কানাডায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশী অভিবাসীদের!

বিশ্বের গোটা মানবজাতিকে কয়েকবার ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মারণাস্ত্র মজুদ আছে মানুষের হাতে : অথচ শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যও নেই পর্যাপ্ত সংখ্যক পার্সনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট!!!

18 ই মে, 2020

প্রবাসী কণ্ঠ : বিশ^ব্যাপী করোনা মহামারী কেড়ে নিয়েছে বহু মানুষের প্রাণ। আক্রান্ত হয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। প্রায় ৬ মাস হতে চললো এর প্রদুর্ভাবের বয়স। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ এখনো সুদূরপরাহত বলেই মনে হচ্ছে। এখনো প্রতিদিনই বাড়ছে মৃতের সংখ্যা আর আক্রান্তের সংখ্যা। কেউই বাদ যাচ্ছে না এর আক্রমণ থেকে। রাজা-প্রজা, শিশু-বৃদ্ধ, সাদা-কালো-বাদামী সবাই কুপোকাত করোনার আগ্রাসনের কাছে। করোনার আগ্রাসনে কুপোকাত কানাডাও। এ পর্যন্ত (১৪ মে) দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৩,৩৯৫ জন। মৃত্যুবরণ করেছেন ৫,৫৭৬ জন। আর এই মৃত ও আক্রান্তদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশই অভিবাসী। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নই এখন দেখা দিয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানীসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো কোন গবেষণা বা জরিপ পরিচালিত হয়নি কানাডায়।

কানাডায় তুলনামূলকভাবে করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এখানকার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায়ও কানাডায় বৃদ্ধাশ্রমে করোনায় আক্রান্তদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশী। ‘ইন্টারন্যাশনাল লং-টার্ম কেয়ার পলিসি নেটওয়ার্ক’ কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে কানাডায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যে কজন মারা গেছেন তার মধ্যে শতকরা ৬২ জনই বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা। এই সংখ্যা নিদারূনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অন্য আরো ১৩টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। অবশ্য ঐ ১৩টি দেশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইটালী নেই। কারণ করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঐ তিনটি দেশে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের হিসাবটা এরকম আলাদা ভাবে করা হয়নি। তবে ফ্রান্স ও জার্মানী ঐ ১৩ দেশের তালিকায় আছে।

কিন্তু উপরের এই হিসাব একটু পুরানো। গত ৭ মে, টরন্টো স্টার এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে কানাডায় বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের সংখ্যা আরো অনেক বেশী। কানাডায় এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে শতকরা ৮২ জনই বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা ছিলেন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন এজিং এর পক্ষ থেকে বলা হয়, বৃদ্ধাশ্রমগুলোর ৩,৪৩৬ জন বাসিন্দা মারা যান করোনায় আক্রান্ত হয়ে। আর বৃদ্ধাশ্রমে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মী মারা যান ৬ জন। কানাডায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট মৃতের সংখ্যা (৬ মে) ৪,১৬৭ জন। ইনস্টিটিউটের রিসার্স ডিরেক্টর বলেন, এটি একটি বিস্ময়কর চিত্র। কানাডায় বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে মোট অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৪ লক্ষ। সেই হিসাবে এরা কানাডার মোট জনসংখ্যার মাত্র ১%। এই বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে অভিবাসীদের সংখ্যা বা হার কত তার হিসাব অবশ্য আলাদাভাবে পাওয়া যায়নি।

করোনায় যারা আক্রান্ত হচ্ছেন এবং আক্রান্তদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছ তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই অভিবাসী। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নই এখন দেখা দিয়েছে চিকিৎসকদের মধ্যে। ছবি : সিটিনিউজ-উইনিপেগ

এদিকে সিবিসি নিউজ জানায়, প্রাথমিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে টরন্টোতে কিছু সোসিয়ো-ইকনমিক বা আর্থ-সামাজিক সম্প্রদায়ের লোকেরা অন্যদের তুলনায় বেশী মাত্রায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ কথা জানান টরন্টোর মেডিক্যাল অফিসার এলিন ডি ভীলা। তিনি সাংবাদিকদের জানান, টরন্টোর যে সব এলাকায় স্বল্প-আয়ের লোকজন থাকেন, যারা সাম্প্রতিক অভিবাসী এবং যে সকল এলাকার লোকজনের মধ্যে উচ্চমাত্রার বেকারত্ব আছে সেই সকল এলাকার লোকজন অন্যদের তুলনায় বেশীমাত্রায় করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং তাদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যাও বেশী।

ডা. ভীলা আরো জানান, যারা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদেরকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিশেষ কিছু প্রশ্ন করা হবে। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হবে তারা কোন এলাকায় থাকেন, তাদের সম্প্রাদয়গত পরিচয় কি, আয় কেমন, বাড়িতে কতজন সদস্য থাকেন ইত্যাদি।

