কানাডায় বিপজ্জনভাবে সীমাহীন সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে অল্পকিছু অতি ধনী লোকের হাতে

ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৭

খুরশিদ আলম ॥

কানাডা বিশ্বের ধনী দেশগুলোর একটি। কিন্তু এখানে যেমন আছেন ধনবান জনগোষ্ঠি তেমনি আছেন দরিদ্র জনগোষ্ঠিও। আবার এই ধনবানদের মধ্যে কয়েকজন আছেন যাদেরকে বলা হয় অতি ধনী। সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফ্যামের এক গবেষণা পত্রের তথ্য থেকে জানা যায় এই অতি ধনীরা এতই ধনী যে তা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।

অক্সফ্যাম এর গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায় এই সুপার ধনীদের মধ্যে যারা শীর্ষে আছেন এমন দুইজন ব্যক্তির হাতে যে পরিমাণ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে আছে তার পরিমাণ দেশটির ১ কোটি ১০ লাখ দরিদ্র মানুষের হাতে যে সম্পদ রয়েছে তার সমান! ধনী এই দুই ব্যক্তি হলেন ডেভিড থমসন এবং গ্যালেন ওয়েস্টন সিনিয়র। ডেভিড থমসন ‘থমসন রয়টার্স’এর চেয়ারম্যান এবং গ্যালেন ওয়েস্টন সিনিয়র লবলজ কোম্পানী লিমিটেড এর প্রেসিডেন্ট। থমসন রয়টার্সের ব্যবসা হলো মিডিয়া আর লবলজ এর ব্যবসা হলো গ্রোসারী ও ঔষধের দোকান।

এই দুই ব্যক্তির হাতে বর্তমানে কি পরিমাণ সম্পদ আছে তা শুনলে আমাদের মত যারা নিতান্তই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তাদের কথা বাদই দিলাম, যারা পর্যাপ্ত ধনী তারাও যারপর নাই বিস্ময়াভিভূত হবেন। এই অতি ধনীরা তাদের সম্পদ দিয়ে কানাডার মাঝারি ধরনের একটি প্রভিন্সের সবকিছু কিনে ফেলার ক্ষমতা রাখেন!

অক্সফ্যামের গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী আট ধনকুবেরের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে ৩৬০ কোটি মানুষের সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ! অক্সফ্যাম তাদের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়ে বিপজ্জনকভাবে সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। অক্সফ্যামের গবেষণা প্রতিবেদনে আট ধনকুবেরের হাতে বিশ্বের দরিদ্রতম ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ কুক্ষিগত থাকার বিষয়টিকে ‘কল্পনাতীত বৈষম্য’ হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়।

অক্সফ্যামের প্রতিবেদন অনুযায়ী মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, স্পেনের ফ্যাশন প্রতিষ্ঠান জারা’র প্রধান আমানিকো ওর্তেগা, মার্কিন ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফেট, মেক্সিকান টেলিকম ব্যবসায়ী কার্লোস সিøম হেলো, আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা মালিক জেফ বেজোস, ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ, ওরাকলের সিইও ল্যারি এলিসন এবং ব্লুমবার্গ নিউজের প্রতিষ্ঠাতা মিকায়েল ব্লুমবার্গ- এই আট ধনকুবেরের হাতে  মোট ৪২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে। তাদের এই সম্পদ পৃথিবীর ৩৬০ কোটি দরিদ্র মানুষের সম্পদের সমান।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত অন্যান্য গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে কানাডার এই অতি ধনীরা দিন দিন আরো বেশী পরিমাণের সম্পদের মালিক হচ্ছেন। দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যা ঘটছে তার প্রায় পুরো ফয়দাটা তারাই বাগিয়ে নিচ্ছেন। বাদবাকী যারা আছেন তারা পাচ্ছেন অতি সামান্য সুবিধা অথবা কিছুই পাচ্ছেন না। ফলে সমাজে তৈরী হচ্ছে সীমাহীন বৈষম্য। অক্সফ্যামের পলিসি এন্ড ক্যাম্পেইন ডিরেক্টর লরেন রেভন বলেন, যে সমাজে বৈষম্য অনেক বেশী সে সমাজ অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয়। দীর্ঘ মেয়াদে যদি আমরা দেখি যে সম্পদ মাত্র গুটি কতক লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে তবে আমরা এও দেখবো যে ভবিষ্যতে বাজারে পণ্য কিনার লোক থাকবে না অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য।

