কানাডায় আমাদেরকে ময়ূরপুচ্ছ পরে নকল ময়ূর সাজতে হবে?

নভেম্বর ৫, ২০১৬

খুরশিদ আলম ॥

কানাডায় আমরা আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবো না। আমরা আমাদের দেশাচার, আমাদের সংস্কৃতি ইত্যাদির চর্চাও করতে পারবো না। আমাদেরকে ময়ূরপুচ্ছ পরে নকল ময়ূর সাজতে হবে। কথা বলতে হবে ইংরেজদের ভাষায় অথবা ফরাসীদের ভাষায়। টুপি – হেজাব আর বোরখারতো প্রশ্নই ওঠেনা। সম্ভতব নামাজ-রোজা বা পূজা-অর্চনাও করা যাবে না। কে জানে, হয়তো শেষপর্যন্ত চার্চে যাওয়ার পরামর্শও আসতে পারে!

পাঠক, ঘাবড়ে গেলেন কি? আচ্ছা সত্যি সত্যি যদি কানাডায় এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তবে কি করবেন? ঘরে যদি লুঙ্গি পরা বাদ দিতে হয়, বাইরে পায়জামা-পাঞ্জাবী পরা যদি নিষেধ হয়ে যায় তাহলে কি করবেন? বঙ্গ ললনারা যদি শাড়ি না পরতে পারেন তবে কি হবে? শুটকী খাওয়া যদি বারণ হয়, যদি বারণ হয় ছানা-সন্দেশ আর রসগোল্লা? আমিত্তি, জিলাপী, পুলি পিঠা, ভাপা পিঠা, ফুল পিঠাসহ অন্যান্য পিঠা? বিরিয়ানী-পোলাও? বাংলা নাটক-সিনেমা বাদ দিয়ে যদি ইংরেজী বা ফরাসী ভাষার নাটক-সিনেমা দেখতে বলা হয় কিংবা ইংরেজী- ফরাসী ভাষার গান শুনতে বলা হয়?

পাঠক, ঘাবড়াবেন না। কানাডা মঘের মুল্লুক নয়। কেউ একটা জিগির তুললেন আর অমনি করে সব এমপিরা পার্লামেন্টে হুমড়ী খেয়ে পড়লেন নতুন আইন করার জন্য, এরকম দেশে আমরা বাস করি না। কানাডা একটি সুসভ্য দেশ। সভ্যতার মাপকাঠিতে কানাডা বর্তমান পৃথিবীতে সেরা কয়েকটি দেশের একটি।

কিন্তু কথায় বলে না যে, ‘প্রদীপের নিচেই অন্ধকারের বাস’? কানাডার মতো একরম একটি সুসভ্য দেশেও ‘রক্ষণশীলতা’ বলে একটি ব্যাপার চালু রয়েছে। এই রক্ষণশীলতাই কানাডার প্রদীপের নিচের অন্ধকার। কানাডায় যারা রক্ষণশীলতার রক্ষক ও প্রতিপালক তারা চান না তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ দেশে কিছু ঘটুক। তারা চান তাদের মত করে অন্যরা কথা বলুক, পোষাক পরিধান করুক। তাদের মত করে অন্যরা ভাবুক এবং আদপ-কায়দা শিখুক। তাদের ধারণা তাদের ভাষা ও তাদের জীবনাচার তথা সংস্কৃতি এবং জাগতিক ও পরলৌকিক চিন্তা-ভাবনা জগৎশ্রেষ্ঠ। তাই অন্যদেরকেও তাদের মত করেই চলতে হবে। অথবা ব্যাপারটিকে এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায় যে, এই রক্ষণশীলেরা নিজেদেরকে জগৎশ্রেষ্ঠ মানুষ ভাবেন। তাই বাদবাকী যে জনগোষ্ঠিসমূহ আছেন দুনিয়াতে তারা তাদেরকে অনুসরণ করবেন জীবনের প্রতিটি কর্মকান্ডে।

সুদুর প্রবাসে নিজেদের সংস্কৃতিকে ধরে রাখার চেষ্টা বাঙ্গালীদের। টরন্টোতে গত বাংলা নববর্ষের র‌্যালীতে নারী পুরুষ শিশু সকলের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। ছাবি : মুনির বাবু