উল্লেখ্য যে, মন্ট্রিয়লেও দেখা গেছে একই চিত্র। সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কভিড-১৯ এ সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হয়েছেন মন্ট্রিয়লের দরিদ্র এলাকাগুলোতে। এর মধ্যে আছে  Montréal-Nord, Mercier–Hochelaga-Maisonneuve and Ahuntsic-Cartierville. আর এই দরিদ্র এলাকাগুলোতে বেশীরভাগ অধিবাসীই অভিবাসী সম্প্রদায়ের যারা এসেছেন এশিয়া বা আফ্রিকার দেশগুলো থেকে। তারা প্রধানত কাজ করেন ফ্রন্টলাইনে এবং কম বেতনে। এই ফ্রন্টলাইনের কর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মী যারা কাজ করেন সাধারণত ক্লিনার হিসাবে। হাসপাতালের অন্যন্য সাধারণ কর্মচারীদের মধ্যেও এই এথনিক সম্প্রদায়ের সদস্যই বেশী। আর দেখা গেছে মন্ট্রিলে যারা কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে ১৯%ই স্বাস্থ্যকর্মী। এই স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেকেই থাকেন ঐ দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে।

কানাডার পাশাপাশি ব্রিটেনেও দেখা গেছে করোনা ভাইরাসে যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশই অভিবাসী বা জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক। বিবিসি’র এক খবরে বলা হয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে যারা ভর্তি আছেন তাদের এক তৃতীয়াংশের বেশি জাতিগত সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের মানুষ। সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের মানুষের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি আনুপাতিক হারে বেশি কিনা তা নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালানোর আহ্বান জানিয়েছে বিরোধী লেবার পার্টি। সরকার বলেছে স্বাস্থ্য খাতে কোনরকম অসমতা দূর করতে তারা বদ্ধপরিকর।

ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এথনিক মাইনরিটি বা জাতিগত সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ১৪%।

কিন্তু ব্রিটেনে নিবিড় পরিচর্যায় চিকিৎসাধীনদের ওপর ‘ইনটেনসিভ কেয়ার ন্যাশানাল অডিট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’ পরিচালিত  গবেষণা তথ্যে দেখা যাচ্ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সঙ্কটজনক অবস্থায় তিন হাজারের ওপর যেসব রোগী নিবিড় পরিচর্যায় আছে তাদের ৩৪% সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের।

বিবিসি’র খবরে আরো বলা হয়, নাইজিরিয়ান বংশোদ্ভুত ড. চাইনগুয়নডো বলছেন সরকারের উচিত সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের মধ্যে করোনাভাইরাসের বিস্তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং এই সংক্রমণের হারের আনুপাতিক বিশ্লেষণ করে দেখা।

“আমরা যদি রোগের ধরণ এবং কেন সংখ্যালঘুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে সেটা বুঝতে পারি, তাহলে তার থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে এই স¤প্রদায়ের মানুষকে যথাযথ পরামর্শ ও সহায়তা দিতে পারব।”

লেবার পার্টি বলেছে আনুপাতিক হিসাবে এত বেশি সংখ্যক সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের চিকিৎসকেরও করোনাভাইরাসে মৃত্যু “গভীরভাবে উদ্বেগজনক”।

সরকারের স্বাস্থ্য ও সামাজিক কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলেছে এই ভাইরাসের সংক্রমণে যারা মারা গেছেন তাদের প্রত্যেকের মৃত্যুই দু:খজনক।

“কোভিড নাইনটিনে আক্রান্তদের মধ্যে আনুপাতিক হিসাবে জাতিগত সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা যে অনেক বেশি, তা নিয়ে নতুন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। সরকার এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান চালাতে ইংল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য বিভাগ পাবলিক হেল্থ ইংল্যান্ডের সঙ্গে কাজ করছে এবং এ বিষয়ে আমরা কিছু দিনের মধ্যে আরও বিস্তারিত তথ্য জানাবো।”

লেস্টার ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক ড. কমলেশ খুন্তি বলছেন, “সম্প্রতি যেসব তথ্য দেখা গেছে তাতে অনেকেই উদ্বিগ্ন। নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে যাদের আশংকাজনক অবস্থায় ভর্তি হতে হচ্ছে তাদের মধ্যে এত বেশি সংখ্যক মানুষ এথনিক মাইনরিটি জনগোষ্ঠির হওয়ায় উদ্বেগ আরও বাড়ছে।”

তিনি বলছেন এই তথ্য আসলে কী বার্তা দিচ্ছে তা বুঝতে আরও গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

