প্রবাসে পরহিতকর্ম -৭

জানুয়ারী ১, ২০১৫

॥ রীনা গুলশান ॥

পকেটের মধ্যে হঠাৎ করে মুঠো ফোনটা বড় বেশী রকমের দাপাদাপি শুরু করলো (ভাইব্রেশন মুডে ছিল)। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অফিসের মধ্যে ব্যক্তিগত মুঠোফোন তোলাতো দূরের কথা, হাত দিয়ে ধরাও নিষেধ। কি করি? কি করি? হু! ওয়াশরূমে যাবার নাম করে কাট দিলাম। তারপর ঝট করে ফোন তুলে কলার আইডি দেখলাম, ওহ। রুম্মান! কি ব্যাপার? এই সময় ওতো কখনো ফোন করে না! আমিই ফোন দিলাম আবার : কি হয়েছে রুম্মান… ফোন দিয়েছিলি যে?

ওহ! হ্যা… মামনি… একটা খারাপ খবর পেলাম, ভাবলাম তোমাকে বলি।

কি ব্যাপার? জল্দি বল…।

ঐ যে অর্ক। যার কথা তোমাকে বলেছিলাম। মনে আছে না? আমরা পাশাপাশি ছিলাম বহুদিন… ওর বাবা ওকে গতকাল বাসা থেকে বের করে দিয়েছে!!

কি বলিস? যাহ!

হ্যা, অর্ক-ই আমাকে কিছুক্ষণ আগে ফোন দিয়েছিল। ওর বাবা ওকে বের করে দিয়েছে। তো কোথায় থাকবে? কি করবে … এই সব আরকি।

হঠাৎ?

হঠাৎ কেন হবে? আমি তোমাকে গত পরশু সবিস্তারে ওর ব্যাপারে বল্লাম না?

হুম! Ñ ফোনটা আমিই কেটে দিলাম।

খবরটি শুনার পর, ওদেরকে সাহায্য করা থেকেও, একটা প্রবল কষ্ট আমার বুকটাকে আচ্ছন্ন করে রাখলো। পাশাপাশি বহু বছর থেকেছি। আমরা কানাডায় আসার দুই বছর পর ওরা এসেছিল। আমাদের বেশ কাছেই ওদের বাসা ছিল। খুউব বেশী বাঙ্গালী ছিল না, তাই অন্তরঙ্গ হতে বেশী সময় নেয় নি। এক সঙ্গে প্রায় ৭ বছর ছিলাম (হয়তো কিছুটা বেশীও হতে পারে)। অর্ক’রা দুই ভাইবোন। অর্ক বড়। ২ বছরের ছোট অদিতা। ওদের স্কুলে ভর্তির বিষয়ে যতরকম সাহায্য প্রয়োজন পড়েছিল তা আমার স্বামী করেছিল। স্বামী স্ত্রী দুজনেই বাংলাদেশে অনেক বড় জব করতো। তবু এখানে এলো সোনার হরিন ধরবে ভেবে। সোনার হরিনের পিছনে বহুদিন ঘুরলো, অর্থাৎ প্রফেশনাল জবের জন্য। তারপর একসময় ক্ষান্ত দিল। এবং যা হাতের কাছে পেল, তাই গ্রহন করতে বাধ্য হলো। কারণ, ততদিনে বাংলাদেশ থেকে আনা অর্থ লো-ব্যাটারী সাইন দিতে শুরু করেছে। বাচ্চারা যার যার মত স্কুলে যায়। বাবা-মা দুজনেই প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে গ্যালো যার যার জবের পিছনে। বাড়ী আসে, রাতে ঘুমায়, ছুটির দিনে রান্না করে। অথবা অন্যদিন বন্ধুদের বাসায় পটলাক বা বারবিকিউ পার্টি করে। এদের আবার বৃহৎ একটি বন্ধু সার্কেল আছে। এভাবেই একটা নেশার ঘোরে জীবন চলছিল। ইতিমধ্যে কবে কখন যে সংসারে একটা বিশাল চোরাবালি তৈরী হয়েগিয়েছিল তা তারা কেউ টের পায়নি। অষ্টম গ্রেডের বাৎসরিক ফলাফল বের হলো। দেখা গেল অর্ক প্রতিটি বিষয়ে ফেল করেছে। বিশেষ কোন কারণ থাকলে রেজাল্ট খারাপ হতে পারে, তাই বলে সব বিষয়ে ফেল? অদিতা’র রেজাল্টও খুব ভাল না।

