তাসের আড্ডা – ২

জানুয়ারী ৭, ২০১৭

এই সপ্তাহে শনিবারে বৈঠক বসেনি, কারণ মেজর লিগ সকারের ফাইনাল খেলা ছিল রাতে। কবির এবং রনি দু’জনাই সকার বলতে অজ্ঞান, তারা টরন্টো ভার্সাস সিয়াটলের ফাইনাল খেলা বাদ দিয়ে স্বর্গে যেতেও দ্বিধা করতে পারে। সাইদ নিজেও খেলা-টেলা সুযোগ পেলেই দেখে, যদিও ব্যাস্ততার কারণে সবসময় খুব একটা দেখা হয়না। একবার ভেবেছিল সবাই মিলে তার বাসায় খেলা দেখবে কিন্তু তাতে রুমা বাগড়া বাঁধাল। রাতে তাস খেলা না হবার সম্ভাবনা আছে জানা মাত্র সে দাওয়াত নিয়ে বসেছে। বাধ্য হয়ে তার বান্ধবীর বাসাতেই যেতে হল।

রোববার দুপুরে ‘হবে না’, ‘ব্যাস্ত’, ‘দেখি’ ইত্যাদি করতে করতে কবির, রনি, জালাল এবং জিত এসে হাজির হল। লাল ভাইয়ের নাকি কি একটা ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। সে আর আজকে আসতে পারবে না। খেলা শুরু হতে কবির এবং রনিকে গুরুগম্ভীর হয়ে থাকতে দেখে জালাল খোঁচা দিল, “ঘটনা কি? দুই বাক্যবাগীশ দেখি আজকে একেবারে বাক্য বিমুড়। কল কব্জা সব ঠিক আছে তো?”

সাইদ মুচকি হেসে বলল, “বুঝতে পারছ না ব্যাপারটা? আমাদের টিম তো হেরেছে গতকাল।”

জালাল হাতের তাস গোছাতে গোছাতে বলল, “কোন টিম? বাস্কেটবল? র‌্যপটার্স?”

রনি কড়া চোখে তাকাল। “জালাল ভাই, আপনি কি গতকাল এই দুনিয়ায় ছিলেন? টরন্টো এফ সি যে মেজর লিগ সকারের ফাইনাল খেলল, খবর রাখেন না?”

কবির আজকে জালালের সাথে খেলছে। জিত পরে খেলবে। কবির একটা নো ট্রাম্প কল দিয়ে বিষন্ন কন্ঠে বলল, “বড় মর্মাহত হয়েছি, ভাই। ভালো খেলেও টাইব্রেকারে গিয়ে হারা যে কি কষ্ট! সারা রাত ঘুমাতে পারি নি। এই রকম কাপ জেতার সুযোগ আবার কবে আসবে কে জানে?”

সাইদ বলল, “এক শ’ বিশ মিনিট খেলেও যদি একটা গোল না দিতে পারে তাহলে কি করে হবে? টাইব্রেকার হল কপাল। ব্রাডলি যে পেনাল্টি মিস করবে কে ভেবেছিল?”

রনি বিড়বিড়িয়ে বলল, “ব্যাটার চান্দিতে একটা চটকান দেয়া দরকার। গোলকির হাতে তুলে দিল বলটা।” একটু চুপ করে থেকে যোগ করল, “অবশ্য সে খেলে ভালো। সে না থাকলে টিম এতো দূর আসতে পারত না। খুব আশা করে ছিলাম জিওভেঙ্কো একটা গোল করবে। বুলেটকে ওরা খেলতেই দেয় নি।”

দু’ চক্কর কল হল। জালালের কাছে গিয়ে কল আটকে গেল। জালাল ভয়ানক চিন্তা করছে। কবির তিন নো ট্রামপ কল দিয়েছে। জালাল বোধহয় ফোর হার্টসে যাবার ধান্দা করছে। দু’জনে নো ট্রাম্প আর হার্টস নিয়ে ফাটাফাটি করছে। রনি এবং সাইদ পরস্পরকে চোখ টিপছে।কল যত উপরে ওঠে ততই ভালো। কিছু শর্ট পাওয়া যেতে পারে।

জিত হঠাত বলল, “তা সাইদ ভাই, ফিদেল ক্যাসট্রো তো পটল তুলল। এই বার কি কিউবায় কোন বড় সড় পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয়?”