করোনাভাইরাস যে কাউকেই সংক্রমিত করতে পারে। কিন্তু সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের বেশি আক্রান্ত হবার পরিসংখ্যান শুধু যে ব্রিটেনেই দেখা যাচ্ছে তা নয়, আমেরিকাতেও একইধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।

আমেরিকার শিকাগো শহরে জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ কৃষ্ণাঙ্গ বংশোদ্ভুত হলেও আক্রান্তদের মধ্যে ৭০% আফ্রিকান বংশোদ্ভুত বলে শহরের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

আমেরিকার অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গ ও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত শহর যেমন নিউইয়র্ক, নিউ অরলিয়েন্স, ডেট্রয়ট এবং মিলওয়াকি দেশটিতে করোনাভাইরাসের হটস্পট হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে গত ১০ এপ্রিল কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা’র এক খবরেও বলা হয়, চীন থেকে উৎপত্তি হলেও করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। আর যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গরা।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সপ্তাহের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শহরটিতে ৬ হাজার ১শ জন করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি কৃষ্ণাঙ্গ।

শিকাগোর কর্মকর্তারা জানান, শহরটির মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ। আর করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেক এবং মারা যাওয়া প্রায় ৭০ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। লুইজিনিয়া রাজ্যেও মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ। এখানেও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা ৭০ শতাংশ আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ জাতি। এছাড়া মিশিগানে মাত্র ১৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ বাস করলেও সেখানে করোনায় মারা যাওয়া ৪০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের। যুক্তরাষ্ট্রের করোনার এপিসেন্টার হিসেবে পরিচিত নিউ ইয়র্কেও শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুর হার বেশি।

বিশ্লেষকরা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করায় তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। অপরদিকে অবহেলিত কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বাস কষ্ট, ডায়বেটিসের মত জটিল রোগে ভুগছে কারণ তাদের জন্য স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত সুবিধা রাখা হয়নি।

এ বিষয়ে একসেস কমিউনিটি হেলথ নেটওয়ার্কের কর্মকর্তা ব্রায়ান ব্রাগ বলেন, আমরা এই ঐতিহাসিক বঞ্চনা তুলে ধরা জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি।

যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেম এর একজন শিক্ষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বিডি২৪.কম এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার সংখ্যানুপাতে অধিক হারে আক্রান্ত হচ্ছেন বাংলাদেশি এবং কৃষ্ণাঙ্গরা। অনুমান করা হচ্ছে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ হাজার বাংলাদেশি কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার আরো দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্তানি অভিবাসীদের বাংলাদেশীদের তুলনায় আক্রান্ত এবং মারা যাবার সংখ্যা এবং অনুপাত কম। নিউ ইয়র্কে আনুমানিক কয়েক লাখ বাংলাদেশীর বাস। এদের বড় অংশটিই থাকেন দরিদ্র অঞ্চলগুলিতে। দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যারা কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের বড় অংশটি হয় দরিদ্র অথবা দরিদ্র অঞ্চলের বাসিন্দা।

সাঈদ ইফতেখার উল্লেখ করেন, তুলনামূলক বিচারে সুবিধাভোগী শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় বাংলাদেশি অভিবাসীসহ অশ্বেতাঙ্গ দরিদ্র হওয়ায় তাঁদের উল্লেখযোগ্য অংশের পক্ষেই এ দেশে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া দুরুহ। পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ বিকশিত এ দেশটিতে চিকিৎসা এবং শিক্ষাকে  মানুষের মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য করা হয়না। ফলে, এ খাত দুটি এখানে মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্র।  চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরোটাই এখানে পরিচালিত হয় কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায়। পাশাপাশি চিকিৎসকদের কাছ থেকে চিকিৎসা সেবা নেবার ব্যবস্থার পুরোটাই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর হাতে জিম্মি। বীমা কোম্পানিগুলো মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় খুবই শক্তিশালী এবং এদের সাথে মূলধারার মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে এখানে কোনও রাজনীতিবিদ বা মিডিয়া, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর হাত থেকে মুক্ত করে, সমস্ত জনগণের স্বাস্থ্য সেবা পাবার অধিকার নিশ্চিত করবার কথা বলে না। বার্নি স্যান্ডার্স সাহস করে স্বাস্থ্য খাতকে জাতীয়করণ করবার কথা বলাতে তাকে নানা কৌশলে ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবার দৌড় থেকে বাদ দেওয়া হয়।

