শতায়ু হবেন না, প্লীজ

ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৪

মীজান রহমান: গেল মাসে স্যান ডিয়েগো গিয়েছিলাম দিন চারেকের জন্যে। বেড়াতে নয়, কাজে। বা কাজের অজুহাতে। অজুহাতটি ছিল একটা অধিবেশন—-আমেরিকান ম্যাথেমেটিক্যাল এসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলন। একেক বছর একেক শহরে ঘটে এই বাৎসরিক মিলনসভা। আগে প্রায় প্রতি বছরই যেতাম, এখন যাই কালেভদ্রে। আগে গৌরি সেনের কাছ থেকে টাকা পেতাম, এখন বয়সের কারণে গৌরি সেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এবার নিজের খরচেই গেলাম। পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হবে সেই লোভে।
কনফারেন্স সেন্টারের কাছাকাছি একটা হোটেলে রুম ঠিক করে রেখেছিলাম আগেই। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলের দূরত্ব খুব বেশি নয়। শাটল বাস ঠিক সময়তেই এসে গেল এয়ারপোর্টের বারান্দায়। ছোট হোটেল, ছোট বাস, ছোটখাটো ড্রাইভার, আমরা তিনজন ছোটখাটো যাত্রী—-আমি আর আমার পেছনের সিটে আঁটশাট করে বসা একটি বর্ষিয়ান যুগল। চেহারাতে অনুমান করে নিলাম দুজনের কারুরই বয়স সম্ভবত আমার চেয়ে কম নয়—-অনুভূতিটা ভালোই লাগছিল। খুব হাসিখুশি দুজনই—-বিশেষ করে মহিলাটি। চটপট কথা বলছিলেন। প্রধানত স্প্যানিশভাষী ড্রাইভারটির অঙ্গে, ফাঁকে ফুঁকে আমার দিকেও দুটি একটি ‘হ্যালো’ ‘নাইস ওয়েদার’ জাতীয় মামুলি আলাপের চেষ্টা, নেহাৎ ভদ্রতার খাতিরে। লক্ষ করলাম গাড়িতে ওঠার পর থেকেই একে অন্যের হাতের মুঠোতে আঙ্গুলগুলো আঁট করে বাঁধা। বেশ মজা লাগলো দেখে। আমাদের দেশে সাধারণত বয়োবৃদ্ধরা একে অন্যের কাঁধে ভর করে চলাফেরা করেন, কারণ দুজনের একজনই কেবল নিজের পায়ে উঠাবসার ক্ষমতা রাখেন, অপরজন তাঁকে ব্যবহার করেন কাষ্ঠনির্মিত যষ্ঠির বিকল্প হিসেবে। কিন্তু স্যান ডিয়েগোর এই যুগলটির হাতদুটি ঠিক সেভাবে ধরা নয়, অনেকটা প্রেমান্ধ টিনেজদের মত—-মজা লাগলো বিশেষ করে সেকারণে। এবং সেখানেই শেষ নয়—-শুরুমাত্র। একটু পরেই ভদ্রমহিলা সগর্বে ঘোষণা করে দিলেন আসল ব্যাপারটি—তাঁরা দুটিতে স্যান ডিয়েগোতে এসেছেন এমনি এমনি নয়, হানিমুন কাটাবেন বলে এসেছেন। এই বলে ভদ্রমহিলার সেকি সলাজ মুখভঙ্গী। আমি ওঁদের দিকে দ্বিতীয়বার মুখ ফিরিয়ে তাকাবার লোভ সামলাতে পারলাম না। তাঁরা থাকেন নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের কোনও এক হাড়-কাঁপানো শীতের বৃদ্ধাশ্রমে, যেখানে তাঁদের পরিচয়, প্রেম প্রণয়, অবশেষে বিবাহ। দস্তুরমত প্রেমের গল্প—-এদেশে যাকে বলে রোমান্স নভেল। আশি-নব্বুই বছর বয়সের ‘নবদম্পতি’ আমি আগে দেখিনি তা নয়, এদেশের টেলিভিশনে প্রায় প্রতি বছরই একটা-দুটো দেখবার সৌভাগ্য হয়। কিন্তু স্বচক্ষে একই-হোটেলে-হানিমুন- কাটাতে যাওয়া নবদম্পতিকে একই শাটল বাসে সহযাত্রী হিসেবে পাওয়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম আমার জীবনে। