নতুন দেশে বাবা-মা হিসাবে আপনার ভূমিকা কেমন হওয়া উচিৎ

অভিবাসীদেরকে বাবা-মা হিসাবে সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে বেশ কিছু দোলাচলের মধ্যে পড়তে হয় যা স্থানীয়দের ক্ষেত্রে হয় না। যেমন, অভিবাসী বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়ের শিক্ষক যে ভাষায় কথা বলেন সে ভাষায় হয়তো যোগাযোগ করতে পারেন না। শিশুদেরকে স্কুলে বা বন্ধুদের মাধ্যমে যে মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়া হয় তার সঙ্গে বাবা-মা একমত না-ও হতে পারেন। তাদের শিশুরা যে ধরণের সাংস্কৃতিক সংঘাতের বা আত্ম-পরিচয়ের সংশয়ের মুখোমুখি হয় বাবা-মা হয়তো সে ধরণের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অপরিচিত হতে পারেন। এধরণের চ্যালেঞ্জের মুখে বাবা-মাকে নতুন পরিবেশে তাদের ভূমিকা নতুন করে নিরূপণ করতে হচ্ছে এমনটা প্রায়ই দেখা যায়।

বাবা-মা হিসাবে ভূমিকা (প্যারেন্টিং স্টাইল) এমন একটি ধারণা যার অর্থ হলো সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাবা-মার সার্বিক মনোভাব ও আচরণ যেমন থাকে সেটিই। বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষক মনোবিজ্ঞানী ডিয়ানা বমরিন্ড এই ধারণার উদ্ভাবক। গবেষকরা প্রধানত চারটি প্যারেন্টিং স্টাইল চিহ্নিত করেছেন। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি অন্যগুলোর চেয়ে বেশি কার্যকর যার ফলে শিশুদের মধ্যে উচ্চস্তরের মানসিক কল্যাণ, সামাজিক যোগ্যতা  ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে ভাল করার দৃষ্টান্ত তৈরি হয়।

প্রথম যে ধরণটির কথা গবেষকরা বলেন সেটি হলো উদারনীতিক ধরণ। উদার বাবা-মা তাদের সন্তানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থায় না গিয়ে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং অধিকতর গ্রহণশীল হন। তারা সন্তানের কাছে খুব বেশি কিছু দাবি করেন না এবং তাদেরকে নিজের আচরণ যতটা সম্ভব পরিচালনার সুযোগ দেন। এসব বাবা-মা বাইরে থেকে নির্ধারিত নিয়ম-কানুন মেনে চলতে উৎসাহিত করেন না এবং তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেয়ার পরিবর্তে যৌক্তিকভাবে আচরণ করেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, উদার বাবা-মায়ের সন্তানেরা তাদের আবেগ ও আকস্মিক তাড়না নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সমস্যায় ভোগে। তারা দায়িত্ব গ্রহণে অনিচ্ছুক হয় এবং তাদের মধ্যে সমস্যাবহুল  কিংবা অসামাজিক আচরণের দিকে (যেমন মাদক গ্রহণ, গুন্ডামি ইত্যাদি) ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বেশি থাকে। স্কুলেও তারা তেমন ভাল করতে পারে না। তার পরও এসব শিশুর আত্মবিশ্বাস থাকে অপেক্ষাকৃত উঁচু এবং তারা বিষন্নতায় কম ভোগে।

বাবা-মার ভূমিকা সম্পর্কিত দ্বিতীয় যে ধরণ চিহ্নিত করা হয়েছে সেটি হলো একেবারেই সংস্রববিহীন বাবা-মা। উদার বাবা-মার মতই সংস্রববিহীন বাবা-মারও সন্তানের কাছে চাহিদা খুব সামান্য। তবে উদার বাবা-মার সঙ্গে এদের তফাৎ হলো এরা সন্তানের ব্যাপারে সামান্যই উষ্ণতা দেখান বা সাড়া দেন। এই ধরণের বাবা-মার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় যখন তারা সস্তানকে প্রত্যাখ্যান করেন বা তাদের প্রতি অবহেলা করতে শুরু করেন।

এর ফলে যেমনটা আশা করা যায় সংস্রববিহীন বাবা-মার সন্তান হতে পারে সমাজে সবচেয়ে খারাপভাবে খাপ খাওয়ানো একজন মানুষ। তাদের অপেক্ষাকৃত দুর্বল সামাজিক দক্ষতা থাকে। আবেগ ও আকস্মিক তাড়না নিয়ন্ত্রণে তাদের সমস্যায় পড়তে হয়, স্কুলে তারা তেমন ভাল করতে পারে না এবং অনেক বেশি পরিমাণে বিষন্নতায় ভোগে।

তৃতীয় ধরণের বাবা-মা হলো ব্যক্তি-স্বাধীনতার পরিবর্তে কর্তৃপক্ষীয় শাসনের পক্ষপাতি বাবা-মা। এরা সন্তানের জন্য অত্যন্ত উন্নত কাঠামোর ও শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করেন। তারা মূল্যবোধের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করেন, যেমন কর্তৃপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা, কাজের প্রতি শ্রদ্ধা এবং শৃঙ্খলা ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা।