সাইদ কাঁধ ঝাঁকাল। “ফিদেল তো অনেক দিন ধরেই পেছন থেকে গাইড করছিল। তার ভাই রউল তার চেয়ে বরাবরই একটু খোলা মনের মানুষ ছিল বলে মনে হয়। কিন্তু ফিদেলের উপস্থিতিতে খুব দ্রুত পরিবর্তন করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। এবার হয়ত কিছু কিছু ব্যাপারে অগ্রগতি দ্রুততর হবে- বিশেষ করে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে।”

রনি বলল, “আমেরিকার সাথে কি সম্পর্ক আরো ভালো হবে মনে হয়? গত বছর তো ওবামা উদ্যোগ নিয়ে দুই দেশের মশ্যে সম্পর্কটা খানিকটা স্বাভাবিক পর্যায়ে এনেছিল। কিন্তু এখন বুরবক ট্রাম্প কি করবে কে জানে? ব্যাটা গাড়োল, এর মধ্যেই চীনের সাথে খামাখা ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করছে। বুঝলাম ফিডেল ক্যাস্ট্রো শক্ত হাতে দেশ চালিয়েছে, রাজনৈতিক বিরোধীতা সহ্য করে নি, কিন্তু সে সাধারণ মানুষের জন্য অনেক কাজও করেছে। শিক্ষা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যপক উন্নতি হয়েছে। তার মৃত্যুর পর সার্ভে করে দেখা গেছে কিউবার অর্ধেক মানুষ অন্তত তার সমর্থক ছিল।”

সাইদ বলল, “ক্যাপিটালিজম আর কমিউনিজম যাই বল, কোন ব্যবস্থাতেই সবাইকে খুশী রাখা সম্ভব না। চীনের কথাই ধর না। আগের চীন আর এখনকার চীনের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশাল পরিবর্তন এসেছে, ব্যবসা বানিজ্যের সুযোগ বেড়েছে, কিন্তু তারপরও তাদের এক পার্টি ব্যাবস্থা কিন্তু পাল্টায়নি। পার্টির বিরুদ্ধে কথা বলে দেখ, খবর হয়ে যাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো খারাপ নাই। এখন যদি বহু পার্টি ব্যবস্থা করে দেয়া হয়, কি হবে কে বলতে পারে? হয়তো বিশাল হাঙ্গামা বেঁধে যাবে। কোন কাজ এগুবে না। যেটা হয় আমাদের গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়, প্রায়ই দেখা যায় ভোটে জিতেও কোন কাজই করতে পারে না সরকার যেহেতু অতিরিক্ত বাধা বিপত্তি। কংগ্রেস, সিনেট – কত রকমের ক্যাচাল।”

জালাল অবাক হয়ে বলল, “সাইদ ভাই, আপনি কি কমিউনিজমকে সমর্থন করছেন?”

সাইদ হেসে ফেলল। “বল কি? সেটা কখন বললাম? আমি হলাম প্রাইভেট কর্পরেশনের ডিরেক্টরাল বোর্ডের মেম্বার। আমার চেয়ে বড় ক্যাপিটালিজমের সমর্থক কে থাকতে পারে? আমি বোঝানোর চেষ্টা করছি এক পার্টি ব্যবস্থাতেও কিছু ভালো দিক আছে।”

কবির বলল, “ভালো হয়ত সরকারের জন্য, কিন্তু দেশের মানুষের জন্য কতখানি ভালো সেটা ভাবার বিষয়। ইয়াংগসি নদীর উপর নতুন একটা বাধ দেবার জন্য কয়েক লক্ষ্য মানুষকে নাকি তাদের ঘর বাড়ী থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে, হাজার খানেক শহর গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে কিংবা যাবে। চিন্তা করা যায়?”

জিত বলল, “বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য কিছু বিসর্জন তো করতেই হবে। ঐ বাধ কোটি কোটি মানুষকে বন্যার হাত থেকে বাঁচাবে।”

“এক দলের মাথায় কাঠাল ভেঙ্গে আরেক দলকে খাওয়ানো,” রনি বিড়বিড়িয়ে বলল। “যাই হোক, জালাল ভাই, আপনি কি কল দেবেন নাকি একটা ঘুম দিয়ে উঠব?”