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই রক্ষণশীল গোষ্ঠি কারা? প্রথমেই হয়তো অনেকে ভাববেন এখানকার শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠিদের কথা। না, শ্বেতাঙ্গ হলেই কেউ রক্ষণশীল হন না। আমরা দেখেছি ভারতবর্ষেও রক্ষণশীল লোকের অভাব নেই। কিন্তু তারা কেউ শ্বেতাঙ্গ নন। ভরতবর্ষে রক্ষণশীলতার চিত্রটি অত্যন্ত কদর্য, অমানবিক এবং ক্ষেত্রবিশেষ নৃশংসও। জাত প্রথা সে অঞ্চলের মানুষের জীবনকে আজো অধিকার বঞ্চিত করে রেখেছে অনেক জনপদে। মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরী করে রেখেছে ধর্ম। ধর্মের নামে তৈরী করা রাখা হয়েছে বর্ণপ্রথা। কেউ উচ্চ বর্ণের, কেউ নিন্ম বর্ণের! অন্যদিকে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে কথায় আচরণে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পিছপা হন না অনেক সময়। ধর্মীয় দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণহানী হয়েছে এই অঞ্চলটিতে। অথচ এরা একই দেশের বা একই অঞ্চলের মানুষ। ধর্ম বাদ দিলে এরা একই সংস্কৃতির মানুষ। একই জীবনাচার এদের।

সেই তুলনায় কানাডার রক্ষণশীলতা অতটা মন্দ বা অশুভ নয়। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়। রক্ষণশীলতার মাত্রা যত কমই হোক, শেষপর্যন্ত তা রক্ষণশীলতাই। কাউকে জুতা পেটা করা যেমন অবমাননা করা, তেমনি কোন কটু কথা বলাও অবমাননা করারই সামিল। অন্যকে নিজের মত করে চলার পরামর্শ দান করা বা নির্দেশ দেয়াও অবমাননারই সামিল। কারণ, এতে করে অন্যের জীবনযাপন প্রনালীকে তুচ্ছ জ্ঞান করা হয়, হেয় করা হয়।

আমি টরন্টোতে এক মহিলাকে দেখেছি যিনি বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই অতি ধার্মিক হয়ে উঠেছেন। বছর পনের আগে তাকে প্যান্ট শার্ট পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। তবে মাথায় হিজাব থাকতো। গত প্রায় আট/দশ বছর ধরে তাকে দেখছি বোরখা ও নিকাব পরা অবস্থায়। হাতে হাতমোজা পরা থাকে। অর্থাৎ আগাগোড়াই তিনি পর্দার অন্ধকারে থাকেন। তিনি যে এপার্টমেন্টে থাকেন সেই একই এপার্টমেন্টে আরেক বাঙ্গালী মহিলা থাকেন যিনি ধর্মমতে হিন্দু। একদিন এই বোরাখা পরা মহিলার সঙ্গে ঐ হিন্দু ধর্মালম্বী মহিলার দেখা লবিতে। কুশল বিনিময়ের পর তারা একে অন্যের খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। এরই এক পর্যায়ে বোরখা পরা ঐ মহিলা হিন্দু ধর্মাবলম্বী মহিলাকে বলে বসলেন, আপনি মুসলমান হয়ে যান না কেন?

মাথায় বজ্রপাতের মত ঘটনা! ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্বিত হয়ে যান ঐ হিন্দু মহিলা। প্রত্যুত্তরে কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সেই যাত্রায় নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়ে তিনি নিজ ঘরে ফিরে আসেন। পরে একদিন দুঃখ করে তিনি এই ঘটনা বলছিলেন এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অন্যান্য অতিথিগণ এই ঘটনার কথা শুনে যারপর নাই স্তম্বিত হয়ে যান। কানাডার মতো একটি সমাজব্যবস্থায় বাস করে এহেন উদ্বত্য ও ধৃষ্ট আচরণ!

