বহুসংস্কৃতিবাদ এক নতুন ধরণের অভিবাসীদের উৎসাহিত করছে যারা আমাদের সম্পদে ভাগ বসায় কিন্তু মূল্যবোধ ধারণ করে না

গিওর্গি জোনাস ॥

নাগরিকত্ব কেবল সুবিধা লাভের পাসপোর্ট হওয়া উচিৎ নয় বলে কানাডার নাগরিকত্ব ও অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডার যে মন্তব্য করেছেন তার সঙ্গে একমত হওয়া খুব সহজ। কিন্তু তার প্রস্তাবিত বিল সি-২৪-এ এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা আদৌ কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি না সেটা বলা কঠিন। তিন বছরের জায়গায় এখন চার বছর কানাডায় বসবাসের পর কেউ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন, এটুকুই তো? বিরাট কাজ। ৫০ বছর আগে এই সময় সীমা  ৫ বছর ছিলো।

সম্প্রতি প্রকাশ করা সংস্কার কর্মসূচির আওতায় নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের আগে বর্তমানের তিন বছরের জায়গায় অভিবাসীদেরকে কানাডায় চার বছর অপেক্ষা করতে হবে। সংস্কার কর্মসূচি অনুযায়ী কানাডীয় হতে আগ্রহী ব্যক্তিদেরকে বর্ধিত ফি দিতে হবে এবং তাদের ভাষাগত ও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান পরীক্ষার শর্ত পূরণ করতে হবে।

নাগরিকত্বের মূল্যবোধ জোরদারের প্রচেষ্টা হিসাবে দাবি করে প্রচারিত অভিবাসন মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডারে প্রস্তাবিত এই সংস্কারে প্রতারণার দায়ে শাস্তির বিধান বাড়ানো হয়েছে এবং নতুন কানাডাবাসীদের এদেশে বসবাসের আবম্যকতার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে।

সন্ত্রাস, গুপ্তচরবৃত্তি বা বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে কানাডীয়দের নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে যদি তারা দ্বৈত নাগরিক হয় অর্থাৎ যদি সে অন্য কোন দেশেরও নাগরিক হয়ে থাকে।

একজন অভিবাসী হিসাবে আমার স্বাভাবিক সহানুভূতি থাকবে অভিবাসীদের প্রতি; একজন কানাডীয় হিসাবে আমার স্বাভাবিক সহানুভূতি থাকবে কানাডীয়দের প্রতি। এই দুটির মধ্যে কোনও বৈরিতা নেই। এরা একটি আরেকটির চমৎকার পরিপূরক যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এদেরকে অতি চতুর নীতি যেমন বহুসংস্কৃতিবাদের মাধ্যমে সাংঘর্ষিক অবস্থার দিকে ঠেলে দিই।

এটি কোনও তত্ত্ব নয়; এটি হচ্ছে যা ঘটছে সেই বাস্তবতা। বড় ধরণের অভিবাসী গোষ্ঠী রয়েছে এমন অন্যান্য কিছু দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি কানাডাও সমস্ত বিশ্ব থেকে নতুনদের আগমনকে উৎসাহিত করা এবং তাদের ইচ্ছা ও ব্যবস্থাপনার আলোকে তাদেরকে কানাডীয়, আমেরিকান বা অস্ট্রেলীয় হওয়ার সুযোগদানের মাধ্যমে একটি যৌক্তিক সামগ্রিকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং তারপর তারা কতটা ঘনিষ্ঠভাবে সমাজের সঙ্গে মিশতে পারছে সেই নিরিখে তাদেরকে পুরষ্কৃত করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় অভিবাসীরা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে, কিন্তু সাধারণভাবে তারা সেই সমাজকে সমৃদ্ধ করছে যা তাদেরকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর এটি ঘটছে প্রায়শ এক জেনারেশনের  মধ্যেই।