সাঈদ ইফতেখার আরো উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্রে একজনকে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সেবা পেতে হলে তাকে তিনটা ইন্স্যুরেন্স কিনতে হয়-তার শরীরের জন্য একটা, বাকি দুটো চোখ এবং দাঁতের জন্য। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তিকে এখানে প্রতি মাসে তিনটা ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম দিয়ে যেতে হয়। অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর পক্ষে পরিবারের সব সদ্যস্যের জন্য তিনটা ইন্স্যুরেন্স কেনা সম্ভব হয় না। অনেকে এখানে শুধু সন্তানদের জন্য ইন্স্যুরেন্স কেনেন, নিজেরা ইন্স্যুরেন্সবিহীন অবস্থায় ভাগ্যের উপর নির্ভর করে থাকেন। দেশটিতে প্রায় তিন কোটি লোক আছেন, যাদের কোনও রকম ইন্স্যুরেন্সই নেই। এ ইন্স্যুরেন্স না থাকবার ফলে প্রথম যখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়াতে থাকে, তখন অনেকে লক্ষণ থাকা সত্তে¡ও পরীক্ষা করাতে যেতে পারেননি। পরে যখন সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে থাকে, তখন পরীক্ষা ফি মওকুফ করে দেওয়া হয়। কিন্তু, মওকুফ করা হয়নি চিকিৎসা ফি। ফলে অনেকেই টাকার অভাবে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হন নাই। আবার কৃষ্ণাঙ্গ, অভিবাসীসহ আমেরিকাতে যারা দরিদ্র, তারা ছোট বাসায় এক সাথে অনেকে বাস করেন। কেননা, উচ্চহারে বাসা ভাড়া দেবার সামর্থ্য তাদের নেই। এছাড়া গৃহহীন মানুষদের জন্য যে সমস্ত আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে, সেখানেও ছোট জায়গায় এক সাথে অনেককে রাখা হয়। অনেকটা বস্তির মত, আমেরিকানরা যেটাকে বলেন “ঘেটো,” সেখানেও অনেকে অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে থাকেন। ফলে, অপেক্ষাকৃত কম লক্ষণযুক্ত আক্রান্তদের যখন বলা হল বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবার জন্য, তখন তাদের অনেকের পক্ষেই হোম কোয়ারেন্টিন বা সেলফ আইসোলেশনের নিয়ম মেনে চলা সম্ভব হয়নি। এতে, দাবানলের মত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ।

উল্লেখ্য যে, সাঈদ ইফতেখারের তথ্য থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এথনিক সম্প্রদায় সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে তার সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে কানাডায়ও এথনিক জনগোষ্ঠির অবস্থা অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের মতনই। ব্যতিক্রম শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থায়। আমরা জানি কানাডার এথনিক সম্প্রদায়ের বেশীরভাগ সদস্যই থাকেন দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে। তাদের আয় কম। এক বা দুই বেডরূমের এপার্টমেন্টে গাদাগাদি করে থাকেন চার থেকে ছয়, সাত বা আরো বেশী সংখ্যক সদস্য। বাথরূম একটা। পরিবারের আয় কম হওয়াতে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার ক্রয় করার ক্ষমতা থাকে না অনেকের। সম্প্রদায়গত বিশেষ কিছু ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী রোগের প্রাদুর্ভাবও আছে কানাডার এথনিক জনগোষ্ঠির মধ্যে। এর মধ্য অন্যতম হলো ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক রোগ ইত্যাদি। করোনা ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে এই ক্রনিক রোগগুলো অনুকুল পরিবেশ তৈরী করে দেয় রোগীর পরিস্থিতি জটিল করে তোলার জন্য। ফলে অনেকেই তখন করোনার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেন না।

উল্লেখ্য যে, টরন্টোতে বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রথম প্রজন্মের বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ এ সবই আছে কমবেশী সবার মধ্যে। তাদের মধ্যে নিয়মিত ব্যায়াম করা, স্বাস্থ্য সম্মত খাবার গ্রহণ করা ইত্যাদির প্রবণতা খুবই কম। অধিকমাত্রায় কার্বোহাইড্রেট, মিষ্টান্ন, তৈলাক্ত খাবার গ্রহণের অভ্যাস রয়েছে অধিকাংশের মধ্যে। এমনকি যারা

ডায়াবেটেসের রোগী তাদের মধ্যেও এই অভ্যাস বিদ্যমান। ধূমপানের অভ্যাসও আছে কারো কারো। মহিলাদের মধ্যে অনেকের শারীরিক স্থুলতার সমস্যা রয়েছে। ফলে এদের কেউ যদি করোনায় আক্রান্ত হন তাহলে তার মৃত্যু ঝুঁকির মাত্রা অন্যদের চেয়ে বেশী হয়ে দাড়ায়।

অন্যদিকে টরন্টো ও মন্ট্রিয়লে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী কাজ করেন ফ্রন্টলাইনে। এর মধ্যে আছে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ক্যাব ড্রাইভিং, রিটেইল শপ ইত্যাদি। এরা প্রতিদিনই কোন না কোনভাবে অন্যলোকের সংস্পর্শে আসছেন। স্যোসাল ডিস্টেন্স সব ক্ষেত্রে বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। ফলে অন্যদের তুলনায় করোনায় আক্রান্ত হবার ঝুঁকি তাদের বেশী।

