টরন্টোতে গাড়ি হামলায় নিহতদের স্মরণে শোক সমাবেশ

মে ৫, ২০১৮

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : টরন্টোতে গাড়ি হামলায় নিহতদের স্মরণে গত ২৯ এপ্রিল রবিবার সন্ধ্যায় এক শোক সামাবেশ ও পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, অন্টারিও প্রিমিয়ার ক্যাথলিন উইন, কুইবেক প্রিমিয়ার ফিলিপ কুইলার্ড, টরন্টো মেয়র জন টরি-সহ কয়েক হাজার লোক অংশ নেন।

গত ২৩ এপ্রিল টরন্টোর ইয়ং এবং ফিঞ্চ এভিনিউর নিকট অ্যালেক মিনাসিয়ান (২৫) নামের এক যুবক পথচারীদের উপর ইচ্ছাকৃতভাবে একটি ভ্যান উঠিয়ে দেন। এই ঘটনায় ১০ জন নিহত হন এবং আহত হন ১৫ জন। ছবি: সিবিসি

গত ২৩ এপ্রিল টরন্টোর ইয়ং এবং ফিঞ্চ এভিনিউর নিকট অ্যালেক মিনাসিয়ান (২৫) নামের এক যুবক পথচারীদের উপর ইচ্ছাকৃতভাবে একটি ভ্যান উঠিয়ে দেন। এই ঘটনায় ১০ জন নিহত হন এবং আহত হন ১৫ জন।

এক প্রত্যক্ষদর্শী সিটি নিউজকে বলেন, সামনে যা আসছিল তার উপরই আঘাত করছিল ভ্যানের চালক। দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে এ ঘটনা ঘটে। মিনাসিয়ান টরন্টোর রিচমন্ড হিলের বাসিন্দা।

টরন্টোর পুলিশ প্রধান জানান, ভ্যানের চালক ইচ্ছে করেই ভুল পতে ঢুকে টানা দুই কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে। এই সময়ে সে কখনও ফুটপাতে উঠে লোকজনকে আঘাত করেছে আবার কখনও রাস্তার উপরই লোকজনকে ধাক্কা মেরেছে। তবে এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত জঙ্গীবাদের যোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তবে তাকে কাবু করতে গিয়ে গুলি চালাতে হয়নি পুলিশকে। একটি ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, অ্যালেক পুলিশের দিকে কিছু একটা তাক করে বলছে, ‘‘আমাকে মারো!’’ পুলিশ তাকে শান্ত ভাবে ভ্যান থেকে নেমে আসতে বলে। তখন অ্যালেক বলছে, ‘‘আমার কাছে অস্ত্র আছে।’’ পুলিশ অফিসার নিরুত্তাপ ভাবে বলেন, ‘‘আমার তাতে কিছু যায় আসে না। নেমে এসো।’’ এ ভাবেই গুলি না চালিয়ে অ্যালেককে ধরে ফেলে পুলিশ। এ জন্য পুলিশের যথেষ্ট প্রশংসাও করা হয়েছে।

কানাডার পুলিশ বলেছে, ওই যুবক হামলার ঠিক আগে অনলাইনে রহস্যজনক কিছু বার্তা পোস্ট করেন। যা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি নারীবিদ্বেষী ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অপর এক হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তির প্রশংসা করে বক্তব্য দিয়েছেন।

পেশাজীবীদের যোগাযোগের মাধ্যম লিঙ্কডইনে খোলা তার প্রোফাইলে লেখা আছে, তিনি সেনেকা কলেজের ছাত্র। ঘটনাস্থলের বেশ কাছেই অবস্থিত এ কলেজটি। গুগলে একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোনের জন্য একটি গাড়ি পার্কিং অ্যাপ রয়েছে, যার প্রতিষ্ঠাতা অ্যালেক মিনাসিয়ান একই ব্যক্তি কিনা সেটিও পরিষ্কার নয়।

হামলাকারী মিনাসিয়ান

তবে তার সহপাঠীরা জানিয়েছেন, তিনি কম্পিউটারে খুব পারদর্শী। তার একজন সহপাঠী তাকে সামাজিকভাবে বিদঘুটে প্রকৃতির বলে বর্ণনা করেন।

তবে কোনো উগ্রপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী বলে তাকে মনে হয়নি বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সহপাঠী। স্কুলে তার সাবেক সহপাঠীরা জানিয়েছে, তিনি কারও সঙ্গে মেলামেশা করতেন না।

স্কুলে তিনি বিশেষ সহায়তা দরকার এমন তালিকাভুক্ত ছিলেন। স্কুলে একা একা হেঁটে বেড়াতেন এবং ক্যাফেতেও একা বসেই খেতেন। কিন্তু তিনি সহিংস ছিলেন না বলে সহপাঠীরা জানান। কেন তিনি হঠাৎ করে রাস্তার ধারে মানুষজনকে এভাবে গাড়ি দিয়ে হামলা চালালেন সেটি এখনো পরিষ্কার নয়।