যদিও এটি কখনও মুখে উচ্চারণ করা হয়নি তবু সত্য বলে ধরে নেয়া হয় যে, ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত মানুষের মধ্যে এমন ধারণা ছিলো যে, অভিবাসন ততক্ষণ পর্যন্ত উপকারী যদি সেটা প্রথমে স্বাগতিক সমাজের জন্য উপকারী হয়। অভিবাসীর নিজের স্বার্থ তখনই অর্জিত হবে যখন তিনি স্বাগতিক সমাজের সঙ্গে নিজেকে কার্যত যুক্ত করতে পারার সুযোগ নিতে পারবেন। এর কোন অর্থবহতা থাকলে তা অবশ্যই একটি স্বাগতিক জাতীয়তার অস্তিত্ব থাকতে হবে ও তা গ্রহণ করার আকাঙ্খা মেনে নিতে হবে। যদি ‘আমেরিকান’ বা ‘কানাডিয়ান’ বলে কিছু না থাকে তাহলে তাতে যোগ দেয়ারও কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। স্বাভাবিকভাবে তৈরি হয়ে ওঠা বহু জাতিগোষ্ঠীর লোকদের এক করে ফেলতে সক্ষম আমেরিকান ‘মেল্টিং পট’ মডেলের সমাজ এবং একইসঙ্গে দেখেশুনে পছন্দ করা কানাডীয় মডেলের ‘সাংস্কৃতিক মিশ্রণ’ ছিলো একটি জাতির প্রাক-অস্তিত্ব যা গ্রহণ করার জন্য অভিবাসীরা আবেদন করতেন।

সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত এমনকি বৈরি অঞ্চল ও সংস্কৃতি থেকে আসা অভিবাসীদের আনুগত্য পাশ্চাত্যকে বিনষ্টির দিকে ঠেলে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে প্রত্যেক টোকিও রোজের জন্য  (টোকিও রোজ হলো লস-অ্যাঞ্জেলেস-এ জন্মগ্রহণকারী একজন জাপানি-আমেরিকান নারীর ডাকনাম যিনি যুদ্ধকালে রেডিওতে জাপানি প্রচারণা কার্যক্রম সম্প্রচার করেছিলেন) হাজারও জাপানি-আমেরিকান সৈনিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছিলেন। একই রকমের প্রবণতা অব্যাহত থাকে ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ও, যখন শত্র“ভাবাপন্ন কমিউনিস্ট দেশগুলোর নাগরিকরা প্রায়শ উত্তর আমেরিকায় আশ্রয় পেতেন। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এবং পূর্ব ইওরোপ থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা এসব নবাগতরা তাদের নতুন আবাসভূমির মূল্যবোধ ও স্বার্থের প্রতি পাশ্চাত্য বংশোদ্ভূত স্থানীয় নাগরিকদের মতই নিবেদিতপ্রাণ। ফিডেল ক্যাস্ট্রোর আমেরিকাবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ফ্লোরিডার সাবেক-কিউবান কমিউনিটি যতটা প্রবলভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো খুব কম আমেরিকানই তেমনটা সোচ্চার হয়েছিলো।

গত ৪০ বছরে সংশয়ান্বিত আনুগত্যশীল অভিবাসীদের উদ্ভব ঘটেছে এবং এর পর এসেছে আনুগত্যহীন স্থানীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকরা যারা কখনও অভিবাসীদের সন্তান হিসাবে কখনও ইসলামী ধর্মান্তরিত হিসাবে দেখা দিয়েছে। নতুন অভিবাসীরা পাশ্চাত্যের সম্পদে ভাগ বসাতে চায় কিন্তু তাদের মূল্যবোধের শরিক হতে রাজী নয় বলে মনে হয়। অনেক দিক থেকেই তার চেহারা একজন স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বা রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর চেয়ে বরং একজন অনুপ্রবেশকারীর সঙ্গে মিলে যায়।