টরন্টো, মন্ট্রিয়ল এবং ভেঙ্গুভারে বেশীর ভাগ বাংলাদেশী বাস করেন এপার্টমেন্ট ভবনে। সেখানেও স্যোসাল ডিস্টেন্স বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন। কারণ বহুতলা ভবন হলে এলিভেটর ব্যবহার করতে হয়। এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে এলিভেটর পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে সরু করিডোর ব্যবহার করতে হয় যেখানে কোনভাবেই ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা যায় না। এলিভেটরেও একই অবস্থা। অবশ্য করোনার পর অনেক ভবনেই নিয়ম করে দেয়া হয়েছে একসাথে একজন বা দুজনের বেশী এলিভেটরে উঠা যাবে না। এক পরিবারের সদস্য হলে অন্যকথা। কেউ যদি সিড়ি ব্যবহার করতে চান সেখানেও দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন। কারণ, অনেক ভবনের সিড়িগুলো ৬ ফুট চওড়া নয়।

সমস্যা আরো আছে। এলিভেটরে উঠে সুইচ টিপতে হয়। সেই সুইচ এর মধ্যে করোনার জীবানু লেগে আছে কি না তা বোঝার কোন উপায় নেই। করোনায় আক্রান্ত কেউ যদি ইতিপূর্বে এলিভেটরের ভিতরে কাশি দিয়ে থাকে তবে তার মুখ থেকে নির্গত ভাইরাস এলিভেটরের দেয়ালের গায়ে বা ফ্লোরে লেগে থাকতে পারে। লেগে থাকে পারে সুইচের গায়েও। এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর লন্ড্রিরূমেও সমস্যা রয়েছে। সেখানে একই মেশিন সবাই ব্যবহার করে থাকেন। করোনা ভাইরাস সেখান থেকেও বিস্তার লাভ করতে পারে একজন থেকে আরেকজনের দেহে। কারণ লন্ড্রিরূমেও মেশিন এর সুইচ টিপতে হয়, মেশিনের ডালা খুলতে হয় এবং বন্ধ করতে হয় হাত দিয়ে। লন্ড্রিরূমে টেবিল বা কাউন্টারের উপর কেউ যদি সদ্য ব্যবহৃত কাপর রাখেন তবে সেখান থেকেও সংক্রমনের সম্ভাবনা থাকে।

সিটি অব টরন্টোর ওয়েবসাইটের হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় ৪১% টরন্টোবাসী বাস করেন এই ভবনগুলোতে। ২০১১ সালের হিসাব এটি। তবে ২০১৬ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাবে দেখা যায় ৪৩.৬% টরন্টোবাসী বাস করেন  ছোট বড় এই এপার্টমেন্ট ভবনগুলোতে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে টরন্টোর প্রায় অর্ধেক অধিবাসী এমন স্থানে বাস করেন যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সত্যিই কঠিন কাজ। এই ভবনগুলোতে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশী। জরুরী কোন প্রয়োজনে এপার্টমেন্ট থেকে বের হতে গেলে কারো না কারোর খুব কাছাকাছি চলে আসার সম্ভাবনা থাকে। আর সে ক্ষেত্রে ঝুঁকির মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। তাহলে এই বিপুল সংখ্যক টরন্টোবাসী কি করতে পারেন তাদের ঝুঁকির মাত্রা কমানোর জন্য? কঠিন প্রশ্ন। সহজ কোন উত্তর নেই।

তবে আমেরিকার তুলনায় কানাডার স্বল্প আয়ের এথনিক সম্প্রদায়ের সদস্যগণ চিকিৎসা পান অনেক ভাল। হোক সেটি কোন সাধারণ রোগ বা জটিল রোগ অথবা সাম্প্রতিক সময়ের করোনার রোগ।

উল্লেখ্য যে, শিক্ষার অভাবেও কোন কোন এথনিক সম্প্রদায়ের সদস্যরা কারোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন বেশী। করোনা ভাইরাস কি ভাবে সংক্রমিত হয় সে সম্পর্কে কিছু লোকের ধারণ খুবই কম। টিভিতে বা সংবাদপত্রে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ কি ভাবে করা যায় সে সম্পর্কে যতই প্রচার চালানো হোক, অভিবাসীদের মধ্যে যারা অল্প শিক্ষিত তারা সেটি সঠিকভাবে অনুসরণ করতে পারেন না। ভাষারও একটি ব্যাপার রয়েছে। কারণ টিভি বা সংবাদপত্রে প্রচার চালানো হয় ইংরেজী বা ফরাসী ভাষায়। যাদের শিক্ষার দৌড় কম তারা সেই ভাষায় প্রচারিত কোন তথ্য সহজে বুঝতে পারেন না। আলস্য বা গাফিলতিরও একটি বিষয় আছে। জেনেও অনেকে যথাযথভাবে ডাক্তরদের পরামর্শ অনুসরণ করেন না। সঠিকভাবে হাত ধোয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করেন না। কিংবা ভুল যান হাত ধোয়ার কথা। হাত ধোয়ার এই সমস্যাটি কেবল যে এথনিক জনগোষ্ঠির মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা নয়। সব সমাজেই এর চিত্রটি মোটামুটি একই রকম।