তবে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার কাছে ২২ বছর বয়সী এক তরুণের গুলিতে ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনাটি নিয়ে অনলাইনে আলাপ করেছেন অ্যালেক মিনাসিয়ান।

পুরনো ফেসবুক পোস্টে তাকে বলা হয়েছে, ইনভলান্টারি সেলিবেট যারা অনিচ্ছাকৃতভাবে বিয়ে অথবা অন্য কোনো ধরনের যৌনসম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। তবে এর কোনো কিছুই অবশ্য এখনও প্রমাণিত নয়। ক্যালিফোর্নিয়ার ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী যুবক এলিয়েট রজার্স লিখে গিয়েছিলেন, তিনি মেয়েদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে একাকী জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। রজার্স ওই হামলার সময় নিজেও আত্মহত্যা করেন। এসবের সঙ্গে মিনাসিয়ানের সম্পর্ক থাকতে পারে। অর্থাৎ তিনিও প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়েই এ হামলা চালিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আবার এগুলো কোনো ধরনের মিথ্যা প্রচার কিনা সেটি নিয়েও স্থানীয় গণমাধ্যমে আলাপ হচ্ছে।

গত ২৪ এপ্রিল সকালে মিনাসিয়ানকে টরন্টোর আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তাঁর পরনে ছিল সাদা জাম্পস্যুট। মাথা কামানো আর হাত পিছমোড়া করা। তাঁর মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখা যায়নি। আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো পড়ে শোনানো হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ১০টি হত্যা ও ১৩টি হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১৫ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের সংখ্যা পর্যালোচনার পর তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলার সংখ্যা বাড়ানো হতে পারে।

শোক সামাবেশে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, অন্টারিও প্রিমিয়ার ক্যাথলিন উইন, কুইবেক প্রিমিয়ার ফিলিপ কুইলার্ড, টরন্টো মেয়র জন টরি-সহ কয়েক হাজার লোক অংশ নেন। ছবি : রয়টার্স

দেখা গেছে হামলার শিকার বেশির ভাগই নারী। তাঁদের বয়স ২৫ থেকে ৮০ বছর। পথচারীদের ওপর গাড়ি তুলে দেওয়ার কিছু সময় আগে মিনাসিয়ান ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। সেখানে দুর্বোধ্য ভাষায় একটি বার্তা আছে। মিনাসিয়ান তাঁর ফেসবুক পোস্টে এলিয়ট রজার (২২) নামের এক ব্যক্তির প্রশংসা করেছেন। আর লিখেছেন, ‘ইনসেল বিদ্রোহ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আমরা সব চ্যান ও স্টেসিসকে উৎখাত করব।’ আর এগুলো তদন্ত করতে গিয়েই অনেকটা কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার দশা হয়েছে। মিনাসিয়ান যাঁর প্রশংসা করেছেন, সেই এলিয়ট রজার ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ইসলা ভিসতায় গুলি চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন। তিনি ছিলেন ভীষণ রকমের নারীবিদ্বেষী। মৃত্যুর আগে এক ভিডিওতে তিনি বলে যান, নারীর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি হতাশ ছিলেন। নিজের নিঃসঙ্গতার জন্য সব নারীকে শাস্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি।

অ্যালেক মিনাসিয়ান‘ইনসেল’ শব্দটি আসলে ‘ইনভলান্টারি সেলিবেটস’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘অনিচ্ছাকৃত কুমার’। অর্থাৎ, এ মতবাদে বিশ্বাসী পুরুষেরা নারীর সঙ্গে স্বাভাবিক রোমান্টিক সম্পর্কে জড়াতে চান। কিন্তু নারীদের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তাঁরা নারীবিদ্বেষী হয়ে পড়েন। এই বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটান নারীর প্রতি নানা সহিংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।

মিনাসিয়ান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেকে সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতেন। কানাডার সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র জেসিকা লামিরান্ডে এ ব্যাপারে বলেন, গত আগস্টে মিনাসিয়ান সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিলেন। তবে বনিয়াদি প্রশিক্ষণের মাত্র ১৬ দিনের মাথায় তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

পুলিশ গত মঙ্গলবার তাঁর বাড়ি তল্ল্লাশি করেছে। তাঁর সঙ্গে কারিগরি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা কয়েকজন বলেন, মিনাসিয়ান বেমানান ছিলেন। তাঁর সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক ক্লাসে পড়া আরি ব্লাফ নামের একজন সিবিসিকে বলেন, তাঁর আচরণ ছিল খুবই অদ্ভুত। তবে সহিংস কিছু করতে পারেন এমন কিছু তিনি কখনো দেখেননি।