কানাডায় বৈষম্য শুধু সম্পদের ক্ষেত্রেই নয়। আয়ের ক্ষেত্রেও সীমাহীন বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। গত ২০১৫ সালে কানাডার কয়েকটি কোম্পানীর শীর্ষ কর্মকর্তাগণ যে পরিমাণ বেতন ও সুবিধা গ্রহণ করেছেন সে দিকে তাকালে স্তম্ভিত হতে হয়। বিস্ময়ের সীমা অতিক্রম করে যায় তাদের বেতনের পরিমাণ দেখলে।

চলতি বছরের শুরুতে (৩ জানুয়ারী) সিবিসি নিউজের এক সংবাদে বলা হয়, কানাডার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত 100 CEO (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) ২০১৫ সালে গড়ে ৯.৫ মিলিয়ন বেতন (বিভিন্ন সুবিধাসহ) নিয়েছেন। প্রতি বছরই এই তালিকা প্রকাশ করা হয়। এবারের তালিকায় যিনি শীর্ষে আছেন তিনি হলেন ভ্যালেন্ট ফার্মাসিউটিক্যাল এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাইকেল পিয়ার্সন। তিনি ২০১৫ সালে ১৮২.৯ মিলিয়ন বেতন নিয়েছেন! হ্যা, একশত বিরাশি দশমিক নয় মিলিয়ন ডলার! কথায় লিখলাম, কেউ যেন না ভাবেন যে অংকে ফিগার লিখতে গিয়ে ভুল করা হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন কানাডার মেঘনা ইন্টারন্যাশনাল এর (Magna International Inc) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডন ওয়াকার। তিনি বেতন নিয়েছেন ২৬.৫ মিলিয়ন ডলার। তৃতীয় স্থানে আছেন কানাডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ে লিমিটেড এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হান্টার হ্যারিসন। তিনি বেতন নিয়েছেন ১৯.৯ মিলিয়ন ডলার। চতুর্থস্থানে আছেন এলিমেন্ট ফিনান্সিয়াল কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টিভেন হাডসন। তিনি বেতন নিয়েছেন ১৯.৩ মিলিয়ন ডলার। পঞ্চমস্থানে আছেন ওপেন টেক্স কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক বেরেনেচিয়া। তিনি বেতন নিয়েছেন ১৮ মিলিয়ন ডলার। আর এই Top 100 CEO এর মধ্যে সবচেয়ে কম বেতন যিনি নিয়েছেন তিনি হলেন মেট্রো ইনক এর প্রধান নির্বাহী এরিখ লা ফ্ল্যাস। তিনি বেতন নিয়েছেন ৩.৬ মিলিয়ন ডলার।

সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অতীতেও বিভিন্ন কোম্পানীর প্রধান নির্বাহীগণ বিপুল পরিমাণের বেতন নিতেন। তবে এখনকার মতো এরকম অবিশ্বাস্য অংকের বেতন ছিল না তখন। এইতো মাত্র ৩০ বছর আগেও তারা যে পরিমাণ বেতন পেতেন তা ছিল এ দেশের সাধারণ কর্মজীবী মানুষদের চেয়ে তিরিশ গুণ বেশী। কিন্তু এখন তারা ১৯৩ গুণ বেশী বেতন পান।

২০১৫ সালে কানাডায় একজন সাধারণ সার্বক্ষনিক (সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা) কর্মজীবীর বাৎসরিক গড় বেতন ছিল ৪৯,৫১০ ডলার। সেই হিসাবে উপরে উল্লেখিত  Top 100 CEO গণ সকাল নয়টায় কাজে হাজির হয়ে দশটার মধ্যে অর্থাৎ এক ঘন্টায় যা আয় করবেন (বাৎসরিক গড় আয় ৯.৫০ মিলিয়ন ডলার স্ট এক বছরের মোট কর্মঘন্টা ১৯২০ = ৪৯৪৭.৯১ ডলার), একজন সাধারণ কর্মজীবীর পক্ষে সেই পরিমাণ অর্থ আয় করতে পুরো এক বছর লেগে যাবে! Top 100 CEO দের বেশীর ভাগ অবশ্য নিজ নিজ কোম্পানীর মালিকও।

একদিকে সম্পদের এই সীমাহীন বৈষম্য অন্যদিকে বেতনের এই আকাশপাতাল তফাৎ গোটা সমাজকেই একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়। আর শুধু অক্সফ্যামের গবেষণা প্রতিবেদনেই যে এই বৈষম্যের চিত্র ফুটে উঠেছে তা নয়। অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদন থেকেও প্রায় একই ধরণের চিত্র পাওয়া যায়। ২০১৪ সালের জুনে প্রকাশিত কানাডার সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভ নামের বাম ঘরাণার একটি সংগঠনের রিপোর্টে দেখা যায়, সবচেয়ে ধনী ৮৬ জন ব্যক্তি বা পরিবার অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ০.০০২ শতাংশ লোক ক্রমশ আরও ধনী হয়ে উঠছেন এবং এই মুহূর্তে তাদের হাতে দেশের দরিদ্রতম এক কোটি ১৪ লাখ লোকের সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ পুঞ্জীভূত রয়েছে।

রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, এই পরিসংখ্যান ১৯৯৯ সালের চেয়ে বেশি। ওই বছর সবচেয়ে ধনী ৮৬ ব্যক্তি বা পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ছিলো সবচেয়ে গরীব এক কোটি ১লাখ মানুষের সম্পদের সমান। তাদের ওই সম্পদ দিয়ে নিউ বার্নসউইক প্রভিন্সের সবকিছু কিনে ফেলার পরও আরো ৪ হাজার কোটি ডলার তাদের হাতে থেকে যাওয়ার কথা!

রিপোর্টের লেখক অর্থনীতিবিদ ডেভিড ম্যাকডোনাল্ড রিপোর্ট প্রণয়নের জন্য স্ট্যাটিস্টিক্স কানাডা এবং কানাডিয়ান বিজনেস ম্যাগাজিনের গবেষণার উপাত্ত ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন, তার রিপোর্টের লক্ষ্য হলো এটা দেখানো যে, আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য যদি নীতি হয় এবং সামাজিক ন্যায়বিচার যদি ভাবনার কারণ হয় তাহলে সম্পদের অসাম্যও চরম পর্যায়ে পৌঁছে। তিনি আরো বলেন, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে- সম্পদের এই পুঞ্জীভবনের ফলে এই সম্পদ আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কিনে ফেলতে শুরু করে।

তবে স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার তথ্যে আরও দেখা গেছে যে, সম্পদ জমা হচ্ছে শীর্ষ পর্যায়ে। মধ্যবিত্ত পর্যায়ে দায়দেনা মিটিয়ে প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ যখন ১৯৯৯ সাল থেকে ৮০ শতাংশ বেড়ে পরিবার পিছু ২ লাখ ৪৩ হাজার ৮০০ ডলারে পৌঁছেছে, তখন শীর্ষ পর্যায়ের ৪০ শতাংশ মানুষ দায় দেনা মিটিয়ে প্রকৃত সম্পদের ৮৮.৯ শতাংশের মালিকানা ধরে রেখেছে। অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ মানুষ মাত্র ১১.১ শতাংশ সম্পদের মালিক। চোখ খুলে দেয়ার মত উপাত্ত হলো, সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশ মানুষের দায়দেনার পরিমাণ তাদের সম্পদের চেয়ে বেশি।

২০১৩ সালে দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ও পরিবারগুলোর মধ্যে মোটামুটিভাবে তারাই রয়েছেন যারা ২০০৫ এবং ১৯৯৯ সালে সবচেয়ে ধনীর তালিকায় ছিলেন। সুপরিচিত পরিবারগুলোর মধ্যে রয়েছে থমসন, ইরভিং, ডেসমারিয়াস এবং পেটিসন।

রিপোর্টে দেখা গেছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ৮৬ কানাডিয়ানের সম্পদের পরিমাণ ১১৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৭৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

একটি দেশে সীমাহীন সম্পদ নির্দিষ্ট স্বল্পসংখ্যক মানুষের হাতে কুক্ষিগত হলে তা একদিকে যেমন আইন না মানা স্বেচ্ছাচারী একটি গোষ্ঠি তৈরী করে অন্যদিকে সৃষ্টি করে বৈষম্যের সংস্কৃতি। টরন্টোর কথাই ধরা যাক। এটি এখন হয়ে দাড়িয়েছে বৈষম্যের রাজধানী। ২০১৫ সালের মধ্যভাগে ‘ইউনাইটেড ওয়ে’ এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে এখানে ধনী ও দরিদ্র পরিবারের মধ্যকার ব্যবধান কানাডার জাতীয় হারের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, টরন্টোতে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য ১৯৮০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ৩১ শতাংশ বেড়ে গেছে। এটি কানাডার যে কোনও বড় শহরের চেয়ে নাটকীয় বৃদ্ধি। কারণ সারাদেশে ধনী-গরিবের আয়ের ব্যবধান বেড়েছে গড়ে ১৪ শতাংশ হারে।

আয়ের অসাম্য বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে একটি বিকাশমান সংস্থার ওই রিপোর্টে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয় যে, নগরীর ক্রমবর্ধমান ব্যবধান সামাজিক সচলতাকে স্থবির করে দিতে, সামাজিক বন্ধনকে দুর্বল এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে খর্ব করতে পারে।

