দুই দশকের আলোড়নপূর্ণ রাজনৈতিক জীবন থেকে বিদায় নিলেন স্টিফেন হারপার
সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৬
প্রবাসী কণ্ঠ : কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার অবশেষে তার এমপি পদ থেকেও পদত্যাগ করলেন এবং বিদায় নিলেন প্রায় দুই দশকের আলোড়নপূর্ণ রাজনৈতিক জীবন থেকে। গত ২৬ আগস্ট তিনি তার ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে সবাইকে এই বার্তা প্রদান করেন।
হারপার ছিলেন ক্যালগারি প্রভিন্সের ‘ক্যালগারি হেরিটেজ’ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি। তিনি ছিলেন কানাডার ২২তম প্রধানমন্ত্রী। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়রী থেকে ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি কানাডার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। জন্ম ১৯৫৯ সালের ৩০ এপ্রিল। প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টি ও কানাডিয়ান এলাইন্স একিভূত হয়ে কনজারভেটিভ পার্টি অব কানাডা গঠিত হওয়ার পর তিনিই এই নবগঠিত দল থেকে প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন নির্বাচনে জয়ী হয়ে। তবে ২০০৬ সালে তার দল প্রথমবারের মত নির্বাচনে জীয় হলেও সংখ্যালঘু সরকার গঠন করতে হয়েছিল তখন। ঐ নির্বাচনে আসন সংখ্যার বিচারে তার সরকার ছিল কানাডার ইতিহাসে কনফেডারেশন গঠনের পর সবচেয়ে ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সরকার। তবে মজার বিষয় হলো, ঐ ক্ষুদ্রতম সংখ্যালঘু সরকার দীর্ঘ সময় ধরেই ক্ষমতায় ছিল যা অন্য কোন সংখ্যালঘু সরকারের পক্ষে ইতিপূর্বে সম্ভব হয়নি।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অবশ্য স্টিফেন হারপারের নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টির আরেকটু অগ্রগতি হয়েছিল। সেবার তার দল সংখ্যালঘু হলেও বেশ শক্তিশালীই ছিল আসন সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি করতে পেরে। ৩০৮ টি আসনের মধ্যে ১৪৩ টি আসন পেয়েছিল তার দল। তবে ২০১১ সালে নো কনফিডেন্স ভোটে ৪০তম পার্লামেন্ট বাতিল দেয়া হয় এবং পরের নির্বাচনে স্টিফেন হারপারের দল বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সংখ্যা গরিষ্ঠ সরকার গঠন করে।
এর পর আসে ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচন। ১৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ঐ নির্বাচনে হারপার নিজ আসনে জয়ী হলেও তার দলের পরাজয় ঘটে। সেই পরাজয়ের দায় কাধে নিয়ে তিনি তখনই দলীয় প্রধানের পদ থেকে সরে দাড়ান। তবে নিজের এমপি পদ বহাল রাখেন এবং ক্যালগারিতে চলে যান। অবশ্য পার্লামেন্টের অধিবেশনে তিনি আসতেন কিন্তু বসতেন পিছন সারিতে। এর মধ্যে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন এমপি পদ থেকেও পদত্যাগ করবেন এবং রাজনীতিকে বিদায় জানাবেন। গত গত ২৬ আগস্ট তিনি তার ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে সবাইকে ঐ বার্তাই প্রদান করেন।
উল্লেখ্য যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে এখন ব্যবসার দিকে মন দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই তিনি তার দুই সাবেক ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত উপদেষ্টা রে নোভাক এবং জারমে হান্টকে নিয়ে একটি কোম্পানী গঠন করেছেন বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল ইস্যুতে কনসালটিং করার জন্য। গত ডিসেম্বরে গঠিত এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে ‘হারপার এন্ড এসোসিয়েটস কনসালটিং’।
স্টিফেন হারপারের রাজনৈতিক জীবনটা ছিল আলোচনা – সমালোচনায় ভরপুর। তিনি বরাবরই মিডিয়াকে এড়িয়ে চলতেন। হারপার যেমন রক্ষণশীল রাজনীতি করতেন তেমনি তিনি ছিলেন কট্টরপন্থী খ্রীষ্টান। তার দলের এক এমপি একবার তাকে যীশু খ্রীস্টের সঙ্গে তুলনাও করেছিলেন। ঐ এমপি’র নাম ওয়াই ইয়াং। তিনি ভেঙ্কুভার সাউথ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০১১ সালের নির্বাচনে। আরো আশ্চার্যের ব্যাপার হলো, স্টিফেন হারপার ঐ এমপিকে এ ধরণের মন্তব্য করার জন্য দল থেকে বহিস্কার করেননি। সম্ভবত মনে মনে তিনি খুশিই হয়েছিলেন ওয়াই ইয়াং এর ঐ উক্তি শুনে।
