কানাডায় এখন যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি মানুষ একা থাকে

গত ৩৫ বছরে এক-ব্যক্তির পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি

এপ্রিল 8, 2019

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : নিঃসঙ্গ কানাডীয়র সংখ্যা গত ৩৫ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে এবং এর ফলে কানাডায় এক ব্যক্তির পরিবার সবচেয়ে সাধারণ ধারা হয়ে উঠেছে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার নতুন এক রিপোর্টে এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।

সর্বশেষ আদমশুমারি এবং ২০১৭ সালের পরিবার সম্পর্কিত সাধারণ সামাজিক সমীক্ষার তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে প্রণীত স্ট্যাটসক্যান রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, এক ব্যক্তির পরিবার শ্রেণিটি এখন দম্পতি ও শিশুসহ পরিবার এবং শুধু দম্পতির পরিবার শ্রেণির চেয়েও বৃহত্তর। খবর সিবিসি নিউজের।

যেখানে একসময় এটি ছিলো বিধবা নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা একা বসবাস করতো, সেটি এখন অনেক বিচিত্র লোকদের জন্য প্রযোজ্য। রিপোর্টের অন্যতম সহযোগী লেখক এবং স্ট্যাটসক্যান-এর জনমিতি বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তা নোরা গ্যালব্রেইথ বলেন, “গত কয়েক দশক ধরে আমরা যেটা দেখে আসছি সেটা হলো, একা বসবাসকারী মানুষের দ্রুত বর্ধনশীল বয়স গ্র“পদের গ্র“প যাদের বয়স ৩৫-৬৪ বছর।”

১৯৮১ সালে এই বয়স গ্র“পের মাত্র আট শতাংশ মানুষ একা বসবাস করতো। কিন্তু ২০১৬ সালের মধ্যে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে। গ্যালব্রেইথ বলেন, ওই বয়স গ্র“পের একা থাকা পুরুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ওই বৃদ্ধি ঘটেছে।

নিঃসঙ্গ কানাডীয়র সংখ্যা গত ৩৫ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে এবং এর ফলে কানাডায় এক ব্যক্তির পরিবার সবচেয়ে সাধারণ ধারা হয়ে উঠেছে। ছবি : সিবিসি নিউজ

পুরুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কানাডায় অকারণ বিবাহ-বিচ্ছেদের ব্যাপকতা বেড়ে যাওয়াটাও সব বয়স গ্র“পের লোকেদের মধ্যে এক ব্যক্তির পরিবার সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। গ্যালব্রেইথ বলেন, “সম্বন্ধ ভেঙ্গে যাওয়ার হার বৃদ্ধির মধ্যে এই প্রবণতার আংশিক প্রতিফলন দেখা যায়, যা গত কয়েক দশক ধরে দৃশ্যমান। আমরা জানি যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সেপারেশন বা বিবাহ-বিচ্ছেদের কারণে যৌথভাবে বাচ্চাদের দেখাশোনার বিষয়টি বাড়লেও এটাই বাস্তবতা যে, সেপারেশন বা বিচ্ছেদের পর সন্তানদের প্রাথমিক আশ্রয় হয় মায়ের সঙ্গেই। তার মানে হলো, কিছুদিনের জন্য হলেও বাবাদের একা থাকার সম্ভাবনা বেশি।”

পারিবারিক কাঠামোর ব্যাপারে অধিকতর নমনীয় মনোভাব

গ্যালব্রেইথ বলেন, মানুষের একা থাকার বিষয়টিকে আরও বেশি সাধারণ ঘটনায় পরিণত করেছে অসংখ্য সামাজিক পরিবর্তন। উদাহরণ হিসাবে ধরুন তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের কথা যাদের বয়স ২০ বা ৩০-এর কোঠায়। “আমরা এখন আর একটি সমাজ হিসাবে বিয়ের সঙ্গে বয়োপ্রাপ্তির বিষয়টিকে মেলাই না। বিশেষ করে যখন আরও বেশি সংখ্যক তরুণ উচ্চতর শিক্ষার পেছনে ছুটছে।”

দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, একা থাকা ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে ৭৭ শতাংশই কলেজ পাশ করা। সেই তুলনায় অন্য কারো সঙ্গে থাকা ওই একই বয়সের মেয়েদের কলেজের ডিগ্রি আছে ৬৭ শতাংশের। এটি হলো রিপোর্টের তথ্য। আর গ্যালব্রেইথ বলেন, রোমান্টিক সম্পর্ক স্থাপন ও বিলম্বে সংসার গড়ে তোলার সঙ্গে উচ্চতর শিক্ষার পারস্পরিক সম্পর্ক আছে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, যারা একা থাকে তারা দীর্ঘ সময় ধরে একা থাকতে চায় না। গ্যালব্রেইথের ভাষায়, “বেশিরভাগ লোক ভবিষ্যতে কারো সঙ্গে সম্বন্ধ গড়ে তুলতে ইচ্ছুক। এথেকে বোঝা যায় একা থাকাটা তাদের কাছে শুধুই ভবিষ্যতের পথে একটি পা রাখার জায়গা ।

অলাভজনক গবেষণা কেন্দ্র ভ্যানিয়ের ইনস্টিটিউট অব দ্য ফেমিলির সিইও নোরা স্পিঙ্কস বয়স গ্র“পের লোকেদের জীবনযাত্রার প্রবণতা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, রিপোর্টে যেসব তথ্য বেরিয়ে এসে তাতে তিনি মোটেও বিস্মিত নন। তিনি বলেন, “পুরুষ বা নারী কারোরই একজন সঙ্গী থাকাটা জরুরী বা প্রত্যাশিত কোনওটাই নয়, তাই কেউ কেউ সঙ্গী না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং একা থাকছে।”

তবে যারা একা থাকছে তাদের প্রত্যেকেই যে রোমান্টিক সম্পর্কের বাইরে রয়েছে ব্যাপারটা এমনও নয়। অনেকেই আছেন যারা বর্তমানে কথিত ‘একসঙ্গে আলাদা থাকা’ যেটাকে ইংরেজিতে বলা হচ্ছে লিভিং অ্যাপার্ট টুগেদার (এলএটি) সেইরকম সম্পর্কে জড়িয়ে একা থাকছেন অর্থাৎ তিনি কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িত কিন্তু একসঙ্গে বসবাস করছেন না।

রিপোর্টে বলা হয়, ২০ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে যাদের বয়স তাদের এক-তৃতীয়াংশই এখন এই নতুন ধরণের সম্পর্ক ল্যাট-এ জড়িত। আর ৩৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যবয়সী প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ২০ শতাংশ এ ধরণের সম্পর্ক রক্ষা করেন।

স্পিঙ্কস বলেন, সব ধরণের পরিস্থিতিতেই ল্যাট-এর সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। বিয়ে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া দম্পতি যারা প্রতি সপ্তাহান্তের দিনটি তাদের সন্তানের সঙ্গে কাটান তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন অন্য কাউকে সঙ্গী হিসাবে নিজের ঘরে না নেওয়ার। অর্থাৎ তারা আলাদা বাড়িতে বসবাস করেও নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখলেন। আবার এমন দম্পতিও আছে যারা ভিন্ন ভিন্ন শহরে বাস করেন।

স্পিঙ্কস বলেন, “ওই ধরণের সম্পর্কে যারা জড়িত তাদের সবাইকে এক-ব্যক্তির পরিবার হিসাবেই সমীক্ষার তথ্যে দেখানো হয়।”

