‘ওরা অর্থনৈতিক সন্ত্রাসী ছাড়া কিছু নয়’

কানাডা রেভিনিউ এজেন্সীর নাম করে টেলিফোন স্ক্যাম বিষয়ে ৬০ হাজার কানাডীয়র অভিযোগ

নভেম্বর 4, 2018

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : সম্ভবত আপনিও এধরণের টেলিফোন কল পেয়ে থাকবেন। স্বয়ংক্রিয় একটি মেসেজে ট্যাক্স অনাদায়ের কারণে আপনাকে গ্রেফতারের ভয় দেখানো হচ্ছে। সেই নম্বরে কলব্যাক করলে কেউ একজন নিজেকে কানাডার রেভিনিউ এজেন্সির এজেন্ট পরিচয় দিয়ে আপনাকে আবারও ভয় দেখাবে।

তারা খুব কম অর্থ, মাত্র ৭০০ ডলার পর্যন্ত দাবি করতে পারে আপনার কাছে – যদিও অনেককে এক লাখ ডলার পর্যন্ত তাদের হাতে তুলে দিতে হয়েছে।

গত পাঁচ বছরে অন্তত ৬০ হাজার কানাডীয় এধরণের ফোন চক্রের টার্গেট হওয়ার অভিযোগ করেছেন। ওই একই সময়ে এই প্রক্রিয়ায় এক কোটি ডলারের বেশি অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে এটি হয়ে উঠেছে কানাডার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাইবার কেলেঙ্কারির ঘটনা। ভারতের শীর্ষস্থানীয় সাইবার অপরাধ অনুসন্ধানী রিতেশ ভাটিয়া বলেন, “ওরা অর্থনৈতিক সন্ত্রাসী ছাড়া আর কিছু নয়। এটি এক বিরাট চক্র, একটি বিরাট শিল্প।” সিবিসি নিউজে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় সম্প্রতি।

কারা এই কেলেঙ্কারির শিকার?

জাহাঙ্গীর রশিদী (৬৩) তার সারা জীবনের সঞ্চয় এক লাখ ১০ হাজার ডলার এই চক্রের খপ্পরে পড়ে খুইয়েছেন।

এই কেলেঙ্কারির শিকার হয়ে রশিদী এখন খুবই বিব্রত। কিন্তু যখন এই ঘটনা ঘটে তখন তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, সরকারের কোনও লোক ফোন করে একজন নাগরিককে হুমকি দিচ্ছে। তার নিজ দেশ ইরানে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে।

সম্ভাব্য শিকারদের বেশিরভাগই এধরণের কল পেলে তা উপেক্ষা করেন এবং কখনই কলব্যাক করেন না। কিন্তু এই চক্রের হোতারা মানুষকে ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের সম্মত করাতে নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করে। তারা টার্গেট করা ব্যক্তির হিসাব রক্ষক হিসাবে পরিচয় দেওয়া থেকে শুরু করে কখনও এমন প্রযুক্তিও ব্যবহার করে যাতে লোকটি তার ফোন কল উপেক্ষা করতে না পারে।

কানাডায় এধরণের চক্রের কাছে সবচেয়ে নাজুক হলেন নতুন আসা অভিবাসী এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা।

সম্প্রতি ভারতের নয়াদিল্লিতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে একদল প্রতারককে গ্রেফতার করে। ছবি : গ্রেনোনিউজ.কম

চক্রটি কীভাবে কাজ করে?

রবোটিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কানাডীয়দের সেল ফোন বা ল্যান্ডফোনে কল করা হয় এবং স্বয়ংক্রিয় একটি মেসেজ দিয়ে কলব্যাক করতে বলা হয়। যারাই কলব্যাক করেন তাদেরকেই বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেওয়া হয়। তাতে গ্রেফতার, চাকরি খোয়ানো, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এমনকি তাদের সন্তানদের তুলে নেওয়ার হুমকিও থাকে।

তবে একইসঙ্গে তারা খুব দ্রুত লোকটিকে জরুরীভিত্তিতে কিছু অর্থ ও রেয়াতসহ জরিমানা দেওয়ার শর্তে সাহায্য করারও প্রস্তাব দেয়। এ জন্য তারা প্রায়শ এক হাজার ডলারের মত অর্থ দাবি করে।

কেউ যখন অর্থ দিতে সম্মত হয় তখন কলটি অন্য একজনের কাছে স্থানান্তর করা হয়। সেই লোকটিও আগের মতোই হুমকি ধমকি দিতে থাকে এবং অর্থ কোথায় কীভাবে পাঠাতে হবে তার নির্দেশনা জানিয়ে দেয়। এই বিস্তারিত নির্দেশনা এমনভাবে দেওয়া যাতে এমন সন্দেহ জাগে যে, লেনদেনটি হচ্ছে কোনও ব্যাংকের সঙ্গে।

টরন্টো এলাকার একজন বাসিন্দার সঙ্গে ঠিক এমনটাই ঘটেছিলো। আমরা তাকে জো নামে ডাকবো।

সিবিসি তার নাম-পরিচয় গোপন করছে কারণ তিনি উদ্বিগ্ন একথা ভেবে যে, এটা প্রকাশ পেলে তার চাকরিদাতা তাকে এমন একটি ভুলের জন্য দোষারোপ করবে যাতে তার ক্ষতি হয়েছে ৩৬,৬০০ ডলার।

তিনি বলেন, “আমি এদেশে আসার পর থেকেই অর্থ সঞ্চয় করতে থাকি। প্রায় ২৮ বছর ধরে এটা করছি।”

ফোনকল চক্রের লোকেরা তাকে কল করে বলে যে, তিনি ট্যাক্স সম্পর্কিত একটি ঝামেলার মধ্যে রয়েছেন এবং তারা তাকে এ থেকে উদ্ধার পেতে সাহায্য করতে পারে যদি তিনি দ্রুত সাড়া দেন।

জো-কে তার সব অর্থ তুলে নিয়ে একটি বিটকয়েন যন্ত্রে জমা করতে বলা হয়। জো তার সব ব্যাংকের শাখায় গিয়ে সব অর্থ তুলে নিয়ে আসেন এবং ফোনকলের নির্দেশনা মত বিশেষ স্থানে জমা করে দেন। অর্থ দিয়ে দেওয়ার পর ফোনের অন্যপ্রান্তের লোকেরা হেসে ওঠে এবং লাইন কেটে দেয়।

চক্রের লোকজন

যারা এই চক্রের হয়ে কাজ করে তারা তরুণ এবং সাধারণত তাদের বয়স ২০ বছরের মত। এদের পেছনে রয়েছে মুম্বাইয়ের বৈধ কলসেন্টারের বয়স্ক ব্যক্তিরা। এসব কলসেন্টারে কাজ করতে হলে ইংরেজি ভাষাজ্ঞান এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মানুষের মনমানসিকতা বোঝার ক্ষমতা থাকা অপরিহার্য।

এখানে উপার্জনের সম্ভাবনা প্রচুর

কখনও এক রাতের মধ্যেই আপনার সারা মাসের আয়ের সমান অর্থ উপার্জন করা সম্ভব হতে পারে। একজন কানাডীয়র মনে কোনওরকম সন্দেহের উদ্রেক না করে আপনি যত বেশি অর্থ চুরি করতে পারবেন ততই বেশি অর্থ আপনি নিজের ঘরে নিয়ে যেতে পারবেন।

একটি কলসেন্টারের সাবেক কর্মী যিনি পরে এদের কর্মকা- ফাঁস করে দিয়েছেন সেই জয়েস দুবে এমন চক্র থেকে লাভবান হয়েছিলেন। তিনি বলেন, “এখানে বিপুল অর্থ পাওয়া সম্ভব। আমি অন্য কোথাও এত অর্থ আয় করতে পারতাম না।”

যারা এসব চক্রের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন তাদের কাছে এটা বিশেষভাবে লোভনীয়। এমনই এক ব্যক্তি সাগর থাক্কার ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে ব্যক্তিগত বিমান কিনেছিলেন।

