রাজনীতিকদের প্রতি জনগনের প্রত্যাশাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন জাস্টিন

কানাডার রাজনীতিতে নাটকীয় সব পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগান তিনি : কৃতিত্বে ছাপিয়ে যান অনেক কিছুতেই

আগস্ট ১০, ২০১৬

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : এখন থেকে ঠিক এক বছর আগে এই সময়টাতে জাস্টিন ট্রুডো ভেঙ্গুভারে গিয়েছিলেন সমকামীদের বার্ষিক প্যারেডে অংশ নিতে। তখন তিনি শুধুমাত্র লিবারেল পার্টির দলীয় প্রধান ছিলেন। নির্বাচনী দৌড়েও তিনি পিছিয়ে ছিলেন অনেক দূর । জনপ্রিয়তায় তার দলের অবস্থান ছিল তৃতীয় স্থানে। ঐ সময় সমকামীদের প্যারেডে যোগ দেওয়াটা ছিল তার নির্বাচনী প্রচরণারই অংশ। নির্বাচনী বিশেষজ্ঞরা সেই সময় নিশ্চিত ছিলেন যে ট্রুডোর নেতৃত্বে লিবারেল পার্টির আসন সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পাবে। তবে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের সম্ভাবনা নির্বাচনী বিশেষজ্ঞরা ঐ নির্দিষ্ট সময়টাতে দেখতে পাননি। বিভিন্ন সংস্থা পরিচালিত নির্বাচনী জরীপেও ট্রুডোর দল পিছিয়ে ছিল।

সেই জাস্টিন ট্রুডো কদিন আগে আবারো ভেঙ্গুভারে গিয়েছিলেন সমকামীদের বার্ষিক প্যারেডে অংশ নিতে। তবে এবার তিনি সেখানে গিয়েছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতে তার দল অনেক পিছিয়ে থাকলেও নির্বাচনের আগমুহুর্তে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ট্রুডোর লিবারেল পার্টি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়। গঠন করে সরকার।

গত বছর ৪ নভেম্বর জাস্টিন ট্রুডো কর্তৃক কানাডার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহনের পর ইতিমধ্যে পার হয়ে যায় ৯ মাস। কানাডার রাজনীতিতে নাটকীয় সব পরিবর্তনের ছোয়া লাগান জাস্টিন ট্রুডো। কৃতিত্বে ছাপিয়ে যান অনেক কিছুতেই।

সরকার গঠনের শুরুতেই চমক সৃষ্টি করেন জাস্টিন ট্রুডো। তিনি পাল্টে দেন মন্ত্রীসভার গতানুগতিক চেহারা। মন্ত্রী সভায় তিনি যাদের ডেকে আনেন তাদের অর্ধেকই মহিলা এবং এথনিক কমিউনিটি থেকে নির্বাচিত বেশ কয়েকজনও ঠাই পান তার মন্ত্রী সভায়। এদের কেউ কেউ পান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব।

জাস্টিন ট্রুডো সম্প্রতি ভেঙ্গুভারে গিয়েছিলেন সমকামীদের বার্ষিক প্যারেডে অংশ নিতে : ছবি- রয়টার্স

ক্ষমতা গ্রহনের পর জাস্টিন ট্রুডোর অগ্রযাত্রা যখন অব্যাহত রয়েছে তখন কানাডার রাজনৈতিক অঙ্গণ থেকে বিদায় নিচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার । বিগত নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর কনজারভেটিভ পার্টির দলীয় প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। হারপার রাজনীতি থেকেও সরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। আগামী ফল সিজনের আগেই এমপি পদ থেকেও সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন তিনি গত মে মাসে। অন্যদিকে থমাস মূলকেয়ারের দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি গত নির্বাচনে তৃতীয় স্থান দখল করার পরও পার্টি প্রধান মূলকেয়ার দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াননি নিজ থেকে। গত এপ্রিলে দলের কনভেনশনে তার দলের লোকেরা তার প্রতি অনাস্থা আনেন। পরে তিনি পদত্যাগ করার জন্য রাজী হন। তবে পরবর্তী দলীয় প্রধান কেউ নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনিই দলের প্রধান হিসাবে থাকবেন এমন ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।

