২০১৮

 নাজমুল ইসলাম

এদেশে অভিজ্ঞতার শেষ নেই। এর আগেও একটা লেখায় লিখেছিলাম যে, অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরেই চলেছি। এবার থানা পুলিশের অভিজ্ঞতা। এদেশের পুলিশ জনগনের সঙ্গে কেমন আচরণ করে, সেটি জানার খুব ইচ্ছা ছিল। সম্প্রতি বেশ টেনশনের মধ্যে দিয়ে সে আশাও পূরণ হয়েছে।

মাস দুয়েক আগে একটা মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেছি। রাতে ড্রাইভ করে বাড়ী ফিরছিলাম হাইওয়ে ডনভ্যালী পার্কওয়ে দিয়ে। স্পীড ষাট-সত্তর কিলোমিটারের মতো হবে। রোডে ট্রাফিক আছে বেশ। ডনমিলস আর এগলিনটনের মাঝামাঝি লক্ষ্য করলাম আমার সামনের সব গাড়ী হঠাৎ একটা হালকা ব্রেক করে আবার ছেড়ে দিল। আমিও একই কাজ করতে গিয়ে যখন দেখলাম আমার ঠিক সামনের গাড়ীটা মুভ করছে না। তখন আমার আর করার কিছু নেই। কারণ ততক্ষনে আমি ভীষণ জোরে বিকট শব্দে আমার সামনের গাড়ীকে হিট করে ফেলেছি। মধ্যরাতে চোখের পাতাও লেগে এসেছিল কিনা এখন আর মনে করতে পারি না।

আমার গাড়ী ২০০৮-এর পনটিয়াক টর‌্যান্ট (এসইউভি)। সেকেন্ডের মধ্যে আমার গাড়ীর সামনের অংশ দুমড়ে মুচড়ে গেল। স্টিয়ারিং থেকে এয়ারব্যাগও বেরিয়ে গেল। গাড়ীর ভিতরে পোড়া গন্ধ এবং ধোঁয়ায় ভরে গেল। আমার শরীরে কোন ভাঙচুর না হলেও হাতে এবং পাঁজরে প্রচন্ড ব্যথা পেলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহব্বল হয়ে গেলেও তিন চার সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে সিটবেল্ট মুক্ত করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। এই রিফ্লেক্সটা কিভাবে কাজ করলো সেটা এখনও মাঝে মাঝে ভাবি। এক্সিডেন্টের পর করণীয় কি বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ এসে গেল। সম্বিত ফিরে পেতেই দেখলাম হাইওয়েতে লম্বা ট্রাফিক জ্যাম হয়ে গেছে।

এদেশে যেকোন বড় ধরনের এক্সিডেন্টের পর পুলিশের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব জনদুর্ভোগ দূর করা এবং ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে একটা এক্সিডেন্ট রিপোর্ট দেয়া। এ ছাড়াও দোষীকে তাৎক্ষনিক শাস্তি বা জরিমানার ব্যবস্থাও করে পুলিশ। এদেশের হাইওয়ে প্যাট্রোলকারগুলো যেন একটা মোবাইল অফিস। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, প্রিন্টারসহ নানান যন্ত্রপাতি সবই আছে সেখানে। এক্সিডেন্ট রিপোর্ট দিতে যে সময় লাগবে তাতে ট্রাফিক জ্যামের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে। কাজেই আগে রাস্তা ক্লিয়ার করা জরুরী। পুলিশ অফিসাররা সেটা নিয়েই ব্যাস্ত। আমার গাড়ী ড্রাইভেবল থাকলেও রেডিয়েটর ভেঙে ফ্লুয়িড সম্পূর্ণ পড়ে গেছে। ফলে ড্রাইভ করে বেশীদুর যাওয়া যাবে না। তাছাড়া পুলিশও এ অবস্থায় গাড়ী ড্রাইভ করে নিতে দিবে না। কাজেই টোয়িং ট্রাক বা টো-ট্রাক দিয়ে গাড়ী সরাতে হবে।

