আবেগ
ডিসেম্বর ৫, ২০১৮
রোজানা নাসরীন
যাযাবর বলেছিলেন,‘বিজ্ঞাণ দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ আসলে মানব জাতির আবেগ কেউ কেড়ে নেয়নি কেবল মাত্র আবেগের পরিবর্তন ঘটেছে। কেউ আবেগকে কেড়ে নিতে চাইলেও পারেনা। তাহলে সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড স্থবির হয়ে যাবে। গ্রহ উপগ্রহ আর ঘুরবেনা, সকাল-সন্ধ্যা হবেনা, সূর্য উঠবেনা, এমনিভাবে সবকিছু থেমে যাবে। তাই বিজ্ঞান মেনে নিয়েছে আবেগের পরিবর্তনকে। এই ব্রহ্মাণ্ডের ভিতরে একটা আবেগ আছে যার জন্য সে ঘূর্ণনে মেতেছে। আর ঘূর্ণনের ফলে যে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে তাই আমাদের চোখে উদ্ভাসিত হচ্ছে। ব্রহ্মাণ্ডের এই পরিবর্তনের সাথে মানব জীবনেরও পরিবর্তন ঘটেছে, না হলে জীবনধারণ অচল হয়ে পড়ে। এবং পরিবর্তন আছে বলেই এখনও সবকিছুর অস্তিত্ব আছে, মানে যে নিয়মটির উদ্ভব হয়েছিল প্রাচীনকালে, তার অস্তিত্ব আমরা আজো লক্ষ্য করছি। পরিবর্তন না থাকলে সবধরনের সংস্কার ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু এই পরিবর্তনকে মানুষ সবসময় মেনে নিতে পারেনা বা চায়না, কারণ পরিবর্তন কারো ব্যক্তি জীবনের উপর ভর করে আসেনা, সে আসে জীবনের ব্যপক আয়তনে। পরিবর্তনকে নিয়ে মানুষের মনে অনেক দ্বন্দ্ব আছে, হয়তো এজন্যই আবেগকে কেড়ে নেওয়ার মত বক্তব্য যুগে যুগে সীমাহীন তৃপ্তিতে মানুষের অন্তরকে ভরে রেখেছে। আসলে আবেগের রূপ এক এক সময় এক এক রকম করে পরিবর্তিত হয়েই জীবনে উদয় হয়েছে। ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ম অনুসারে এই ছুটে চলার মাঝেই রয়েছে পরিবর্তনের মন্ত্রধ্বনি, যা জীবনকে সফল করে তুলেছে। ছুটে চলাকে যদি আমরা বেগ বলি তাহলে ছুটে চলার নিয়মকে রূপায়িত করার জন্য চঞ্চলতার নাম গতি, এবং এই গতি সৃষ্টির আবেদন রয়েছে কেবল আবেগেই। বেগ এবং আবেগ দুটো অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, একটিকে ছাড়া অন্যটি ভাবা যায় না, আবেগের পরিণতিই বেগে। বেগ ছাড়া জীবন অর্থহীন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাকে বলেছেন, ‘বেগের আবেগ।’ তিনি বলাকা কাব্য খানিতে খুব চমৎকার ভাবে আবেগকে তুলে ধরেছেন।
“মনে হল , এ পাখার বানী
দিল আনি
শুধু পলকের তরে
পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে
বেগের আবেগ”
অন্তরের ছুটে যাওয়ার ইচ্ছাই আবেগ আর তাকে দৃশ্যমান করে বেগ। আবেগের নির্দেশে কর্ম পরিচালনাই বেগ, তাই এই চঞ্চলতাই আবেগের যথার্থ রূপ। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অন্তরে অন্তরে যে আবেগের তাড়না আছে যার কোনটি প্রকাশিত আর কোনটি অপ্রকাশিত। প্রকাশের সুযোগ পেয়েছে বলে বিভিন্নভাবে তা বিকশিত হয়েছে বা হচ্ছে , কিন্তু যে আবেগ প্রকাশের অপেক্ষায় আছে সে-ই মানুষের কল্পনা তাড়িত এক চমৎকার অভিব্যক্তি। অর্থাৎ মানুষের কল্পনার মধুর শক্তিই হচ্ছে আবেগের অপ্রকাশিত ক্ষমতা । এর সাথে রোমান্টিকতা মিশিয়ে বলগাহীন ভাবে মানুষ স্বপ্ন দেখছে । আবেগের চঞ্চলতা যখন ব্যপক ভাবে গতি পায় তখনই মানুষের অন্তরে আবেগের মূর্তিমান রূপ ধরা পড়ে।
