ধনে পাতা মশলা ও ভদ্রতার গল্প
মার্চ ১৯, ২০১৫
মোয়াজ্জেম খান মনসুর
ভদ্রতার গল্পটা দিয়ে শুরু করি। পশ্চিম জার্মানীতে সবে মাত্র আমরা গিয়েছি। মাস দুই বা কয়েক সপ্তাহ হবে। থাকি অদিল ভাইয়ের বাসায়। হামবুর্গ থেকে একটু দূরে হারবুর্গ শহরে। বাসে করে হামবুর্গ মেইন শহরে আসতে প্রায় আধা ঘন্টা লেগে যায়। আদিল ভাই এক উইকএন্ডে নিয়ে গেলেন আমাদের ছবি দেখাতে। হিন্দি ছবি। ছবি দেখতে এসেছে প্রচুর ভারতীয় ও বাংলাদেশীরা। ছবি চলছে। পিনপতন নিরবতা দর্শক সারিগুলোতে। আমি আর জামাল ভাই (বিয়াই) ছবি দেখার ফাকে ফাকে ফিশফাস কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ফিশফাশ আওয়াজে মনযোগ ক্ষুন্ন একজন বাঙ্গালী ভদ্রলোক বললেন, এই চুপ কর তোমরা। ছবি দেখতে এসে এত কথা বলছ কেন। আমাদের ছবি দেখতে দাও। আমি তখন ঘার ঘুড়িয়ে তাকে অগ্রায্য করে বললাম আপনার ছবি আপনি দেখেনে মিয়া। আর আমাদের ছবি আমরা দেখি। – ছবি ঘরে এসে কারো আনন্দ উল্লাস নষ্ট করার অধিকার যে আমাদের নেই সেই সৌজন্যতা বোধটুকু উপলব্দি করার বয়স বোধ হয় তখন ছিল না। – যৌবনের অহংকারে কাউকে সম্মান সমীহ তোয়াক্কা করার মতন ব্যাপারটা মাথায় সম্পূর্ন অনুপস্থিত ছিল। তারুন্যের ঝংকারে কেমন যেন একটা ডেমকেয়ার ভাব শরীরের ভিত সর্বক্ষণ খেলা করতো। (সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাই। এখন ভাবি জীবন মানুষকে কিভাবে বদলে দেয়) । ছবি শেষে আদিল ভাই পিছনের ছিটের সেই ভদ্রলোকের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি হলেন ভদ্র দা। বাঙ্গালীদের একজন খুব প্রিয় মানুষ। কলকাতার বাঙ্গালী। কিন্তু বাংলাদেশী বাঙ্গালীদের সঙ্গে তার উঠাবসা চলাফেরা এবং ভিষণ সখ্যতা। বাঙ্গালী মহলে আপন এক ব্যক্তত্ব ভদ্র দা। আলাপ পরিচয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কবে আসলে জার্মানীতে? আমি বললাম, মাসখানেক। তিনি আমার কথা শুনে মৃদু হেসে বললেন, বেশ বেশ ইয়ং ম্যান হট ব্লাড। সেদিন ভদ্র দার সঙ্গে আর কথা বাড়েনি। পরে তার সাথে প্রায়ই দেখা হতো হামবুর্গ ইউনিভারসিটির ক্যাফেটারিয়াতে। তার পর ভদ্র দার সাথে ধীরে ধীরে একটা সম্পর্ক সখ্যতার সৃষ্টি হয়। বয়সের ব্যাবধানে আমাদের দ্বিগুন বয়সী ভদ্র দা আমাদের একজন প্রিয় বন্ধু ও শুভাকাংখী হয়ে উঠে। হামবুর্গে আমাদের সমবয়সী একটা গ্রুপ ছিল। রনি, ফিরোজ, পিচ্চি বাবু, হেলাল ও আমি। পঞ্চাশ ছুই ছুই ভদ্র দা আমাদের আসরে দাওয়াত নিমন্ত্রণ ও বিয়েতে থাকবেন না সেটা হতেই পারে না। বন্ধু ফিরোজের বিয়েতে এসেছিলেন তার জার্মান জায়াকে সঙ্গে করে। আর ভদ্র দার পূজা পার্বনে আমাদের নিমন্ত্রণ ও উপস্থিতি সে তো থাকতেই হবে।