জালাল নিজের কার্ডের দিকে আরেকবার নজর বুলিয়ে মাথা চুলকাতে লাগল। জিত বলল, “আমি দেখে দেব একটু?”

জালাল মাথা নাড়ল। “না, না, দেখতে হবে না। আমি কিউবার কথা ভাবছিলাম তো, চিন্তা ভাবনা করতে পারি নি।”

রনি দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল। “সর্বনাশ! আপনি এখনও চিন্তা করা শুরুই করেন নাই!”

সাইদ, কবির এবং জিত হেসে ফেলল। জালাল গভীর মনযোগ দিয়ে তাস দেখছে।

সাইদ হাসি থামিয়ে বলল, “কিউবা প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক। রউলের বয়েস ৮৫। সে ২০১৮ তে পার্টি থেকে সরে দাঁড়াবে বলে ঘোষনা দিয়েছে। ডিক্টেটর বাতিস্তার বিরুদ্ধে যারা লড়াই করেছিল তারা সবাই এখন শেষ জীবনে। এবার তরুন প্রশাসকরা আসবে। আধুনিক দুনিয়ার সাথে পাল্ল­া দিতে হলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন আনতেই হবে। তাছাড়া কিউবার সাধারণ মানুষরাও নিশ্চয় বদ্ধ একটা সমাজ ব্যবস্থায় থাকতে থাকতে হাফিয়ে উঠেছে।”

রনি বলল, “কিন্তু ভাই, বদ্ধ বলেন আর যাই বলেন, এখনও কিউবাতেই ক্রাইম অনেক কম। মেক্সিকোর কি অবস্থা দেখেন। লাটিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। কিন্তু কিউবা সে দিক দিয়ে এখনও অনেক ভালো। মুঠি আলগা হবার সাথে সাথে দেখা যাবে রাজ্যের সমস্যা পাকিয়ে উঠছে।”

জিত বলল, “যাই বলেন দাদা, স্বাধীনতার উপর আর কিছু হয় না। আমরা হলাম মানুষ। জীব জন্তুও আবদ্ধ থাকতে চায় না। জোর করে একটা নিয়মের মধ্যে মানুষকে কি বেঁধে রাখা যায়, না সেটা ঠিক?”

রনি বলল, “মানুষের কথা রাখেন ভাই, এবার জালাল ভাইকে কল দেয়ান।”

জালাল খুক করে হেসে বলল, “দিচ্ছি, দিচ্ছি। পাশ।”

কবির হা হা করে হেসে উঠল। “এতো চিন্তা করে আপনি পাশ দিলেন? জালাল ভাই!”

স্পেডে খেলা নিল রনি। ফটাফট খেলা হল। তিনটা শর্ট। জালাল কল দিলে তাদের আরামসে খেলা হয়ে যেত, গেম হয়ে যেত। কবির হতাশ চোখে তাকাল। “এটা কি করলেন, জালাল ভাই? এতো পয়েন্ট নিয়ে ছেড়ে দিলেন?”

জালাল শ্রাগ করল। “এতো কঠিন আলাপের মাঝখানে কার্ড নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা যায়? পরের বার পুষিয়ে দেব। কোন চিন্তা কর না তুমি, কবির মিয়া।”

কবিরের বাট। সে নিঃশব্দে কার্ড শাফল করছে। জিত বলল, “তো দাদারা, বাংলাদেশে এসব কি হচ্ছে বলেন তো? আগে তো কখনও এইভাবে কিছু হতে দেখিনি। ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় যে ভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ হল, বাংলাদেশের মত দেশে এটা ভাবা যায় না। সেখানে আমরা হিন্দু মুসলমানরা হাজার বছর ধরে কাধে কাঁধ মিলিয়ে চলেছি। কি শুরু হল

এসব? উগ্রপন্থী মুসলমানরাই কি শেষ পর্যন্ত আমাদের সমাজ ব্যবাস্থাটাকে ডোবাবে?”