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম তাদের দিকে, খানিকটা অশোভন ভাবেই হয়তবা। তাকিয়ে তাকিয়ে একই সঙ্গে অনেকগুলো ভাবনা দোল খেয়ে গেল মনে। এই একই দৃশ্য যদি চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে দেখতাম এই একই জায়গায় তাহলে আমার প্রতিক্রিয়াটি হয়ত সম্পূর্ণ ভিন্নরকম হত। নিশ্চয়ই আমার নবাগত স্বদেশী ভাইবোনদের মতই আমিও মনে মনে ‘ছি ছি’, ‘নির্লজ্জ’, ‘বেহায়া’ আর ‘থুর্ত্থড়ে বুড়োবুড়ির বেলেল্লাপনা’ জাতীয়বিবিধ চোশ্ত গালাগাল আওড়ে ফেলতাম। কিন্তু আজকে আমি ঠিক সেই একই মানুষ নই। অনেক দেশের অনেক মানুষের সঙ্গে অনেক, অনেক মেলামেশা করার পর একটা ভিন্ন চোখ হয়েছে আমার যার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনকে একটূ স্বতন্ত্রভাবে দেখবার ক্ষমতা অর্জন করেছি। দেশে থাকতে যে জিনিসটা কখনই হয়ত বুঝা সম্ভব হত না, সেটা হল যে দীর্ঘজীবি হওয়াটাই বেঁচে থাকার প্রধান লক্ষ নয়, এমনকি অপেক্ষাকৃত সুস্থদেহেও নয়, বড় কথা কতটা তীব্রভাবে, কতটা পূর্ণভাবে, কতটা অর্থপূর্ণভাবে, বেঁচে আছেন আপনি। আমার শাটল বাসের এই যে বাচাল যুগলটিকে দেখে এলাম এবার, এঁরা জানেন জীবনকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়। এরা কতটা অর্থপূর্ণভাবে বেঁচে আছেন জানিনা, কিন্তু পূর্ণভাবে, তীব্রভাবে বেঁচে আছেন তার প্রমাণ তো আমি নিজের চোখেই দেখে এলাম। জানিনা হোটেলের ঘরে দুয়ার বন্ধ করে কিভাবে তাঁরা নিশাযাপন করেছিলেন, সেটা জানার কোন প্রয়োজনও আমার নেই, শুধু এটুকু জানাই যথেষ্ঠ আমার জন্যে যে তাঁরা দরজায় খিল লাগানো দরকার সে-বোধটি এখনো হারিয়ে ফেলেননি। একে বলে জীবনবোধ। পশ্চিমের সামাজিক সংস্কৃতিতে জীবনের প্রতি, ইহজাগতিকার প্রতি, এই সুস্থ জীবনমুখি দৃষ্টিভঙ্গীটি শৈশব থেকেই গড়ে ওঠার আবহাওয়া তৈরি হয়ে থাকে। যা আমাদের নেই। আমাদের জীবনে আছে কেবল হতাশার বন্দনা, কেবল বিরহেরই জয়গান। সেকারণেই আমরা কর্মজীবনে অবসরগ্রহণের পরমূহুর্তেই স্বগৃহে প্রবেশ করার পথ ভুলে গিয়ে চলে যাই বিরহমন্দিরে, যার সামাজিক নাম উপাসনাগৃহ।
আমাদের এই অধিবেশন ব্যাপারটি এক বিশাল ঘটনা। দশ বারো হাজারের কম নয় সদস্যসংখ্যা। বলা বাহুল্য যে আমার মত বয়োবৃদ্ধের সংখ্যা সেখানে প্রায় নগণ্য, আনুপাতিকভাবে, তবে একেবারে দুর্লভ তা’ও বলা যাবে না। সবচেয়ে অবাক লাগলো বেশ কিছু শারীরিকভাবে অচল অক্ষম মানুষের উপস্থিতি দেখে। হুইলচেয়ারে বসা লোক তো কমপক্ষে গোটা পঁচিশেক দেখলাম আমি নিজেই। তারপর ছিলেন ওয়াকার ঠেলে ঠেলে হাঁটা মানুষ, বয়সের ভারে কুব্জ হয়ে যাওয়া মানুষ, যষ্ঠিহস্তে অতি সাবধানে পা ফেলে ফেলে চলা অন্ধ মানুষ, একলা মানুষ, অসহায় মানুষ, তাঁরাও যোগ দিয়েছেন অধিবেশনে। কিসের নেশায় জানিনা। জীবনের এই শেষ বেলাকার খেয়াঘাটে তাঁদের কি আকর্ষণ থাকতে পারে যা তাঁদের টেনে নিয়ে যায় জনাগমপূর্ণ, কোলাহলমুখর