পাঠক, যে রক্ষণশীলতার কথা বলছিলাম, সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কানাডায় সম্প্রতি এক জরীপ চালানো হয়েছিল ইমিগ্রেন্টদের বিষয়ে কানাডিয়ানদের কি মনোভাব তা নিয়ে। দেখা গেছে ৬৮% কানাডিয়ান মনে করেন, নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে ইমিগ্রেন্টদের উচিৎ এখানকার মূলশ্রোতের সঙ্গে মিশে যাওয়া! এই ৬৮% কানাডিয়ানদের মধ্যে ৮৭%ই শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ান। অর্থাৎ প্রতি দশজন শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ানদের মধ্যে প্রায় ৯ জনই চান ইমিগ্রেন্টরা তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলে যাক! জরীপটি চালিয়েছিল CBC-Angus Reid যৌথভাবে।

কানাডিয়ান বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ানদের এই মনোভাবের সঙ্গে আমাদের সেই বোরখা পরা মহিলার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় কি? বোরখা পরা সেই মহিলা চরমভাবে রক্ষণশীল এবং এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিনি একই সাথে চরমভাবে মৌলবাদীও। তাহলে কি আমরা বলতে পারি না যে, ঐ ৮৭% শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ানও এক ধরণের মৌলবাদী? তারাও ঐ বোরখা পরা মহিলার মত নিজের ভাষা, বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে অন্যের ঘারে চাপিয়ে দিতে চান? অর্থাৎ ইমিগ্রেন্টদেরকে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে এখানকার মূলশ্রোতের সঙ্গে মিশে যেতে হবে!

হাফিংটন পোস্ট (কানাডা) এর সিনিয়র এডিটর যশোয়া অসট্রফ এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, “আমি কানাডিয়ান কারণ আমার প্রপিতামহগণ রাশিয়া থেকে কানাডায় এসেছিলেন পালিয়ে যখন সেখানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলছিল ইহুদীদের বিরুদ্ধে। ইহুদীদের এলাকা বা পল্লীগুলো কেন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল? কারণ, তারা সেখানকার মূলস্রোতের সঙ্গে অঙ্গীভূত হননি। সুতরাং, যখন দেখি এত বিপুল সংখ্যক কানাডিয়ানও চান ইমিগ্রেন্টরা তাদের সমাজে অঙ্গীভূত হোক, তখন তা আমাকে কষ্ট দেয়।”

যশোয়া অসট্রফ আরো উল্লেখ করেন যে, “এ বিষয়টিও আমাকে কষ্ট দেয় যখন দেখি ফেডারেল টরিরা (কনজার্ভেটিভ পার্টি অব কানাডা) ইসলামোফোবিয়াকে নিন্দা জানিয়ে পার্লামেন্টে বিল পাস করানোর বিপক্ষে রায় দেন। তাদের কারণে বিলটি পাশ হয়নি। হ্যা, এই টরিরাই নিকাব ইস্যু এবং ‘বারবারিক কালচারাল প্র্যাকটিস’কে কাজে লাগিয়ে ভোট পেতে চেয়েছিলেন গত জাতীয় নির্বাচনের আগে। নির্বাচনের পরে আবার তারাই জিকির তুলেছেন নতুন ইমিগ্রেন্টদেরকে ‘এন্টি কানাডিয়ান ভ্যালিউজ’ পরীক্ষায় পাশ করতে হবে কানাডায় আসার আগে।”

উল্লেখ্য যে, গত ৫ অক্টোবর পার্লামেন্টে এনডিপি নেতা থমাস মুলকেয়ার কর্তৃক একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছিল। ঐ বিলে সব ধরণের ইসলামোফোবিয়াকে নিন্দা জানানোর আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু কনজার্ভেটিভ পার্টির কিছু সদস্য তাতে বাধ সাধেন। তারা এর পক্ষে ভোট দেন নি। থমাস মুলকেয়ার এতে খুবই নিরাশ হন। তিনি বলেন, “আমি ভাবতে পরিনা ঘৃনা প্রকাশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত একটি বিলে কি করে কনজার্ভেটিভরা বিরোধীতা করেন।” তিনি আরো বলেন, “আমরা এখানে সমবেত হয়েছি সমাজে সব ধরণের ঘৃণাকে নিন্দা জানানোর জন্য। এটা জেন্ডার আইডিয়েন্টির বিষয়ে হোক, ব্যক্তির এথনিক পরিচয়, সংস্কৃতি বা ধর্মীয় পরিচয়ের বিষয়ে হোক, কোন ব্যাপারেই ঘৃণা প্রকাশ করা যাবে না।”-(সূত্র: হাফিংটন পোস্ট)