সাইদ বলল, “এটা যতখানি না ধর্ম ভিত্তিক তার চেয়ে অনেক বেশী কুচক্রীদের কান্ড। অর্ধশিক্ষিত, ধর্মভীরু সমাজে এমনটাই হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করা অনেক সহজ।”

রনি মাথা নাড়ল। “ভাই, বাংলাদেশের মানুষকে বোঝা সহজ কাজ না। একটা সময় ছিল যখন ভাবতাম গরীব, ধর্মভীরু মানুষেরাই হচ্ছে উগ্রপন্থীদের শিকার। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে ভদ্র ঘরের শিক্ষিত ছেলেমেয়ারা তাদের সাথে জোট পাকাচ্ছে। যে ধর্ম পালন পর্যন্ত করত না হঠাত করে সে অস্ত্র পাতি নিয়ে ইসলামের তথাকথিত শত্রুদের নিধন করতে লেগে গেছে। এই ধারা আমি বুঝতে পারছি না। ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় মন্দির ভাঙ্গা এবং হিন্দু এলাকায় আক্রমনের সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে কি নেই জানি না, হয়ত নেই, হতে পারে পুরোটাই এলাকার কোন কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্র, সাইদ ভাই যেটা বললেন, কিন্তু কেন যেন মনে হয় বৃহত্তর দৃষ্টিতে তাকালে বাংলাদেশে বিবেক হীনতার একটা কালো ছায়া যেন মানুষত্বকে গ্রাস করছে।”

জালাল বলল, “আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশের সরকারেরা নিজেদের জনপ্রিয়তা বজায় রাখবার জন্য এই উগ্রপন্থীদেরকে নিয়ন্ত্রন করবার জন্য সময়মত পদক্ষেপ নেয়নি? জুলাইয়ের হলি আর্টীসান বেকারীতে হত্যাযজ্ঞ হবার আগেই কিন্তু বেশ কয়েকজন ব্ল­গার, শীক্ষককে হত্যা করা হয়েছিল, তখন কিন্তু প্রায় কাউকেই ধরা যায়নি। কিন্তু গুলশানের ঘটনাটার পর ব্যাপক ধড়পাকড় হয়েছে, অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে।”

সাইদ শ্রাগ করল। “গুলশান আক্রমণের পর পরিস্থিতির নাজুকতাটুকু খুব পরিষ্কার হয়ে গেছে। দোষারোপ করার চেয়ে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা। আমাদের পুলিশ বাহিনী চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে। তাদের শক্তি এবং বুদ্ধিমত্তা কারো চেয়ে কম নয়।”

জালাল বাঁকা গলায় বলল, “তাদের সবই আছে, কিন্তু তারা কিছুই করতে চান না। জানেন তো বাংলাদেশের সবচেয়ে কোরাপ্ট সংস্থা হচ্ছে পুলিশ। রক্ষকই যখন ভক্ষক হয় তখন সেই দেশ কি আর বসবাসের যোগ্য থাকে?”

জিত ম্ল­ান কন্ঠে বলল, “এই জাতীয় কারণের জন্যেইতো আমরা দাদা এই দেশে।”

রনি বল্ল, “সেটা হয়তো পুরোপুরি সত্য নয়। কিন্তু একটা দেশের আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রণের ভার যাদের হাতে তারা যদি দৃঢ় হাতে সেই দায়িত্ব পালন না করে তাহলে ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় যা হয়েছে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সুযোগ পেলে সংখ্যালঘুকে কিংবা দূর্বলকে দাবানোর সুযোগ সবাই নিতে চায়। এখানেই দেখেন না, ট্রাম্প ব্যাটা ভোটে জেতার পর ডানপন্থী উগ্র শ্বেতাঙ্গরা কিন্তু বেশ খানিকটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কু ক্লাক্স ক্ল্যান পর্যন্ত এখন মাথা উচিয়ে দাড়ানোর চেষ্টা করছে। কানাডায় আমরা বলি সব জাতী সম্প্রদায় শান্তিতে সহবস্থান করছে, কিন্তু সেখানেই ক’দিন আগে উগ্র ডানপন্থীদের পোস্টার পাওয়া গেছে টরন্টোর বিভিন্ন জায়গায়। কানাডার সেকিউরিটী ইন্টেলিজেন্সও স্বীকার করেছে এখানে অনেক উগ্রপন্থী গ্রুপ আছে কিন্তু তারা তেমন এক্টিভ নয়। সেখানেই হচ্ছে দেশের সরকার এবং আইন রক্ষাকারী বাহিনীদের কৃতিত্ব। আমেরিকা, কানাডায় এতো কিছুর মাঝেও আমরা কিন্তু কখনই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিনা। কেন? কারণ এই দেশগুলোর পুলিশ বাহিনীর উপর আমাদের একটা আস্থা আছে। এই আস্থাটুকু হচ্ছে অমূল্য।”