মানুষের এই বিশাল জীবন জুড়ে রয়েছে আবেগের বিশাল ভুমিকা ও প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজনের কারনেই তৈরি হয়েছে শহর, বন্দর, মহাদেশ, এবং সভ্যতার সকল উপকরণ ও উপাদান। সভ্যতা সৃষ্টির মূলে রয়েছে সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছা , এই ইচ্ছাকেই পরিণতি দিতে জীবনের এতসব উৎসব, এবং এই ইচ্ছা শক্তিই আবেগে রূপান্তরিত হয়ে মহা সমারোহে বিকশিত হয়েছে। মহাবিশ্বের মূলে রয়েছে সৃষ্টির এক মহান আবেগ-ধ্বনি। যে ধ্বনি মানুষ শুনতে পেয়েছে, আর হৃদয়ের ইচ্ছা শক্তি দিয়ে তাকে গ্রহণ করেছে। যে শুধু জীবনকে সুন্দর ও মহিমান্বিত করে স্রষ্টার মর্যাদায় নিজেকে ভূষিত করেছে। তাই জীবনে বেঁচে থাকা এত মনোরম ও চরম সত্য হয়ে উঠেছে। মানুষ বুঝে নিয়েছে যে জীবনে আবেগের প্রকাশই জীবনের সকল সৃষ্টির মূলে বসে তার কর্ম যজ্ঞকে নির্দেশ করছে। তাইতো পৃথিবী নামক গ্রহটিতে জীবনধারা এত আনন্দে টিকে আছে। বেঁচে থাকার সাধ এজন্যই এত বেশি ও সুন্দর।
মানব জীবনের হৃদয়াবেগ কখন বুদ্ধিযুক্ত হয় আবার কখনও অযৌক্তিক হয় । বুদ্ধিহীন আবেগ কখনও কখনও মানব জীবনে ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে, আবার বুদ্ধিবৃত্তির সাথে আবেগ যুক্ত হয়ে যদি জীবন বিধান রচিত হয় সেখানে থাকে জীবনের সৌন্দর্য , চঞ্চলতা ও পরিবর্তন। মানুষের অন্তরের ভেতর প্রতিষ্ঠিত আবেগের কলধ্বনি দ্বারা রচিত হয় জীবনের ভালোমন্দ। মানব জীবনের সুন্দর ও কল্যাণকর ভাবনাগুলো বুদ্ধির দীপ্তিতে অলোকিত হয়ে তার সাথে আবেগের মিশ্রিত রূপ যদি গতি পায় মানুষ তাহলে সুন্দর জীবন তৈরি করতে সক্ষম হয় । মানুষের আবেগ দ্বারা তার সভ্যতা , অগ্রগতি, পরিণতি পরিচালিত হয়ে থাকে। আবেগ না থাকলে সে মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে বড় হতে পারেনা, সে হয় মানসিক প্রতিবন্ধী। মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও মনুষ্যত্ব দিয়ে আবেগ পরিচালিত হতে থাকলেই জীবনের সকল সাফল্য এসে ধরা দেয় । তাইতো মনোবিজ্ঞানে বুদ্ধি ও আবেগের এই দুটি রূপ নিয়ে ব্যপক আলোচনা হয়েছে।
