পারিবারিক ‘বঞ্চনা’ মামলায় ফোর্ড, কে হবেন অন্টারিও প্রিমিয়ার?

জুন ৫, ২০১৮

পিসি নেতা ডাগ ফোর্ডের বিরুদ্ধে সাড়ে ১৬ মিলিয়ন ডলারের পারিবারিক ‘বঞ্চনা’র মামলা রুজু । ছবি : টরন্টো স্টার

৭ জুন অন্টারিও প্রাদেশিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন লিবারেল প্রিমিয়ার ক্যাথলিন ওয়েনের আগাম পরাজয় স্বীকার এবং সর্বশেষ প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ ‘পিসি’ নেতা ডগলাস ‘ডাগ’ ফোর্ডের বিরুদ্ধে সাড়ে ১৬ মিলিয়ন ডলারের পারিবারিক ‘বঞ্চনা’র মামলা রুজু হওয়ায় নিউ ডেমোক্রেটিক ‘এনডিপি’ নেত্রী এন্ড্রিয়া হরওয়াথ কী অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রিমিয়ার হচ্ছেন? আপাতদৃষ্টিতে এই প্রশ্নের উত্তরটি সহজবোধ্য হলেও নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি কল্পনাতীতভাবে দ্রুত পাল্টে যাওয়ায় এখন দুই দিনের ব্যবধানে তা আর নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কেননা ক্যাথলিন ওয়েন ও এন্ড্রিয়া হরওয়াথ উভয়েই ডগলাস ফোর্ডের বিষয়ে সুগভীর সতর্কতার কথা ব্যক্ত করেছেন।
এতে সর্বশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্টারিও প্রদেশের রাজধানী টরন্টো থেকে প্রকাশিত দৈনিক টরন্টো স্টার, টরন্টো সান, গ্লোব অ্যান্ড মেইল, ন্যাশনাল পোস্টসহ জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম সিবিসি-তে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাতে সেখানে ডগলাস ফোর্ডের বিরুদ্ধে রুজুকৃত মামলার শিরোনামগুলো সাধারণ ভোটারদের জন্য রীতিমত আতঙ্ক জাগানো।
দেখা যাচ্ছে, টরন্টো স্টারের শিরোনাম ‘রব ফোর্ডস উইডো সুজ ডাগ ফোর্ড, অ্যালেজিং হি হ্যাজ ডিপ্রাইভড্ হার অ্যান্ড হার চিলড্রেন অব মিলিয়নস’। অর্থাৎ ডাগ ফোর্ডের বিরুদ্ধে রব ফোর্ডের বিধবা পতœীর মামলা, অভিযোগ তিনি এবং তার সন্তানেরা লাখো ডলার থেকে বঞ্চিত। টরন্টো সানের শিরোনাম ‘ডাগ ফোর্ড এমব্রোয়েল্ড ইন ফ্যামিলি ফিউড ওভার ব্রাদার্স এস্টেট’। অর্থাৎ ভাইয়ের সম্পত্তির পারিবারিক দ্বন্দ্বে ডাগ ফোর্ড জড়িয়ে পড়েছেন। গ্লোব অ্যান্ড মেইলের শিরোনাম ‘ল্যাটেস্ট কন্ট্রোভার্সি টু হিট ডাগ ফোর্ড কুড বি দ্যা মোস্ট ড্যামেজিং’। অর্থাৎ সর্বশেষ বিতর্ক ডাগ ফোর্ডকে ডোবাবে। আর সিবিসি’র শিরোনাম ‘পিসি লিডার ডাগ ফোর্ড ফ্যাসেজ ল’স্যুট অ্যালেজিং মিলিয়নস উইথহেল্ড ফ্রম ল্যাট ব্রাদার্স ফ্যামিলি’। অর্থাৎ লাখো ডলারের বঞ্চনায় আইনি মামলার মুখোমুখি পিসি নেতা ডাগ ফোর্ড।
পাঠক, চোখ বন্ধ করে ভাবুন, পশ্চিমা বিশ্বে পারিবারিকভাবে অভিযুক্ত এমন একজন দলীয় নেতা আপনার সামগ্রিক ভোটের ফলাফলে অন্টারিও প্রদেশের প্রিমিয়ার হওয়ার ক্ষেত্রে জনমত জরিপে এগিয়ে ছিলেন! এক্ষেত্রে ওই জরিপের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী এন্ড্রিয়া হরওয়াথ বলেন, ভোটারদের ভাবা উচিত ৬ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুত ‘কর্মক্ষম’ প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ সরকারের আমলে তাদের কি হাল হতে পারে? তাদের ভাবা উচিত, আসছে শুক্রবার থেকে ডাগ ফোর্ড ক্ষমতায় বসলে কেমন দিন কাটবে? তিনি বলেন, অন্টারিওর মানুষ তা নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করে না। তার কথা, ফোর্ডের প্রার্থী তালিকার কমপক্ষে ১০ জনের বিরুদ্ধে নানা ধরণের তদন্ত চলছে এবং সেগুলো অন্টারিওবাসীর জন্য অশান্তিময়। অন্যদিকে, ক্যাথলিন ওয়েন সতর্কতার সুরে বলেন, কল্পনাতীতভাবে এই নির্বাচনে ডাগ ফোর্ড সত্যিকার অন্তরায় হিসেবে দেখা দিয়েছেন। তার মতে, প্রদেশব্যাপী হাজারো কনজারভেটিভ সমর্থক সত্যিকারার্থে ডাগ ফোর্ডকে বিশ্বাস করে না। তাই কল্পনাতীতভাবে এই নির্বাচনের বাস্তবতাটি ভিন্নতর।