কবিরের বাট শেষ হয়েছে। নিজের হাত দেখে সে মুখ ব্যাজার করে ফেলল। “জিত দা, এবার আপনি খেলেন।”

তার হাত দেখে জিত চোখ কুচকাল। “এই ফালতু হাতটা তুমি আমাকে দিচ্ছ?”

কবির কার্ড গছিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। “আরে খেলেন না। আমি দেখি ভাবীকে পটিয়ে চা বিসকুট আনতে পারি কিনা।”

কবির সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। জিত কার্ড সাজাতে সাজাতে বলল, “দাদা, আপনার যুক্তিটা আমি বুঝতে পারছি। আপনি বলতে চাইছেন, আইন শৃংখলা বাহিনীগুলো যদি আরোও কঠিন ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করত তাহলে এই জাতীয় ঘটনা এমন ব্যাপক হারে ঘটা সম্ভব হত না – এর পেছনে কুচক্রী যেই হয়ে থাক।”

সাইদ অসম্ভব ভালো হাত পেয়েছে। সে হাত তুলেই বলল, “টু নো ট্রাম্প!”

রনি প্রতিবাদ করল। “আরে ভাই, একটাই দেন না। খেলছি তো অকশন।”

সাইদ খুক খুক করে হাসল। “দুইটা কেন, তিনটাই দিয়ে দিতে পারি। তোমাদের কারো হাতে কোন পয়েন্ট টয়েন্ট আছে? আমার হাতেই তো সব ছবি।”

তার টু নো ট্রাম্পের উত্তরে আর কেউ কোন ডাক দিল না। খেলা শুরু হতে রণি থার্ড হ্যান্ড নামিয়ে দিল। তার হাত দেখার পর কার্ড ফেলে দিল সাইদ। “তোমরা একটাও পাবে না। গ্রান্ড সøাম।”

জালাল ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল, “কি কার্ড! কবির মিয়া, এইটা কি বাট করলা? ছিঃ ছিঃ!”

সাইদের বাট। সে কার্ড গোছাতে গোছাতে বলল, “এই সমস্ত দেশে পুলিশকে যে ধরণের সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়, তেমনটা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দেয়া হয় না। মানুষের তুলনায় পুলিশের সংখাও কম। সুতরাং পুলিশের উপর সব দোষ দেয়াটা ঠিক হবে না। বিবেকবান মানুষদেরকেই এই জাতীয় কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে।”

জিত বলল, “মানুষের মধ্যে আরোও সহিষ্ণুতা থাকা দরকার। ধর্ম সম্বন্ধীয় যে কোন কিছু অবমাননাকর মনে হলেই দল বেঁধে ঝাপিয়ে পড়ে আইন হাতে তুলে নেবার চেষ্টা করা, এটা তো সভ্য মানুষের কাজ নয়। ভগবানকেই যদি বিশ্বাস করি তাহলে বিচারের ভারটা তার হাতেই কেন ছেড়ে দেই না। আর ভগবানের বিচার যদি খুব ধীর হয়ে থাকে তাহলেও তো আমাদের কোর্ট কাচারী আছে। আমাদের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই হজুগে বিচারের মন মানষিকতা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কথা হল, কি ভাবে?”

