রহস্য
মীজান রহমান
অনুষ্ঠানের মাঝখানে চায়ের বিরতি। খাবারের স্টলে মানুষ একে অন্যের ঘাড়ের ওপর। এক হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রলোক প্লেটভর্তি খাবার নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মনে হল খোশালাপের বাসনা। খুচরো দু’চারটে কুশলজিজ্ঞাসার পর সোজাসুজি প্রশ্ন করলেনঃ আপনার রহস্যটি কি বলুন তো ভাই।
রহস্য মানে? আমি থতমত খাই তার প্রশ্ন শুনে।
মানে এই যে আশিতে পৌঁছুলেন আপনি, অথচ দেখলে মনে হয় ষাট। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারা দুনিয়া। তরুণদের মত কেবল ছুটোছুটি করছেন।
রহস্য কিছু না ভাই। আপনিও পারবেন। ওই প্লেটের সাইজটা একটু কমিয়ে ফেলুন, তাহলেই হবে। ভদ্রলোককে বলতে চেয়েছিলাম, এবং এই যে ভূড়িটাকে চালের বস্তা বানিয়েছেন সেটাও একটু সমস্যা বটে। বলা গেল না ভদ্রতার খাতিরে।
ভদ্রলোক খুব মজা পেলেন কথাটিতে। হেসে লুট। যা বলেছেন। কিন্তু কি করি বলুন, জিভের লোভ সামলানো যায়, চোখের লোভ সামলাই কি করে। কিন্তু না, ঠাট্টা নয়, সিরিয়াসলি বলছি। আপনার কোনও সিক্রেট ফর্মুলা আছে নিশ্চয়ই। আপনি হলেন অঙ্কের লোক, ফর্মুলা নিয়েই তো আপনাদের কারবার। বলে ভদ্রলোক আবারো হাসলেন। অনর্থক। সম্ভবত নিজেরই মন্তব্যের চাতুর্যে প্রীত বোধ করার ফলে। আমিও হাসি। ভিন্ন কারণে। অঙ্ক হল আর্ট। একথা বললে তো ভদ্রলোক আরো ভড়কে যাবেন। সব আর্টের সেরা আর্ট। সর্বনাশ। বলে কি লোকটা, নিশ্চয়ই ভাববেন এই প্লেটভর্তি-খাবার-নেওয়া ভূড়িতে-চালের-বস্তা-ধারী হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রলোক।
না ভাই, ফর্মুলা নেই কোনও। সিক্রেটের তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। তবে একান্তই যদি শুনতে চান, রহস্য একটা আছে বই কি। একটা নয়, দুটো, আসলে। প্রথমটি খুবই সাদামাঠা। লোকে যাকে ভাগ্য বলে, আর আমি বলি প্রবাবিলিটি। সিক্রেট যদি বলতে হয় কোনকিছুকে তাহলে এটিই প্রকৃতির সবচেয়ে বড় সিক্রেট। প্রবাবিলিটি সূত্র। বা সম্ভাব্যতা। লোকে সেটা বোঝে না বলে ভাগ্য বলে চালিয়ে দেয়। ‘ভাগ্য’টা লটারি জেতার মত। সবার বেলায় ঘটে না। কারো কারো বেলায় ঘটে। আমি সেই ‘কারো কারো’দের অন্যতম। এটা কি রহস্য? নাকি প্রতিরহস্য? এন্টিমিস্টেরি?
আর দ্বিতীয়টি?