সম্মেলনে জানিনা। নতুন কিছু শিখবার আশাতে নিশ্চয়ই। এই যে ‘নতুন কিছু শিখতে চাওয়া’ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, একেই আমি ‘জীবন’ বলে অভিহিত করি। বেঁচে থাকার অর্থই সেখানে। এইসব অক্ষম, অচল, প্রতিবন্ধী মানুষগুলো কেউই মৃত নন, তাঁরা সচল, সজীব সতেজ। এমনকি তাঁরা সত্যিকার অর্থে প্রতিবন্ধীও নন। দৈহিক দৌর্বল্য আর প্র্তিবন্ধকতা তাঁদের গৃহবন্দী করে রাখতে পারেনি। তার সাথে আমাদের মূল পার্থক্যটা কোথায়? আমরা দৈহিকভাবে প্রতিবন্ধী না হয়েও মানসিকভাবে প্রায় আবাল্য প্রতিবন্ধী। তাই আমরা শ্বাসপ্রশ্বাসই নিই কেবল, জীবিত নই। আসলে আমরা মৃতাবস্থাতেই জন্মগ্রহণ করি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে—-জীবন্মৃত। আমাদের চিন্তার জগত অবরুদ্ধ। এবং ওই রুদ্ধ কপাট আমরা কিছুতেই খুলতে দেব না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে শিখি সেই ছোটবেলা থেকেই—-হয় স্কুলে গিয়ে, নয়ত মাদ্রাসার মৌলবি সাহেবের সৌজন্যে, অথবা নিজেদের পরিবারেই।
আমার দেশী ভাইদের কারু কারু মুখে বিরূপ মন্তব্য শুনেছি ‘পশ্চিমাদের জাগতিক আসক্তি’ নিয়ে। তারা বস্তুবাদী, ইহসর্বস্ব, স্বার্থপর, ইত্যাদি। তারা অতিরিক্ত মদ্যপায়ী, যৌনাসক্ত, জীবনকেন্দ্রিক, অর্থলোলুপ—-আরো কত কি। এমনকি দুচারজনকে দেখেছি পশ্চিমের নানা লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা নিয়ে পুস্তক রচনাও করে ফেলেছেন দেশের ভাইবোনদের অবজ্ঞাতির জন্যে। আমি এগুলো শুনি, দেখি, আর হাসি। কখনও কাঁদিও বা। এই যে অজ্ঞতার উপাসনা আমাদের, বিদেশে আসার পরও, এ অপসংস্কৃতি কি কোনদিনই দূর হবে না?
আমার এই গাণিতের অধিবেশনে এতগুলো অক্ষম আর অচল মানুষগুলো যে এত কষ্ট করে এলেন, তাঁরা হয়ত সবাই সমান শিক্ষা নিয়ে ফেরেননি নিজ নিজ বাসস্থানে, কিন্তু তাঁদের মধ্যে হয়ত দুটি-একটি মানুষ ছিলেন যাঁরা শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ওখান থেকে এমন সব জ্ঞান নিয়ে ফিরেছেন যার ফসল ভোগ করার সৌভাগ্য হয়ত একদিন হবে সকল বিশ্ববাসীরই। জানিনা আমার অভাগা দেশের ক’জন ‘সুস্থ সবল’ নাগরিক খবর রাখেন ‘জাগতিক আসক্তি’তে আক্রান্ত পশ্চিমের দুচারজন ‘অক্ষম অচল’ মানুষের অসামান্য অবদানের কথা। স্টিফেন হকিং নামক এক সম্পূর্ণ অচল প্রতিবন্ধীর নাম হয়ত অনেকেই শুনেছেন। তাঁর বয়স এখন ৭১। এখনও পূর্ণভাবে সজাগ সচেতন, বুদ্ধির জগতে। তিনি সাধারণ জীবনের নিত্তনৈমিকতা নিয়ে ভাবেন না, ভাবেন বিশ্বচরাচরের বাইরে যে রয়েছে বিপুল রহস্যঘেরা মহাবিশ্ব, যেখানে আমরা, মুর্খতার আজন্ম পূজার্রী সৃষ্টিকর্তার বাসস্থান বলে চিহ্নিত করে রেখেছি। তিনি কৃষ্ণবিবর নামক বিশাল অন্ধকারাচ্ছন্ন বস্তুটির আবিষ্কারক নন বটে, কিন্তু সেখান থেকেও যে শক্তি বিকিরণ ঘটতে পারে তার খবর জানিয়েছেন আমাদের। তাঁরই আবিষ্কার ‘গ্র্যাভিটেশনাল সিঙ্গুলারিটিজ’ নামক এক অদ্ভুত জিনিস যা ব্যাখ্যা