জালাল বলল, “ঠিকই বলেছেন, দাদা। সমস্যাতো শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতেও আছে -শুধু দাবার ছকটা সেখানে উলটে যায়।”

মাথা দোলাল জিত। “অস্বীকার করছি না সেটা, দাদা। ধর্ম ভিন্ন হতে পারে, মানুষগুলো তো সেই কম বেশী একই।”

সাইদ বাট করছে। “অত দূরে যেতে হবে না, সেদিনই পড়ছিলাম আমাদের টরন্টোতেই এক কোরিয়ান বংশদ্ভুত মহিলা এক ব্যঙ্কে গেছে। লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাত শোনে পেছন থেকে এক সাদা লোক তাকে লক্ষ্য করে ‘চিংকি চিংকি’ করছে। সবাই শুনেছে কিন্তু কেউ কিছু বলেওনি, করেওনি। ব্যাঙ্কের কর্মচারীদেরকে নালিশ করবার পর তারাও কাটিয়ে যায়। পরে মহিলা যখন অফিসিয়ালি কমপ্লেইন ফাইল করতে যায়, তখন ব্যঙ্কের পক্ষ থেকে তার কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়। কিন্তু মোদ্দা কথা হল, বদমাশ সব জায়গাতেই আছে। পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরও এখানে সতর্কভাবে থাকা উচিৎ। আমরা শুধু মনে করি সবাই বোধহয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে জোট পাকিয়েছে, সত্য হল কাউকে দূর্বল মনে হলেই তার উপর সবাই চড়াও হয়। একেবারে জংগলের নিয়ম।”

কবিরকে খালি হাতে নেমে আসতে দেখে জালাল চোখ গোল গোল করে ফেলল। “কি ব্যাপার? শুন্য হাতে কেন ফিরে এলে ভিখারী? নাকি একা একাই সব সেটে এলে?”

কবির দুই হাত তুলে সারেন্ডার করল। “অরে বাবা! রুমা ভাবীর যে মেজাজ দেখলাম। এক গ্ল­াশ পানি খেয়ে চলে এসেছি। কিছু চাওয়ার সাহস হয় নি।”

সাইদ নীচু স্বরে বলল, “শপিংয়ে যেতে চেয়েছিল। আমার মাথা খারাপ, খেলা টেলা ফেলে হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াবো? বলেছি কাল বান্ধবীদের সাথে যেও। সেই জন্য এমন গাল ফুলিয়ে আছে।”

রনি বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে বলল, “সাইদ ভাই, আপনি ভাবীকে এমন একটা কঠিন কথা বলতে পেরেছেন? আমার তো ধারনা ছিল আপনি স্টিয়ারিং হুইল আর ভাবী হচ্ছে ড্রাইভার।”

সাইদ কন্ঠস্বর আরোও নামিয়ে বলল, “আরে, ঐ ভাবে তো আর বলিনি। বললাম, মাথা ধরেছে, কোমরে ব্যাথা। হাঁটতে পারছি না…”

সবাই হেসে উঠতে সে দুই হাত তুলে সবাইকে থামার জন্য ইঙ্গিত করল। “বেশী চেতে গেলে কিন্তু সবাইকে তাড়িয়ে দেবে।”

কারো হাতই ভালো না। কেউ ডাকল না। আবার বাট করছে সাইদ। কবির বলল, “আপনারা দেখেছেন গুগল যে স্যার জগদীশ চন্দ্র বোসের ১৫৮তম জন্মদিন উদযাপন করেছে।”

রনি বলল, “দেখেছি। মনে আছে ছোটবেলায় আমরা পাঠ্যপস্তকে তার সম্বন্ধে পড়েছিলাম? তখন মার্কণির উপর খুব রাগ হত। দু’জনাই রেডিও আবিষ্কার করেছিল কিন্তু নাম হল তার।”

জিত বলল, “জগদীশ বাবুকেই কিন্তু রেডিও সায়েন্সের জনক বলা হয়। বিশ্ব বিখ্যাত ইনসটিটিউট অফ ইলেক্ট্রিকাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার তাকে ১৯৯৭ সালে এই ভুষন দেয়। তার নামে নাকি চাঁদেও একটা উপত্যকার নাম আছে। ওনাকে যে বাংলা সায়েন্স ফিকশনের জনক বলা হয়, এটা জানেন কেউ?”