হাফিংটন পোস্ট এর রিপোর্ট থেকে আরো জানা যায়, বিল উত্থাপনের আগে সব পার্টির সঙ্গে আলোচনা থেকে মুলকেয়ারের ধারণা হয়েছিল এ ব্যাপারে পার্লামেন্টে সবাই একমত হবেন। ঐ দিন কোশ্চেন পিরিয়ডের পর মুলকেয়ার একটি ‘ই-পিটিশন’ এর পক্ষ হয়ে কাজ করেন। এই ই-পিটিশনটি স্পন্সর করেন লিবারেল এমপি ফ্রেংক বেইলিস। এই ই-পিটিশনে কানাডার ৬৬ হাজার মুসলিম অধিবাসীর স্বাক্ষর রয়েছে। ই-পিটিশনের মাধ্যমে স্বাক্ষরকারী মুসলিমরা পার্লামেন্টকে আহ্বান জানিয়েছিল ইসলামোফোবিয়াকে নিন্দা জানিয়ে একটি আইন পাশ করার জন্য। কিন্তু সেদিন কনজার্ভেটিভ পার্টির কতিপয় এমপি এর বিপক্ষে ভোট দেন। ফলে বিলটি পাশ হয়নি।

পাঠক, এই রক্ষণশীল গোষ্ঠির লোকেরাই চান ইমিগ্রেন্টরা যাতে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে মূলশ্রোতের সঙ্গে মিশে যান! সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ইসলামোফোবিয়ার নামে কেউ ঘৃণা বা বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশ করলেও সেটাকে তারা আমলে নিতে চান না। তাদের বিচারে এই জাতীয় বর্ণবাদ বা ঘৃণা অপরাধের মধ্যে পড়ে না!

স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইংরেজরা যখন ভারতবর্ষে গিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর ছলনার আশ্রয় নিয়ে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিল এবং পরবর্তী প্রায় দুই শ বছর শাসন ও শোষনের রাজত্ব কায়েম করেছিল তখন কিন্তু তারা নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে আপন করে নেননি। শুধু ভারতবর্ষ কেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই তারা একই কায়দায় রাজত্ব দখল করেছিল। কিন্তু নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে এক পা-ও সরে আসেননি। একই কর্ম করেছিল ফরাসীরাও। এই ইংরেজ আর ফরাসীরা যখন কানাডায় আসেন তখন তারাও কিন্তু নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভুলে যাননি। তাহলে আজ কেন ইমিগ্রেন্টদেরকে তাদের নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলে যেতে হবে?

ইংরেজ ও ফরাসীরা যে অন্য দেশে গিয়ে তাদের নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভুলে যাননি এটা তাদের কৃতিত্ব অবশ্যই। কিন্তু তারা যখন তাদের দখলকৃত দেশে তাদের নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিকে জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছিল সেটা ছিল জবরদস্তিমূলক দেশ দখলের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আক্রমণ বা হামলা। এবং আজকে যখন তারাই আবার বলেন কানাডায় ইমিগ্রেন্টদের নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে মূল স্রোতের সঙ্গে মিশে যাওয়া উচিত তখন সেই জবরদস্তিমূলক সাংস্কৃতিক আক্রমণ বা হামলার কথাই আবার মনে পড়ে যায়।

কানাডা একটি মাল্টিকালচারের দেশে। এটি শুধু কথার কথা নয়। রাষ্ট্রিয়ভাবেই গত ৪৫ বছর ধরে এটি স্বীকৃত হয়ে আসছে কানাডায়। ১৯৭০ দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডো উদ্যোগে রাষ্ট্রিয়ভাবে গৃহীত হয় এই পলিসি। বলা হয়ে থাকে যে, “ Multiculturalism in Canada is the sense of an equal celebration of racial, religious and cultural backgrounds ”। কিন্তু সেই মাল্টিকালচারের দেশেই ইমিগ্রেন্টদের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ব্যাপক সংখ্যক কানাডীয় নাগরিকের এরকম মনোভাব প্রকাশ করায় অনেকে কিছুটা আশ্চর্য হয়েছেন।