একদিন ক্যাফেটারিয়াতে বসে গল্প করতে কারতে ভদ্রদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভদ্র দা এই বিদেশ বিভূইয়ে কতকাল কাটালেন? ভদ্র দা গালে হাত রেখে কপালে বিষন্নতার চিহ্ন মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, দিনে দিনে অনেক বেলা হলো। চব্বিশটা বছর হয়ে গেল এই প্রবাসে। জিজ্ঞেস করলাম, ভদ্র দা দেশে ফিরবেন না? তিনি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন, এই তো যাব যাচ্ছি এ মাসে এ বছর করতে করতে কেটে গেল চব্বিশটা বছর। নিয়তির আশ্চর্য খেলা সেই আমিও ভদ্র দার মতো এখন প্রবাস দ্বিপে স্বেচ্ছা বন্দী সুদির্ঘ চব্বিশ বছরেরও অধিককাল। জন্মভূমি আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব বর্ষাভেজা সন্ধ্যা মাঘের শিশির ধোয়া প্রভাতের জন্য মন পুড়ে দিবানিষি। স্মৃতির জানালায় উকি দেয় শৈশব যৌবন ও ছেলে বেলার রকমারি সময়ের গল্প। তখন নষ্টাল্জিয়ার আচরে বিষাদ বিষন্নতায় ভরে যায় মন। ব্যাথাক্রান্ত হৃদয়ে আমার আবৃত্তি করতে ইচ্ছে করে আমার লেখা পুরানো একটি কবিতা:
‘‘কোথায় আমার জন্ম / কোথায় আমার বাস / নাইবা হলো বলা / তার গোপন ইতিহাস / এ আমার বড় সাধের / স্বপ্নের নীল কারাবাস।”
আগেই বলেছি আমরা তখন গিয়ে উঠেছি আদিল ভাইয়ের বাসায়। আমরা মানে আমি আর আমার বিয়াই জামাল। আদিল ভাই হামবুর্গের একটি বাসায় তিন বন্ধু নিয়ে ভাড়া করে থাকেন। বাবলা ভাই তখনো কাজকর্মে ঢুকেনি। সে কারণেই সম্ভবত ঘরের রান্নাবান্নার দায়িত্বটা তার উপর ছিল। মাঝে মাঝে আমাদের ডেকে বলতেন আস দেখ কিভাবে রান্না করতে হয়। আমরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে তার চিকেন বীফ সবজি ডাল রান্না দেখতে দেখতে রান্নার কলাকৌশল রপ্ত করার চেষ্টা করতাম। অত্যান্ত বন্ধুবৎসল আলাপী সুদর্শন বাবলা ভাইয়ের কাছ থেকে জানতাম জার্মানীর টুকিটাকী সংবাদ। এর মধ্যে একদিন আমি ও বিয়াই জামালভাই গেলাম বাড়ির কাছে আলবি সুপারমার্কেটে। বিশাল বড় সুপার মার্কেট। অনেক্ষণ মার্কেটের এদিক সেদিক হাটাহাটি করে কিছু কেনাকাটার পর আমরা মশলা খুঁজতে লাগলাম। অনেক খুঁজা খুঁজির পরও মশলা পাওয়া গেল না। বাসায় যে জারগুলোতে হলদী মরিচ আদা রসুন রাখা হয়েছে ঐ জারগুলোতে এখানে সব জেলী আর মামলেট ভর্তি। কাউকে যে জিজ্ঞেস করে জেনে নিব মশলা কোথায় পাওয়া যায় সেই ভাষাটুকু তখন রপ্ত করা হয়নি। সেদিন আর মশলা কেনা হয়নি। রাতে ডিনার টেবিলে আদিল ভাইকে মশলা খুঁজার কথাটা বললাম। আদিল ভাই আর বাবলা ভাই আমাদের মশলা খুঁজার কাহিনী শুনে হেসে প্রায় অজ্ঞান। আমরাতো তাজ্জব। এ নিয়ে এত হাসার কি হলো। পরে আদিল ভাই ব্যাপারটা খোলসা করে বললেন, তোমরা আলদি মার্কেটে তো কোন ইন্ডিয়ান স্পাই পাবে না। ইন্ডিয়ান স্পাইস পাওয়া যায়
ইউনিভারসিটির কাছে একটা জার্মান দোকানে। আমরা সেখান থেকেই আনি। আর বাসায় আমরাতো জেলীর খালি জারগুলোতে মশলা ভরে রেখেছি। তখন আমি আর বেয়াই জামাল এই কথা শুনে উচ্চস্বরে হাসি। আমাদের ধারণা ছিল যেহেতু বাসায় এসব জারে মশলা রাখা হয়েছে ঠিক এইসব জারগুলোতে দোকানে মশলা পাওয়া যাবে। মূর্খ আর কাকে বলে!
