আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : স্বাধীনতা পদক পাচ্ছেন রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম
মার্চ ১৩, ২০১৬
প্রবাসী কন্ঠ : একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী মরহুম রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পদক পেতে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে এই পদক পাচ্ছেন আবদুস সালামও। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৪ মার্চ ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে এই পদক তুলে দেবেন। তবে রফিকুল ইসলামের পক্ষে কে এই পদক গ্রহণ করবে তা এখনো জানা যায়নি।
২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর কানাডার ভ্যাঙ্কুভার হাসপাতালে রফিকুল ইসলাম শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তাঁর সেই পরিচয় ছাপিয়ে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এই মিশনে তাঁর অন্যতম সহযোদ্ধা ছিলেন আবদুস সালাম। তাঁরা ছিলেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রচলনের উদ্যোগী।
বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে প্রায় ১২ হাজার মাইল দূরে থেকেও দেশপ্রেমিক এই দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম বাংলা ভাষা, শহীদ দিবস, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন কোনো কিছুকেই ভুলতে পারেননি। প্রবাসে বসে আওয়ামী আর বিএনপি রাজনীতিতে সময় অপচয় না করে সবসময় ভাবতেন আমাদের মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিকে কীভাবে বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে দেয়া যায়। এই ভাবনা থেকেই ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত এই দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম। তাদের ঐ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আর ২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে যথাযথ মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের বুকে একুশে ফেব্রুয়ারি আজ একটি বিশেষ দিবস।
তাঁদের এই উদ্যোগ ও সাফল্য বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, যাঁরা সংগ্রাম করেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁদের পাশাপাশি এই দুজন বিশিষ্টজনের অবদানও স্মরণীয়।
পিছনের ঘটনা :
বিডি-প্রতিদিন.কম এ সেলিনা হোসেনের লিখিত এক নিবন্ধ থেকে জানা যায় – ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ কানাডায় অবস্থিত Mother Language Lover of the World নামের একটি বহুভাষী ও বহুজাতিক ভাষাপ্রেমী গ্রুপ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠান। ঐ পত্রে তারা উল্লেখ করেন যে, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের অসংখ্য জাতিগোষ্ঠীকে তাদের মাতৃভাষা ব্যবহার না করার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে, কাউকে মাতৃভাষা ভুলে যেতে বল প্রয়োগ করা হচ্ছে, সেসব ভাষাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে না। কোনো কোনো চমত্কার ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা মনে করেন, এসব কিছু সব ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের মারাত্মক লঙ্ঘন। এক সময়ে বাংলা ভাষাকেও এ সংকটের মুখোমুখি
হতে হয়েছিল বলে তাদের আবেদনে তারা ২১ ফেব্রুয়ারির পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। বাঙালি ভাষার জন্য যে জীবন দিয়েছে সেটি পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা। সে জন্য ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিলে প্রতিটি মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত দিবস হবে। এ আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেন ১০ জন ব্যক্তি। এরা হলেন:- আলবার্ট ভিনজন ও কারমেন ক্রিস্টোবাল- তাদের মাতৃভাষা ফিলিপিনো। জেসন মরিন ও সুসান হজিনস- তাদের মাতৃভাষা ইংরেজি। ড. কেলভিন চাও- মাতৃভাষা ক্যান্টোনিস। নাসরিন ইসলাম- মাতৃভাষা কাচ্চি। রিনাতে মার্টিনস- মাতৃভাষা জার্মান। করুণা যোশী- মাতৃভাষা হিন্দি। রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম- মাতৃভাষা বাংলা। মোট সাতটি ভাষার মানুষ এ আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেন। তবে এটা বিনাদ্বিধায় বলা যায় যে, বাঙালি যারা ছিলেন তারা এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। অন্য ভাষার যারা ছিলেন তাদের একুশের তাৎপর্য বোঝাতে তারা সক্ষম হন। নিজেদের মাতৃভাষার গৌরবের কথা তাদের কাছে তুলে ধরেন এবং সম্মিলিতভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে এ দিনটির জন্য নির্বাচন করার ব্যাপারে তাদের সম্মত করান।
এ আবেদনপত্রের উত্তরে জানানো হয় যে, বিষয়টি নিয়ে ইউনেস্কোতে যোগাযোগ করতে হবে। সে অনুযায়ী তারা ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের কাছে প্রস্তাব পেশ করেন। ইউনেস্কো উক্ত গ্রুপটিকে জানায় যে, এ ধরনের প্রস্তাব ইউনেস্কোর সদস্য রাষ্ট্রসমূহের যে কোনো জাতীয় কমিশন কর্তৃক উত্থাপিত হতে হবে। ভাষাপ্রেমী গ্রুপের পক্ষে রফিকুল ইসলাম টেলিফোনে বিষয়টি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শিক্ষাসচিব বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের মহাসচিবকে অবহিত করেন। বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে প্রস্তাবটি ইউনেস্কো দফতরে যথাসময়ে পেশ করে।