সাইদ বলল, “’নিরুদ্দেশের কাহিনি’ তো তারই লেখা। কোথায় যেন পড়েছিলাম।”

কবির বলল, “ইন্টারনেটে ঘাটতে ঘাটতে একটা চমৎকার জিনিষ জানলাম। বিখ্যাত ইংলিশ লেখক এইচ জি ওয়েলসের ‘দ্য ওয়ার অব দা ওয়ার্ল্ড’ এর কথা তো সবাই জানেন। মুভিটাও দেখে থাকবেন। ওটা লেখা হয়েছিল ১৮৯৮ তে। তার বছর দশেক আগে ভারতীয় লেখক জগদানন্দ রায় লিখেছিলেন ‘শুক্র ভ্রমন’। সেটাও ভিন গ্রহ থেকে আসা এলিয়েনদের নিয়ে লেখা ছিল।”

সাইদ বলল, “ওটা মনে হয় ১৯৬০ এর দিকে লেখা। উনি পরে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব ভারতীতে শিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। আর জগদিশ চন্দ্র বোসের কথা যদি বল, তার কিন্তু আরেকটা প্রধান আবিষ্কার হচ্ছে ক্রেসগ্রাফ। নানা ধরণের ক্রিয়ার উপর নির্ভর করে উদ্ভিত কিভাবে প্রতিক্রিয়া করে – সেটাই নির্ধারন করবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। উদ্ভিত যে ব্যাথা পায় এবং স্নেহ ভালোবাসা বোঝে সেটাও প্রথম তিনিই বলেছিলেন।”

রনি বলল, “মনে হচ্ছে আবার স্কুলের ছাত্র হয়ে গেছি। তখন মুগ্ধ হয়ে পড়তাম এসব। উনি যে তার যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন, জেনে ভালো লাগছে।”

জিত ভাবুক গলায় বলল, “হ্যাঁ, উনি আজ নেই, হয়ত স্বর্গে বসে সবই দেখছেন। কিন্তু যে মাটিতে তার জন্ম সেই মাটির শত কোটি সন্তানেরা তাকে নিয়ে অন্তত একটুক্ষনের জন্য হলেও গর্ব বোধ করতে পারবে।”

দরজায় টুংটাং শব্দ হল। কবির গেল দরজা খুলতে। দরাজ কন্ঠের ‘আসসালামু আলাইকুম’ শুনেই বোঝা গেল মঞ্চে কার প্রবেশ হল। কবির দরজা লাগিয়ে নেমে এলো। লাল ভাই গেল রুমার সাথে দেখা করতে। মিনিট পাঁচেক পর সে যখন নীচে এলো তার হাতে বিশাল এক ট্রে তে চা এবং বিস্কিট। কবির ক্ষুন্ন কন্ঠে  বলল, “আশ্চর্য!”

জালাল খোঁচা দেবার জন্য বলল, “তোমারে দিয়া যদি কোন কাম হয়। লাল ভাই, আপনি না আসলে আমরা তো আজকে ভুখা থাকতাম।”

লাল ভাই হা হা করে হাসল। “আল্ল­াহ হইল খানা পিনার মালিক। আমি তো অছিলা মাত্র।”

রনি বলল, “আপনার এই বিলম্বের কারন কি লাল ভাই?”

লালা ভাই সবার হাতে চা ধরিয়ে দিতে দিতে বলল, “বলব, বলব। অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। প্রথমেই আপনাদেরকে একটা প্রশ্ন করি। ডিকশনারি ডট কমের ২০১৬ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ কোনটা বলেন দেখি?”

সাইদ বলল, “জেনোফোবিয়া।“

জিত বলল, “হ্যাঁ, ফিয়ার অব ফরেইনার।”

লাল চেয়ারে শরীর এলিয়ে বসল। “আপনারা খেলা চালাইয়া যান, আমি আজকে সকাল থেকে কি কি হইছে আপনাদেরকে বলি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আমার বিবি সাব আমাকে বললেন…”

রনি চোখ কুচকাল, “লাল ভাই, একেবারে সকাল থেকে শুরু করতে হবে? লাফ দিয়া বিকালে আসেন।” লাল ভাই শ্রাগ করল। “আচ্ছা, আচ্ছা, বিকাল থেকেই শুরু করি। বিকালে একটা চুটকি ঘুম দিয়া ওঠার পর বিবি সাব আমাকে বললেন…” (চলবে)