কানাডায় হালাল পণ্যের বাজার বৃদ্ধি পাচ্ছে

একই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা

মে ১৪, ২০১৭

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : কানাডায় একদিকে যখন মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন তার সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে হালাল পন্যের বাণিজ্য। আর এই হালাল পণ্যের বাণিজ্য করে গ্রোসারী স্টোর, উৎপাদনকারী ও রেস্টেুরেন্টগুলো অধিক মুনাফা লাভের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে এই হালাল পণ্য নিয়ে প্রতারণা শুরু হওয়াতে।

বিশ্বব্যাপী হালাল পণ্যের বাণিজ্য এখন রমরমা। প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য এটি। কানাডায় এই হালাল পণ্যের বাণিজ্যের পরিমান ১ বিলিয়ন ডলার। দিনে দিনে এর পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধির মাত্রা বছরে প্রায় ১০ থেকে ১৫ %। অন্যান্য পণ্যের তুলনায় এই বৃদ্ধি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা বলেন হেলিফেক্স এর ডালহৌসী ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সিভিয়ান সারলেবুয়া। খবর কানাডিয়ান প্রেস এর।

উল্লেখ্য যে, গত বছর ৪ এপ্রিল থেকে কানাডিয়ান ফুড ইন্সপেকশন এজেন্সি কর্তৃক কার্যকরী এক আইনে বলা হয় কানাডায় কোন খাদ্যদ্রব্যের প্যাকেটের গায়ে হালাল শব্দটি সংযুক্ত করতে হলে কে বা কারা হালালের সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন তাদের নামও লেখা থাকতে হবে। নতুন এই আইন প্রবর্তনের আগে হালাল সার্টিফিকেট প্রদানকারী ব্যক্তি বা সংস্থার নাম থাকা বা না থাকার বিষয়ে কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না।

তবে CFIA তাদের নতুন প্রবর্তিত আইনে এ কথা জানায়নি কে বা কারা হালাল সার্টিফিকেট প্রদানের বৈধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া CFIA হালাল সার্টিফিটেক প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর কোন নজরদারীও করে না। বিষয়টি তারা ছেড়ে দিয়েছে কানাডায় বসবাসরত মুসলিম কমিউনিটির সদস্যদের উপর। তবে বাজারে বিক্রি হচ্ছে এমন কোন হালাল ফুড সম্পর্কে কারো কোন সন্দেহ বা অভিযোগ থাকলে তারা নালিশ আকারে সেটি CFIA কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন।

হালাল মনিটরিং অথরিটি অব কানাডার চিফ অপারেটিং অফিসার ইমাম ওমর সুবেদার বলেন হালাল পণ্য নিয়ে প্রতারণা চলছে প্রচন্ডভাবে। কানাডার সরকার ধর্মীয় বিষয়ে নাগ গলায় না। কিন্তু হালাল পণ্য নিয়ে প্রতারণা চলছে বিধায় সরকার বিষয়টির উপর নজর দিয়েছে।

এদিকে হালাল পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কানাডার মেইনস্ট্রিমের কয়েকটি চেইন স্টোর কোম্পানী তাদের দোকানে হালাল সেকশন খুুলেছে। সুবেজ ইনক ব্রাম্পটনে তাদের ফ্রেসকো স্টোরের নাম দিয়েছে ‘চলো ফ্রেসকো’। এখানে হালাল মাংস ছাড়াও সাউথ এশিয়ান কমিউনিটির জন্য নানান রকম পণ্য বিক্রি করছে। লবলজ তাদের নিজস্ব হালাল ব্রান্ড ‘সফুরা’ বাজারে ছেড়েছে। অন্যান্য ব্রান্ডের হালাল পণ্যও তারা বিক্রি করে।

ফাস্ট-ফুড রেস্টুরেন্টগুলোও হালাল ফুড এর অপশন রেখেছে ক্রেতাদের জন্য। এর মধ্যে আছে পিজ্জা পিজ্জা, কেএফসি, পাপাইয়াস।

