অভিনয়কে কখনোই পেশা হিসেবে ভাবতে চাইনা-পরমা
মে ১০, ২০১৫
রেজাউল হাসান ॥‘চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার, সরসীর আরশিতে’..তার নাম পরমা, পুরো নাম পরমা সাইবা আলী । তার সুন্দর দ্যুতিময় মুখখানির সামনে বসে মনে হলো চাঁদের সেই নীলাভ আলোই যেন নেমে এসেছে ধরণীতে। নজরুলের ‘চাঁদ হেরিছে..’গানটাই স্মৃতিতে হয়ে ওঠে দেদীপ্যমান।
বিশিষ্ট টেলিফিল্ম নির্মাতা ও লেখক চয়নিকা চৌধুরী অতি সম্প্রতি টরন্টোতে এসে নায়গ্রা ফলসের পটভুমিতে এখানকার তিন দম্পতিকে নিয়ে নির্মাণ করেন একটি টেলিফিল্ম। সেই তিন দম্পতির এক দম্পতির তরুণী স্ত্রীর ভূমিকায় রূপ দেন পরমা। নাটকে সবাই অভিনয় করেছেন সুন্দর ও সাবলীল। তাদের মধ্যে থেকে হীরক দ্যুতির মতোই-সকলের থেকে আলাদা হয়ে তার প্রতিভার স্ফূরণ ঘটিয়েছেন। তার অভিনয়ের সম্ভাবনায় চয়নিকা চৌধুরীও উচ্ছ্বসিত।
এই হীরক দ্যুতির আবিষ্কারে আমি আর প্রবাসী কন্ঠের সম্পাদক খুরশিদ আলম উপস্থিত হই পরমার মা,বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক ফারহানা পল্লবের নিজস্ব অফিসে। সেদিন শীত ছিল। আর অপরাহ্নের আকাশে ছিল ভারী জমাট মেঘ। পার্কিং লটেই এক পশলা বৃষ্টি আমাদেরকে ভিজিয়ে দেয়। অফিসের উষ্ণতায় এবং পরমা ও তার মায়ের আন্তরিক আতিথিয়েতায় উড়ে যায় শীতের মেঘ। পরমার ব্যাপারে চয়নিকার প্রসঙ্গ টানতেই পরমা হাসতে হাসতে বললেন, জানেন আমার পরিচালকদের ভাগ্য ভাল। তারাই আমাকে সুন্দর করে শিখিয়ে পড়িয়ে নেন।
-কিন্তু প্রতিভা না থাকলে তো হবে না।
সুন্দর করে হাসতে হাসতে পরমা বললেন, সে আমি জানিনে। আমি নাচি গান গাই আবার লিখিও-এসবই সখে।
-তা অভিনয়ের ব্যাপারটা শুরু হলো কিভাবে?
পরমা বললেন, আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড আকতার আঙ্কেল (আকতার হোসেন,নাট্যকার ও নির্দেশক), তিনি আমাকে একটা প্রজেক্ট হিসেবেই নিলেন যেন। যদি পরমাকে একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়া যায়। তখন তিনি মঞ্চে আনছেন-তারই লেখা নাটক যুদ্ধশিশু। সেখানে আমি একজন যুদ্ধশিশুর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। আমার চরিত্রটির নাম ছিল পূর্ণিমা। আমি যেহেতু একজন যুদ্ধশিশু – তার জন্ম বৃত্তান্ত যেহেতু অজ্ঞাত – তাই হিন্দুরা তাকে টানে – তুমি আমাদের আবার মুসলমানরাও বলে,না-তুমি আমাদেরই – ভেরি ইন্টারেস্টিং। অবশ্য এটাই আমার প্রথম অভিনয় নয়, এখান থেকে ব্রডকাস্ট হয় – দেশ টিভিতে রবীন্দ্র নাথের কঙ্কাল,শেষের কবিতায় অভিনয় করা হয়েছিল। তো যুদ্ধশিশুর মঞ্চস্থের তিন দিন পর ফ্লাই করলাম বাংলাদেশে। সাইফুল ওয়াদুদ হেলালের লেখা ও পরিচালনায় নির্মিত টেলিফিল্ম ‘সুপ্রভাত বাংলাদেশে’ অভিনয় করার জন্যে। তাতে আমার ক্যারেকটারের নাম ও ছিল পরমা। পরমা এই প্রথম দেশে গেছে। সে ঢাকাকে দেখছে আবিষ্কার করছে। পুরাণ ঢাকায় গিয়ে বাকরখানি খাচ্ছে। সত্যিই জীবনে আমি ঐই প্রথম বাকরখানি খেলাম। এটা ছিল কাইন্ড অব ডকুড্রামা। একটি মেয়ে ছোট বেলায় প্রবাসে পাড়ি জমায়।তারপরে যৌবনে সে যখন দেশে ফেরে-সব কিছুই যেমন নতুন করে আবিষ্কার করে। আমার ক্যারেকাটারটা ছিল খুবই ন্যাচারাল।
-তা কি হলো এই সুপ্রভাত বাংলাদেশের?