এখন কথা উঠতে পারে এই বলে যে, কানাডায় ফরাসী ভাষাভাষীরাওতো সংখ্যালঘু। তাহলে তাদেরকে কেন বলা হয় না তারা নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে ইংরেজী ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে একীভূত হয়ে যাক? বরং দেখা গেছে সংখ্যালঘু হওয়া সত্বেও তাদের ভাষাকে কানাডার রাষ্ট্রিয় ভাষা হিসাবেই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কানাডায় অফিসিয়ালি দুটি রাষ্ট্রয় ভাষা রয়েছে। একটি ইংরেজী এবং অপরটি ফরাসী।

কানাডায় ফরাসীরা তাদের ভাষাকেই শুধু রাষ্ট্রিয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করেনি, তারা তাদের সংস্কৃতিকেও সগর্বে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে কানাডায় সংখ্যালঘু হয়েও।

এখন সমস্যা হয়ে দাড়ালো শুধু ইমিগ্রেন্টদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে? কানাডায় ইমিগ্রেন্ট নয় কে? ইংরেজ, ফরাসী, ইতালিয়ান, স্পেনিশ, জার্মান সবাইতো ইমিগ্রেন্ট। কেউ আগে এসেছেন কেউ পরে এসেছেন। পার্থক্য এইটুকুই। এখন ইংরেজ আর ফরাসীরা যদি যার যার ভাষা ও সংস্কৃতি বজায় রেখে একই দেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারেন তবে অন্যান্য ভাষাভাষীর লোকদের নিয়ে সমস্যা কোথায়? অন্যেরাতো বলছে না যে তাদের ভাষাকে রাষ্ট্রিয় মর্যাদা দিতে হবে।

আমরা জানি মাল্টিকালচারালইমজ একটি শক্তি। কানাডা সবসময়ই এর মাল্টিকালচারালইজম পলিসি নিয়ে গর্ববোধ করে। উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা প্রদান করে বিভিন্ন এথনিক গ্রুপের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে। আমরা জানি বিশ্বে কানাডাই প্রথম দেশ যেখানে মাল্টিকালচারালইজমকে রাষ্ট্রিয় নীতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা আসে ১৯৭১ সালে। পরে ২০০২ সালের নভেম্বর মাসে ২৭ জুনকে কানাডার মাল্টিকালচারালইজম দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে প্রতি বছর এই দিনটি মাল্টিকালচারালইজম দিবস হিসাবে পালন হয়ে আসছে।

গত জুন মাসে মাল্টিাকালচারালইজম ডে উপলক্ষ্যে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এক বাণীতে বলেন, “৪৫ বছর আগে কানাডা বিশ্বে প্রথম মাল্টিকালচারালইম এর নীতি গ্রহণ করে। সেই থেকে কানাডা সব সময় প্রমান করে আসছে যে একটি দেশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে এর বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠির কারণে।” প্রধান মন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আরো বলেন, “মাল্টিাকালচারালইজম আমাদের শক্তি। মানব সমাজ এই বৈচিত্রপূর্ণ জনগোষ্ঠি থেকে লাভবান হয়।”

কিন্তু সংখ্যাগুরু কালচার যদি সংখ্যালঘু কালচারকে গ্রাস করতে চায় তবে সেই দেশে মাল্টিকালচারালইজম আর শক্তি হিসাবে থাকে না। একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক দেশে এই ধরণের মনোভাব থাকা উচিৎও নয়। তবে আশার কথা এই যে, সংখ্যালঘুদের সংস্কৃতিকে ভালবাসার লোকেরও অভাব নেই এই দেশটিতে। প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের আগস্ট,২০১৬ সংখ্যায় টরন্টোর বিচেস ইস্ট ইয়র্ক রাইডিং থেকে নির্বাচিত লিবারেল এমপি ন্যাথানিয়েল স্মিথের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। ঐ সাক্ষাৎকারে এমপি ন্যাথানিয়েল বলেন, আমি নিয়মিত বাংলাদেশীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিই। এমন কি বাঙ্গালী পোষাকে সবার সাথে উৎফুল্ল হয়ে নাচ গানও করি। তোমাদের অনুষ্ঠানে গিয়ে আমি সত্যিই খুব মজা পাই। সত্যিই, তোমাদের খুব সুন্দর এক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আছে। সত্যি বলতে কী, বাঙ্গালী সংস্কৃতি আমাকে মুগ্ধ করে।