আতিক ভাই উচ্চতায় ছয় ফিট ছাড়িয়ে বলিষ্ঠ সুদর্শন এবং বন্ধুবৎসল মানুষ। আমরা তার আরেকটা নাম রক্ষিবাহিনী বলে জানতাম।
কি কারন ছিল তার সেটা আমার জানা ছিল না। আতিক ভাই কাজ করতেন হামবুর্গ মেইন সাবওয়ের নিচে একটা ফুলের দোকানে। সাবওয়ের পথচারী চলাচলের সংযোগস্থলের কারণে আমরা আসা যাওয়ার পথে তার সাথে কিছুক্ষণ গালগল্প করতাম। ফলে তার দোকানে ছোটখাট একটা আড্ডা জমতো আমাদের। বিভিন্ন গাল গল্পের ভিতর জার্মানীতে পার্মানেন্টভাবে থাকার বিষয়টা ছিল হট টপিক। তখন বাঙ্গালীদেরর প্রায় সবারই (কয়েকজন বাদে) জার্মান ভাষা বিদ্যা ছিল অত্যন্ত স্বল্প। সেই জ্ঞান বিদ্যা আর বুদ্ধির মিশেল করে আতিক ভাই সাইতুং পত্রিকার খবরাখবর তর্জমা করে আমাদের জানাতেন।
একদিন আতিকভাই জানালেন ভিন্ন খবর। ধনে পাতার সংবাদ। তাজা ধনে পাতা। জানালেন শ্রীলংকার এক দোকানে ফ্রেশ ধনে পাতা পাওয়া যায় তার আবিষ্কারের সংবাদ। আমরাতো ভীষন উল্লাসিত। মাছ এবং ডাল ফ্রেস ধনে পাতা দিয়ে দারুন রান্না হবে। পরদিন সাবওয়ে বাসে করে ছুটলাম সেই শ্রীলংকার দোকানে। দোকানে গিয়ে দেখি হট আইটেম ফ্রেশ ধনে পাতা। আমাদের দেশী ভাইয়েরা আমার আগেই তাদের ব্যঞ্জন সুস্বাধু করার লক্ষ্যে সেলফ খালি করে ফেলেছে। বিষন্ন ভগ্ন মন নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। দোকানদার জানালো আগামী সপ্তাহে সোমবার আবার আসবে ধনে পাতা। তার কথামত আগামী সোমবার নির্দিষ্ট সময়ে তার দোকানে হাজির হলাম। সেই কাংখিত ধনে পাতার জন্য। পেয়ে গেলাম আমার সাধের ধনে পাতা। বাসায় ফিরে কার্ব ফিশ আর ডাল রান্না করা হলো ফ্রেশ ধনে পাতা দিয়ে। কয়েক বছর পর সুগন্ধি ধনে পাতার ডাল আর মাছ খেয়ে আমাদের তৃপ্তির আনন্দ আর ধরে না। পাঠক আপনারা একবার ভেবে দেখুনতো আপনারা যারা দেশ থেকে এসেই এই দূর প্রবাসে বাঙ্গালী গ্রোসারীতে পেয়ে যান ইলিশ রুই টেংরা পাবদা মছসহ চেপা লইট্যা বালাচাং এর মতো শুটকী আর লতি কাকরল চিচিংগার মতো সবজি তারা কত ভাগ্যবান।
– মোয়াজ্জেম খান মনসুর : কবি ও লেখক, টরন্টো