এসব বাবা-মা আশা করেন যে তাদের সন্তান সুনির্দিষ্ট মান ও বিধি-বিধানের প্রতি অনুগত থাকবে এবং তারা বিশ্বাস করেন যে তাদের যে কোন সিদ্ধান্ত সন্তানেরা বিনা প্রশ্নে এবং দ্বিমত প্রকাশ না করেই মেনে নেবে। এরা সন্তানের সঙ্গে কোন ধরণের দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টাকালে খুব কম ক্ষেত্রেই তাদের বক্তব্যের পেছনে কারণ দেখান।

দেখা গেছে, এধরণের বাবা-মায়ের সন্তানেরা সামাজিক দক্ষতার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়। অন্য শিশুদের চেয়ে তাদের মধ্যে অধিকতর উদ্বেগ থাকে এবং তারা নিজেকে সরিয়ে রাখে, আত্মবিশ্বাস থাকে কম, আর বিষন্নতা থাকে প্রবল। অবশ্য এধরণের শিশুদের সমস্যাসঙ্কুল কর্মকাণ্ড বা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকে কম। স্কুলে এরা ভাল করে।

চতুর্থ শ্রেণীর বাবা-মা হলেন কর্তৃত্ববাদী বাবা-মা। কর্তৃপক্ষীয় শাসনের পক্ষপাতি বাবা-মার মতো কর্তৃত্ববাদী বাবা-মাও আশা করেন যে তাদের সন্তান কর্তৃপক্ষের প্রতি সম্মান দেখাবে এবং তারা সন্তানের

জন্য সুনির্দিষ্ট মান ও আচরণবিধি তুলে ধরেন। এরা অবশ্য সন্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টাকালে কারণ দেখানোর বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেন বা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করেন। এধরণের বাবা-মা তাদের সন্তানকে একই সঙ্গে নিজের মত প্রকাশে এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণে উৎসাহিত করেন। এরা সন্তানের ইচ্ছা বা স্বার্থকে সরাসরি দমিত না করে বরং যৌক্তিকভাবে সন্তানের আচরণকে পরিচালিত করার চেষ্টা করেন।

দেখা গেছে, কর্তৃত্ববাদী বাবা-মার সন্তানই সবচেয়ে ভালভাবে খাপখাইয়ে নেয়া শিশু। উত্তর আমেরিকায় এটি এশিয়ান, আফ্রিকান, ইউরোপিয়ান বা হিস্পানিক সব জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই সমানভাবে সত্যি বলে প্রতিভাত হয়েছে। অন্য যে কোন ধরণের বাবা-মার সন্তানের চেয়ে কর্তৃত্ববাদী বাবা-মার সন্তানদের সামাজিক দক্ষতা থাকে ভাল। তারা নিজেদের আবেগ ও  আকস্মিক তাড়না অনেক ভালভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং তাদের সমস্যাজনক বা সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকে অপেক্ষাকৃত কম। এ ধরণের শিশুদের উচ্চস্তরের আত্মবিশ্বাস থাকে এবং তারা সুখি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়।

কোন ধরণের বাবা-মা হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন এটি নিয়ে প্রায়শ সমস্যার মধ্যে পড়েন অনেক বাবা-মা। অনেক বাবা-মা একাধিক ধরণ বেছে নেন বলে জানা যায়। অবশ্য একটি ধরণই সাধারণত প্রধান হয়ে ওঠে। গবেষণায় দেখা গেছে, অভিভাবকত্বের এই ধরণ শিশুর তিন বছর বয়স থেকে শুরু করে বয়ঃপ্রাপ্তি পর্যন্ত সময়কালে তার মনস্তাত্মিক অভিযোজনে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

অবিভাবকত্ব এমন এক দায়িত্ব যার প্রয়োজনীয়তা থাকবেই। আমাদের বেশিরভাগই এটি শেখার জন্য সংগ্রাম করতে থাকি যে কী করে কার্যকর বাবা-মা হওয়া যায়। বিশেষ করে অভিবাসী বাবা-মা যারা একই সঙ্গে একটি নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ারও চেষ্টা করছেন তাদের ক্ষেত্রে এই সংগ্রাম লক্ষ্যণীয়। যারা এক্ষেত্রে সহায়তার প্রয়োজন আছে বলে মনে করবেন তাদের জন্য সহায়তার  সুযোগ রয়েছে। ইন্টারনেটে এবং পাঠাগারে এসংক্রান্ত পড়ালেখার সুযোগ আছে এবং অনেক কমিউনিটিতে ক্লাস নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। প্যারেন্টিং ক্লাস সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যেতে পারে পরিবার সম্পর্কিত বিসি কাউন্সিলের (৬০৪-৬৬০-০৬৭৫)  মাধ্যমে, আপনার স্থানীয় ফ্যামিলি প্লেস অথবা কোন অভিবাসন এজেন্সি থেকে।

-সুনাইনা আসানন্দ দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা একজন কানাডীয় অভিবাসী। ১৯৭৫ সালে শিশুকালে উগান্ডা থেকে তিনি কানাডায় আসেন। তিনি ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তঃসংস্কৃতি মনস্তত্ব বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং একজন প্রাইভেট কন্সালট্যান্ট হিসাবে কর্মরত। তিনি ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কানাডার অভিবাসী কমিউনিটিতে কাজ করেছেন।

এপ্রিল ৫, ২০১৪

-সৈজন্যে : কানাডিয়ান ইমিগ্রেন্ট