আমেরিকার নাগরিকদের টার্গেট করে অভ্যন্তরীণ রেভিনিউ সার্ভিসের নামে একই ধরণের একটি প্রতারণার ঘটনা জানার পর মার্কিন কর্তৃপক্ষের অনুরোধে পরিচালিত এক অভিযানে সাগর থাক্কার গ্রেফতার হন। ওই অভিযানে শত শত লোক গ্রেফতার ও মামলার মুখোমুখি হন।

‘প্রতারণা একটি বৈশ্বিক সমস্যা’

ভারতের পুলিশ বলছে যে, তারা একই ধরণের দমন অভিযান চালাতে প্রস্তুত তবে সেজেন্য কানাডার পুলিশকে প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের সম্পর্কে এবং প্রতারক চক্রের বিষয়ে প্রাপ্ত সব তথ্য দিতে হবে।

ভারতের পুলিশ কমিশনার পরম বীর সিংহ বলেন, তিনি কানাডীয়দের প্রতারণার কথা তখনই জানতে পারেন যখন তিনি নিজে আরসিএমপির ওয়েবসাইটে ঢুকে সেখানে এ বিষয়ক একটি পোস্ট দেখতে পেয়েছেন। ঈইঈ গধৎশবঃঢ়ষধপব এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “কানাডা থেকে কেউই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এমনটা তো ঠিক নয়।”

তবে পরে জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী র‌্যাল্ফ গুডেল-এর দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, সিআরএর কাছে সাইবার প্রতারণার অভিযোগ নিয়ে আরসিএমপি ‘অতি অবশ্যই’ ভারতীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয়, আরসিএমপি ভারতে যাদের সঙ্গে কাজ করছে মি. সিংহ তাদের একজন নন।

কানাডার কেন্দ্রীয় পুলিশ সংস্থা আরও জানায়, এ ধরণের অপরাধ মোকাবিলার ‘সবচেয়ে ভাল উপায়’ হচ্ছে প্রতিরোধ। “কানাডার নাগরিকদের প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো জনসচেতনতা।”

সিআরএর ওয়েবসাইটে একটি সতর্কবার্তা দেওয়া আছে যে, তারা কোনও নাগরিকের কাছে ব্যক্তিগতভাবে কোনও ফোনকল করবে না। আর সংস্থার এজেন্টরা কখনও করদাতাদের সঙ্গে আগ্রাসী ভাষায় কথা বলবে না বা গ্রেফতারের ভয় দেখাবে না। সিআরএর পরামর্শ, কোনও ফোনকল সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিলে সেটা নামিয়ে রাখুন, অনলাইনে আপনার অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করুন অথবা ১-৮০০-৯৫৯-৮২৮১ নম্বরে সংস্থার কাছে কলব্যাক করুন।

এদিকে গত ৩০ অক্টোবর সিবিসি নিউজে প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জানা যায় এ মাসের শেষ দুই সপ্তাহে ভারতীয় পুলিশ এই প্রতারকদের বিভিন্ন আস্তানায় অভিযান চালায়। অভিযান পরিচালনা করার সময় তারা বেশ কিছু প্রতারককে গ্রেফতার করে এবং তাদের প্রতারণা কার্যক্রমে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিও আটক করে।

নয়া দিল্লির নয়দিয়া পুলিশ স্টেশনের প্রধান অজয় পাল শর্মা বলেন, এটি শুরু মাত্র। আরো অভিযান চলবে এই প্রতারকদের বিরুদ্ধে।

অভিযানে ইতিমধ্যে যারা গ্রেফতার হয়েছেন তারা প্রায় সবাই যুবক বয়সী। ভারতীয় নিরাপত্তা পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাস এই প্রতারক চক্রের সঙ্গে কোন কোন পুলিশ কর্তার যোগসাজস থাকে পারে। পুলিশ কর্তৃক ঘুষ খাওয়া ভারতে অস্বাভাবিক ঘনাটা নয়।