স্বাগতিক দেশের সমাজের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার পরিবর্তে এরা উল্টো স্বাগতিক দেশের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার দাবি জানায়। তারা নিজেদের ভাষাগত বা ধর্মীয় চাহিদাগুলো সমাজে খাপখাইয়ে নেয়ার জন্য সমাজের প্রতি আহবান জানায়। ১৯৮৫ সালে সিএনআর-এর রেলওয়ের একজন শিখ কর্মী তার পাগড়ি বাদ দিয়ে নিয়মমাফিক শক্ত টুপি পরতে অস্বীকৃতি জানায়। এটি তবু যথেষ্ট নিরীহ প্রকৃতির বিষয় ছিলো কিন্তু ১৯৯১ সালে টরন্টো পুলিশে বোর্ড কমিশনার হিসাবে নবনিযুক্ত একজন এশীয় ঐতিহ্যগতভাবে রাণীর কাছে শপথ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান যা কোনভাবেই সামান্য বিষয় ছিলো না।

স্বাগতিক সমাজের স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে সমন্বয় সাধন করে নেয়ার। শক্ত হ্যাটের জায়গায় বিকল্প হিসাবে পাগড়ি পরার নিয়ম করা হয়েছে; পুলিশের শপথ গ্রহণের ভাষা পাল্টানো হয়েছে। এমনকি কিছু বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিক ড্যাগার বহনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়ের কারণে দাবির বহর কেবলই বাড়ছে। সাংস্কৃতিক বিষয়ে ছাড় দেয়ার অনুরোধ শিগগিরই প্রকাশ্যে উত্থাপিত আনুগত্যহীনতার অনুভূতিতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে ব্রিটেনে একটি মুসলিম গ্র“প এমন মনোভাব প্রকাশ করে যে, আল্লাহর আইনের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ কোন ব্রিটিশ আইন মানতে ব্রিটেনের কোন মুসলিম বাধ্য নন।

এ ধরণের বক্তব্য যতই বিরক্তিকর হোক, এটি বেআইনী ছিলো না। ভিন্ন মতের প্রকাশ আমাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অংশ। দুর্ভাগ্যের বিষয় নতুন ভিন্নমতাবলম্বীরা গণতান্ত্রিক নয়। তাদের ভিন্নমত শেষপর্যন্ত আমেরিকা ও ইওরোপের শহরগুলোতে হুমকি দান, ফতোয়া, গুপ্ত হত্যা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে গণহত্যায় পর্যবসিত হয়েছে।

এটা কীভাবে সম্ভব হলো? এর তিনটি কারণ বলা যেতে পারে।

প্রথমত, আমরা আমাদের এই নীতি থেকে সরে এসেছি যে অভিবাসন সর্বপ্রথম স্বাগতিক দেশের স্বার্থ রক্ষা করবে। আমরা ঐতিহ্য-বহির্ভূত অভিবাসনের ধারণা গ্রহণ করেছি। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম যে, যখন ভিন্ন সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের লোকদের দল উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আসবে তখন তারা হয়তো তাদের নিজস্ব কমিউনিটি গড়ে তুলতে পারে। আর তারা যে কেবল জাতিগত বৈচিত্র্যের প্রকাশ বা উৎসব পালন বা রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং তারা আলাদা সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক স্বত্ত্বা হিসাবে নিজেদের সমাজ গড়ে তুলতে পারে।

এরপর, আমরা বহুসংস্কৃতিবাদের ধারণা উজ্জীবত করার মাধ্যমে এসব দায়কে সম্পদে রুপান্তরের চেষ্টা করেছি। আমরা অভিবাসনের কারণে এসবকিছু ঘটছে বলে মূল্যায়ন করা বন্ধ করি এবং এমন ধারণা থেকে অভিবাসনের প্রশংসা করতে শুরু করি যে, স্বাগতিক দেশ তার নিজস্ব সংস্কৃতির বৈধ স্বত্ত্বা নয় বরং এটি সহাবস্থানকারী বিভিন্ন সংস্কৃতির রাজনৈতিক কর্মকাঠামোমাত্র।