এদেশে এটা আবার হয় নাকি? হ্যা, এদশেও হয়। আমি আরো দুইটি ছেলের এরকম ঘটনা দেখেছি। বিষয় হলো, কতটা নির্বিকার বাবা-মা হলে এরকম ঘটনা হওয়া সম্ভব? যেহেতু এদেশে পড়াশুনার সিস্টেম অত্যন্ত ভাল। তাই বেশীর ভাগ (৯০ ভাগ) বাবা মা-ই মনে করে, এ দেশে বাচ্চাদের পেছনে অন্তত (বাংলাদেশের মত) ঐ রকম ছুটে বেড়াতে হয় না। কথাটি কতটা সত্যি, একমাত্র সচেতন বাবা-মা’রাই ভাল জানেন। বেশীর ভাগ বাবা-মা’রাই বলেন, জীবনতো একটাই। তো গোটা জীবনটাই কি বাচ্চাদের পিছনে ছুটে বেড়াবো নাকি? আমাদের জীবনে কি সাধ আল্লাদ নেই নাকি? এ কথাটাও সত্যি। অনেক অনেক সত্যি। একটাই তো জীবন। সেই জীবনটা বাচ্চাদের পিছনে পেছনে ছুটে ছুটেই সারা হয়ে যায়!! তারপর একসময় বাচ্চারা মানুষ হয়ে যায়। যার যার লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। বিয়ে হয়ে যায়। তখন মেয়েরা স্বামীর পেছনে পেছনে ছুটে বেড়ায়। আর ছেলেগুলো বৌ এর আঁচল ধরে। বাবা মায়েরা তখন ‘ইয়া নফসি…ইয়া নফসি’ দুনিয়াতে বসেই করে! কেয়ামতের জন্যও আর অপেক্ষা করা লাগে না।

কিন্তু আমার একটা কথা অবশ্যই আছে। আমি জানি অনেক বাবা-মা’ই ক্ষোভ করে বলেন, আমরা দেশের জমি/বাড়ী সব বেঁচে, নিজের জীবনটাকে ফতুর করে দিয়ে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করলাম। তার বদলে এই পেলাম! বাবা অথবা মা মারা গেলেও তাদের দেখতে আসার সময় নাই? কিন্তু, হ্যা… এখানে এই ‘কিন্তু’টা অবশ্যই আছে। একটা কথা চিন্তা করুন, যদি ছেলে বা মেয়ে নিজের প্রফেশনে জব করে, বাড়ী/গাড়ি কিনে একটা সমুজ্জল জীবন যাপন করে তবে সেটা আপনার কতটা অহঙ্কার- একবার ভাবতে পারেন? কতটা স্বস্তি? সমস্ত কষ্টের ফল, কতটা কেষ্ট পেলেন নিজেই একবার একটু ভেবে দেখুন। আর আপনি নিজের এই একটি জীবনে, যদি নিজেই প্রচন্ড আরাম আয়েশে আর ভোগ বিলাসে মেতে থেকে জীবন সায়হ্নে এসে দেখলেন- আপনার মেয়েটা নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের বাইরে বিয়ে করে বসেছে, ছেলেটা ঘোর ড্রাগ এডিক্টেড ঘরের কোনে পড়ে আছে বা জেলে আছে কিংবা রিহ্যাবে আছে তখন আপনার জীবনের শেষ বিকেলটা কেমন যাবে? ভাবতে পারেন? তখন নিজের ফেলে আসা জীবনের কথা ভেবে (আরাম আয়েশের কথা ভেবে) নিজেই নিজেকে দংশাবেন।

ধান ভানতে শিবের গীত এই জন্য গাইলাম যে, অর্ক এর জীবনের জন্য শুধু অর্ক-ই দায়ী নয়। শতকরা নব্বুই ভাগই ওর বাবা-মা দায়ী। অনেক দিন থেকেই একটু একটু করে ছেলেটি চোরাশ্রোতে পা দিচ্ছিল। বেশ কিছু তথ্য আমার ছেলেটা আমাকে দিয়েছিল। আর আমার পরহিতের ভূত নিয়ম অনুযায়ী নড়ে চড়ে বসেছিল। ওর মাকে এক বিকেলে কথা প্রসঙ্গে বললামও : ভাবী, আপনার ছেলেটা কিন্তু ধা — ধা — করে বড়

হয়ে যাচেছ। এখনি সময়, একটু রাশ

টেনে ধরার।

ওমা… তাই? কেন ভাবী?