পরমা যেন কিছুটা স্মৃতি হাতড়ে দেখার ভঙ্গিতে বললেন, জানিনা। নাটকটির প্রিমিয়ার হলো নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইট্স-এ। অটোয়াতেও হলো। কিন্তু দেশের কোন টিভি চ্যানেলে নাটকটি প্রচার হয়েছে বলে আমি শুনিনি। আসলে চয়নিকা আন্টি যেমন আর্টিস্টিক আর কমার্শিয়ালও-হেলাল আঙ্কেল-আর্টিস্টিক কিন্তু কমার্শিয়াল নন।
-যদি চয়নিকা চৌধুরীর এই নাটকটা প্রচার হওয়ার পর যদি বেশ নামডাক হয়ে যায়-সেক্ষেত্রে পরমা কি অভিনেত্রীর খাতায় নাম লেখাবে?
উত্তরটা যেন পরমার মুখেই ছিল। মাথা নেড়ে বললেন, না না আমার সে রকম কোন প্লান নেই। ওই যে বললামনা,আমি নাচি গাই অভিনয় করি আবার লিখিও। লিখে তো আমি মিজান রহমান এওয়ার্ড পেয়েছিলাম।
-কি ছিল সেই লেখার বিষয়বস্তু?
-লেখাটার টাইটেল ছিল ‘হোম’। সে সময় ইউনিভার্সিটিতে আমার মেজর ছিল ক্লাসিকাল লিটারেচার। তাই লেখালিখিতে বেশ ডুবে ছিলাম। আমার লেখার শুরুটা ছিল-এরকম যে,একটা মেয়ে শৈশবে বিদেশে যখন এসেছিল তখন তার কোন কিছুই বোঝার বয়স ছিলনা। যখন তার বোঝার বয়স হয়েছে-তখন সে যাচ্ছে তার দেশে। কিছুটা বাস্তব আর কিছুটা কল্পনার থেকে লিখেছিলাম। মেয়েটির বয়স তখন পনেরো। সে ঢাকা এয়ারপোর্টে নামে। মেয়েটির মাঝে তখন একটা অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম নেয়। তখন তার মনে হয়, এখানেই তো আমি-এটাই তো আমার দেশ। শেকড় বলে একটা ব্যাপার আছে না! আমি হয়তো দেশকে সে ভাবে দেখার সুযোগ পাইনি-কিন্তু আমার মা বাবারা তো দেখেছে-সেই ফিলিংসটা তো বায়লজিক্যালি তো আমার ভেতরে ঢুকেই আছে। আমাদের দেশের বাড়ি ফরিদপুরে। জানেন তো পদ্মা পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। রাস্তাঘাট,যানবাহন,ইলেকট্রিসিটি কিছুই তো এখানকার মতো উন্নত নয়। তারপরেও দেশটিতে পা দিয়ে মনে হয়,গাছপালা-প্রকৃতি-এসবই যেন আমার খুব চেনা-খুব আপন! যেমন এখানে আমার ক্রিস্টমাসের লাইটিং দেখতে খুব ভাল লাগে। খুবই এনজয় করি। ড্রাইভ করে করে বিভিন্ন ভ্যেনুতে যাই। কিন্তু খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো-যখন গ্রামের ঘুটঘুটে অন্ধকার নিশুতিতে যেখানে জোনাকীর আলো ছাড়া আর কোন আলো নেই। আমরা ভ্যানে করে যাচ্ছি মাইলের পর মাইল। হাজার হাজার জোনাকীরা নীলাভ আলো জ্বালিয়ে পথ করে দিচ্ছে। কি উজ্জ্বল সেই আলোর প্রভা-এর কাছে ক্রিস্টমাসের সেই আলো মনে হচ্ছিল নিস্প্রভ। দ্যুতিহীন। আমি আমার সেই অনুভূতির কথা কখনোই ভুলবনা। ক্রিস্টমাসের সময় জোনাকীরা আমার হৃদয়ে আলো জ্বেলে যেন মনে করিয়ে দেয়-“আমি কে কোথা হইতে আসিয়াছি!”