সবশেষে, মৌলবাদী ইসলামের ক্ষেত্রে, আমরা একটি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি যার কাছে সিজারের যা প্রাপ্য তা সিজারকে দেয়া এবং খোদার যা প্রাপ্য তা খোদাকে দেয়ার মৌলিক ধারণাই অচেনা। সংশোধনবাদী (চঁৎরঃধহরপধষ) ইসলামে বিবেচনা করা হয় যে, সবকিছুরই মালিকানা খোদার (অন্তত আল্লাহ সম্পর্কে কতিপয় মোল্লার যেমনটা ধারণা)। এই ধারণা কারও বিশ্বাসের চেয়ে তার নাগরিকত্ব উচ্চতর আনুগত্য দাবি করবে এমনটা কল্পনাও করতে পারে না।

অভিবাসীরা কোত্থেকে এলো সেটা কোন বিষয় নয় বরং তারা কোথায় যাচ্ছে সেটাই বড় কথা। প্রাচ্য থেকে আসা উদ্বাস্তুরা আমাদের জন্য হুমকি নয় কিন্তু উপনিবেশবাদীরা হুমকি। এই জায়গাতেই অনিয়মিত অভিবাসন (হড়হ-ঃৎধফরঃরড়হধষ রসসরমৎধঃরড়হ) এবং বহুসংস্কৃতিবাদ একটি উত্তপ্ত মিশ্রণে পরিণত হয়। আমাদের মূল্যবোধ অন্যদের কাছে তুলে ধরা এক জিনিস, আর অন্যদের মূল্যবোধের সঙ্গে খাপ-খাওয়ানোর জন্য আমাদের মূল্যবোধের সংস্কার করা একেবারেই ভিন্ন জিনিস।

বর্তমান সময় পর্যন্ত বহুসংস্কৃতিবাদ এক নতুন ধরণের অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐতিহ্য ও আদর্শকে সুরক্ষাদানের বিষয়টিকে কঠিন করে তুলেছে। নতুন ধরণের অভিবাসীরা আমাদের ঐতিহ্য ও আদর্শের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে ফেলতে আগ্রহী নয় বরং তাদের লক্ষ্য হলো তাদের নিজস্ব উপজাতি, তাদের ভাষা, আচার-আচরণ অথবা ধর্মের জন্য একটি আলাদা বিশেষ জায়গা তৈরি করে নেয়া। সেখানে আমরা আর একটি দেশ বলে বিবেচনা করতে পারি না বরং এটি হয়ে দাঁড়ায় একটি বিশাল কেন্দ্রীয় স্টেশন এবং একটি শুণ্যস্থানের মাঝামাঝি কিছু একটা।

কানাডা যখন তার নিজস্ব ঐতিহ্য ও স্বতন্ত্র ইতিহাসসমৃদ্ধ সংস্কৃতি হিসাবে বিবেচিত হবে না বরং একটি পরিষ্কার খাতা হিসাবে বিবেচিত হবে যাতে যে কেউ যা ইচ্ছা লিখতে পারবে তখন নতুন ধরণের সেই অভিবাসীরা তাদের নিজস্ব ভাষ্য নিয়ে আসবে যার মধ্যে এমন কিছু থাকতে পারে যা খুব সুখকর নয়।

যে আওয়াজ আপনি শুনছেন  (যেমনটা আমি ১২ বছর আগে লিখেছিলাম) সেটি হলো তাদের  র‌্যাঁদায় ধার দেয়ার শব্দ। নাগরিকত্বের আবেদন করার ফি ১০০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৩০০ ডলার করা, যেমনটা বিল সি-২৪-এ বলা হয়েছে, একটি এমনই ক্ষুদ্র পদক্ষেপ যে এটি সঠিক পদক্ষেপ কি না সে নিয়েও কোন বিস্ময়ের অবকাশ নেই।

সৌজন্যে : ন্যাশনাল পোস্ট

(গিওর্গি জোনাস, সিএম একজন হাঙ্গেরীয়-কানাডিয়ান লেখক, কবি ও সাংবাদিক। তিনি একজন স্বঘোষিত ক্লাসিকাল লিবারেল। তিনি ১৬টি গ্রন্থের লেখক। এর মধ্যে ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদের ওপর লেখা বই ‘ইসলামের ওপর আলোকপাত : ধারণা, মতামত, যুক্তি’ অন্যতম।)

এপ্রিল ২৭, ২০১৪