না… এই প্রবাসে… এখানে মিশ্র জাতির বসবাস। তাই কাদেরে সাথে মেলামেশা করে একটু দেখা দরকার…।

না — না– ভাবী– , আমার অর্ক খুবই অন্য ধরনের ছেলে। ও সবসময়ে নিজস্ব পরিমন্ডলেই বিচরণ করে।

আমি তবু একটু ‘কিন্তু’ ‘কিন্তু’ করলাম। কিন্তু ভাবী আমাকে বাতাসের মতো উড়িয়ে দিল। এর কদিন পরই রিজাল্ট এলো — সব বিষয়ে ফেল! অর্ক এর বাবা আমাদের বাড়ী এসে হাউমাউ করে কেঁদে পড়লো। আমার স্বামী তখন বেশ কিছু অনুযোগ করলো ছেলেমেয়েদের বিষয়ে তাদের ক্রমশ উদাসীন হয়ে পড়ার জন্য। অনুযোগ শুনে অর্ক এর বাবা চিৎকার করে অর্ক এর মাকে যাচ্ছে তাই কটুক্তি করতে লাগলো- আপনি জানেন না ভাই, প্রত্যেক উইক এন্ডেই তার বুকিং থাকে অনেক আগে থেকেই। আর আমি যদি তাকে নিয়ে না যাই (যেহেতু সে একাই তার বাড়ির ড্রাইভার!) তবে আমার সে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ( এরকম একটি মজার ঘটনা আমি নিজেও জানি। আমার নিজের ছেলের বিয়ের রিসেপসনে একজন পারিবারিক বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম তিন মাস আগে থেকেই। কিন্তু আমার ঐ বন্ধুটি জানিয়েছিলেন যে পরবর্তী তিন মাসের কোন শনি/রবিবারই তিনি ফ্রি না। দুঃখ করে বলছিলেন… কি করবো ভাবী…অনেক দিন আগে থেকেই ‘অমুক’ ‘অমুক’ ভাবীকে কথা দিয়ে রেখেছি। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত ঐ ভাবীকে ছাড়াই আমাদের রিসেপশন পার্টি করতে হয়েছিল। মজার ব্যাপার যেটি বলছিলাম… এই ভাবীরও এক ছেলে নজরদারীর অভাবে এলেবেলে এক বিষয়ের উপর কোনরকমে গ্রাজুয়েশন করেছে। অন্য ছেলেটা ড্রাগ এডিক্টেড হয়ে যেখানে সেখানে পড়ে থাকে। এর বাবাও তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এটি মোটেও কোন আনন্দের ঘটনা নয়। আমি শুধুমাত্র মা/বাবাদের ‘ফরজ’ আদায়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি মাত্র। মনে রাখবেন জগতে কিছ্ইু বৃথা যায় না।)

আবারো… ধান ভানতে…. যাইহোক, অর্ক এর বাবার অনেক কান্নাকাটির পর আমার স্বামী তখন তার পরিচিত একজন খুবই ভাল শিক্ষককে ঠিক করে দিলেন। মোটামুটি অর্ক এর মূল বিষয়গুলো উনি পড়িয়ে দিবেন। অদিতাকেও একই শিক্ষকের কাছে পড়ার জন্য ঠিক করে দেয়া হলো। বেশ চলছিল। প্রথম সেমিস্টারে অর্ক সব বিষয়েই পাশ করলো। এভাবেই ৬/৭ মাস চলার পর একদিন হঠাৎ ঐ শিক্ষক মহোদয় আমার স্বামীর কাছে ফোন করলেন। এ কথা সে কথার পর তিনি জানতে চাইলেন, অর্ক এর বাবার কি লে-অফ হয়েছে নাকি?

কেন বলুন তো?

না, গত ২ মাস আমার পাওনাটুকু দেয়নি তো তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। গত সপ্তাহে অর্ক এর কাছে বিষটি জানতে চাইলে সেও বললো, আমার আব্বুর লে-অফ হয়েছে। তাই আপনার পাওনাটা দিতে পারছেন না।

আমার স্বামী সাথে সাথেই অর্ক এর বাবা-মাকে ডেকে পাঠালো। উনারা আসার সাথে সাথেই আমার স্বামী বললেন, আপনাদের এতটুকু সৌজন্যতাবোধ নেই? বাচ্চাদের হাত দিয়ে শিক্ষকের পাওনা অর্থ কেন পাঠান?