করতেই আমি হিমশিম খেয়ে যাব, প্রধানত আমি নিজেই ভাল করে বুঝি না বলে। তিনি যেসব বই লিখেছেন সেগুলো শুধু পণ্ডিতমহলেই পাঠযোগ্য নয়, আমি আর আপনার মত সাধারণ পাঠকদেরও নাগালের মধ্যে। কুয়ান্টাম শাস্ত্রের জীবিত যত বড় বড় পণ্ডিত আছেন সারা পৃথিবীতে তাদের মধ্যে তিনি একেবারে চূড়ায়। অথচ তাঁর জীবনকাহিনী শুনে অবাক বিস্ময়ে হাঁ করে থাকবে না এমন মানুষ কোথায় আছে। তিনি ২১ বছর বয়স থেকেই হুইলচেয়ারে আটক হয়ে পড়েছেন। এদেশের চলতি ভাষায় রোগটির নাম ‘লু গেরিং ডিজিজ’—-মারাত্মক রকমের রোগ। এখনও যে বেঁচে আছেন সেটাই আশ্চর্য। তিনি কথা বলতে পারেন না। অঙ্গভঙ্গী করতে পারেন না, কারো সঙ্গে কোনও সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করার কোন ক্ষমতাই তাঁর নেই। তাঁর শরীরের সঙ্গে একটা স্বয়ংক্রিয়যন্ত্র সংযুক্ত থাকে চব্বিশ ঘন্টাব্যাপী। এই যন্ত্রই তাঁর মনের ভাবনা চিন্তাগুলোকে ইংরেজিতে ব্যক্ত করে দেয়তাঁর স্ত্রী জেইন এবং বৈজ্ঞানিক সহকর্মী ও দৈনন্দিন সেবকদের জন্যে। অর্থাৎ তিনি চাইলেই চট করে আমাদের কনফারেন্সে চলে যেতে পারতেন না, বা নিজের হাতে পানি তুলতে পারেন না, এতটাই অক্ষম তিনি। তাঁর যে শক্ত অসুখ সে অসুখ নিয়ে বেশিদিন বেঁচে থাকাটাই একরকম অলৌকিকতা বলতে পারেন। সাধারণ মানুষের জন্য এরকম অক্ষমতা নিয়ে বেঁচে থাকাটা রীতিমত অত্যাচার বলা যায়। কেবল নিজে ভোগা নয়, কাছাকাছি সবাইকে ভোগানো। কিন্তু স্টিফেন হকিং সাধারণ মানুষ নন। বিরল রোগের ভুক্তভোগী হয়েও তিনি বিরল প্রতিভাধর হয়েই বেঁচে আছেন এখনও।
দুদিন আগে খবরে শুনলাম ৮৪ বছরের এক ভদ্রলোক প্রস্তুত হচ্ছেন অটোয়ার বার্ষিক ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবেন। প্রতিবছরই নাকি তিনি তাই করেন। ম্যারাথনের জয়পরাজয় নিয়ে মাথা ঘামান না তিনি, মেডেলের লোভে তিনি যোগ দেন না প্রতিযোগিতায়—-এবয়সে প্রতিযোগিতাটি আসলে অন্যের সাথে হয়না, হয় নিজেরই সাথে। ৮৪ বছর বয়সেও তিনি জীবিত, সুস্থ, সবল, আত্মনির্ভর—- ম্যারাথনের মাধ্যমে এটুকু নিশ্চিতভাবে জানতে পারাই যথেষ্ঠ তাঁর জন্য। হতাশা মন্দিরে গিয়ে প্রভুর কাছে কান্নাকাটি করে পরজীবনের আরাম-আয়েশ কামনা করার মন মানসিকতা নেই তাঁর। তাঁর কাছে পরজীবনের মূল্য কতখানি জানিনা, আশা করি একেবারেই নেই, তবে এজীবনের যে অগাধ মূল্য তার প্রমাণ তো তিনি নিজেই।
তবে ইহজীবনের প্রতি ভালোবাসা সবাই সমানভাবে প্রকাশ করেন তা নয়। সবার সে ভাগ্য ঘটেও না। বার্ধক্যের একটা স্বাভাবিক ধর্ম আছে, আছে ক্রমিক অবক্ষয়ের অবধারিত নিয়ম। জীবজগতের অনিবার্য অংশ হিসেবে সেনিয়মের বিপরীতে তরী ফেরানোর সাধ্য কারুরই নেই—-এমনকি ম্যারাথনে যোগদানকারি অসমসাহসী বৃদ্ধেরও নেই। স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, তিনি যে বেঁচে আছেন এটাই তাঁর পরম ভাগ্য। সেটা কেবল তাঁর বেলাতেই নয়, সবার বেলাতেই সত্য। এই বেঁচে থাকাটির ওপর