ব্যবসায়ের সুযোগ

বয়সভিত্তিক জনমিতির ওপর বিশেষজ্ঞ হ্যালিফ্যক্স-এর ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় ও অর্থনীতির প্রফেসর এডি এনজি ১০ বছর ধরে ল্যাট সম্পর্কে জড়িত ছিলেন। তার সঙ্গীনী ছিলেন নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত এবং তিনি টরন্টোতে বাস করতেন। মি. এনজি এমন কোনও চাকরিতে যেতে বাধ্য ছিলেন যেখানে তার পদোন্নতির এবং চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। এজন্যে তিনি প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় এবং সেটা যাতায়াতের জন্য খুব বেশি দূরে মনে হওয়ায় পরে কানাডার ইস্টকোস্টে চাকরি নিয়ে চলে আসেন।

একা থাকার ব্যাপারটা তাকে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসার সুযোগ সম্পর্কে ভাবার অবকাশ দেয় আবার সঙ্গীনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকার প্রবণতায়ও তিনি যথেষ্ট চৌকস।

তিনি বলেন, একা থাকা মানুষেরা অপেক্ষাকৃত ছোট, অধিকতর জ্বালানি-দক্ষ সরঞ্জাম কিনতে চায় এবং বাসস্থানের কাছাকাছি পাওয়া যায় এমন সেবা পেতে আগ্রহী হয়। তাঁর ভাষায়, “আপনার শ্রম ভাগাভাগির সুবিধা নেই, সুতরাং অনেককেই পয়সা দিয়ে অন্যের সহায়তা কিনে নিতে হয়।”

এক-ব্যক্তির সংসারের ব্যাপক বিস্তৃতির ফলে বরফ পরিস্কার করা, বাড়ির নিরপত্তা এবং পোষা প্রাণির দেখাশোনার মত সেবাদানকারীরা সবাই লাভবান হচ্ছে।

মি. এনজি বলেন, পর্যটন শিল্পেও এখন এই প্রবণতা চালু হচ্ছে- দু’জনের হিসাবে যেসব সার্ভিসের চার্জ নেওয়া হতো সেগুলোতে এখন একা ভ্রমণকারীর জন্য আরও যৌক্তিক চার্জ নেওয়া হচ্ছে।

সাধ্যের মধ্যে আবাসন

একা থাকা লোকেদের জন্য আবাসন সুবিধা দেওয়ার ব্যবসাটা অনেক ভালো একটি সুযোগ। গ্যালব্রেইথ বলেন, “সমীক্ষায় উঠে আসা একটি তথ্য হলো, যারা একা থাকে তাদের সাধ্যের মধ্যে আবাসন সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।”

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, একা থাকা লোকেদের প্রতি পাঁচজনে একজন কন্ডোতে থাকে। তবে উল্লেখযোগ্য যে, এদের মধ্যে ৪১ শতাংশ মানুষের মাসিক আবাসন ব্যয় তাদের মাসিক আয়ের ৩০ শতাংশের বেশি। আয়ের ৩০ শতাংশ আবাসন ব্যয় হলো সাধ্যের মধ্যে আবাসনের একটি মানদন্ড। পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায়, আবাসন সুবিধা এর চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এগুতে পারেনি।

গ্যালবেইথ বলেন, দীর্ঘকাল ধরে একা বসবাসকারী বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সহায়ক সেবাদানকারী এবং অবসরের পর আবাসনের সুবিধা দানকারীরা তাৎক্ষণিক ভালো ব্যবসা করে নিচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে একা থাকা লোকদের জন্য প্রয়োজনীয় সেবামূলক সার্ভিসের পরিমাণ বাড়বে বলেই মনে হয়।

গ্যালব্রেইথ বলেন, “আমি আবারও বলতে চাই যে, এরা হচ্ছে এমন এক জনগোষ্ঠী যারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিন দিন আরও বৈচিত্রপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং তাদের চাহিদা, তাদের ভোগ্যপণ্য, তাদের অগ্রাধিকার ইত্যাদি সবই আরও বেশি বহুমুখি হয়ে উঠছে।”