ও হ্যাঁ, দ্বিতীয়টি। সেটিও তেমন রহস্য নয়। লোকে বলে আমি শরীরচর্চা করি। ঘড়ির কাঁটা আর আমার কাঁটা সমান তালে চলে, ইত্যাদি। সেটা ধর্তব্য বটে, তবে আসল ব্যাপার অন্যত্র। আসল ব্যাপার শরীর নয়, মন। মানের লাগাম ছেড়ে দিন। শেকল খুলে ফেলুন। তাহলেই দেখবেন আকাশ আপনার দখলে এসে গেছে।
একটু ধাঁধায় ফেললেন ভাই। মনের শেকল বলতে কি বোঝায়? লাগামটিই বা কি জিনিস? আপনি দেখি রহস্য কেবল বাড়িয়েই দিচ্ছেন।
এর জবাব আমার জানা নেই। মনের শেকল, মনের লাগাম, এগুলো কেবল মন থাকলেই জানা যায়। এগুলো কাউকে বোঝানো যায় না। বোধ নামক সেই যে সূক্ষ্ম, অন্তর্লীন বস্তু রয়েছে একটি, ওটা থাকতে হয়। আসলে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই শেকলপরা। তারা জানেনা, এই যা। মনের শেকল বলতে এ’ই বোঝায়—-শেকল আছে এটাও তখন বোঝার শক্তি লোপ পায়।
আমি কি পেরেছি সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হতে? আংশিকভাবে হয়ত হয়েছি (পরম ভাগ্যবলে), কিন্তু সম্পূর্ণ মুক্তি পাইনি। অতিমানব হতে হয় তার জন্যে, যা আমি নই। আমার যদি সিক্রেট থাকে কোনও তাহলে এই আংশিক শেকলভঙ্গের ব্যাপারটিই সেই সিক্রেট। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তার জন্যে। জীবনের বেশির ভাগ সময় তো নিগড় পরা অবস্থাতেই থাকলাম, শেষ বয়সে হঠাৎ কি হল মনে বেঁকে বসল। এসবের কোন অর্থই আর বোধগম্য মনে হল না। বিজ্ঞান আর গণিতের ছাত্র হলে কাজটা একটু সহজ হয়। বিজ্ঞান প্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটন করাতেই নিত্য প্রয়াসী। উদ্ঘাটন করে করে পরম সত্যের দুয়ারে পৌঁছানো এই তো বিজ্ঞানের লক্ষ। গণিতেরও তাই। এর কোন বিকল্প নেই। ‘পরম সত্য’ বলে আসলেই কি আছে কিছু? হয়ত আছে হয়ত নেই। তারও সিদ্ধান্ত দেবার ক্ষমতা কেবল বিজ্ঞানেরই। এই যে নিরন্তর পথচলা আমাদের দর্শন-গণিত-বিজ্ঞানের হাত ধরে তার অন্তিম লক্ষ তো তাই। এই খোঁজার মধ্যেই আমাদের বেঁচে থাকার সার্থকতা। আসলে সন্ধান মানেই কি জীবিত থাকা বোঝায় না?
আমার রহস্য যদি থাকে কিছু তা হল যে আমি নালিশ পছন্দ করি না। জীবন আমাকে যা দেয় তা’ই আমি গ্রহণ করি অম্লানবদনে। আক্ষেপ আমার অসহ্য। হাহুতাশ আমার দুচক্ষের দুষমন। ‘কি হতে পারতাম কি হইনি’ বলে আহাজারি করার মত কাপুরুষ আমি নই, ভাগ্যিস (তাহলে নিজেকে সহ্য করা দুষ্কর হয়ে যেত)। আমার মতে বিগতকে অতীতের দেশে বাস করতে দিন। তাকে আমি বদলাতে পারব না। ওটা নিয়ে ভাবতে গেলে বরং বর্তমানটিও হাতছাড়া হয়ে যাবে। আমার দর্শন অনুযায়ী, গতকাল ইতিহাসের অন্তর্গত, আগামীর বাস স্বপ্নের রাজ্যে। কেবল আজকের দিনটিই আমার অধীন। আমি অদ্যের অধিপতি। যে-কোন কাজ, যে-কোন পরিকল্পনা, যে-কোন উদ্যোগ, আমি আগামীকালের জন্যে ফেলে রাখব না, আজই শুরু করা চাই। আজ, এবং এই মুঘূর্তে। আগামী একটি সুদূর সম্ভাবনা মাত্র যার ভিত্তি আজকের উদ্যম। সিক্রেট যদি জানতে চান ভাই এই আমার বিনীত সিক্রেট। সাধারণ মানুষের সাধারণ সিক্রেট।