কি? কৈ, আমিতো অমার স্ত্রীকে বলেছি সে যেন মাসের প্রথমেই নিজে গিয়ে শিক্ষকের হাতে টাকাটা তুলে দেয়। স্ত্রীর দিকে তাকিয়েই তিনি চিৎকার করে কথাগুলো বললেন। এর পর আমাদের সামনেই স্বামী -স্ত্রী’তে তুমুল বাক-বিতন্ডা হয়ে গেল একদফা। কেউ কারো চেয়ে কম নয়। থামানোই মুশকিল!

তারপর অর্ক এর বাবা জাহিদ সাহেব কোনমতে নিজেকে কন্ট্রোল করে বললেন, আপনিতো জানেনই আমার নাইট শিফটের জব। সকালে বাসায় আসতে আসতে ৮/৯টা বেজে যায়। তারপর চারটে খেয়েই ঘুম দেই। বিকেল ৩/৪টার দিকে উঠি। উঠেই আবার কর্মস্থলে যাওয়া জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। একি একটা জীবন? কৃতদাসেরও অধম!!

কিন্তু আপনার তো এখন জব নেই। আপনি নাকি লে-অফে আছেন?

সেকি… এটা আবার কে বললো?

কেন, অর্ক-ই তো তার শিক্ষককে বলেছে।

এ সমস্ত কথাবার্তার সময় অর্ক এর মা শিরিন ভাবী বার বারই নিজের ছেলের পক্ষাবলম্বন করছিল। পরে আরো জানা গেল, অদিতা নাকি তার মাকে আগেই জানিয়েছিল যে অর্ক তাদের শিক্ষকের হাতে টাকাটা তুলে দেয়নি। জবাবে ওদের মা নাকি বলেছে; ঠিক আছে, চুপ থেকো। তোমাদের আব্বুর কাছে বলতে যেয়ো না। আমি পরে গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসবো।

যাই হোক, এরপর ঐ শিক্ষক ওদেরকে পড়াতে আর রাজী হলেন না। এদিকে অন্টারিও লেকের পানি আরো গড়িয়ে বছর ঘুরলো। অর্ক গ্রেড এলিভেন/টুয়েলভ এর মধ্যে বছর তিনেক ঘুরপাক খেয়ে একসময়ে লেখা পড়া ড্রপ করলো। ততদিনে সে ঘোরতরভাবে ড্রাগের চক্করে পড়ে গিয়েছিল। দেখতে দেখতে হ্যান্ডসাম অর্ক কঙ্কালসার হয়ে গেলো। বেশ উজ্জল গাত্রবর্ণ ছিল। সেখানে গভীর কালো আর ক্লান্তির ছাপ।

এর পর ওদের সাথে বেশ কিছু কাল আর দেখা নেই। আমরা বছর পাঁচেক আগে আমাদের এখনকার বাড়িতে চলে এসেছি। এর মধ্যেই তারা হঠাৎ করেই “নাই দেখা” হয়ে গেল। তবে রুম্মানের সাথে ওদের দুই ভাই বোনের যোগাযোগ ছিল ফেসবুকে। আর এতদিন পর এই খবর পেলাম।

কি করি? অফিস থেকে ২ ঘন্টা আগেই ছুটি নিয়ে অর্কদের ঘরমুখো হলাম। অনেক দিন পর ওরা আমাকে দেখে খুব একটা অবাক হলো না। তবে শিরীন ভাবী ও জাহিদ ভাইকে দেখে আমি যেন মনে মনে আকাশ থেকে পড়লাম। এত সুন্দর লাবন্যময়ী শিরীন ভাবীর চেহারার একি হাল হয়েছে! মনে হচ্ছে যেন বিবর্ন ঝরা পাতা! আহা, মায়ের মন। বড় বিপন্ন। দু’দিকেই কাটে। যেন শাখের করাত। জাহিদ ভাইয়ের অবস্থাও খুবই মলিন।

এরপর আমি আমার কর্মকান্ড শুরু করলাম। মানে জাহিদ ভাইকে বুঝাতে শুরু করলাম। উনি আবার খুব জেদী ধরনের। আর শিরীন ভাবী সত্যযুগের শুধুই মমতাময়ী মা। ভাইকে ক্রমাগত বুঝিয়ে চললাম। আমি বললাম, এটা কোন সমাধান নয়। আপনাদের একমাত্র ছেলে! বের করে দিলে অর্ক আরো উচ্ছন্নে যাবে।

যাক উচ্ছনে। ওর আর বাকী কি আছে?