প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ ‘পিসি’ নেতা ডগলাস ‘ডাগ’ ফোর্ডের বিরুদ্ধে সাড়ে ১৬ মিলিয়ন ডলারের পারিবারিক ‘বঞ্চনা’র মামলা রুজু ।   ছবি : টরন্টো স্টারপিসি নেতা ডাগ ফোর্ডের বিরুদ্ধে সাড়ে ১৬ মিলিয়ন ডলারের পারিবারিক ‘বঞ্চনা’র মামলা রুজু । ছবি : টরন্টো স্টার

বাস্তবে এসব কথার বাইরে ভিন্নতাটি অন্যত্র। সেক্ষেত্রে সুখবরটি হচ্ছে, পথ্যপরিসেবা (ফার্মাকেয়ার), দন্ত চিকিৎসা ও শিশুপরিচর্যার মতো গুরুত্ববহ সামাজিক নীতিমালাগুলো এ নির্বাচনে জোরালোভাবে উচ্চারিত হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত। দুঃসংবাদটি হচ্ছে, প্রতিটি দলেরই প্রতিশ্রুত কর্মপরিকল্পনা সুবিন্যস্ত নয়, এমনকী প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ দলটি প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা প্রকাশ করেনি। খারাপ সংবাদটি হচ্ছে, এই সুখবর ও দুঃসংবাদের কোনোটিই প্রধান বিবেচ্য নয়, বিবেচ্য বিষয়ের মাঝে নীতিমালার পরিবর্তে ব্যক্তিত্বের লড়াইটি-ই মুখ্য।
তথাপি এই নির্বাচনে ভাল ও মন্দের মাঝে পাঁচটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে- জ্বালানি, পরিবেশ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জবাবদিহিতা, সামাজিক কার্যক্রম এবং নেতৃত্ব ও জবাবদিহিতা।
জ্বালানি বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদে জনগণ উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে বিদ্যুৎ চায়। এক্ষেত্রে ‘লিবারেল’ লগ্নির মাধ্যমে ২৫ শতাংশ দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ‘পিসি’ সব কিছু ঠিক রেখে ১২ শতাংশ দাম কমাবে। আর ‘এনডিপি’ লগ্নি পরিকল্পনা ছাড়াই উল্লেখযোগ্যভাবে ৩০ শতাংশ দাম কমাবে, তবে তাতে ‘এইচএসটি’ কর লাঘবের কোনো ব্যাখ্যা নেই।
পরিবেশ বিবেচনায় লিবারেলের রয়েছে ‘গ্রীনগ্যাস’ নির্গমণের ক্ষেত্রে ক্যুইবেক ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো বাজারজাতগত ‘ক্যাপ অ্যান্ড ট্রেড’ ভিত্তিক নীতিমালা; এতে প্রতি লিটার বৈদেশিক গ্যাস বা পেট্রলের উপর ৪.৩ সেন্ট আদায় করে বছরে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারকারীদের বিলে ৮০ ডলার ভর্তুকি প্রদান করা হবে। এনডিপি তা মানলেও সমাজকে আরও বেশি কিছু দিতে চায়। অনুরূপভাবে গ্রীন পার্টি সেটি বহাল রাখলেও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানকে কোনো ছাড় দিতে আগ্রহী নয়। তবে পিসি নাকি ওই ‘ক্যাপ অ্যান্ড ট্রেড’ বাতিলসহ সকল প্রদেশের উপর ফেডারেল আরোপিত ‘কার্বন টেক্স’ বাতিল করবে।