লাইভসায়েন্স.কম থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে এক সমীক্ষা চালানো হয়েছিল এ বিষয়ে। ওতে দেখা যায় বাথরূম ব্যবহারের পর ৯৫% মানুষ যথাযথভাবে হাত ধোয়ার কাজটি করেন না। হাত থেকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ভালভাবে পরিষ্কার করার জন্য ডাক্তারগণ পরামর্শ দিয়ে থাকেন ২০ সেকেন্ড ভেজা হাতে সাবান মেখে হাত কচলানোর জন্য। এর পর টেপের ধাবমান পানি দিয়ে তা ধুয়ে ফেলতে হয়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে তিনজনের মধ্যে দু’জন হাত ধোয়ার জন্য সাবান ব্যবহার করেন। আর দশজনের মধ্যে একজন বাথরূমের সিঙ্ক এর ধারে কাছেও যান না। অর্থাৎ হাত ধোয়ার কাজটি তারা করেন-ই না। সমীক্ষায় দেখা গেছে বাথরূমে মানুষজন সাধারণভাবে হাত ধোয়ার কাজটি সারেন ৬ সেকেন্ড এর মধ্যে। আর যথাযথভাবে অর্থাৎ ১৫/২০ সেকেন্ড সময় ব্যয় করে হাত ধোয়ার কাজটি সারেন মাত্র ৫% মানুষ।

পুরুষদের মধ্যে দেখা গেছে সাবান ব্যবহার করেন ৫০%। ১৫% পুরুষ বাথরূম ব্যবহারের পর মোটেও হাত ধোয়ার কাজটি করেন না। তবে মহিলারা পুরুষের তুলনায় অনেকটা সচেতন। ৭৮% মহিলা বাথরূমে সাবান ব্যবহার করেন। আর হাত ধোয়ার কাজটি মোটেও করেন না এমন মহিলার সংখ্যা ৭%।

সুতরাং এই ধারণাটি অমূলক নয় যে, মানুষের এই অভ্যাস করোনা রোগ বিস্তারের পিছনে কিছুটা বা অনেকটা ভূমিকা রাখে। কারণ, যারা বাথরূম ব্যবহারের পর যথাযথভাবে হাত পরিস্কার করেন না, তারা অন্যত্র হাত ধোয়ার কাজটি যে আরো কম করেন তা সহজেই অনুমেয়। করোনায় আক্রান্ত রোগীর অপরিচ্ছন্ন হাত থেকে ভাইরাস সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে যে কোন সুস্থ্য মানুষের শরীরে।

করোনার সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন অধিকমাত্রায় আক্রান্ত দেশগুলোর স্বাস্থ্য কর্মীরা। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কোন কুলকিনারা পাচ্ছেন না কি ভাবে একে নিয়ন্ত্রণে আনবেন। তাদের হাতে বিশে^র গোটা মানবজাতিকে কয়েকবার ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মারণাস্ত্র মজুদ আছে! কিন্তু করোনা নামক অদৃশ্য শত্রæর হাত থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট-ও নেই হাসপাতালগুলোতে!!! আক্রান্ত রোগীর সেবার জন্য পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট যেমন হ্যান্ড গøাভস, সেনিটাইজার, ভেন্টিলেটর এগুলোর সংকট প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে আরো অনেক আগে থেকেই। ওষুধও নেই এর চিকিৎসায়। গবেষণা চলছে। কবে নাগাদ সেই ওষুধ আসবে তা কেউ বলতে পারছেন না। ছয় মাস, এক বছর বা তিন বছরও লেগে যেতে পারে এর ভ্যাকসিন আবিস্কার ও বাজারজাত করার জন্য। ততদিনে এই করোনার কারণে আরো কত ক্ষতি হবে মানবজাতির তা কেউ জানেন না।