তখন পরমাকে আমি আমার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলি। বলি, একবার এক ব্যাংকে গিয়ে টেলর মেয়েটিকে দেখে মনে হলো,মেয়েটি ভারতীয়। আমরা অনেক সময় কৌতুহলী হয়ে উঠিনা যে-তোমার ব্যাক-গ্রাউন্ড কি-হোয়্যার আর ইউ ফ্রম? মেয়েটি খুবই গর্ব ভরে জবাব দিল-আই বর্ণ হেয়ার। আমি অবাক হয়ে বললাম, আই সি।
পরমা দৃঢ়তার সাথে বললেন, কিন্তু ওরা যদি শাদাদের কাছে গিয়ে বলে,আমি তো তোমাদেরই একজন। ওরা তখন ভ্রূ কুচঁকে বলবে, না তো তুমি তো আমাদের নও! পরমা বললেন,আমি একটা নৃত্য নাট্য লিখেছিলাম,আমাদের পিচ্চিদের দিয়ে তা মঞ্চস্থও করিয়েছিলাম। নাম হচ্ছে আইডেনটিটি। কাহিনীটা হচ্ছে, ময়ূরেরা নেচে নেচে তাদের পালক ঝরায়। আর কাক সেই পালক তার অঙ্গে গেথেঁ গেথেঁ ময়ূরদের কাছে গিয়ে বলে,আমি তো তোমাদেরই দলে। ময়ূররা কাককে ভাল করে দেখে বলে, ময়ূরের পালক গায়ে জড়ালেই কি কাক ময়ূর হয়! কাক তো কাকই। তখন কাক ফিরে আসে আবার সেই ডাস্টবিনের কাছে। একদা সে যে ডাস্টবিন ছেড়ে ময়ূরদের দলে ভিড়তে গিয়েছিল,সেখান থেকে সে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আবার কাকদের কাছে আশ্রয় চায়। কাকেরা তাকে আশ্রয় দেয়। আমার বক্তব্য হচ্ছে, তুমি যেখানে বিলং করো-সেখানেই থাকো।
-আপনি কতো বছর বয়সে এখানে এসেছিলেন?
-মাত্র দেড় বছর বয়সে
-এখানে বর্ণ না হলেও তো যে বয়সে এসেছেন, তাতে তো এখানকার শিক্ষা সংস্কৃতি সবই তো অঙ্গে ধারণ করার কথা। কিন্তু যেভাবে শেকড়টাকে আকড়ে রেখেছেন,তা প্রশংসা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। এই প্রবাসী কন্ঠেই আমরা একবার প্রতিভাময়ী নৃত্য শিল্পী পৃথুলা প্রসূনকে কভার করেছিলাম। সেও আপনার মতো জন্ম বাংলাদেশে কিন্তু বেড়ে ওঠেছে এখানে। তার কথায়ও যেন আপনার প্রতিধ্বনি শুনিতে পাই…
পরমা বললেন, সে (পৃথুলা) তো অসম্ভব টেলেন্টেড..তাকে দেখে দেখেই তো আমরা বড় হয়েছি-ইনিসপায়ার্ড হয়েছি। সে একজন দামী আর্কিটেক্ট। এখানকার পড়াশোনা-এখানকার অপরচ্যুনিটি দেশে গিয়ে কাজে লাগিয়েছে। বর্ষার সময় আমাদের মানুষদের কষ্ট তো অবর্ণনীয়। সে ভাসমান বাড়ির একটা প্রজেক্ট করে দেশে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।
-এই যে আপনারা এখানে বেড়ে ওঠলেও দেশের জন্যে দেশের মানুষের জন্যে যে ফিলিংস-এটা কিভাবে ডেভালাপ করলো?