মানুষের সৃষ্টি যন্ত্রণার সফলতার পিছনে বসে আছে এই আবেগ । জীবনের গতি যেমন আবেগের দৃশ্যান্তর মাত্র, তেমনি জীবনের প্রেক্ষাপট জুড়ে থাকে এই আবেগেরই পরিব্যাপ্তি । মানব গোষ্ঠী যেমন বংশ পরাম্পরায় আবেগের অনুসারী সত্ত্বা, তেমনি আবেগ মানব জীবনের একটি সচরাচর জীবন অতিবাহিত করার পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ। পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির সাথে সাথে তার আবেগেরও সৃষ্টি হয়েছে, এজন্যই জীবনের এই আবেগকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই , এটা মানব জীবনের অশেষ ব্যাপকতা নিয়ে চিরদিন টিকে থাকবে। আবেগ আছে বলেই মানুষের জীবনের চমৎকার ব্যাপ্তিতে আজ পৃথিবী নামক এই গ্রহটি মানুষের বেঁচে থাকার কলধ্বনিতে মুখর। মানুষই সৃষ্টি করেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, এটা তার এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আবেগ দ্বারাই সৃষ্ট। মানুষের জীবন জুড়ে তাই সারাটি জনম থাকে আবেগের স্পন্দন। মানুষের প্রাণের মাঝেই আবেগের বাস, তাই এই আবেগের স্পন্দন যখন স্ফূর্তিতে পরিণত হয়ে যখন দিকবিদিক ছুটে বেড়ায়, আর তখন জন্ম হয় কল্যাণ ও শুভক্ষণের; যা মানুষকে উচ্চতর জীবনের প্রতিশ্রুতি দেয়, আশ্বাস দেয়। মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে আবেগের শক্তিও ততদিন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখবে। প্রাণ আছে বলেই আবেগের এমন সোনার সেকল মনকে বেঁধেছে অদৃশ্য বাঁধনে। এজন্যই মানবতার কল্যাণে চমৎকার স্বপ্ন সৃষ্টির প্রত্যয় মানুষের আজন্মের অভিলাষ। যে প্রত্যয় নিয়েই মানুষ সংসার জীবন যাপন করে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আকুল আগ্রহে চঞ্চল হয়। আবেগ তাড়িত হয়েই এই বিশাল কর্মযজ্ঞে মানুষের এত উৎসাহ, এত রচনা।
আবেগই মানব জাতিকে মানুষ হিশেবে বিশেষিত করে। প্রাণের বেগ কখন কোথায় মানুষকে মানবতার বন্ধনে বেঁধে ফেলে তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনা। মানুষের আবেগ যে মানুষকে শুধুমাত্র মানুষে পরিণত করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই । যেমন মানুষ একসময় ভাবত আলাদা আলাদা জাতিসত্তা নিয়ে বেঁচে থাকাই মানুষের একমাত্র লক্ষ্য। অর্থাৎ জাতিতে জাতিতে প্রতিযোগিতা হবে কেবলমাত্র মানুষকে প্রদর্শন করতে যে কারা জাতি হিসাবে কত ধনী ও কতবড়। একসময় ইংরেজ জাতি পৃথিবীর অনেক দেশে তাদের উপনিবেশ রচনা করেছিল, অভিপ্রায় ছিল নিজেদের বিরাটতা দেখানোর এবং ধন বৃদ্ধি করার পক্ষে ছিল তাদের উপনিবেশ রচনার অভিসন্ধি। অলক্ষ্যে তারাই ঔপনিবেশিক জাতির মধ্যে জাতীয়তা বোধটাকে শক্ত করে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তার উপর ভর করেই বিভিন্ন জাতি দেখিয়ে দিয়েছে, মানুষ বোধ সম্পন্ন হওয়ার পরে কারো পদানত থাকতে চায়না বা পারেনা, তারপর সেখান থেকেই তাদের রাজ্য বিস্তার সংকুচিত ও নিঃশেষিত হতে বাধ্য হয়েছিল। বিশ্ব জুড়ে কেবল জাতিসত্তার মুক্তির