গরু মরলে যেমন শকুন পড়ে তেমনি এক্সিডেন্টের সঙ্গে সঙ্গে তিন চারটা টো-ট্রাক এসে হাজির হলো। পুলিশ অফিসারদের একজন একটা টো-ট্রাক ঠিক করে গাড়ী হাইওয়ে থেকে সরিয়ে লোকাল রোডে নিয়ে গেল। একটা নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের দু’পক্ষের সঙ্গেই আলাদা আলাদাভাবে কথা বলে সঙ্গে সঙ্গেই রিপোর্ট প্রিন্ট করে দিল পুলিশ অফিসারটি। এরপর গাড়ী নিয়ে যাবার পালা। আমাকে টো-ট্রাকের সঙ্গেই তুলে দিল পুলিশ। এক্সিডেন্টের অভিজ্ঞতা এই পর্যন্ত হয়তো অনেকের সঙ্গেই কমন পড়তে পারে। এর পরবর্তী অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্যই আজকের এই লেখা।

টো-ট্রাকের চেম্বারে আমি আর ড্রাইভার। উদ্দেশ্য গাড়ী আমার বাসায় অথবা পরিচিত গ্যারেজে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু বেঁকে বসলো ড্রাইভার। সে তার পছন্দের গ্যারেজে নিয়ে যাবার জন্য নানান যুক্তি দিতে শুরু করলো। এই গাড়ী ঠিক করা কোন ব্যাপারই না…. পুলিশ তাকে তার পরিচিত গ্যারেজে নিয়ে যেতে বলেছে…. আমি যেন গাড়ী নিয়ে কোন চিন্তা না করি…. কালকেই গাড়ী ঠিক হয়ে যাবে…. ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি রাজী না হওয়াতে সে আরও উচ্চস্বরে বোঝাতে লাগলো আমাকে। এমনিতেই এতবড় একটা এক্সিডেন্টের পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছি। বেশী কথা কাটাকাটি করলে আমাকে আবার কিল ঘুষি দিয়ে রাস্তায় ফেলে যায় কিনা এই ভয়ে আমি আর কোন প্রতিবাদ করলাম না। এগলিনটন-বার্চমাউন্ট ইন্টারসেকশনের কাছে সিনট রোডে একটা অটোশপের কাছাকাছি একটা পার্কিংলটে গিয়ে সে আমাকে নামিয়ে একজনকে ফোন দিয়ে ডেকে আনলো।

এক ভদ্রলোক এসে আমার হাতে ডিএমকে অটো সার্ভিস লেখা একটা বিজনেস কার্ড ধরিয়ে দিয়ে (পরদিন রোববার হওয়ায়) আমাকে সোমবার যোগাযোগ করতে বললো। আর আমার গাড়ীটা ড্রাইভ করে তার অটোশপের পাউন্ডে (গাড়ীর স্টোরেজকে এরা পাউন্ড বলে) নিয়ে গেল। এক্সিডেন্টের পর ঘন্টাখানেক হয়ে গেছে। এতক্ষণ কাউকে কিছু জানাইনি। আমার এক আত্মীয় কাম বন্ধুকে ফোন দিয়ে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য আসতে বললাম। বাসায়ও ফোন করে জানালাম। অতঃপর হাসপাতালে দীর্ঘ চার ঘন্টা অপেক্ষার পরীক্ষা দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে রাত চারটারও পরে বাসায় ফিরলাম।

পরদিন রোববার আত্মীয়-স্বজন অনেকেই আমাকে দেখতে এলেন। গাড়ীর বিষয়ে করণীয় নিয়েও বেশ আলাপ আলোচনা হলো। আমেরিকান গাড়ী সম্পর্কে ধারণা কারোই খুব একটা উচ্চ নয় দেখলাম। গাড়ীর অবস্থার কথা শুনে সবাই না সারার পরামর্শই দিলেন। কারণ যে পরিমাণ ড্যামেজ হয়েছে এবং সেটা সারাতে যে খরচ হবে তা দিয়ে আর একটা গাড়ী কেনা যায়। আমার ওয়ান ওয়ে (থার্ড পার্টি) ইনসিওরেন্স। গাড়ীর ক্ষতিপুরণ কিছুই পাবো না। কাজেই আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম যে, দু’একটা বডিশপে দেখিয়ে এস্টিমেট নিয়ে না পোষালে গাড়ী স্ক্র্যাপ করে ফেলবো। এখন গাড়ীটা আনা দরকার।

