কানাডায় পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে নতুন উদ্যোগ নেয়া অত্যন্ত জরুরী

মে ৫, ২০১৯

রবার্ট হুইটলে

কানাডার সাইকিয়াট্রি জার্নালের সাম্প্রতিক এক সংখ্যায় পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে তিন তিনটি নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে। নিবন্ধগুলোতে যেসব তথ্য ও পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে তা দুঃখজনক। কানাডার মানসিক স্বাস্থ্য অ্যাসোসিয়েশনসহ অনেক ভাষ্যকার এমন উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি একটি নিরব সঙ্কট।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কানাডায় প্রতি সপ্তাহে ৫০ জনের বেশি পুরুষ আত্মহত্যা করে মারা যায়। তার মানে হলো দেশটিতে প্রতি সপ্তাহে যত মানুষ আত্মহত্যা করে তাদের শতকরা ৭৫ জনই পুরুষ। একইভাবে ১০ লাখের বেশি কানাডীয় পুরুষ মাদকাসক্তিতে ভুগছে। আবার ফেনটানিল ও আফিম জাতীয় দ্রব্যের অতিরিক্ত সেবনে মারা যাওয়া লোকেদের মধ্যে শতকরা ৮০ জনই পুরুষ।

এভাবে পুরুষদের নির্দিষ্ট বয়স গ্রুপের লোকেদের মধ্যে সুস্পষ্টভাবেই মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা রয়েছে। যেমন বালকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে রয়েছে মনোযোগের ঘাটতিজনিত সমস্যা যা তাদেরকে স্কুল থেকে ঝরে পড়া এবং নতুন করে শুরু করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে। গে হিসাবে চিহ্ণিত মানুষদের মধ্যে নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা সামঞ্জস্যহীনভাবে বেশি, বয়োবৃদ্ধ পুরুষদের বস্তুর অপব্যবহারের এবং আদিবাসী মানুষদের আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে।

উদ্বেগের বিষয় হলো পুরুষেরা সরকারের মানসিক স্বাস্থ্য সুবিধার খুব সামান্যই ব্যবহার করে। দেখা গেছে, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ হলো পুরুষ। ভিন্নভাবে বললে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কানাডীয় পুরুষ ও বালক বিনা চিকিৎসায় নিরবে ভুগছে, যা ব্যক্তি, পরিবার ও সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনছে।

অনেকে আলোচনা-ভিত্তিক উপশম বা ওষুধ সেবনের পরিবর্তে কর্ম-ভিত্তিক উপশমকে অগ্রাধিকার দেয়

পুরুষদের নির্দিষ্ট বয়স গ্রুপের লোকেদের মধ্যে সুস্পষ্টভাবেই মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা রয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো পুরুষেরা সরকারের মানসিক স্বাস্থ্য সুবিধার খুব সামান্যই ব্যবহার করে। ছবি : গেটি ইমেজ

এই সবকিছুই হচ্ছে কানাডার মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসা-পদ্ধতির বৈচিত্রের অভাবের কারণে। কানাডার মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কেবল ওষুধ সেবন এবং আলোচনা-ভিত্তিক থেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এর বিপরীতে আমার গবেষণায় দেখেছি, অনেক লোকই আলোচনা-ভিত্তিক থেরাপির পরিবর্তে কর্ম-ভিত্তিক উপশমের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়। উদাহরণ হিসাবে বলি, আমার সাম্প্রতিক এক গবেষণায় অংশ নেওয়া এক তরুণ বলেছে যে, মানসিক অসুস্থতার জন্য তাকে যে ওষুধ দেওয়া হয়েছে সেগুলো সেবন করলে তার ভেতরটা শূন্য হয়ে যায়। অন্যদিকে হাইকিং বা মাছ ধরার মতো কাজ নিয়মিত করলে সেগুলি তার মানসিক অবস্থা ভালো রাখতে সাহায্য করে।

এ ধরণের উদ্বুদ্ধকরণ থেকে বোঝা যায় কেন কানাডায় “পুরুষদের ছাউনি” দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পুরুষদের ছাউনিতে বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ মানুষেরা একসঙ্গে রান্না, বাইক মেরামত, কাঠের কাজ এবং অন্যান্য সক্রিয় কর্মকা-ে অংশ নিতে পারে। আর এই সমস্ত কর্মকা-ের মধ্যে তারা অন্য শরিকদের কাছ থেকে সার্বক্ষণিক সান্ত¡না এবং সমর্থন লাভ করেন। প্রাথমিক মূল্যায়নে আভাস পাওয়া গেছে যে, এ ধরণের ছাউনি মানুষের বিচ্ছিন্নতার বোধ হ্রাস করতে এবং ইতিবাচক মানসিক স্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে।

কানাডার পুরুষদের সহায়তায় কী করা যেতে পারে?