আরেকটা জিনিস আমি মানি—-নিজেকে খুব বেশি গুরুত্ব দিই না। কেউ কেউ ভাবেন তিনি চলে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, পৃথিবীর একটা অংশ ধ্বসে পড়বে একেবারে। আপনি আশ্বস্ত হোন, আপনি চলে গেলে সংসার যেভাবে চলছে ঠিক সেভাবেই চলতে থাকবে—- পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হবে না। নিজেকে কখনোই অপূরণীয় ভাববেন না। আমি যেমন ভাবি না, এবং এটি আমার আরেকটি সিক্রেট। বরং আমি নিজেকে নিয়ে হাসি। নিজের অসঙ্গতিকে নিয়ে ব্যঙ্গ করি—-ভেংচি দিই নিজেকে। অনেক চেষ্টা করে আমি আয়ত্ত করেছি কিভাবে নিজের রক্তমাংসের কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরবর্তী পর্যবেক্ষকের সারিতে দাঁড়াতে। তাই আমার মনে খ্যাতির মোহ প্রশ্রয় পায়না। চাওয়া-পাওয়ার প্রাত্যহিক প্রত্যাশা প্রশ্রয় পায়না। আমি যা পাই তা চাই বলে পাই না, চাই না সত্বেও পেয়ে যাই কখনো কখনো—–তখন তা সকৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করি। গ্রহণ করি, প্রধানত যার কাছ থেকে পাওয়া তারই সম্মানার্থে। নিজের সম্মান? সে-ভাবনাটাই আমার কাছে দারুণ হাস্যকর মনে হয়।
মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা দুটি। এক, তার আকাঙ্ক্ষা। দুই, তার ভয়। বিশেষ করে মৃত্যুভয়। আকাঙ্ক্ষা তাকে খর্ব করে, ভয় তাকে কুব্জ করে। মানুষ জীবনে সুখি হতে চায়, কিন্তু এ এক অদ্ভুত বিড়ম্বনা জীবনের যে সেই সুখের প্রত্যাশার ভেতরেই উপ্ত তার অসুখের বীজ। যতই চাই আমরা ততই হারাই—- এ কেমনতরো বিচার বলুন তো।
কিন্তু তারও চেয়ে বড় বিড়ম্বনা হল মৃত্যুভয়। প্রতিটি মানুষ জানে যে তার জন্মের পর কেবল একটা কথাই ধ্রুবসত্যের রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হয় তার সামনে—-মৃত্যু। অথচ এটিকেই তার সবচেয়ে বড় ভয়। মানুষ মরতে চায় না। তাই মৃত্যুঞ্জয় হবার আশায় কত না ফন্দী সে আবিষ্কার করেছে। কত না স্বর্গ বেহেশত আর দোজখ আখের সে রচনা করেছে অমরত্বের অর্বাচীন আকাঙ্ক্ষায়। আমার মতে, মানুষ মৃত্যু দ্বারা যত না মরে, তার চেয়ে বেশি মরে মৃত্যুর ভীতি দ্বারা। এবং এই ভয় কোনও জৈবিক উপায়ে তার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে না, প্রবেশ করে সামাজিক আর সাংস্কৃতিক উপায়ে। জীবনের প্রথম প্রভাত থেকেই তাকে প্রস্তুত হতে হয় মৃত্যুর পরবর্তী সেই অলীক পৃথিবীটির জন্যে। যা অস্তিত্বহীন তার জন্যে তাকে বিসর্জন দিতে হয় যা অস্তিত্বমান ও বাস্তব। জীবনের প্রতিটি সজাগ মুহূর্ত আমরা মরে মরে ক্ষয় করি অমর হবার মূঢ় বাসনাতে। এর চেয়ে বড় আত্মবিড়ম্বনা আর কি হতে পারে।