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে কোনো দলেরই যথাযথ কোনো উদ্যোগ নেই। লিবারেল গত বছর ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট ঘোষণা করতে সক্ষম হলেও পরবর্তী তিন বছরে ফি বছর শিশুপরিচর্যা ও স্বাস্থ্যসেবার কারণে ৬ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি বহাল রাখবে। সেই হিসেবে এনডিপির ব্যয়ভার কম হলেও বছরে ১.৪ বিলিয়ন ডলারের গোঁজামিলের কারণে লিবারেলের অনুরূপ ভর্তুকি অব্যাহত থাকবে। আর পিসি নিজেদের ‘অতি হিসেবি’ দাবি করলেও ডাগ ফোর্ডের রয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের করকর্তন; উপর্যপুরি ওই ৬ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতিকে বলছে ‘অপচয়’। স্বতন্ত্র অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য, ফোর্ডের আর্থিক পরিকল্পনা প্রদেশকে বিপদে ফেলবে।
সামাজিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে লিবারেল ও এনডিপি ‘ফার্মাকেয়ার’ ঘোষণা করলেও মতান্তর রয়েছে। এনডিপি চায় সকলের জন্য আংশিকভাবে প্রায় ১২৫টি পথ্য দিতে এবং লিবারেল চায় অনুর্ধ্ব ২৫ বছর ও ৬৫ বছর ঊর্ধ্ব সকলের জন্য ৪,৪০০টি পথ্য দিতে। এক্ষেত্রে পিসি’র দেবার মতো কিছুই নেই। এছাড়া এনডিপি সকলের দন্ত চিকিৎসা দেবে এবং লিবারেল সকলের জন্য ৪০০ ডলার পর্যন্ত নির্ধারিত সেবা প্রদান করবে। এনডিপি অনুর্ধ্ব ৪০ হাজার ডলার আয়সমৃদ্ধ পরিবারকে আড়াই বছর অবধি শিশুপরিচর্যা প্রদান করবে। এক্ষেত্রে লিবারেল ২.৫ থেকে ৪ বছর অবধি ‘ফ্রি ডে কেয়ার’ প্রদান করবে। আর পিসি’র মাঝারি কর রেয়াত ছাড়া কিছুই নেই।
পরিশেষে, নেতৃত্ব ও জবাবদিহিতায় লিবারেল নেত্রী ক্যাথলিন ওয়েন এবং এনডিপি নেত্রী এড্রিয়া হরওয়াথ উভয়েই স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণভাবে নির্বাচনি প্রচারণায় অসংখ্য সাক্ষাতকার, এমনকী দিনে দুই-তিনটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সে তুলনায় ডাগ ফোর্ড কোনোই বসা সাক্ষাতকার দেননি, বরং শুধুই সমর্থকদের শোরগোলের মাঝে সাংবাদিকদের প্রাত্যহিক ৪-৫টি প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। লক্ষণীয় দিকটি হচ্ছে, এন্ড্রিয়া হরওয়াথ আদর্শিক অবস্থান থেকে কর্মবিরতিগত ধর্মঘট বন্ধে কখনোই কোনো সংসদীয় পদক্ষেপ নেবেন না। অথচ অপরাপর প্রদেশে এনডিপি সরকার জনস্বার্থে কর্মে যোগদানের সংসদীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। এবার ভেবে দেখুন, কাকে ভোট দেবেন এবং কে হবে পরবর্তী প্রিমিয়ার?
ই-মেইল: bukhari.toronto@gmail.com