আমাদের কারুরই কোন হাত নেই—-এটা প্রায়পুরোপুরিই প্রকৃতির বিবিধ অন্তর্নিহিত শক্তি আর সম্ভাব্যতার বিধিবিধানের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের হাত আছে কেবল যেটুকু সময়আমরা বেঁচে থাকি সেই অমূল্য সময়টিকে কিভাবে ব্যবহার করি। পৃথিবীর অনেক মানুষের ভাগ্যেই দীর্ঘায়ুর অভিজ্ঞতা হয়, কিন্তু মৃত্যুর পর তাদের কথা কারুরই মনে থাকে না। তাঁরা জীবিত থাকাকালেই কার্যত মৃত। আবার কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা স্বল্পায়ু হওয়া সত্ত্বেও অমর হয়ে থাকেন। ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গাণিতিক বলে খ্যাত শ্রীনিভাস রমানুজন মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। সোভিয়েট ইউনিয়নের আলেক্সি ফ্রিডম্যান গত শতাব্দীর বিশের দশকে আইনস্টাইনের অভিকর্ষতত্বের সমীকরণ সমূহের সমাধান খুঁজে সিদ্ধান্তে পৌঁচেছিলেন যে মহাবিশ্বের চিরস্থিতির অবস্থা যেমন সম্ভব একদিকে, অপরদিকে নিত্য সম্প্রসারণশীল অবস্থাটিরও সমান সম্ভাবনা। এই অসম্ভব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্তের শেষটুকু স্বচক্ষে দেখবার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি—-মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে টাইফয়েড রোগে মারা যান বেচারি। তাঁর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর এই দূরদর্শী গবেষণার সাফল্য প্রতিষ্ঠিত হয়আমেরিকার নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী-জ্যোতির্বিদ হাবল দ্বারা। হাবলের আবিষ্কৃত ভীষণ শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্য ছাড়া মহাবিশ্বের দ্রুত সম্প্রসারণ অবলোকন করা হয়ত সম্ভব হত না।
আমাদের দেশে বুড়োর ভীমরতি বলে একটা কথা আছে। সেটা কেবল আমাদের দেশে নয়সব দেশেই। আশি বছরের বুড়োর চোখ লেগেছে ষোড়শী রূপসীর রূপের প্রতি সেটা শুধুই রূপকথারই গল্প নয়—বাস্তবেও ঘটে অনেক। দেশে এবং বিদেশে, সবখানেই। একটা মজার গল্প বলি। জার্মানীর রলফ ইডেন বলে এক নারীপাগল আমোদপ্রিয়লোক বড়াই করতেন যে এজীবনে ৩,০০০ নারীর বিছানায় ঘুমানোর অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর—–এমনই অপ্রতিরোধ্য তাঁর পৌরুষ আর ব্যক্তিত্ব যে মেয়েরা তাঁর কাছে আসা মাত্র প্রায় অবশ অবস্থাতে পৌঁছে যেত। কোন মেয়েই নাকি কখনো ‘না’ বলেনি তাঁকে।
তারপর পরিচয়এক ১৯ বছরের তরুণির সঙ্গে, তাঁর নিজেরই নাইটক্লাবের ঘনিষ্ঠ পরিবেশে। এক কথা দুকথার পর মেয়ে রাজি হয়ে গেল তাঁর নিজস্ব ফ্ল্যাটে গিয়ে একটু ‘আরাম’ করতে, দুজনে মিলে অবশ্য! ইডেন সাহেব স্বভাবতই ধরে নিলেন যে মেয়ে কাত হয়ে গেছে। অতএব ফ্ল্যাটে গিয়ে খানিক সুরাপানের পর বেডরুমে যাবার আহ্বান জানালেন। মেয়ে সরাসরি কোন আপত্তি জানালো না—-শুধু বলল, রলফ, মনে কষ্ট নিও না, কিন্তু তুমি অনেক বুড়ো হয়ে গেছ আমার তুলনায়(রলফ ইডেনের