কানাডার রাজনীতিতে চমক সৃষ্টির পাশাপাশি অধিকতর সক্রিয় ও সহসী এবং সপ্রতিভ ফেডারেল সরকার উপহার দেওয়ার জন্য জাস্টিন ট্রুডো ইতিমধ্যেই প্রশংশিত হয়েছেন কানাডার সাধারণ মানুষের কাছে। এ কথা বলেছেন কানাডার একটি জরীপ প্রতিষ্ঠানের ((EKOS Research Associates) ) প্রেসিডেন্ট ফ্রেঙ্ক গ্র্যাভিস। তিনি বলেন, জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বে লিবারেল পার্টি অব্যাহতভাবে জনপ্রিয়তার বিচারে এগিয়ে আছে ৪০% এর উপরে সমর্থন পেয়ে। ইকোস পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরীপে দেখা গেছে জনপ্রিয়তার দিক থেকে লিবারেল ৪৬%, কনজারভেটিভস ২৬% এবং এনডিপি ১৫% এগিয়ে আছে। ইকোস এর প্রেসিডেন্ট বলেন সরকারের উপর জনগনের আস্থা বর্তমানে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা গত ২৫ বছরে দেখা যায়নি।

আরেক জরীপ প্রতিষ্ঠান এবাকাস ডাটা’র প্রধান নির্বাহী ডেভিড কলেটো বলেন, গত নির্বাচনে জাস্টিন ট্রুডো তার সমালোচকদের বোকা বানিয়েছেন এবং ক্ষমতা গ্রহনের পর রাজনীতিকদের প্রতি জনগনের প্রত্যাশাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

কানাডার জনগন চান রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও অবারিত দ্বার। ট্রুডো কানাডার রাজনীতিতে সেই বিষয়গুলোই আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তার পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার করেছেন ঠিক তার উল্টোটি। জনগন এমনকি পার্টির লোকদের কাছেও তিনি স্বচ্ছ ছিলেন না। গোপন দ্বার বৈঠকে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে ও চাপিয়ে দিতে ভালবাসতেন।

গত ফেডারেল নির্বাচন কানাডার রাজনীতিতে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে যা এদেশের রাজনীতিকে নতুন ছাঁচে গড়ে তুলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গত নির্বাচনে লক্ষ্য করা গেছে অধিক সংখ্যক লোক ভোট কেন্দ্রে গিয়েছেন। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়েছিলেন ৬৮.৫% ভোটার। গত দুই দশকের মধ্যে এই হার ছিল সর্বোচ্চ এবং আরো যে বিষয়টি লক্ষ্যনীয় ছিল তা হলো, নবীন বা তরুন ভোটারদের অধিকতর উপস্থিতি।

কানাডার নির্বাচনী বাজারে পরিবর্তন এসেছে। আর এর অর্থ হলো, কানাডার রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন থেকে তাদের নীতিনির্ধারণ করার আগে এই বিষয়টিকে মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে যখন নেতৃত্বের বিষয়টি সামনে আসে। এ কথা বলেছেন এবাকাস ডাটা’র প্রধান নির্বাহী ডেভিড কলেটো।

নির্বাচনের সময় ভবিষ্যতবানী করা খুব কঠিন কাজ। তবে গত নির্বাচন থেকে কনজারভেটিভ পার্টি এবং এনডিপি কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিতে পারে। কারণ, ভোটারদের মতামত বা কোন দলের প্রতি আনুকুল্য কতটা দ্রুত পাল্টাতে পারে সে বিষয়টি তারা ঐ নির্বাচন লক্ষ্য করেছে।

নির্বাচনের পর ৯ মাস পার হয়েছে। এবার দেখা যাক কোন দলের অবস্থান কোথায় :

নিউ ডেমোক্রেটস

এনডিপি গত নির্বাচনের আগে খুব ভাল অবস্থানেই ছিল। বিভিন্ন জরীপে বাকি দুই প্রধান দলের চেয়ে বেশ এগিয়ে ছিল জনপ্রিয়তার বিচারে। দলীয় প্রধান স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছিলেন কানাডার প্রধানন্ত্রীর পদ দখলের। কিন্তু নির্বাচন যত এগিয়ে আসতে থাকে এনডিপি’র জনপ্রিয়তাও ততই কমতে থাকে। নির্বাচনের দিন দেখা গেল তারা তৃতীয়স্থান দখল করেছে। আসন পেয়েছে মাত্র ৪৪টি। এবাকাস ডাটা’র প্রধান নির্বাহী ডেভিড কলেটো বলেন, এনডিপি নির্বাচনে যোগ দিয়েছিল একজন জনপ্রিয় নেতাকে সামনে রেখেই । কুইবেকে তাদের সমর্থন ছিল খুব ভাল। কিন্তু আজ আর সেটা নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দলটি এখন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। দলের নেতা দল থেকে পদত্যাগ করেননি নির্বাচনে পারাজিত হয়েও। পার্টি কনভেনশনে তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশিত হওয়ার পরও তিনি এখনো দলের প্রধান হয়েই আছেন। বলেছেন পরবর্তী নেতা নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ঐ পদে বহাল থাকবেন। কোন অন্তর্বর্তী নেতার হাতে দলের দায়িত্ব দিবেন না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ বলছেন, রাজনীতিতে পরিস্থিতি পাল্টায়। কিন্তু এনডিপি সহসা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এমন কোন লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। তাদের দখলে আছে বর্তমানে ৪৪টি আসন। এই আসনগুলো ধরে রাখা বা আরো বৃদ্ধি করার জন্য তাদের প্রয়োজন দলে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং নতুন নীতি প্রণয়ন করা যার মাধ্যমে পুনরুদ্ধার হতে পারে তাদের নাশিত জনপ্রিয়তা যেটা এখন লিবারেল পার্টির দখলে।