উল্লেখ্য যে, টরন্টোতে কিছু মানুষের আর্থিক দুরাবস্থার কারণে ক্ষতি হচ্ছে প্রতি বছর ৪.৪ থেকে ৫.৫ বিলিয়ন ডলার। ইউনাইটেড ওয়ের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত এক যুগান্তকারী গবেষণায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এই তথ্য। দারিদ্রতার কারণে মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটে বেশী। দরিদ্র মানুষ মানসিকভাবে বিষন্ন থাকে যার প্রভাব পড়ে কর্মস্থলের উৎপাদনশীলতায়। দরিদ্র অঞ্চলে মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেশী থাকে যার কারণে পুলিশ ও আইন বিভাগকে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করতে হয় তা মোকাবেলা করার জন্য। আর এসব সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয় স্থানীয় সরাকারকে।

টরন্টোতে বর্তমানে দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা দুই লাখ ৬৫ হাজার। অন্যদিকে ২০০৯ সালের এক হিসাবে দেখা যায় কানাডায় প্রতি দশজনের মধ্যে একজন বাস করেন দারিদ্রসীমার নিচে। উল্লেখ্য যে, টরন্টোতে টেক্স প্রদানের পর একজন কর্মজীবী মানুষের বাৎসরিক আয় ১৮,৫০০ ডলারের কম হলে তাকে দরিদ্র বলা হয়। আর স্বামী-স্ত্রীসহ চার সদস্যের একটি পরিবারের বাৎসরিক আয় ২৭,৫০০ ডলারের নিচে হলে সেই পরিবারকে দরিদ্র পরিবার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

ইতিপূর্বে কানাডিয়ান প্রেসের এক খবরে বলা হয়, অন্টারিতে কর্মসংস্থানের মান বা স্ট্যান্ডার্ডেও গুরুতর সমস্যা খুঁজে পেয়েছেন একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল। তারা বলেন, “তদন্তের পর আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে অন্টারিওতে অনেক কর্মস্থলে অনেক কর্মী তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।” এমপ্লয়মেন্ট স্ট্যান্ডার্ডস এক্ট এন্ড দি লেবার রিলেশনস এক্ট এর পর্যালোচনার পর বিশেষজ্ঞ প্যানেল এই অভিমত প্রকাশ করেন। গত শতকের নব্বুই দশকের পর এই প্রথম এই ধরনের একটি পর্যালোচনা করা হলো।

সম্পদের অসমবন্টন, শ্রমিক শোষণ, মানুষকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এর কোনটাই মানব সমাজে নতুন কোন বিষয় নয়। শত সহস্র বছর ধরে আমরা এই একই চিত্র দেখে আসছি। রাজতন্ত্রের দেশগুলোতে রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বঞ্চনার শিকার হন সাধারণ মানুষ। অপরদিকে গণতান্ত্রিক কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ বঞ্চনার শিকার হন ধনী মালিক শ্রেণী কর্তৃক। এ সব দেশে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করার জন্য রাজতন্ত্রের মত রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা সরাসরি না থাকলেও যারা রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় থাকেন তারা মূলত ঐ পুঁজিপতিদের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিংবা পূজিপতিদের মধ্যে যারা অতি ধনী তারা পর্দার নেপথ্যে থেকে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহার করেন। এভাবে দিনে দিনে মানুষে মানুষে ব্যবধান আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। অক্সফ্যামের গবেষণা প্রতিবেদনেও বলা হয় আগামী ২৫ বছরের মধ্যে এখন যারা বিলিয়নার তাদের মধ্য থেকে ‘ট্রিলিয়নিয়ার’ তৈরি হবে। তার অর্থ হলো একেকজন অতি ধনীর সম্পদের পরিমাণ এক লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

আমরা জানি পৃথিবীতে এখনো অনেক দেশে মানুষ না খেয়ে এবং বিনা চিকিৎসায় মারা যান। কানাডায় অবশ্য কেউ না খেয়ে মারা যান না বা বিনা চিকিৎসায় মারা যান না। কিন্তু অনেক মানুষ আছেন যারা দারিদ্রতার কষাঘাতে প্রতিনিয়তই জর্জরিত হচ্ছেন। এই দারিদ্রতা তাদের স্বাস্থ্যের উপর বড়রকমের বিরুপ প্রভাব ফেলছে। কানাডায় প্রতিদিন প্রায় এক মিলিয়ন লোককে ফুড ব্যাংকের স্মরনাপন্ন হতে হয় অভাবের তাড়নায়। অথচ কানাডা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ধনী দেশগুলোর একটি। বহু  সংখ্যক সেরা ধনীরও বসবাস রয়েছে এই দেশটিতে।