বয়স তখন ৭৭, অর্থাৎ মেয়ের প্রপিতামহের সমান বয়স!) রলফের জীবনে কোন মেয়ে এভাবে তাঁকে অপমান করেনি কোনদিন। মেয়েটা চলে যাবার পর অপমানটা গায়ে বিঁধে রইল কমপক্ষে দুই সপ্তাহ। কি করবেন দিশা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়ের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। কিসের দায়ে? বৈষম্য! মেয়ে তাঁর বয়সের কারণে বৈষম্যপূর্ণ ব্যবহার করেছে তাঁর প্রতি, যা জার্মানীর সংবিধান অনুযায়ী নিষিদ্ধ। ঘটনাটি ২,০০৭ সালের। মামলার ফলাফল কি হয়েছিল জানিনা, জানার দরকারও নাই। এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে পারে কোথাও সেটা জানতে পারাই যথেষ্ঠ। মাঝে মাঝে এধরণের হাসির খোরাক পেলে মন্দ হয়না।
আমেরিকার রকেফেলার পরিবারের কথা নিশ্চয়ই কারুর অজানা নয়। ১৯০৮ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অন্যতম কীর্তিমান রকেফেলার—-নেলসন রকেফেলার। অনেক বড় বড় কীর্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইসপ্রেসিডেণ্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন একবার। নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের গভর্ণর ছিলেন একবার নয়, পরপর চারবার। অনেক জনহিতকর কাজও তিনি করে গেছেন কর্মজীবনে। দুর্ভাগ্যবশত সাধারণ মানুষ তাঁকে বেশি মনে রেখেছে তাঁর সেসব কীর্তি দিয়ে নয়, অন্যান্য, কিঞ্চিৎ আদিরসমিশ্রিত কীর্তিকলাপ দিয়ে। ব্যাপারটা বলি তাহলে। তাঁর দ্বিতীয়স্ত্রী তখনও জীবিত এবং সম্পূর্ণ সুস্থদেহী আকর্ষণীয় নারী। তা সত্ত্বেও অস্থিরচিত্ত গভর্নরের চোখ নানাদিকে বিচরণ করে বেড়াতে পছন্দ করত। যেখানে যাবার কথা বলে বেরুতেন বাড়ি থেকে সবসময় সেখানে যাওয়া হত না। হয়ত মনের ভুলেই চলে যেতেন অন্যত্র—-যদিও কতটা মনের ভুল আর কতটা ভাবের ভুল সেবিষয়ে সন্দেহের অবকাশ ছিল প্রচুরই। সেকারণে তাঁর নামে একটা কটু কথাই ছড়িয়ে পড়েছিল একসময়ঃ ‘ নেলসন কি কোথাও যাচ্ছেন না আসছেন?’ এই ‘যাচ্ছেন না আসছেন’ মার্কা নেলসন বেচারি হঠাৎ করে মারা গেলেন যখন তাঁর বয়স মাত্র সত্তর। কিভাবে মারা গেলেন? কথা ছিল শহরের বাইরে যাবেন একটা জরুরি মিটিংএ। ‘জরুরি’ মিটিংটা ঘটেছিল ঠিকই, তবে শহরের বাইরে নয়, ভেতরেই, তাঁর ২৫ বছর বয়স্ক সুন্দরি সেক্রেটারি মেগান মার্শাকের এপার্টমেন্টে। জরুরি কোনও সরকারি কাজকর্ম ছিল কিনা জানিনা, তবে কাজ থাকলেও সুন্দরি সেক্রেটারির সঙ্গে কি সারাক্ষণ কাজ নিয়ে মজে থাকা যায়? যায়না। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারেই একসময়তাঁরা দুটিতে একে অন্যের ওপর সওয়ার হওয়ার লীলাতে মেতে গেলেন। আকস্মিকভাবে, এবং অত্যন্ত বিব্রতকরভাবে, নেলসন যখন মেগানের দেহের ওপর নিবিড়ভাবে শায়িত, তখন তাঁর হৃদপিণ্ডের হাপর গেল বিগড়ে। অর্থাৎ হার্ট এটাক। এবং মাসিভ। ধপাস করে পড়ে গেলেন বেচারি। এবং সাথে সাথে অক্কালাভ। বেচারি মেগানের মনের অবস্থাটি কল্পনা করুন একবার। ৯১১ ডাকবে সে উপায়ও তো ছিল না তার—-কেমন করে এমার্জেন্সির লোকেদের কাছে বলেন যে তাঁরা যখন রমণবিলাসে মগ্ন তখনই গভর্নরের হার্ট এটাক হয়। তিনি এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে দিয়ে খবরটা পাঠিয়েছিলেন ৯১১তে।