কানাডায় দৃশ্যমান সংখ্যালঘু বা বিভিন্ন এথনিক সম্প্রদায়ের লোকেরা অধিকমাত্রায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। দারিদ্রতা, অপুষ্টি, গাদাগাদি করে এক সঙ্গে এক বাড়িতে অধিক সংখ্যক লোকের বাস, আগে থেকেই ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদিতে ভোগা, অসচেতনতা ইত্যাদি সব মিলিয়েই হয়তো এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে কিছুটা আশার কথা এই যে, আমেরিকার তুলনায় কানাডার এথনিক সম্প্রদায়ের লোকেরা চিকিৎসা পান অনেক ভাল। কিন্তু করোনা ভাইরাসটি এমন অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে যে, চিকিৎসা দিয়ে একে ঠেকানো যায় না। ঠেকানো যায় না ওষুধ দিয়েও। সেরকম ওষুধও তৈরী হয়নি এখন পর্যন্ত। এথনিক সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক যে পরিস্থিতি সেটাও রাতারাতি এমনকি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা বা উদ্যোগের মাধ্যমেও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। পূঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাটাই এরকম। সেখানে অল্প সংখ্যক লোক ধনী হবেন আর ব্যাপক সংখ্যক লোক দরিদ্র থাকবেন।

এখন একমাত্র ও সহজ উপায় হলো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। কানাডায় এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সুফল ইতিমধ্যে পেতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ কলম্বিয়া, সাস্কাচুন, মেনিটোবা, আলবার্টা-সহ অন্যান্য প্রভিন্সগুলো ভাল ফল পেয়েছে। অন্টারিও প্রভিন্সও ফল পেতে শুরু করেছ। কুইবেক অবশ্য এখনো পিছিয়ে আছে কিছুটা। তবে আশা করা হচ্ছে অন্টারিও এবং কুইবেকেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে কিছু দিনের মধ্যে। আর তার জন্য দরকার সবাই মিলে সামাজিক দূরত্বটা কঠোরভাবে বজায় রাখা।

করোনার হাত থেকে কি ভাবে নিজেকে ও আপনার পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করবেন  সে সম্পর্কে কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরা হলো। তথ্যগুলো জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনিসেফ এর ওয়েবসাইট থেকে নেয়া।

কোভিড-১৯ ভাইরাস কীভাবে ছড়ায়?

সংক্রমিত ব্যক্তির শ্বাসতন্ত্রের ফোঁটার (কাশি এবং হাঁচির মাধ্যমে তৈরী) সাথে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে এবং এই ভাইরাস দ্বারা দূষিত অংশ স্পর্শ করার মাধ্যমে এটি সংক্রমিত হয়। কোভিড-১৯ ভাইরাস বেশ কয়েক ঘন্টা ভূপৃষ্ঠে বেঁচে থাকতে পারে, তবে সাধারণ জীবাণুনাশক এটিকে মেরে ফেলতে সক্ষম।

করোনাভাইরাসের লক্ষণগুলো কী?

করোনভাইরাসের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট। আরও মারাত্মক ক্ষেত্রে, এই সংক্রমণের ফলে নিউমোনিয়া বা শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা হতে পারে। তবে, খুব কম ক্ষেত্রেই এই রোগ প্রাণঘাতী হয়।

এসব লক্ষণগুলো ফ্লু (ইনফ্লুয়েঞ্জা) বা সাধারণ ঠান্ডা-জ্বর, যা কোভিড-১৯ এর চেয়ে অনেক বেশি সাধারণ। এ কারণেই কোনও ব্যক্তি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখে নেয়া দরকার। এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে, মূল প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো একই রকম। এর মধ্যে রয়েছে বার বার হাত ধোয়া এবং শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। যেমন, কাশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় কনুই দিয়ে ঢেকে নেয়া বা টিস্যু ব্যবহার করা, তারপর টিস্যুটি নিকটবর্তী বন্ধ ময়লার বাক্সে ফেলে দেয়া।

সংক্রমণের ঝুঁকি কীভাবে এড়াতে পারেন?

সংক্রমণ এড়াতে আপনি এবং আপনার পরিবার নিচের চার ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেন:

ঘন ঘন সাবান ও পানি দিয়ে বা অ্যালকোহলয্ক্তু হাত-ধোয়ার সামগ্রী ব্যবহার করে আপনার হাত ধূয়ে নিন

কাশি বা হাঁচি দেবার সময় মুখ এবং নাক কনুই দিয়ে বা টিস্যু দিয়ে ঢেকে রাখুন। ব্যবহূত টিস্যুটি তাৎক্ষণিকভাবে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিন

ঠান্ডা লেগেছে বা জ্বরের লক্ষণ আছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন

আপনার বা আপনার সন্তানের জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রæত চিকিৎসা সেবা নিন

সঠিকভাবে হাত ধোয়ার অন্যতম উপায় কী?