জন্য অনেক যুদ্ধ হল। এমনকি বিশ্ব জুড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়ে গেল, তারপর পৃথিবী অনেক ভাবল, অনেক গবেষণা করল, এবং আনেক সঙ্ঘ বানাল, এটা মানুষের আবেগের একটি ফলপ্রদ অংশ। কারণ এর সাথে মানুষ যুক্ত করেছিল বুদ্ধিবৃত্তিকে। মানুষের নৈতিক জীবনের উন্নতিই তার মূল লক্ষ্য, কিন্তু এক এক জাতি এক এক বোধ সম্পন্ন, আর সব জাতিরই ভাবনার মূলে কিছু দেশীয় কারণও রয়েছে, সেই কারণটি আবিষ্কার করাই মানুষের সফল অনুসন্ধানের লক্ষ্য। যদি পশ্চাৎপদ জাতির অনগ্রসরের কারণটি মানুষ বুঝে ফেলতে পারে তাহ’লে পশ্চাৎপদতার অভিশাপ থেকে সে জাতিকে মুক্ত করা মানুষের কাছে সহজতর হয়ে যাবে।
মানুষের আসলে ভিন্ন কোন জাতিসত্তা নেই, মানুষ একটিমাত্র জাতি সে মানব জাতি, একদিন মানুষই তা প্রমাণ করবে। উচুতা ও নিচুতা মানুষকে কল্যাণকর মানুষ হিশেবে গড়ে তুলতে কোন প্রতিবন্ধকতা নয়, এই চিন্তাটি আজ জন্মেছে মানুষের উন্নত চিন্তার ফসল হিশেবে মানুষেরই মধ্যে। যে ধারণা আজ মানুষের মধ্যে অনেক আশা বহন করছে। তাই আজকে মানুষের মস্তিষ্কে একটি বোধের জন্ম হয়েছে তাহ’ল পৃথিবীর সব মানুষ মিলেই একটা মানুষ জাতি। এর মধ্যে জীবনের সুযোগ-সুবিধা, আবহাওয়া, বুদ্ধিমত্তা এবং প্রতিভা সবার এক নয়; কিন্তু মানুষ হিসাবে সবাই এক। অনগ্রসর জাতির ক্ষেত্রে জীবনের সকল সুবিধা নিশ্চিত করে তাকে মানুষের মুল্যবোধ দিয়ে ক্রমাগত অগ্রসর মানুষে পরিণত করা সম্ভব ; কারণ সবাই মানুষ। তাই পৃথিবীকে এখন ‘ global village ’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। যদিও মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষেই মানব মনে এই ধারণাটির উদ্ভব ঘটেছে, কিন্তু এই ধারণাটি মহান। এই মহান চিন্তাটি মানুষের স্বার্থের যে পথ ধরেই আসুক সেই আসাটাই আধুনিকতা ও মানবতা। অগ্রসর জাতি অনগ্রসর জাতির উন্নতি
করতে ব্যস্ত এবং যাতে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত হয় এটাই মানবতার চূড়ান্ত বাসনা। তার মানে মানুষের আবেগের পরিবর্তন ঘটেছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে মানুষের আর্থিক মুক্তি অর্থাৎ ক্ষুধার অন্ন জোগানোর নিশ্চয়তা, তারপর তার নৈতিক উন্নতি দিকে মানবতা স্বয়ংক্রিয় ভঙ্গীতে গড়াচ্ছে। মানবতা আশা করছে আবেগের পরিবর্তনের মাধ্যমে বিকশিত জীবনের উৎসাহ ক্রমাগত মানুষের হৃদয়ে ফুটে উঠছে। পৃথিবী জুড়ে মানুষের একই অবস্থানে পৌঁছতে হয়ত প্রচুর সময় লেগে যাবে; কিন্তু যে পরিবর্তনের দোরগোড়ায় মানুষ জাতি এসে উপনীত হয়েছে তাকে মানুষই কার্যকর করে তুলবে। একদিন মানব জাতি সফলতায় পৌঁছবেই। যেখানে সকল মানুষ সুখের পরিব্যাপ্তিতে শুধু মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবে।
রোজানা নাসরীন
টরন্টো