ঘটনাটি ১৯৭৯ সালের। সারা দেশব্যাপী সে যে কি রসিকতা তাঁর মৃত্যু নিয়ে। একটা খবর ছড়াায় এভাবেঃ এইরে, নিউইয়র্কে গভর্নর মারা গেছেন কিভাবে জানিস? অতিরিক্ত লঘুচাপের ফলে। ওপরে ৭০, নিচে ২৫! রক্তচাপ এত নিচে নেমে গেলে আসলেই কারু পক্ষেই বাঁচা সম্ভব নয়। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে এরকম নিষ্ঠুর কৌতুক—-এত কীর্তি থাকা সত্ত্বেও শেষমেশ এই অপবাদ নিয়েই জনগণের মাঝে অধিকতর পরিচিত হয়ে থাকলেন তিনি।
আমার বয়স আশিতে উপনীত। তথাপি হিতৈষীরা নিয়মিতভাবেই আমাকে ‘দীর্ঘায়ু’ হবার শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। ঠিক দীর্ঘায়ু বলে না এখন, বলে শতায়ুহোন। শতায়ুহবার কোনরকম ইচ্ছা আমার নেই। যদিও আধুনিক বিজ্ঞান আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মানুষকে একশ দেড়শ বছর পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে। ব্যক্তিগতভাবে আমি হয়ত একেবারেই চাইনা সে দশায় পৌঁছাতে, কিন্তু অনেকেই চায়। অনেকে কেবল দীর্ঘজীবি নয়, চিরজীবি হবারও আকাঙ্খা পোষণ করে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর জীবনের প্রতি সব মানুষেরই একটা সহজাত দুর্বলতা। কাউকে আশীর্বাদ করা বলতেই বোঝায়ঃ ‘দীর্ঘজীবি হও মা’, ‘শতায়ুহও বাবা’। এদিকে পৃথিবীর যেকটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পন্ন গণতান্ত্রিক দেশ আছে, বিশেষ করে পশ্চিম বিশ্বে, সেখানকার রাজনৈতিক নেতাদের মাথা দিয়ে ধোঁয়া ছোটার অবস্থা। এত বুড়োর খরচ চালাবে কি করে সমাজ। এমনিতেই তো সবাই ঋণের সাগরে গলাডুবা, তার ওপর বুড়োদের নাই এক পয়সা রোজগার, অথচ খরচ সবার বাড়া। জনসংখ্যার প্রায়অর্ধেকই তো এখন সিনিয়ার সিটিজেন। যেখানে যান সেখানেই দেখবেন সাদা চুলে ভরে গেছে জায়গা। ওদের সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখবেন ফার্মেসিগুলোতে। সরকারের পয়সায়ওষুধ খেয়ে খেয়ে তারা (যার মধ্যে আমিও একজন) আয়ু বাড়াচ্ছে। তারা ঠায় বসে থেকেই মাসে মাসে একটা ভদ্রমত মাসোহারা পাচ্ছে। যেখানে যায় সেখানেই তাদের আলাদা খাতির। বাজারে গেলে তারা ডিসকাউন্ট পায়, বাসে-ট্রেনে-প্লেনে-জাহাজে সর্বত্র তাদের ভাড়া কম। খেতে গেলে ডিসকাউন্ট, বসতে গেলে ডিসকাউন্ট। তবে ডাক্তার-পথ্যির তুলনায় এগুলো নস্যি। আমাদের মত বুড়োারা ঘন ঘন হাসপাতালে যাই, এবং একবার গেলে সহজে বেরুবার ইচ্ছা প্রকাশ করি না। হাসপাতাল যে কি প্রচণ্ডরকম ব্যয়বহুল সেসব খবরও আমাদের জানার প্রয়োজন হয়না। সাধে কি পৃথিবীর সব বুড়োরা ক্যানাডায় আসার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছেন? কোনরকমে একটা কাগজ পেলেই হল, ব্যস, ফুস করে দশবছর আয়ু বোনাস পাওয়া গেল ক্যানাডিয়ান ট্যাক্সপয়ারের সৌজন্যে। এর চেয়ে মজার দেশ আর কোথায় পাবেন আপনি।