এরিখ ম্যাং নামের এক ব্লগার (যিনি একসময় অন্টারিওতে হ্যারিস সরকারের এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে ক্যাম্ববেল সরকারের রাজনৈতিক সহায়তাকারী ছিলেন) তার এক লিখনিতে উল্লেখ করেন, কানাডায় যারা প্রোটেস্টান তাদের মধ্যে রক্ষণশীল কনজারভেটিভ পার্টির প্রতি সমর্থন বেশী দেখা যায়। স্টিফেন হারপারের দলীয় কমিটিতে এবং অফিসের কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে প্রোটেস্টানদের সংখ্যা বেশী ছিল। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে স্টিফেন হারপার ক্ষমতায় থাকাকালীন সবসময়ই ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের একটা পরিমন্ডলের মধ্যেই থাকতেন। আর এরিখ ম্যাং যে তথ্য দিয়েছেন তার সমর্থন পাওয়া যায় Ipsos-Reid এর এক জরীপেও। তাদের তথ্য মতে দেখা যায় ‘যে যত বেশী ধর্মপ্রাণ সে তত বেশী কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থক’।
স্টিফেন হারপার রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার কি ভাবে করতে হয় সেটি বেশ ভাল করেই রপ্ত করেছিলেন। খ্রীষ্ট ধর্মের প্রোটেস্টানদের সমর্থন ছাড়াও তিনি ইহুদী ধর্মালম্বীদের সমর্থন পেয়ে আসছিলেন বেশ ভাল মাত্রায়ই। রয়টারের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০১১ সালের নির্বাচনে তিনি ইহুদীদের অনেক ভোট পেয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের প্রতি স্টিফেন হারপারে অতিমাত্রায় সমর্থন ছিল এ কথা সবারই জানা। আর ঐ সমর্থনের কারণেই তিনি কানাডায় বসবাসরত ইহুদী সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমর্থন পেয়ে আসছিলেন।
স্টিফেন হারপার ধর্মীয় কট্টরপন্থী হওয়া সত্বেও হিন্দু, শিখ, মুসলমান, আহমেদীয়া মুসলমান প্রভৃতি সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও করেছেন নিজের স্বার্থে। আর তারই চেষ্টা আমরা দেখতে পেয়েছিলাম গত নির্বাচনের কিছু দিন আগে নিজ সরকারী বাসভবনে ইফতার পার্টির আয়োজনের মধ্য। কানাডার ইতিহাসে যে কাজটি কেউ করেননি ইতিপূর্বে সেই কাজটিই তিনি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনে মুসলমানদেরকে ইফতার পার্টিতে দাওয়াত করে। প্রায় জনা চল্লিশেক মুসলমান নেতৃবৃন্দকে দাওয়াত করে তিনি ইফতার খাইয়েছেন। উদ্দেশ্য- মুসলমানদের সঙ্গে ‘সম্পর্ক উন্নয়ন’। অর্থাৎ গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার মতো বিষয়। ইফতার পার্টিতে মুসলমান কমিউনিটির উল্লেখযোগ্য কোন নেতৃবৃন্দও ছিলেন না।
স্টিফেন হারপারের মুসলিম বিদ্বেষী আচরণ লক্ষ্য করা গিয়েছিল নানান ইস্যুতেই। উদাহরণ হিসাবে নিকাব এর কথা বলা যেতে পারে। হারপার নিকাব ইস্যুতে যে নাটক দেখিয়েছেন তা ছিল নজিরবিহীন। অতি নগন্য একটি বিষয়কে তিনি এবং তার দলের সদস্যরা কি করে যে জাতীয় নির্বাচনের একটি প্রধান ইস্যুতে দাঁড় করিয়েছিলেন তা ভাবতেও অবাক লাগে। প্রথম দিকে তিনি নিকাব ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছিলেন। তখনকার জরীপ তথ্যে দেখা গিয়েছিল, নির্বাচনের আগে যখন তিনি জনপ্রিয়তার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছিলেন তিনি তখন এই নিকাব ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে দলের জনপ্রিয়তার ১০% বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঐ সময় কানাডায় ইসলামোফোবিয়ার পাশাপাশি নিকাবোফোবিয়া নামে আরেকটি শব্দের প্রচলন হয়ে যায় স্টিফেন হারপার ও তার দলের লোকদের এন্টি ইসলাম প্রচারণার কারণে।
নিকাব বিষয়টি আসলে ইসলামের অংশ নয়। এ কথা অনেক পন্ডিত ব্যক্তিই বলে আসছেন বারবার। তবে নিকাবের মতো চরম কুসংস্কারাপন্ন একটি বিষয়কে ধর্মীয় ইস্যুতে পরিনত করে কানাডায় মুসলিম বিদ্ধেষ তৈরী করাই ছিল হারপারের উদ্দেশ্য। এ কাজটি তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করেছিলেন। আর তাতে নিজের অজান্তেই সহায়তা করে আসছিলেন জুনেরা ইসহাক নামের এক পাকিস্তনী মহিলা যিনি সরকারে বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন নাগরিকত্ব লাভের সময় নিকাব পরতে না দেয়ায়। তিনি নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে রাজী কিন্তু নিকাব নয়।