পরদিন সোমবার সারাদিনে তিনবার গিয়ে বিফল হলাম। প্রথমবার আমার এক বন্ধুকে নিয়ে গেলে সেই অটো সার্ভিসের লোকেরা প্রথমে আমাকে না চেনার ভান করলো। একজন বললো, ‘আমরা জানিনা কারা তোমার গাড়ী নিয়েছে। খুঁজে দেখ’। টো-ট্রাক ড্রাইভারকে ফোন দিলাম। সে মেসেজ করে আরও একটা ফোন নম্বর দিয়ে কথা বলতে বললো। সেই নম্বরে ফোন দিয়ে গাড়ীর কথা জিজ্ঞাসা করতেই জানালো যে, গাড়ী নিতে হলে টোয়িংয়ের জন্য ১৫০০ ডলার চার্জ দিতে হবে। জানতে চাইলাম, মাত্র পাঁচ-ছয় কিলোমিটার রাস্তা টো করে আনার জন্য ১৫০০ ডলার কেন? তখন সে জানালো যে, তারা আমার গাড়ী নিয়ে স্টোরেজে রাখার জন্য সারারাত টো-ট্রাক নিয়ে ঘুরেছে। তাই এত বিল হয়েছে।

আমি বললাম, এটা মিথ্যা কথা। সেদিন রাতে আমার গাড়ী আমি তোমাদের এখানেই (স্টোরেজে) রাখতে দেখেছি। আর এত বেশী পরিমাণ টোয়িং চার্জ আমি দিতে পারবো না। তখন সে আবার একটা নম্বর দিয়ে তারও ‘বস’-এর সঙ্গে কথা বলতে বললো। ২য় ‘বস’ও যখন এক পর্যায়ে তার ‘বস’-এর সঙ্গে কথা বলতে বললো, তখন আমার অনুমান হলো, এরা আমার সঙ্গে গেম খেলছে। এরা মনেহয় আমার গাড়ী দেবে না। সেই নম্বরে ফোন দিয়ে একই প্রশ্ন করাতে আবার একটা নতুন নম্বর দিয়ে তার ‘বস’-এর সঙ্গে কথা বলতে বললো। এভাবেই দু’তিন জন তথাকথিত ‘বস’-এর সঙ্গে কথা বললাম। কোন কাজ হলো না।

দ্বিতীয়বার আমার এক আত্মীয়কে নিয়ে গেলাম। তখন তারা আবার পুরনো গল্প শুরু করে দিল। নানান তালবাহানা। গাড়ী তাদের কাছে নেই… আমি যেন ইন্সিওরেন্স কোম্পানীর সঙ্গে যোগাযোগ করি… ইত্যাদি ইত্যাদি। আবারও বসের সঙ্গে কথা বলার কাহিনীর পুনরাবৃত্তি হতে লাগলো। একেকবার একেকটা ফোন নম্বর দিয়ে তাদের তথাকথিত ‘বস’-এর দোহাই দেয়াতে তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে আমার আর বাকী রইল না। গাড়ীর যে অবস্থা তাতে আমি যে গাড়ীটা সারাবো না, সেটা ওরা বুঝে ফেলেছে। কাজেই আমার ভাঙা গাড়ীটা ওরা যে কয়দিন আটকে রাখতে পারে, সেই কয়দিনই ওদের লাভ। আমার ইনসিওরেন্স কোম্পানীর কাছ থেকে ইচ্ছামত স্টোরেজ চার্জ নিতে পারবে। আর সেজন্যেই বার বার তারা আমার ইনসিওরেন্সের তথ্য চাচ্ছে। আমাকে ইনসিওরেন্স কোম্পানীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলছে। এদিকে আমার একটাই চিন্তা ইনসিওরেন্স যেন না বাড়ে। যত দ্রুত পারা যায় গাড়ীটা ছাড়াতে হবে।