কানাডায় সংখ্যালঘু ইমিগ্রেন্টরা এমনিতেই রাষ্ট্রিয় বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি অনুগত। বরং দেখা গেছে শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ানদের চেয়েও বেশী অনুগত। এই আনুগত্য চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে হয়নি। স্বত:স্ফূর্তভাবেই হয়েছে। ইতিপূর্বে এনভাইরনিকস ইন্সিটিউট নামের একটি সংস্থা পরিচালিত এক জরীপে দেখা যায় কানাডায় বসবাসরত ৮৩% মুসলমান নিজেদেরকে কানাডিয়ান ভেবে খুবই গর্ববোধ করেন। ২০০৬ সালের তুলনায় এই গর্ববোধের অনুভূতি বৃদ্ধি পেয়েছে ১০%। কৌতুহলের বিষয় হলো, অমুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যে এই অনুভূতি মুসলমানদের তুলনা কম। অন্যদিকে ৭৩% অমুসলিম খুবই গর্ববোধ করেন নিজেদের কানাডিয়ান পরিচয় নিয়ে। কানাডার ব্যাপক সংখ্যক মুসলমান মনে করেন দেশটির সঙ্গে তাদের শক্তিশালী সংযুক্তি রয়েছে। নিজেদেরকে তারা একাট্রা মনে করেন কানাডার সঙ্গে।

কানাডার সঙ্গে একাট্রা বা একাত্ম হওয়ার জন্য ইমিগ্রেন্টদেরকে এরপরও কি নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দিতে হবে? সমর্পণ করতে হবে নিজেদের আত্মপরিচয়কে? কানাডার মূলধারার বিশিষ্ট সাংবাদিক নেইল ম্যাকডোনাল্ড তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, “দেশটি মূলত মাল্টিকলচারাল এবং মাল্টি ফেইথের দেশ। আমি জানি এবং দেখেছি কানাডায় ইহুদীরা প্রথমে নিজেদেরকে ইহুদী ভাবেন এবং খ্রীষ্টানরাও প্রথমে তাদের অনুগত্য প্রকাশ করেন যীশু খ্রিস্টের প্রতি।” অর্থাৎ সবাই নিজ নিজ আত্মপরিচয়ের প্রতি যত্মশীল। এটাই স্বাভাবিক।

হ্যা, একটা সময় আসবে যখন প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টদের উত্তরসুরীরা সময়ের বিবর্তনের মাধ্যমে একটি মিশ্র সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। নিজের সংস্কৃতির ও অন্যের সংস্কৃতির ভাল দিকগুলো মিলিয়ে গড়ে উঠে যে মিশ্রজাতের সংস্কৃতি। তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মে এসে ভাষাটা হারিয়ে যেতে পারে। তবে এ সবই হবে সময়ের বিবর্তনের মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। আর কানাডায় এই প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে যুগ যুগ ধরে। কারণ ইমিগ্রেন্ট

ছাড়া এই দেশটির অগ্রযাত্রা অসম্ভব। জোর করে বা আরোপ করে কিংবা এক সম্প্রদায়ের চাহিদা মোতাবেক অন্য সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করা যায় না।

বাগানের সৈন্দর্য বৃদ্ধি পায় নানান বর্ণের নানান আকৃতির ও নানান সুবাসের ফুলের সমন্বয়ে। কোন একক ফুলের যে বাগান সে বাগানের সৈন্দর্য একঘেয়ে এবং বৈচিত্রহীন। কানাডাও ঐ নানান বর্ণের নানান আকৃতির এবং নানান গুনের মানুষের সমন্বয়ে এক বৈচিত্রপূর্ণ দেশ যাকে আমরা মাল্টিাকালচারের দেশ বলে থাকি। এই মাল্টিকালচারই এ দেশটির সৈন্দর্য ও শক্তি।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