ধাপ ১: প্রবাহমান পানিতে হাত ভেজানো;

ধাপ ২: ভেজা হাতে পর্যাপ্ত পরিমান সাবান ব্যবহার করা;

ধাপ ৩: হাতের পেছনের অংশ, আঙ্গুলের মধ্যের অংশ এবং নখের নিচের অংশসহ হাতের সব অংশই অন্ততপক্ষে ২০ সেকেন্ড ভালোভাবে ধুয়ে ফেলা;

ধাপ ৪: প্রবাহমান পানিতে ভালভাবে কচলে হাত ধোয়া;

ধাপ ৫: একটি পরিষ্কার কাপড় বা এককভাবে ব্যবহার করেন এমন তোয়ালে দিয়ে হাত ভালোভাবে মুছে ফেলা।

আপনার হাত ঘন ঘন ধুবেন। বিশেষ করে, খাবার আগে, নাক পরিস্কার করার পর, কাশি বা হাঁচি দেওয়ার পর এবং বাথরুমে যাওয়ার পরেও।

সাবান ও পানি যদি সহজে পাওয়া না যায়, সেক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ অ্যালকোহল রয়েছে এমন অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন। যদি হাতে ময়লা থাকে, তবে সব সময় সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন।

মেডিক্যাল মাস্ক পরা উচিত?

যদি আপনার শ্বাসকষ্টের লক্ষণ (কাশি বা হাঁচি) থাকে, তবে অন্যের সুরক্ষার জন্য একটি মেডিকেল মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়। যদি আপনার কোন লক্ষণ না থাকে, তবে মাস্ক পরার কোন প্রয়োজন নেই।

যদি মাস্ক পরা হয় তবে ভাইরাস সংক্রমণের বাড়তি ঝুঁকি এড়াতে অবশ্যই এর যথাযথ ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহারের পর এগুলো যথাযথভাবে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিতে হবে।

তবে শুধুমাত্র মাস্কের ব্যবহার এই ভাইরাসের সংক্রমন রোধ করার জন্য যথেষ্ট নয়। এর সাথে অবশ্যই ঘন ঘন হাত ধোয়া, হাঁচি ও কাশি ঢেকে রাখা, এবং ঠান্ডা লাগা বা ফ্লু-এর মতো লক্ষণ রয়েছে (কাশি, হাঁচি, জ্বর) এমন ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা উচিত।

কোভিড-১৯ কি শিশুদের প্রভাবিত করে?

এটি একটি নতুন ধরনের ভাইরাস এবং ভাইরাসটি শিশু বা গর্ভবতী মায়েদের কীভাবে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে আমরা খুব বেশি কিছু জানি না। আমরা শুধু এটুকু জানি যে, যে কোন বয়সের মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। তবে এখনও পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমনের ঘটনা তুলনামূলকভাবে খুব কম ঘটেছে। এখন পর্যন্ত বয়স্ক ব্যক্তি এবং আগে থেকে অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়া খুব কম ক্ষেত্রেই এই ভাইরাস মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

যদি আমার সন্তানের কোভিড-১৯ এর লক্ষণ দেখা দেয় সেক্ষেত্রে কি করা উচিত?

যদি আপনার শিশুর কোভিড-১৯ এর লক্ষণ দেখা দেয় তখন আপনি অবশ্যই চিকিৎসা সেবা নিবেন। তবে মনে রাখতে হবে যে, উত্তর গোলার্ধ্বে এখন জ্বরের মৌসুম, এবং কোভিড-১৯ এর লক্ষণ যেমন, কাশি বা জ্বর, ফ্লু’র মত একই রকমের হতে পারে বা সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের বিষয়টিও খুবই স্বাভাবিক।

ভালভাবে হাত ধোয়া এবং শ্বাসতন্ত্রজনিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা দরকার। যেসব ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া রোগ সৃষ্টি করে, দৈনন্দিন হাত ধোয়া এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সন্তানকে ভ্যাকসিন দেওয়ার মাধ্যমে সেগুলো থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে পারবেন।

আপনার বা আপনার সন্তানের যদি ফ্লু’র মতো শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত অন্যান্য সংক্রমন থাকে, তবে দ্রæত স্বাস্থ্য সেবা নিন। এছাড়াও, অন্যদের মধ্যে এই সংক্রমন ছড়িয়ে পড়া রোধ করার জন্য জনসমাগমস্থলে (কর্মক্ষেত্র, বিদ্যালয়, গণপরিবহন) যাওয়া যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন।

পরিবারের কোনও সদস্যের এই লক্ষণ দেখা দিলে কী করা উচিত?

আপনার বা আপনার সন্তানের যদি জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট থাকে তবে অবশ্যই চিকিৎসা সেবা নিতে হবে। কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়েছে এমন কোনও এলাকা যদি আপনি ভ্রমণ করে থাকেন, বা কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়েছে এমন কোনও এলাকা ভ্রমণ করেছে ও শ্বাসতন্ত্রের জটিলতার লক্ষণ রয়েছে এমন কারও সাথে যদি আপনার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়, তবে আগে থেকেই স্বাস্থ্য সেবাদানকারীর সাথে কথা বলুন।