তৃতীয়বার যখন আবার আমার প্রথমবারের বন্ধুকে নিয়ে যাই তখন তাদের একজন রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে রেসিস্ট ভাষা ব্যবহার করে আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করলো। একপর্যায়ে আমাদের মারতে উদ্যত হলে আমরা ৯১১ কল করলাম। এদেশে অ্যাসল্ট বা গায়ে হাত তোলা ক্রিমিন্যাল অফেন্স। হয়তো সেই কারণেই সে আমাদের দিকে একাধিকবার মারতে তেড়ে আসলেও আমাদের স্পর্শ করলো না।

কোন অ্যাসল্টের ঘটনা ঘটেনি শুনে ৯১১ থেকে পুলিশের নন-ইমারজেন্সী নম্বর দিয়ে আমাদের সেখানে যোগাযোগ করতে বললো। নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশন বেশ কাছে হওয়ায় আমরা সরাসরি পুলিশ স্টেশনে গিয়ে ঘটনা জানালাম। তখন বিকাল প্রায় পাঁচটা বেজে গেছে। ডেস্কের ডিউটি অফিসার আমাকে পরদিন ঘটনাস্থলের কাছে গিয়ে নন-ইমারজেন্সী নম্বরে ফোন দিতে বললো। আমরা বাসায় চলে এলাম। সোমবার গেল। পরের দিন মঙ্গলবার সকালবেলা পুলিশ স্টেশনে যাবো।

ঘটনা সব শোনার পর সকালবেলা আমার স্ত্রী কিছুতেই আমাকে একা সেখানে যেতে দিতে রাজী না। আমার নিজেরও একা একা যেতে নিরাপদ লাগছিল না। কিন্তু কাকে নিয়ে যাবো? সবাই তো ব্যস্ত। আগেরদিন যে দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম, তাদের একজনের সকালবেলা হাসপাতালে পূর্বনির্ধারিত এপয়েন্টমেন্ট থাকাতে আমার সঙ্গে যেতে পারলো না। অন্যজন ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে পিছলে গেলেন মনে হলো। হয়তো তিনি প্রকৃতই ব্যস্ত ছিলেন। কে জানে? তবে তিনি আমাকে এই ঝামেলা থেকে কিভাবে উদ্ধার হবো সে বিষয়ে কোন বুদ্ধি পরামর্শ না দিলেও পুলিশকে ইনভলভ না করার পরামর্শ দিলেন।

বেশ অসহায় বোধ করতে লাগলাম। ঘটনা বর্ননার সময় কোন বিষয় বাদ পড়ে যেতে পারে বলে আমার স্ত্রী ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ লিখে নিয়ে যেতে পরামর্শ দিল। অবশেষে পুলিশ বরাবরে ঘটনার একটা লিখিত বিবরণ প্রিন্ট করে আর কাউকে না পেয়ে আমার হাইস্কুল পড়–য়া বড়কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ স্টেশনে গেলাম। পুলিশ স্টেশনে যাবার পর ডেস্ক অফিসার আমাদের ঘটনাস্থলের কাছাকাছি গিয়ে সেই নন-ইমারজেন্সি নম্বরে ফোন দিয়ে পুলিশের হেল্প চাইতে বললেন। অটোশপের কাছাকাছি গিয়ে নন-ইমারজেন্সিতে কল করার পর ফোনে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ শুনে প্রথমেই ওপার থেকে জানিয়ে দিল যে, আমাকে পুলিশ টাকা পয়সার লেনদেন বা চার্জ কমানোর ব্যাপারে কোন হেল্প করতে পারবে না। তবে কোন ধরনের ভায়োলেন্স যেন না ঘটে সে বিষয়টা দেখবে এবং গাড়ীটা পেতে সাহায্য করতে পারে। আমি তাতেই রাজী হয়ে কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশের আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম। (চলবে)

নাজমুল ইসলাম

টরন্টো, কানাডা।

nazmul13@gmail.com