দেশের একটা চলতি কথা আমি বরাবরই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখিঃ ‘দোয়া করবেন আমার জন্যে’ বা ‘ আপনাদের দোয়ায়’। প্রথমে বলুন দোয়া বলতে কি বোঝায়। প্রার্থনা? প্রার্থনা কার কাছে? তিনি কোথায়? ‘তিনি’ নামক কেউ সত্যি সত্যি আছেন কি নেই সেটা আপনিও জানেন না আমিও জানি না। লোকের মুখে শোনা, এইমাত্র। প্রবাবিলিটির সূত্র অনুযায়ী না-থাকার সম্ভাবনাটিই বেশি। তবু কেন কথায় কথায় আমরা তাঁরই শরণাপন্ন হই। যদি ধরে নিই যে তিনি আছেন, সাত আসমানের ওপরেই হোক আর বিশ্বব্রম্মাণ্ড জুড়েই হোক, তিনি যে আমার সুপারিশ শুনে আপনার একটা উপকার করে দেবেন, বা, আমার সুপারিশ শুনে করবেন আপনার উপকার, সে-খবরটি আপনি কোত্থেকে পেলেন? তিনি যে তদবির-সুপারিশে আদৌ মত পরিবর্তন করতে পারেন তেমন কথা তো আমি কোনও ধর্মগ্রন্থের কোন পাতাতে খুঁজে পাইনি। তাহলে আমরা, এই স্বাধীন দেশের মহান বাংলাদেশী জাতি, কেন অহরহ ‘দোয়া করবেন’ আর ‘আপনাদের দোয়ায়’ বলে সময় নষ্ট করি। এই ‘দোয়া’ শব্দটাই আমার কাছে ভয়ংকর অপমানজনক মনে হয়।
আমি কষ্টকে কষ্ট হিসেবে দেখি না। দুঃখ নিয়ে অশ্রুবর্ষণ, সেপথ আমার নয় ভাই। দুঃখ আমার মতির হার। দুঃখ আমার স্বর্ণখনি। দুঃখই মহৎ সৃষ্টির আকর। তাই এক অদ্ভুত উপায়ে দুঃখ আমার প্রানে সুখভাব সঞ্চার করে। প্রানে ভাবনার প্রদীপ জ্বালায়। আমাকে উজ্জীবিত করে। আমি সুখি, কারণ আমার ভেতরে মুক্তির শিখা নিত্য প্রজ্বলিত। অনেক, অনেক পথ ভ্রমণ করে অবশেষে আমি মুক্ত। আমি নিজের কেন্দ্র থেকে বহির্ভূত হয়ে এখন বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। যে মুক্তি মানুষকে অন্তর্মুখি করে সে মুক্তি আমার নয়—-আমি বহির্মুখি মুক্তিতে বিশ্বাসী।
আমার বন্ধুরা আমার বয়স নিয়ে উদ্বিগ্ন। কখন না কি হয়ে যায়। কিছু হলে তো কেউ জানবেও না। বেশ, কেউ জানবে বা। তাতে সংসারের কার কি ক্ষতি? রান্নাবান্না এখনও আপনিই করেন? অবশ্যই করি। ঘরদোর পরিষ্কার করার নেই কেউ? নিশ্চয়ই আছে—থাকবে না কেন? আমি থাকতে ভাবনা কিসের। মানুষকে বোঝাতে পারিনা যে বয়সের সঙ্গে আমার সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে গেছে বহু আগেই। বয়স চলে বয়সের পথে, আমি আমার। আয়নায় দাঁড়িয়ে যে লোকটাকে দেখি প্রত্যহ সে মানুষ আর আমি এক নই। আমরা আলাদা হয়ে গেছি। বয়স হয়েছে বলে ঘরে বসে মৃত্যুর ভয়ে কুঁকড়ে থাকব লেপের নিচে সে-মানুষ আমি নই। আমি হেমন্তের গাছেদের মত—-এখনো পাতায় পাতায় সাজবার ক্ষমতা আছে। আছে উত্তরের বাতাসের সঙ্গে হেলেদুলে নাচবার ক্ষমতা। তারপর একসনয় যখন পাতারা ঝরে যাবে, তখনও আমি থাকব—-নিষ্পত্র কঙ্কাল হয়েও আমি থাকব।
মীজান রহমান
অটোয়া,
১০ই অক্টোবর, ‘১২