দুঃখের বিষয়, সংসারে কোনকিছুই বিনামূল্যে পাওয়া যায়না। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে সবাইকেই খাজনা দিতে হয়একসময়। পঞ্চাশ বছর আগে বিলেতের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস আর এখনকার সার্ভিস এক জিনিস নয়—-ইংল্যাণ্ডের ভুক্তভোগীরা খুব ভাল করেই জানেন সেটা। সেরকম অবস্থা ক্যানাডাতেও আসবে, অচিরেই। রোগী হয়ত পয়সা না দিয়েই হাসিমুখে ফিরে এলেন হাসপাতাল থেকে, কিন্তু তাঁর কয়েক হাজার ডলারের বিলখানা তো কাউকে-না-কাউকে চুকাতে হবেই, তাই না? এই বিল চুকানোর দায়িত্বটা পালন করতে হয় সরকারকে, অর্থাৎ দেশের ক্রমহ্রাসমান করদাতা সম্প্রদায়টিকে। প্রথম বিশ্বের সরকারগুলোর বিরাট সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছি আমরা, এই অশীতিপর এবং শতায়ু-হবার-অভিলাষপূর্ণ পক্ককেশ সমাজটি। তাই গত সপ্তাহে যখন পত্রিকায় পড়লাম জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাঁর দেশের ভাতা-নির্ভর সিনিয়ারদের তাড়াতাড়ি মরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, তখন তাঁর মনুষ্যত্ববোধের প্রতি কিঞ্চিৎ সন্দেহ প্রকাশ করলেও তাঁর মনের অবস্থাটা চিন্তা করে একটু সহানুভূতিশীল না হয়ে পারিনা। একটা অপেক্ষাকৃত ধনী দেশের সরকারি কোষাগারের প্রধান দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে বুড়োদের বিল চুকোতে চুকোতে তাঁর যে নিজের চুল নিজেই ছেঁড়ার দশা দাঁড়িয়ে গেছে সেটা সহজেই অনুমেয়। একদিকে বুড়োরা পণ করে বসেছে তারা মরবে না, ওদিকে লোকজনের রোজগার নেই আগের মত, ফলে খাজনাও তারা দেয়না আগের মত—-অথচ খরচ কেবল বেড়েই চলছে। কে জানে, একদিন হয়ত আমাদের ক্যানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রী একই সুরে কথা বলতে শুরু করবেন। ‘শতায়ুনয়, দয়া করে আপনারা তাড়াাতাড়ি বিদায় হোন’।
শুনেছি আগেকার দিনে, ক্যানাডার আদিবাসী সমাজের কোনও এক শাখায়একটা প্রথা ছিল এরকমঃ বুড়ো হতে হতে প্রায় অক্ষম অবস্থাতে পৌঁছে গেলে কেউ যদি ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে তাঁর আর বেঁচে থাকার সাধ নেই, তাহলে সেই সমাজেরই কেউ-না-কেউ তাঁর মনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার দায়িত্ব পালন করবে—-অর্থাৎ চিরবিদায়ের ব্যবস্থা। শুনতে গা কাঁটা দেয় বটে, কিন্তু এই ছিল তাদের ‘স্প্রিং ক্লিনিঙ্গের’ বাস্তবানুগ পদ্ধতি! ‘গত বৎসরের আবর্জনা’ দূর করতে চাইলে কিছু প্রিয় জিনিসও ফেলে দিতে হয়মাঝে মাঝে।
অতএব বন্ধুগণ, দয়া করে আমার শতায়ুকামনা করবেন না।
অটোয়া,
৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ’১৩, মুক্তিসন ৪২