না ভাই। অনকে বাকী। জীবন কোন দিন থেমে থাকে না। জীবন বহতা নদীর মত। চলতে চলতে কত পঁচা গলা খড়কুটো স্রোতের সামনে পড়ে,তাতে কি স্রোত থেমে যায়? যায় না। তাই এভাবে আপনার অর্ক কে নস্যাৎ করে দিতে পারেন না।

পাশে থেকে শিরীন ভাবীও একটু মিন মিন করে বললো, দেখেন না ভাবী, আমিও ওকে এইসবই বলেছি।

তুমি থামো… আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তোমার জন্যই। জাহিদ ভাই হুংকার দিয়ে উঠলেন। রাশি রাশি ডলার তুমি ওকে দিয়েছ।

আমি জানি কথাটা অকাট্য সত্য। তাই ঐ দিক দিয়েই গেলাম না। চললাম সমাধানের দিকে। ওকে এখনি বাসায় আনতে হবে। কিন্তু, ভাই বললো, আমি ওকে রিহ্যাবে দিতে পারবো না। সমাজে আমার একটা মান-ইজ্জত বা পরিচিতি আছে। (এখানে কে কাকে চিনে? নিজে বাঁচলে বাপের নাম।) যাই হোক আপাতত শিরীন ভাবীর করুন চোখের দিকে চেয়ে জলদি করে অর্ক’কে ফোন দিলাম। (রুম্মান আগে থেকেই অর্ক কে ভাল করে ব্রেইন ওয়াশ করে রেখেছিল এই বলে যে, বাপের ঘর গেলে তোর সব কুলই যাবে।) অর্ক বাড়ির আশে পাশেই ছিল। তড়িৎ চলে এলো। এরপর তার বাবা মায়ের সামনেই অনেকগুলো শর্ত তার উপর আরোপ করা হলো। এক নম্বর শর্ত ছিলো, আগামী ৬ মাসের মধ্যে সে বাড়ির বাইরে যেতে পারবে না। কোন বন্ধু বাড়িতে এলেও দেখা করতে পারবে না। ৬ মাস পর আবার কলেজে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিবে। অর্ক সবগুলো শর্তই নিঃশর্তে মেনি নিল।

তারপর আমি তার বাবা-মাকে অনকেগুলো পয়েন্ট দিলাম। যেমন:

১.   আগামী ৬ মাস বাই রোটেশন বাবা ও মা যে কোন একজনকে বাসায় থাকতে হবে।

২.   অর্ক এর সাথে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না।

৩.   বাসায় কোথাও কোন ক্যাশ টাকা রাখা যাবে না।

৪.   আগামী ৬ মাসের মধ্যে বাসায় কোন ধরনের পার্টি দেয়া যাবে না অথবা কোন পার্টিতে যাওয়াও যাবে না।

৫.   যখনই ওর নেশা উঠবে তখন দুধ চিনি ছাড়া কড়া করে শুধু লিকার কফি বা চা পান করাতে হবে। দিনের মধ্যে ৩/৪ কাপ।

৬.   আর বিভিন্ন ধরনের ভিডিও গেম দিয়ে ওকে ব্যস্ত রাখতে হবে।

একজন বলেছিল, মেথি আর কালিজিরার গুড়া খাওয়ালে নেশার লাঘব হয়। তাও বললাম । আর সবশেষে আমাদের দোয়া আর ওর মায়ের অকৃত্রিম সেবা।

আল্লাহর অশেষ রহমতে এবং আমার ও রুম্মানের অক্লান্ত পরিশ্রমে অর্ক ফিরে এলো তার স্বাভাবিক জীবনে। অর্ক এখন ঘৃণা করে তার ঐ তমসাচ্ছন্ন জীবনটাকে। অর্ক আবার কলেজে ভর্তি হয়েছে এবং পার্টটাইম জব করে নিজের খরচা নিজেই বহন করে। এমনকি বাবা-মায়ের ২৫তম বিবাহ বার্ষিকীতে অর্ক বাবাকে সুন্দর একটা পাঞ্জাবী, আর মাকে সবুজ রং এর একটা জামদানী উপহার দিয়েছে। এখন দূর থেকেও অর্কদের বাসার ঝালমলে হাঁসির আওয়াজ পাওয়া যায়….

হে তরুন হে যুবক

হে শ্রমিক হে কৃষক

মেনো না হতাশা

আবার আসবে দিন সূর্যিত আলোর

আবার আসবে দিন সমূহ উজ্জল

এানুষ জাগবে, জাগবে মানুষ।

রীনা গুলাশান

ধৎধমঁষংযধহ@যড়ঃসধরষ.পধ

বি. দ্র. এই লেখায় পাত্র-পাত্রীদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।