ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রবাসীদের ঢল নেমেছিল টরন্টোর ড্যানফোর্থে

অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করলো উপস্থিতির সংখ্যা

ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৬

প্রবাসী কন্ঠ : একুশের চেতনায় উদ্দীপ্ত কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীরা উদযাপন করেছে মহান একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। গত ২১ ফেব্রুয়ারী রবিবার বারটা এক মিনিটে টরন্টোর বাঙ্গালী অধ্যুষিত ড্যানফোর্থে অস্থায়ী ভাবে নির্মিত শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পনের মধ্য দিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশীরা উদযাপন করেন এ দিবসটি। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেদিন প্রবাসীদের ঢল নেমেছিল ড্যানফোর্থে। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে উপস্থিতির সংখ্যা। হাজারো কন্ঠে ধ্বনিত হয় একুশের অমর সঙ্গীত ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি’।

প্রবাসী বাংলাদেশীদের সম্মিলিত উদ্যোগে আয়োজিত এই মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে পুষ্পার্ঘ্য অপর্ণ করেছেন মূলধারার কয়েকজন রাজনীতিকও। এদের মধ্যে ছিলেন বিচেস ইস্ট ইয়র্ক রাইডিং এর এমপি নেথেনিয়েল স্মিথ, এমপিপি আর্থার পটস ও কাউন্সিলর জেনেট ডেভিস। স্কারবরো সাউথ ওয়েস্ট রাইডিং এর এপি বিল ব্লেয়ার নিজে উপস্থিত হতে পারেনি। তবে তার পক্ষ থেকে বার্তা ও পুষ্পার্ঘ্য প্রেরণ করা হয়। অসুস্থতার কারণে উপস্থিত হতে পারেননি প্রতিবারের নিয়মিত অতিথি সাবেক এমপি মারিয়া মিন্না। তবে উপস্থিত হতে না পারলেও বার্তা পাঠিয়েছেন তিনি।
এমপি নেথেনিয়েল স্মিথ আন্তার্জাতিকক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কানডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর পক্ষ থেকে পাঠানো একটি বানী আয়োজদের হাতে তুলে দেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত মূলধারার রাজনীতিকদের সকলেই তাদের সংক্ষিপ্ত ভাষণে মাতৃভাষা রক্ষায় বাঙ্গালীদের বীরত্বগাথার প্রশংসা করেন।

কানাডায় ফেব্রুয়ারী মাস মানেই ভয়াবহ শীত। সেই সাথে শ্বেতশুভ্র তুষারের স্তুপ। গত সপ্তাহেও টরন্টোর তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ৪০‘র কাছাকাছি। তবে ২০ ফেব্রুয়ারী শনিবার সকাল থেকেই তাপমাত্রা ছিল প্লাসে। দিনের বেলায় প্লাস ১২ ছিল। সন্ধ্যায় তাপমাত্রা কমে আসে। কিন্তু তখনও তা ছিল প্লাস ২/৩ ডিগ্রির কাছাকাছি। রাতে যখন সবাই পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করতে আসেন তখন তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ৪ (ফিল লাইক) যা ছিল টরন্টোবাসীর কাছে রোমান্টিক শীত।
এই তুষারবিহীন রোমান্টিক শীত আর উইকএন্ড থাকাতে দিবসটি উদযাপন সহজ হয়ে যায় টরন্টোবাসীর কাছে। উপস্থিতির সংখ্যাও বেড়ে যায়। শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রবাসীদের যতগুলো অনুুষ্ঠান হয়েছে ভাষা দিবসে তার মধ্যে এবারের অনুষ্ঠানে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। প্রায় তিন সহস্রাধিক লোকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আয়োজকদেরকেও হিমসিম খেতে হয়েছে। প্রায় অর্ধডজন পুলিশের উপস্থিতিও ছিল পরিস্থিতি সামাল দিতে।

ভাষা শহীদরে প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মহান একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাদিবস উপলক্ষে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে প্রথম পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধাগণ। এর পর এমপি, এমপিপি ও কাউন্সিলরগণ একে একে শহীদবেদীতে উঠে পুষ্পার্ঘ্য অপর্ণ করেন। এর পর শুরু হয় বাকী সবার পালা। টরন্টোর বাঙ্গালীদের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতি সংগঠন এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান একে একে এগিয়ে যান পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করতে। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। রাত দেড়টা পর্যন্ত চলে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের পালা।

উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অন্যতম রূপকার, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে অবশেষে দেহান্তরিত হন ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার হাসপাতালে তিনি পরলোক গমন করেন।
১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন কানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙ্গালী রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম। রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত দুই বাঙালি। তারপর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেরুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, ড্যানফোর্থে প্রতিবছর অস্থায়ীভাবে যে শহীদ মিনারটি স্থাপন করা হয় তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেন ঘরোয়া রেস্টুরেন্ট এর স্বত্বাধিকারী ও মাসিক সুখবর এর প্রধান সম্পাদক সৈয়দ শামসুল আলম। এ বছর তাকে যারা সহযোগিতা করেন তাদের মধ্যে আছেন গোলাম সারওয়ার, খোকন আব্বাস, রাশেদ খন্দকার বাবু, মুজাহিদুল ইসলাম, এবাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ আজাদ, সাকিব করিম, জহিরুল ইসলাম জিন্নাহ, সবুজ চৌধুরী টিটু, ইমতিয়াজ আহমেদ দীপু, কফিল উদ্দিন চৌধুরী, ছাদ চৌধুরী, কাজী সাকি, আলী ইয়াসির, শিহাব উদ্দিন দীপ, জাহিদ ওবায়েইদ, মোস্তাক চৌধুরী, সৈয়দ ফারহান ও  পিউ।। এবারের অনুষ্ঠানের সার্বিক সাফল্যে সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেন।
মহান একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ড্যানফোর্থে অবস্থিত বাংলাদেশ সেন্টার তাদের নিজস্ব ভবনে দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। এতে আলোচনা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের চিত্রাঙ্গণ প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে ড্যানফোর্থ এভিনিউতে একটি র‌্যালিরও আয়োজন করা হয়।
উদীচী কানাডার (একাংশ) উদ্যোগেও একুশের উপর আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ড্যানফোর্থের মীজান কম্পেøক্সে। সাংস্কৃতিক পর্বে অংশ নেন সংগঠনের শিল্পীরা।