কানাডায় পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরিসংখ্যান অন্য দেশেও যেমন যুক্তরাজ্যেও লক্ষণীয়। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের নারী ও সমতা বিষয়ক কমিটি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে পুরুষ ও বালকদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি সমীক্ষা চালু করেছে। এটি একটি খুবই প্রয়োজনীয় ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যা সব দল ও জনগণের সমর্থন লাভ করেছে।

এই সমীক্ষায় পুরুষ ও বালকদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব সৃষ্টিকারী সবচেয়ে গুরুতর বিষয়গুলো চিহ্ণিত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু কঠোর প্রশ্ন উত্থাপন করবে। যেমন,  কোন বয়স শ্রেণির পুরুষ ও বালকেরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরকারের বর্তমান স্বাস্থ্যনীতি কতটা কার্যকর।

কানাডায় এ ধরণের কোনও সমীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা সরকারের নেই, অবশ্য নিকট ভবিষ্যতে তা পাল্টাতে পারে। এজন্যেই আমি কানাডার কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানাই অনুরূপ একটি তদন্ত শুরু করার।

এ ধরণের তদন্ত শুরুর জন্য কানাডার নারীদের অবস্থা জানার জন্য ১৯৬৭-১৯৭০ সালে রয়াল কমিশনের তদন্ত থেকে অনুপ্রেরণা আসতে পারে। ওই তদন্তে নারীদের অসংখ্য অমীমাংসিত ইস্যু উদ্ঘাটনের জন্য ব্যাপকভিত্তিক আলাপ-আলোচনা এবং জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়। এতে করে অনেকগুলি ধারাবাহিক সুপারিশমালা প্রণীত হয় যার মধ্যে কানাডায় নারীর মর্যাদা সম্পর্কিত আইন প্রণয়নের (মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার) বিষয়টিও ছিলো। এর মাধ্যমে পরে সমাজে নারীর অগ্রগতি নিশ্চিত করতে অনেকগুলি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়।

এই সমীক্ষা কানাডায় পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্নগুলোর জবাব বের করে আনতে পারে। ব্রিটিশ সরকারের তদন্তের মতই এটি পুরুষ ও বালকদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী সামাজিক উপাদানগুলো উদ্ঘাটন করতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কিভাবে আরও আবেদনময় করে তোলা যায় সেই উপায় বাতলে দিতে পারে।

একটি নতুন উদ্যোগ

পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে একটি নতুন উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ বর্তমান উদ্যোগে কার্যত এপিএর মতো সংগঠনের প্রাধান্য  রয়েছে যে সংগঠনটি পুরুষ ও পুরুষত্ব বিষয়ে অনেকটা সংশয়দুষ্ট ও  সাংঘর্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।

পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে আমাদের একটি উদ্ভাবনীমূলক চিন্তাধারা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। আর এটা হতে পারে আলোচনার টেবিলে ভিন্নভিন্ন মতের উপস্থাপনের মাধ্যমে আর সেটা সম্ভব সরকারিভাবে তদন্ত কার্যক্রম চালানো হলে। জাতিগত পরিচয় ও পেশাদার গ্রুপসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের বক্তব্য শুনতে হবে। সূক্ষè পার্থক্যগুলো আবিষ্কার করতে হবে এবং এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটাতে হবে।

পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিতর্কে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় নিয়েই আলোচনা হতে হবে

এক্ষেত্রে মনস্তত্ত্ববিদ এবং মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের অবশ্যই ভূমিকা রাখতে হবে তবে একইসঙ্গে সমাজের অন্যান্য শরিকেদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। এর মধ্যে থাকবেন জাতীয় নেতা, প্রবীণ সংগঠন, শিক্ষাবিদ, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কর্মরত সংগঠনগুলো এবং পুলিশ/প্রাথমিক সাড়া দানকারীদের প্রতিনিধি। এইসব সংগঠনের অনেকগুলিই পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময় অনুপস্থিত ছিলো; বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিত্তিক নতুন ধারণা যোগ করার জন্য কেবল গালভরা মন্তব্যের চাইতে এইসব সংগঠনের বক্তব্য শোনা জরুরী।

এই বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় আলোচনায় আসতে হবে এবং পুরুষত্ব থেকে শুরু করে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী সামাজিক উপাদান পর্যন্ত সব বিষয়ে ব্যাপকতর আলোকপাত করতে হবে। এতে অবশ্যই বিভিন্ন খাতওয়ারি উদ্যোগ নিতে হবে, যেসব বিষয়ে অনুসন্ধান চালাতে হবে তার মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, গ্রামীণ অর্থনীতি, বৃত্তি সম্পর্কিত বিষয়, পারিবারিক আইন এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো বিষয়।

পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন একটি স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের বিষয় এবং একটি সুষ্ঠু ও ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজের জন্য জরুরী। আর সেজন্যেই আমি একটি তদন্ত করার বিষয়টি উত্থাপন করেছি।

রবার্ট হুইটলে, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, সাইকিয়াট্রি, ম্যাক্গিল ইউনিভার্সিটি

-সিবিসি নিউজ।