উল্লেখ্য যে, কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বেই ইমগ্রেন্টবান্ধব নয় এমন আইন পাশ হয়েছে যে আইনে দ্বৈত নাগরিকদেরকে দেশ থেকে বহিস্কার করা যাবে। এর বিরুদ্ধে কোন আপিলের সুযোগও রাখা হয়নি। অথচ যে অপরাধসমূহের দোহাই দিয়ে এই আইন করা হয়েছে সেই অরাধসমূহের বিচার করার জন্য দেশটির প্রচলিত আইনই যথেষ্ট ছিল। কানাডার আইন বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, দেশ থেকে বহিস্কারের আইনটি মধ্যযুগীয় প্রথা যা আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশে একেবারেই বেমানান এবং মানবাধিকার পরিপন্থী। এটি সংবিধানও লংঘন করেছে। বর্তমান লিবারেল সরকার এই আইনটি বতিল করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
স্টিফেন হারপারের সাবেক কনজারভেটিভ সরকার আরো কিছু বিতর্কিত ইমিগ্রেশন আইন তৈরী করে গিয়েছিল যার কিছু কিছু আইন বর্তমান লিবারেল সরকার সংশোধন করেছে বা করতে যাচ্ছে । এর মধ্যে আছে:
-প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যারা কানাডিয়ান সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করবেন তাদেরকে এখন থেকে এই মর্মে কোন ঘোষণা দিতে হবে না যে, সিটিজেনশীপ পাওয়ার পর তারা কানাডায় অব্যাহতভাবে বাস করবেন। উল্লেখ্য যে, সাবেক কনজারভেটিভ সরকার এ ব্যাপারে এমন এক নিয়ম করে গিয়েছিল যার মাধ্যমে দ্বৈত নাগরিকরা নাগরিত্ব হারাবার ঝুঁকিতে ছিলেন।
-সাবেক কনজারভেটিভ সরকার আরো আইন করে গিয়েছিল কানাডার নাগরিকত্ব লাভ করতে হলে ইমিগ্রেন্টদেরকে ৬ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৪ বছর কানাডায় বাস করতে হবে। আগে নিয়ম ছিল ৪ বছরের মধ্যে তিন বছর কানাডায় থাকতে হবে। লিবারেল সরকার এখন নিয়ম করেছে ৫ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৩ বছর কানাডায় বাস করতে হবে সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করার আগে।
-সাবেক কনজারভেটিভ সরকার নিয়ম করে গিয়েছিল সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করতে হলে যেদিন থেকে আবেদনকারী পার্মানেন্ট রেসিডেন্সী লাভ করেছেন সেদিন থেকে দিন গণনা শুরু হবে। কিন্তু লিবারেল সরকারের হালনাগাদ করা সিটিজেনশীপ আইনে বলা হয়েছে, আবেদনকারী যেদিন থেকে
কানাডায় স্বশরীরে উপস্থিত হয়েছেন সেদিন থেকে দিন গননা শুরু হবে। অর্থাৎ পার্মানেন্ট রেসিডেন্সী পাওয়ার আগের দিনগুলোও হিসাবের মধ্য পড়বে। তবে আগের দিনগুলো গননা হবে অর্ধেক দিন হিসাবে। অর্থাৎ এক বছর অবস্থান করে থাকলে তা ৬ মাস হিসেবে গণ্য হবে। আর আগের অবস্থান থেকে ক্রেডিট পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ এক বছর। অর্থাৎ দুই বছর অবস্থান করে থাকলে এক বছরের ক্রেডিট, আর তিন বছর অবস্থান করে থাকলেও ঐ এক বছরেরই ক্রেডিট পাওয়া যাবে।
-নাগরিকত্ব লাভের জন্য ল্যাংগুয়েজ টেস্টকেও কঠিন করে গিয়েছিল স্টিফেন হারপারের সাবেক কনজারভেটিভ সরকার। বয়স্ক ব্যক্তিদের পক্ষে ল্যাংগুয়েজ টেস্ট পাস করা এমনিতেই কঠিন। তা জানা সত্বেও কর্তৃপক্ষ বয়সের মাত্রা আরো বৃদ্ধি করেছিল। আগে নিয়ম ছিল ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যক্তিদেরকে ল্যাংগুয়েজ টেস্ট পাস করতে হবে। কনজারভেট্ভি সরকার নিয়ম করেছিল ১৪ থেকে ৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত ব্যক্তিদেরকে ল্যাংগুয়েজ টেস্ট পাস করতে হবে। এবার লিবারেল সরকার নতুন নিয়ম করেছে যাতে বলা হয়েছে ১৮ থেকে ৫৪ বয়স পর্যন্ত ব্যক্তিদেরকে ল্যাংগুয়েজ টেস্ট পাস করতে হবে।
স্টিফেন হারপারের নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টি গত জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে। কানাডার রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো, কারো নেতৃত্বে দল পরাজিত হলে সাধারণত দলের নেতা পদত্যাগ করেন। স্টিফেন হারপারও তাই করেছেন। পরে এমপি পদ থেকেও পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু পিছনে রেখে গেছেন কিছু বিতর্কিত রাজনৈতিক ঘটনা ও ইতিহাস যার কারণে এদেশের মানুষ তাকে মনে রাখবেন বহু কাল ধরে।