কনজারভেটিভ পার্টি

গত নির্বাচনে পরাজিত হলেও কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থা এনডিপি’র মত নয়। নির্বাচনের আগে পরিচালিত বিভিন্ন জরীপে এই দলটি এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত লিবারেল পার্টির কাছে পরাজিত হয়। কিন্তু ৯৯ টি আসন তাদের দখলে থাকে। পরাজিত হওয়ার পর ঐ সময়কার দলীয় প্রধান স্টিফেন হারপার পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের পর দলের অন্তর্বর্তীকালীন নেতা হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন রোনা এম্ব্রস। রোনা এম্ব্রস ইতিমধ্যেই দলের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।

জরীপ প্রতিষ্ঠান এবাকাস ডাটা’র প্রধান নির্বাহী ডেভিড কলেটো বলেন, কনজারভেটিভ পার্টি কিভাবে তাদের শিবিরকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, কিভাবে তাদের সমর্থক বৃদ্ধি করবে সেটা নির্ধারণ করতে হবে। তাদের বর্তমান দলীয় শক্তি ও সমর্থন যা আছে তা দিয়ে এ মুহুর্তে কোন নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে না। আমার কাছে মনে হয় দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নতুন উদ্যোগ শুরু হতে হবে দলীয় নেতার হাত ধরে।

জরীপ প্রতিষ্ঠান ইকোস এর প্রেসিডেন্ট ফ্রেঙ্ক গ্র্যাভিস বলেন, যদি কানাডায় অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পায় তবে কনজারভেটিভ পার্টি সেটাকে পূঁজি করে সামনে এগুবার চেষ্টা করবে। অবশ্য নতুন নেতা কে হবেন সেটা ছাড়াও এই দলের সামনে আরো একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সময় এসেছে। সেটা হলো তারা কি প্রগতিশীল কোন এজেন্ডা গ্রহণ করবে না তাদের প্রচলিত রক্ষণশীল নীতি নিয়েই থাকবে।

লিবারেল পার্টি

লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত যে ভাবে সরকার পরিচালনা করে আসছে তাতে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট। ফ্রেঙ্ক গ্র্যাভিস এবং ডেভিড কলেটো দুজনেই এই ব্যাপারে একমত।

গ্র্যাভিস বলেন, একটি সাহসী ও সপ্রতিভ এবং সক্রিয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে জাস্টিন ট্রুডোকে মনে হচ্ছে একজন চ্যাম্পিয়ন ব্যক্তিত্ব। তিনি সরকার ব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা এনেছেন। জনগণ আগের সরকারের তিরিক্ষি ও অভদ্র আচরণে পরিশ্রান্ত।

দাম্ভিকতা বা অংহকার প্রদর্শন হবে এই সরকারের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি। অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও একটি ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

গ্র্যাভিস আরো বলেন, কানাডিয়ানদের কাছে লিবারেল যদিও এখন একটি পছন্দের দল কিন্তু এই পরিস্থিতি বদলাতে সময় নিবে না যদি অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে যায়। এটাই এখন বড় ধরণের ঝুঁকি সামনে। সাধারণ মানুষ ধৈর্য্য ধরবে তবে পর্যবেক্ষন করবে এই দলটি তাদের প্রতিশ্রুতি ঠিকমত পালন করে কি না।

লিবারেল পার্টি অবশ্য ইতিমধ্যে মধ্যবিত্তদের কল্যানে কিছুদূর অগ্রসর হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মিডল ক্লাস টেক্স কাট, নতুন চাইল্ড বেনিফিট প্রবর্তন এবং পেনশন রিফর্ম এর কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকগণ বলছেন, লিবারেল পার্টিকে বর্তমান জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হলে জনকল্যানের ব্যাপারে সামনের দিকে আরো অগ্রসর হতে হবে।

লিবারেল পার্টির সামনে এখন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো, বিরোধী দুই দলের আসন্ন দুই নতুন নেতা। নতুন নেতা যারা আসবেন তাদের পারফর্মেন্সের উপর নির্ভর করছে লিবারেল পার্টিকে কি কি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

-টরস্টার নিউজ সার্ভিস অবলম্বনে ।