কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা

আগস্ট ১৮, ২০১৯

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : বাংলাদেশের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গত ৪ জুলাই ফোর্ট এরি সীমান্ত দিয়ে কানাডায় প্রবেশ করে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। আশ্রয় চেয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এর বিরোধিতা করায় তাকে হুমকীর মুখোমুখি হতে হয়। এই বিরোধিতা না করা হলে তখন সংসদের হাতে ভিন্নমত পোষণকারী বিচারকদের বরখাস্ত করার অধিকতর ক্ষমতা প্রদান করা হতো। খবর দি স্টার.কম এর।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের প্রথম একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (৬৮) কানাডায় তার রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার সময় বলেন,“আমি সরকারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়েছি কারণ আমি একজন এক্টিভিস্ট জাজ ছিলাম, আমি এমনসব রায় দিয়েছি যেগুলোর কারণে সরকারের আমলাগণ ক্ষুব্দ হয়েছেন, ক্ষুব্দ হয়েছেন রাজনীতিবদগণ এমনি জঙ্গীরাও। তাদের চোখে আজ আমি দেশের একজন শত্রু, একজন অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি।”

উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়, সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করে। গত ১০ জুলাই প্রকাশিত ঐ রিপোর্টে বলা হয়, “ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে চার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। পরে ‘রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির’ নামে হস্তাস্তর দেখিয়ে আত্মসাৎ ও অর্থ পাচার করা হয়। এমন এক অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান করছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এত দিন সেই ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির’ নাম প্রকাশ না করলেও এবার সেই ব্যক্তির নাম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করল সংস্থাটি। সেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা)। তবে এ বিষয়ে টরন্টো স্টার এর এক অনুসন্ধানের জবাব দেয়নি ঢাকার দুর্নীতি দমন কমিশন। আর এদিকে সুরেন্দ্র কুমার দুদকের এই অভিযোগ তীব্রভাবে অস্বীকার করেন।

সুরেন্দ্র কুমার ইতিপূর্বে বিবিসি’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারেও বলেছিলেন, “বাংলাদেশের সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়টি যেন সরকারের পক্ষে যায়, সেজন্য তার ওপর ‘সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে চাপ তৈরি করা হয়েছিল।”

২০১৭ সালে সিনহার পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত একটি মামলার আপিলের রায়কে কেন্দ্র করে। রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সরকারের কাছ থেকে প্রচন্ড চাপের মুখে বিচারপতি সিনহা দেশ ছেড়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিলেন। দেশ ত্যগের পর কানাডায় বেড়াতেও এসেছিলেন। এখানে তার এক মেয়ে থাকেন।

বিবিসি’র খবরে আরো বলা হয়, সম্প্রতি প্রকাশিত তার এক বইতে সাবেক বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লেখেন- ‘জুলাইয়ের ৩ তারিখ প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার সভাপতিত্বে সুপ্রিমকোর্ট বেঞ্চ আপিল খারিজ করে হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় বহাল রাখেন। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ১ তারিখ সর্বসম্মত রায়ের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়।’ সেখানে তিনি লেখেন- ‘ওই সিদ্ধান্তের পর সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখে পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব পাস করে’ যাতে সেই রায়কে বাতিল করার জন্য আইনি পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়।’

বইটির মুখবন্ধের কিছু অংশে সিনহা লেখেন- ‘প্রধানমন্ত্রী এবং তার দলের অন্যান্য সদস্য ও মন্ত্রীরা পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে যাওয়ায় আমার কঠোর নিন্দা করেন। প্রধানমন্ত্রীসহ কেবিনেট মন্ত্রীরা আমার বিরুদ্ধে অসদাচরণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ এনে বদনাম করতে শুরু করেন। আমি যখন আমার সরকারি বাসভবনে আবদ্ধ, আইনজীবী এবং বিচারকদের আমার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হচ্ছিল না, তখন সংবাদমাধ্যমকে বলা হয়- আমি অসুস্থ, আমি চিকিৎসার জন্য ছুটি চেয়েছি। একাধিক মন্ত্রী বলেন, আমি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাব। অক্টোবরের ১৪ তারিখ, যখন আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই- তখন একটি প্রকাশ্য বিবৃতিতে আমি পরিস্থিতি স্পষ্ট করার চেষ্টায় একটি বিবৃতি দেই যে, আমি অসুস্থ নই এবং আমি চিরকালের জন্য দেশ ছেড়ে যাচ্ছি না। আমি আশা করছিলাম যে, আমার প্রত্যক্ষ অনুপস্থিতি এবং আদালতের নিয়মিত ছুটি- এ দুটো মিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সহায়ক হবে এবং শুভবুদ্ধির উদয় হবে। সরকার ওই রায়ের যে মর্মবস্তু অর্থাৎ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যে জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর, তা বুঝতে পারবে। শেষ পর্যন্ত ভীতি প্রদর্শন এবং আমার পরিবারের প্রতি হুমকির সম্মুখীন হয়ে আমি বিদেশ থেকে আমার পদত্যাগপত্র জমা দেই।’

উল্লেখ্য যে, গত বছর এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে জুডিশিয়ারীর উপর সরকারের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দেশ ত্যাগ ও পদত্যাগের বিষয়টি উল্লেখ করে এই সংস্থাটি বলে বাংলাদেশে মানবাধিকার কর্মীগণ প্রয়শই সরকারের হাতে হয়রানীর শিকার হচ্ছেন এবং তাদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছে। জোর করে গায়েব করাও অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে টরন্টো স্টার এর এক প্রশ্নের জবাবে অটোয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মিজানুর রহমান বলেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহার অভিযোগ সত্যি নয়। সাবেক এই প্রধান বিচারপতি দেশ ত্যাগের পর থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে আসছেন। রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, দেশে ফিরার বিষয়ে সুরেন্দ্র কুমার একেবারেই কোন হুমকির মধ্যে নেই। তিনি এই সকল অভিযোগ করে আসছেন তার রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার বিষটি জোরদার করার জন্য।