-আমাদের আগের জেনারেশন-অর্থাৎ আমার মা বাবাদের মূল সমস্যা ছিল অস্তিত্বের। তাদের স্যাটল হওয়ার বিষয়টি ছিল খুবই ইমপরটেন্ট। আর আমাদের জেনারেশন স্যাটলড্ । তারা আমাদেরকে সুযোগ করে দিয়েছেন। চিন্তা ভাবনা করার একটা স্পেস আছে। আর একটা কথা অপ্রিয় হলেও বলতে হয়,আমাদের আগের জেনারেশনের দেশ প্রেমের ঘাটতি আছে। চায়নিজ, ভারতীয় বা শ্রীলংকানরা যেমন নিজেদের দেশের মানুষের জন্যে পাগল। অবশ্য এটা আমাদের জেনারেশনে নেই। আমাদের জেনারেশনে কারও ভাল কোন খবর হলে আমরা খুশী হই। কংগ্রেচুলেট করি। দেখবেন, আগামী বিশ বছরের মাথায় আমাদের জেনারেশন যখন লাইম লাইটে চলে আসবে,তখন এসব থাকবেনা। অন্যান্য কম্যুনিটির মাঝে যেমন দেশপ্রেম আছে,দেশের মানুষকে টেনে তোলার আগ্রহ আছে-সেটা আমাদের মাঝেও চলে আসবে। যেমন আমি একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কলেজে চাকরি করি। এখানে দেশ থেকে অনেকে এসে ভর্তি হয়। বিশ হাজার ডলার টিউশন ফি চাইল,দিয়ে দিল। অনেক সময় হয় কি,তারা জিগ্যেস করে দেশ কোথায়-বলি বাংলাদেশে। তখন তারা পরামর্শ চায়,কোর্সটা করলে কি লাভ হবে? দেশের মানুষ বলে কথা-তখন সত্যি কথাই বলে ফেলি। বলি,আপনি কোর্সটা করলেও কাজ পাবেন কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ,আপনার ইংরেজী কাজ পাওয়ার ব্যাপারে মোটেই সহায়ক হবেনা। প্রথমে তো বুঝতে হবে আমি কোথায় আছি। এখানে দাঁড়াতে হলে আমার কি কি যোগ্যতা লাগবে। এ ব্যাপারে আমাদের মেলদের আরও এওয়ারনেস লাগবে। নারীদেরও গাইডেন্স-এর প্রয়োজন আছে।
পরমা বলেন, এভাবে আমাদের লোকদের কাউন্সিলিং করতে করতে আমার মাথায় ল’এর ব্যাপারটা চলে আসে। আমি তো টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে ওমেন স্টাডিজের উপর আন্ডারগ্রাড করছি। সেই সঙ্গে প্যারা লিগালের উপরও কোর্স নিচ্ছি। যাতে ভবিষ্যতে আমার কমিউনিটির মেয়েদেকে আইনি সহায়তা দিতে পারি।
খুরশিদ আলম বললেন, টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে অনেক ছেলেই তো দেশ থেকে পড়তে আসে-আর আপনারা যারা এখানে আছেন-তাদের সাথে রিলেশনটা কেমন?
পরমা বলেন,টরন্টো ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন খুবই একটিভ। ভেরি গুড নেটওয়ার্ক। তারা বিরাট হলে সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান করে। নতুন যারা আসে ডেফিনিটলি একটু আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এর একটা গ্যাপ থাকবেই।-সবাই ইয়াং তো-তাদের একটা চমৎকার স্প্রিট কাজ করে।
পরমা বলেন,আপনারা জানতে চেয়েছিলেন,অভিনয়কে আমি পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারি কিনা? কিন্তু তার কোন স্কোপ নেই। অভিনয় তো আমার কেরিয়ার নয়। লেখাপড়ার মাধ্যমে আমি একটা কেরিয়ার বিল্ডআপ করার চেষ্টা করছি। এটাই আমার গোল। নট দ্য এ্যাকটিং। এ্যাকটিং করি সখে। মানুষকে এন্টারটেইন করার চেষ্টা করি। কিন্তু সেখানে জীবন কোথায়? আমাদের কমিউনিটির মানুষের যে সার্ভিসটা দরকার-তারই বা স্কোপ কোথায়? হোয়াট ইজ মাই কনট্রিবিউশন ইন মাই সোসাইটি? আমরা যদি এগিয়ে না আসি তাহলে আমাদের সোসাইটি উঠবে কিভাবে?
পরমা বলেন, তার মাঝেও কেউ যদি আমার অভিনয় প্রতিভাকে কাজে লাগাতে চায়,ইফ আই হ্যাভ সাম টাইম, আই ডোন্ট হ্যাভ এনি প্রোবলেম টু ডু দ্যাট। এমন কি সেটা দেশে গিয়েও করতে পারি।
– প্রচ্ছদেব্যবহৃতছবিতুলেছেননাদিমইকবাল