দারিদ্রতা সত্যিকার অর্থে সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতিটি সদস্যকেই ভোগায়। কারণ, দারিদ্রতার কষাঘাতে যারা জর্জরিত তারা নানান রোগ-শোকে ভোগে, মানসিক রোগ তাদের নিত্য সাথী হয়ে দাড়ায়, আইশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশী সময় ব্যয় করতে হয় তাদের জন্য। ফলে হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় ও আইন-শৃংখলা বজায় রাখার খরচ বৃদ্ধি পায়। দারিদ্রতার কারণে শারীরিক ও মানসিক রোগ লেগে থাকে বলে কর্মস্থলে তাদের উপস্থিতি কমে যায়। ফলে জাতীয় উৎপাদন ব্যহত হয়। স্কুল কলেজেও উপস্থিতির হার কমে যায় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের। ড্রপআউট বেড়ে যায়। ফলে ভবিষ্যতে দক্ষ কর্মীবাহিনীর স্বল্পতা দেখা দেয়। এভাবে আরো নানাভাবে এই দারিদ্রতা সামজ ও রাষ্ট্রকে পিছিয়ে দেয়।

হিসাবে দেখা গেছে কানাডায় শতকরা ৯ জন দরিদ্রসীমার নিচে বাস করেন। সিঙ্গেল মাদার ও আদীবাসীদের মধ্যে এই হার আরো বেশী। উল্লেখ্য যে, কানাডার দুইজন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ড্যানিয়েল মারটিন এবং রায়ান মেইলি ইতিপূর্বে যৌথভাবে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন টরন্টো স্টার পত্রিকায় যেখানে তাঁরা উল্লেখ করেন, “মানুষকে অসুস্থ করে তোলার পিছনে ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির যেমন ভূমিকা থাকে তেমনি থাকে তাদের ব্যক্তিগত অভ্যাস যেমন ধূমপান, খাবার ঠিকমত না খাওয়া বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া অথবা অলস জীবন যাপন ইত্যাদিরও ভূমিকা। তবে এগুলোর চেয়েও অনেক বেশী ভূমিকা রাখে মানুষের দারিদ্রতা।

পরিশেষে বলা যায়, কানাডায় মাত্র কয়েকজন লোকের হাতে পর্বতসমান উচ্চতার সম্পদ কুক্ষিগত হবে আর অন্যদিকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ দারিদ্রতার মধ্যে বাস করে অসুস্থ্য জীবনযাপন করবেন সেটা কোন সুস্থ্য সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন নয়। আমরা দেখেছি, অক্সফ্যামও তাদের প্রতিবেদনে বিপজ্জনকভাবে সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। তারা বলেছে, যে সমাজে অধিক বৈষম্য থাকে  সে সমাজে অপরাধের মাত্রাও অধিক থাকে। ঐ সমাজ হয় অস্বাস্থ্যকর। মানুষ একে অপরকে বিশ্বাস করেন না। মানুষজন মনে করতে থাকেন তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন যখন দেখেন ঐ অতি ধনীরা নিজেদের সুবিধার্থে আইন তৈরী করে নেন।

সংস্থাটি এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটাতে ‘নতুন অর্থনৈতিক মডেল’ প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছে। অক্সফ্যাম অবশ্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ পেশ করেছে তাদের রিপোর্টে এই বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য। এর মধ্যে আছে আগামী বাজেটে প্রগ্রেসিভ টেক্সেশন এর নীতি গ্রহণ করা যেটি নরডিক দেশসমূহে রয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে আছে সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ড। ঐ নীতিতে যাদের আয় বেশী তাদেরকে একটা বড় অংশ প্রদান করতে হয় টেক্স হিসাবে।

একই পরামর্শ দিয়েছেন কার্লটনের অধ্যাপক স্টিফেন হ্যারিস। তিনি বলেন, সম্পদের এই বৈষম্য দূরীকরণে কানাডা কিছু নীতি বা আইন প্রণয়ন করতে পারে যেমনটা নিয়েছে নরডিক দেশসমূহ। এই দেশগুলোতে সম্পদের বৈষম্য এত তীব্র নয়।

আমরাও মনে করি কানাডার সরকারের উচিৎ এ বিষয়ে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হওয়া। নয়তো দেশটির সমাজব্যবস্থা এগিয়ে যাওয়ার বদলে পিছিয়ে যাবে যা কারো কাম্য হতে পারে না।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