হালাল পণ্য বা ফুডের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়াতে এর সুযোগও নিচ্ছে কিছু লোক। উল্লেখ্য যে, ইমাম ওমর সুবেদার ইতিপূর্বেও অভিযোগ করে বলেন, “আমি অনেক দিন আগেই জানতে পারি এই হালাল ফুড নিয়ে কোন কোন প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করে আসছে। হালাল ফুড প্রসেসিং প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লোকদের কাছ থেকেই আমি এরকম তথ্য পেয়েছি। প্রথম দিকে প্রতারণার  বিষয়টি নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল। কিন্তু পরে আমাদের নিজস্ব টিম যখন কয়েকটি স্থানে তদন্ত চালায় তখন আমরা নিশ্চিত হই যে আসলেই প্রতারণা চলছে।” গ্লোবাল নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই কথা বলেন।

উল্লেখ্য যে, কানাডায় হালাল এর নাম করে যে সকল পণ্য বিশেষ করে মাংস বাজারে বিক্রি হচ্ছে তা প্রকৃতপক্ষে কতটা হালাল সেই বিতর্ক যেমন রয়েছে, তেমনি বিতর্ক রয়েছে যারা হালাল সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকেন তাদের কারো কারো গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও। বিতর্কের শেষ এখানেই নয়। মেশিনে পশু বা মুরগি জবাই করা হালাল কি না সে নিয়েও মুসলিম ধর্মীয় গুরুরা আজ পর্যন্ত কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি।

হালাল ফুড নিয়ে বিতর্ক শুধু কানাডায়ই নয়, পাশ্চাত্যের আরো অনেক দেশেই চলছে একই অবস্থা। এই দেশগুলোর মধ্যে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়সহ আরো বেশ কয়েকটি দেশ। আর বিতর্ক শুরু হওয়ার আরেকটি কারণ, সত্যিকার ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ঢুকে গেছে হালাল ফুডের ব্যবসায়। এই অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে লাভটাই মূখ্য। মানুষের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ নেই এদের। যারা নীতি ও আদর্শ বজায় রেখে এবং মানুষের ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে হালাল ফুডের ব্যবসা করে আসছেন তারা এই অসাধু ব্যবসায়ীদের কার্যকলাপের কারণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারাও।

বর্তমানে কানাডায় প্রায় দশ লাখ মুসলমান বাস করেন। আগামী ২০ বছরে এই সংখ্যা ৩০ লাখে দাঁড়াতে পারে বলে ফোরাম অন রিলিজিয়ন এন্ড পাবলিক লাইফ এর এক জরীপ রিপোর্ট থেকে জানা যায়। এ থেকেই অনুমান করা যেতে পারে হালাল পণ্যের ব্যবসায় অসাধু ব্যবসায়ীরা কেন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার হিসাব থেকে দেখা যায়, কানাডার মুসলিম পরিবারগুলো সপ্তাহে প্রায় ৩১ ডলার ব্যয় করেন হালাল মাংস ক্রয়ের জন্য যা মূলধারার পরিবারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন বেশী। তবে কানাডায় সব মুসলমানই হালাল ফুড ক্রয় করেন না। যারা হালাল মাংস ক্রয় করেন তারা মাংসের মূল্য বিবেচনায় আনেন না। দাম একটু বেশী দিতে হলেও তারা হালাল মাংসই ক্রয় করে থাকেন।

যুক্তরাজ্যের  ইসলামিক সোসাইটির ইমাম আজমল মাসরুর বলেন, হালাল মাংস ক্রয় বা ভক্ষণের ক্ষেত্রে  ক্রেতার পক্ষে সম্ভব নয় প্রতিবার তা পরীক্ষা করে দেখা। তিনি বলেন, বিক্রেতা যদি বলেন এই মাংস হালাল, তবে ক্রেতার জন্য সেটাই পর্যাপ্ত। তিনি অবশ্য স্পষ্ট করে বলেননি মেশিনে জবাই করা পশু বা পক্ষীর মাংস হালাল নাকি হারাম।

মোট কথা কানাডাসহ পাশ্চাতের সবকটি দেশেই হালাল ফুড নিয়ে রয়েছে সন্দেহ, বিতর্ক আর প্রতারণা।